প্রবন্ধগানের
ক্রমবিবর্তনের
ধারায় সৃষ্ট হয়েছিল সালগ সুড় প্রবন্ধ। সালগসূড় প্রবন্ধ গানের
একটি ধারা হলো
ধ্রুব-গান।
শাস্ত্রীয়ভাবে এই গানের ব্যাপ্তী ছিল বিশাল। নাটকের প্রয়োজন যখন গানের ব্যবহার শুরু
হয়েছিল, তখন নাটকের স্বল্প পরিসরে
ধ্রুব গান
ব্যবহার করা যেতো না। তাই এর ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসেবে নাটকে
ধ্রুবা
গান ব্যবহৃত হতো।
নাটকের বাইরে এই গান পরিবেশিত হতো না। এর ভাষা ছিল সংস্কৃত এবং প্রাকৃত।
ভরতের নাট্যশাস্ত্রে ৩২শ অধ্যায় থেকে জানা যায়- ধ্রুবাগান গান
ছিল ৬৪ প্রকার। জাতি, স্থান, প্রমাণ, প্রকার ইত্যাদি নানাভেদে এদের ভিন্ন ভিন্ন নাম
ছিল।
সাধারণভাবে ঋক্, পাণিকা, গাথা এবং সপ্তবিধ গানের (মদ্রক, উল্লপ্যক,
অপরান্তক, প্রকরী, ওবেণক, রোবোন্দক ও উত্তর) শ্রেণিগত নাম ছিল ধ্রুবা। এই গানের ছিল নানা অঙ্গ। যেমন- মুখ,
প্রতিমুখ, বৈহায়সক, স্থিত, প্রবৃত্ত, বজ্র, সন্ধি, সংহরণ,
প্রস্তার, উপবর্ত, মাষঘাত, চতুরস্র, উপপাত, প্রবেণী, শীর্ষক,
সংপিষ্টক, অস্তাহরণ ও মহাজনিক।
ধ্রুবা গান পাঁচটি শ্রেণিতে বিভাজিত করা হয়েছে। এগুলো হলো-
প্রাবেশিকী, নৈষ্ক্রামিকী, প্রাসাদিকী, আক্ষেপিকী ও অন্তরা।
- প্রাবেশিকী: নাটকের
প্রস্তাবনা হিসেবে এই গান পরিবেশন করা হতো।
- নৈষ্ক্রামিকী: কোনো
অঙ্কের অভিনেতাদের নিষ্করমণ উপলক্ষে এই গান পরিবেশন করা হতো।
- প্রাসাদিকী:
গানের নির্দিষ্ট রসের বাইরে যখন অন্য রসের অবতারণ করে, মূল রসের সাথে সাম্য
আনার জন্য এই গান পরিবেশন করা হতো
- আক্ষেপিকী: নাটকের
নৃত্য পরিবেশন করার সময় যথারীতি লয় ভেঙে দ্রুত লয়ে পরিবেশন করা হতো আক্ষেপিকী-তে।
- অন্তরা: বিষণ্ণতা,
বিস্মৃতি, ক্রোধ, সুপ্তি, মত্ততা, সঙ্গতা, গুরুভারে অবসন্নতা, মূর্চ্ছা, পতন,
দোষ ঢাকা প্রভৃতিতে অন্তরা পরিবেশন করা হতো।
এছাড়া নাটকের বিভিন্ন
পরিবেশের উপর ভিত্তি করে- ধ্রুবা নানা নামে চিহ্নিত হয়েছে। যেমন- স্থিতা, দ্রুতা,
শীর্ষক, উদ্ধতা, অনুবদ্ধ, অক্ষর, দ্রুত, বিলম্বিতা, অপকৃষ্টা, অড্ডিতা, খঞ্জক এব
নবকূট।
নাট্যশাস্ত্র মতে- পদ, বর্ণ, অলংকার, লয় জাতি, ও পাণি পরস্পরের সাথে ধ্রুবভাবে
(স্থায়ীভাবে) যুক্ত থাকে। এই কারণে এই গানের নাম ধ্রুবা। ধ্রবাগানের এই উপাদানগুলোর
রয়েছে সুনির্দিষ্ট পরিচয়। যেমন-
- পদ: যা
অক্ষর দ্বারা গঠিত।
পদের এই প্রাথমিক পরিচয় থেকে অনুমান করা যায়, ধ্রুবাগানের বাণী অংশই পদ। ছন্দের
বিচারে পদ বিবেচনা করা হয়েছে দুই প্রকার। প্রকার দুটি হলো-
- অনিবদ্ধ পদ:
যাতে মুক্ত ছন্দ ও যতি থাকে, কিন্তু পদগুলো সুনির্দিষ্ট অক্ষরে নিবদ্ধ নয়।
এতে নির্ধারিত তাল ও লয় থাকে না। তাল নেই বলে একে অতাল বলা হয়। এর দ্বারা
যন্ত্রসঙ্গীতে অলঙ্কৃত করা হয়। অনিবদ্ধ পদে
জাতি গান ব্যবহৃত হতো না। এর
প্রধান ব্যবহার ছিল যন্ত্রসঙ্গীতের অলঙ্করণে ব্যবহৃত হতো।
- নিবদ্ধ পদ
সুনির্দিষ্ট অক্ষর দ্বারা গঠিত হবে এবং যাতে যতি-সহ ছন্দ থাকবে এবং তাল ও
লয় থাকবে। তালযুক্ত বলে এই পদকে সতাল পদ বলা হয়।
- বর্ণ ও অক্ষর:
বর্ণ হলো- পদের বর্ণমালার বর্ণ।
বর্ণের মাত্রাগত পরিমাপ হলো অক্ষর। সংস্কৃত ছন্দে
অক্ষর হতে পারে তিন ধরনের। এগুলো হলো- ১ মাত্রার বর্ণ লঘু অক্ষর, বর্ণের
মাত্রাগত বৃদ্ধিতে ২ মাত্রা হলে গুরু অক্ষর, আর বর্ণের মাত্রাগত বৃদ্ধিতে
৩ মাত্রা হলে প্লুত। ধ্রবাগানে যে সকল ছন্দ ব্যবহার করা হতো, তা হলো-
- হ্রী: চরণের
সকল অক্ষর দীর্ঘ। যেমন: যো গঙ্গাত্রিৎ
- অত্যূক্তা
দ্ব্যক্ষর: প্রতিপদে দীর্ঘ অক্ষর
- ত্র্যক্ষরপাদ: মধ্য অক্ষর লঘু
- ধৃতি:
প্রথম অক্ষর লঘু
- রজনী-ত্রিপাদ: ২টি লঘু, ১টি গুরু
- রজনী
মধ্যানাম। এই ধ্রুবাগুলো
বৃত্তশ্রেণির। এর প্রকরণগুলো হলো-
- প্রতিষ্ঠা: চতুরক্ষর পাদ। এর দ্বিতীয় অক্ষর গুরু
- জয়া:
চতুরক্ষর পাদ। ২টি লঘু ও গুরু অক্ষর
- বিজয়া:
চতুরক্ষর পাদ। তৃতীয় অক্ষর লঘু
- বিদ্যুৎভ্রান্তা: পঞ্চাক্ষর পাদে সকল অক্ষর গুরু
- ভূতলতন্বী: পঞ্চাক্ষর পাদে দ্বিতীয় ও তৃতীয়
অক্ষর লঘু
- কমলমুখী:
পঞ্চাক্ষর পাদে অন্ত্য অক্ষর গুরু
- শিখা:
পঞ্চাক্ষর পাদে তৃতীয় ও অন্ত্য
অক্ষর গুরু
- গদিতা:
পঞ্চাক্ষর পাদে দ্বিতীয়, চতুর্থ ও
অন্য অক্ষর গুরু
- ঘন
পংক্তি: পঞ্চাক্ষর পাদে প্রথম দুই অক্ষর লঘু
বর্ণ ও অক্ষরের
সমন্বয়ে সৃষ্ট মাত্রাভিত্তিক বিন্যাস দ্বারা ধ্রুবাগানের ছন্দ নির্ধারিত হতো।
বিন্যাস প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে
ধ্রুবা গানের ছন্দের জাতিগুলো
নির্ধারিত হয়েছিল। এই জাতিগুলো ছিল- অনুষ্টুপ, বৃহতী, জগতী, দ্রুতা,
চপলা, উদ্গতা ও ধৃতি।
ধ্রুবাগানের বিবর্তনের ধারায় তুক বিন্যাস
আদি প্রবন্ধগানের ধারায় তুক বিভাজনের মূলবিন্যাস ছিল-
- উদ্গ্রাহ: নিবদ্ধ গানের প্রথম অংশ। এই অংশ ছিল মূল গানের ভূমিকার
মতো।
- মেলাপক: উদ্গ্রাহ
ছিল পরবরতী ধাতু ধ্রুব-এর মধ্য মেলবন্ধন তৈরিকারক অংশ।
- ধ্রুব: স্থির তুক হিসেবে এর নাম
ধ্রুব। প্রবন্ধগানে এই অংশকে কখনো বর্জন করা হতো না।
- আভোগ: প্রবন্ধগানের সর্বশেষ তুক।
এই অংশে গান পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়। এই অংশে কবি বা গানের (নায়ক) কর্তার
নাম উল্লেখ থাকে।
সালগসূড় প্রবন্ধ গানের একটি ধারায়, বাহুল্য বিবেচনা করে উদ্গ্রাহ
ও মেলাপক অংশ বর্জন করে ধ্রব নামক তুকটিকে গানের শুরুতে রাখা হয়েছিল।
মূলত ধ্রুব
ও আভোগ নিয়ে ধ্রুবগানের সূচনা হয়েছিল। কালক্রমে ধ্রুব ও অভোগের মাঝখানে 'অন্তর'
তুকটি যুক্ত হয়েছিল। এই সময় আভোগ
দুটি অংশে পরিবেশন করা হতো। কালক্রমে আভোগের প্রথম অংশকে পৃথক তুক হিসবে পরিবেশন করা
শুরু হয়। তখন তার নাম দেওয়া হয়েছিল সঞ্চারী। মতঙ্গ, পার্শ্বদেব এবং শার্ঙ্গদেব
তাঁদের রচিত গ্রন্থাদিতে ধ্রুবগানের বর্ণনা পাওয়া যায়।
ধ্রুবগান বৃহৎ পরিসরে পরিবেশিত হতো। ভরতের নাট্যশাস্ত্রে-
ক্ষুদ্র পরিসরে নাটকের জন্য রচিত ধ্রবগানকে বলা হয়েছে ধ্রুবা গান। বিভিন্ন গ্রন্থাদি অনুসরণে জানা যায়- সুলতান আলাউদ্দীনের রাজত্বকালে
(১২৯৬-১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দ) সুলতানের রাজদরবারে
গোপাল নায়ক,
ওই
বৈজু বাওরা
সালগসূড়ের ধ্রুবা গান পরিবেশন করতেন।