প্রবন্ধগান
ভারতীয় রাগসঙ্গীতের প্রাচীনতম একটি ধারা।  প্রকৃষ্টরূপে বন্ধ এই অর্থে প্রবন্ধ শব্দটিকে বিবেচনা করা হয়। যে গান কোনো শাস্ত্রীয় বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তাই প্রবন্ধগীত বা প্রবন্ধগান। তবে প্রাচীন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে একটি বিশেষ বিধিতে রচিত গানকেই প্রবন্ধ গান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বৈদিক যুগের পরে খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ থেকে ৩০০ অব্দের ভিতরে গন্ধর্বরা প্রবন্ধ গানের উদ্ভাবন করেছিলেন। মূলত মহাকাব্যিক যুগে রামায়ণে উল্লিখিত জাতিরাগ ছিল প্রবন্ধ জাতীয় গান। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ অব্দের ভিতরে রচিত হরিবংশে বর্ণিত ছালিক্যগান ছিল প্রবন্ধ গানের নিবদ্ধ জাতীয় গান।  

সঙ্গীতরত্নাকরের মতে মনোরঞ্জনকারী সুরসমূহই হলো গীত। সাধারণভাবে গীতকে দুটি ভাগে বিভক্ত। এই ভাগ দুটি হলো−গান্ধর্বগান  ও লোকরঞ্জক গান। পৌরাণিক গন্ধর্ব জাতির দ্বারা চর্চিত ঐতিহ্যগত গীতকে বলা হয় গান্ধর্ব গান। পৌরাণিক গ্রন্থাদি থেকে জানা যায়  গন্ধর্বরা সঙ্গীতে অত্যন্ত পারদর্শী ছিল। ইন্দ্রের সভায় এরা সভাগায়ক হিসাবে গান করতেন এবং এদের  সঙ্গত পরিবেশনের সময় সঙ্গীত-সঙ্গিনী হিসাবে অপ্সরারা এদের সাথে থাকতো।

মূলত এই লোকরঞ্জক গান বা লোকগানের পরিশীলিত বা শাস্ত্রীয় অনুশাসনে সৃষ্টি হয়েছিল রাগভিত্তিক গান। কিছু বিধি বা বাধ্যবাধকতার দ্বারা সৃষ্ট এবং চর্চিত গান সৃষ্টি হয়েছিল প্রবন্ধ গান। এই বাধ্যবাধকতার মধ্যে সুরের সুনির্দিষ্ট বিন্যাসের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল নানারকম সুরশৈলী। এই নির্দিষ্ট বিধির দ্বারা শাসিত সুরশৈলী থেকে রাগসমূহের সৃষ্টি হয়েছিল। অন্যদিকে এই সুরের কাঠামোর উপরে যে বাণীর বিচরণ ছিল, তাও নির্দিষ্ট কাঠামোতে বাঁধা হয়েছিল। এর সাথে ছন্দের বন্ধন যুক্ত প্রবন্ধগান হয়ে উঠেছিল রীতিমতো শাস্ত্রীয় গান।

খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ অব্দের ভিতরে, প্রাচীন গান্ধর্ব গান নিবদ্ধ ও অনিবদ্ধ রূপে বিকশিত হয়েছিল। ৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে রচিত মতঙ্গের বৃহদ্দেশী গ্রন্থে প্রবন্ধ গানের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থে প্রবন্ধগানের কাকে বলে- এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। এই গ্রন্থে মোট ৪৮টি প্রবন্ধগানের উল্লেখ পাওয়া যায়। এর ভিতরে চারটি প্রবন্ধগানের নাম অন্যান্য গ্রন্থাদিতে উল্লেখ করা হয় নি।

শারঙ্গদেব তাঁর সঙ্গীতরত্নাকর গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণা করেছেন। তাঁর মতে- যে গীতের সম্প্রদায় (গুরুপরম্পরা) অনাদিকাল হতে প্রচলিত। এই গান চর্চা করতেন গান্ধর্বরা। এই গান শাস্ত্রীয় বিধি তথা গ্রহস্বর অংশস্বর মূর্চ্ছনা ইত্যাদির বিধি মেনে পরিবেশিত হতো এবং কল্যাণকর ছিল। এই গান গীতিকারদের দ্বারা রচিত হতো। এই গান ছিল লোকরঞ্জনকারী দেশী গান। মূলত গান্ধর্বদের দ্বারা চর্চিত এই বিশেষ ধরনের গান ছিল প্রবন্ধ গান।

ভাষার ক্ষেত্রে দেবভাষা (সংস্কৃত) এবং মনুষ্য-ভাষা (দেশী ভাষা) ব্যবহৃত হয়েছে। কোনো কোনো গানে উভয় ভাষাই ব্যবহৃত হতো।
গান্ধর্ব গানের শাস্ত্রীয় ধারা থেকে উদ্ভব হয়েছিল প্রবন্ধ গান। এই সময়ের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ছন্দের প্রধান উৎস ছিল সংস্কৃত ছন্দ।  প্রবন্ধ গানভেদে ছন্দ এবং তালে উভয় ধারাতেই পরিবেশিত হতো। তালে নিবদ্ধের বিচারে প্রবন্ধ দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। ভাগ দুটি হলো- অনিবদ্ধ গান ও নিবদ্ধ গান।
কোনো কোনো প্রবন্ধ গানে অন্তরা নামে অতিরিক্ত তুক থাকতো। এই তুকটি যুক্ত হতে গানের ধ্রুব ও আভোগের মধ্যে। ধারণা করা হয়, লৌকিক গানের প্রভাবে এই তুকটি প্রবন্ধগানে প্রবেশ করেছিল।

নিবদ্ধ গানের অঙ্গ:
নিবদ্ধ জাতীয় প্রবন্ধ গানের উপস্থাপিত বিষয় এবং পরিবেশনের রীতি ছিল প্রবন্ধগানের অঙ্গ। এই অঙ্গ ছিল ৬ প্রকার। এগুলো হলো− ১. স্বর: প্রবন্ধগানের সুরের কাঠামো এবং বাহন হলো স্বর। মূলত শাস্ত্রসম্মত স্বরের উপর ভিত্তি করে গান উপস্থাপিত হবে।
২. বিরূদ: গানের স্তুতিবাচক ছন্দময় পদ হলো বিরুদ।
৩. পদ: কোনো বিশেষ বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ গান রচিত হবে। গানের বিষয়বস্তুই হলো- পদ।
৪. তেনক: গানের মঙ্গলবাচক ধ্বনিকে বলা হতো তেনক। যেমন ওঁ, ওম ইত্যাদি প্রতীকী মঙ্গলবাচক শব্দই তেনক নামে অভিহিত হতো। একে প্রবন্ধগানের চোখ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
৫. পাট: আনদ্ধ বাদ্যের বোলবাণী উচ্চারণকে বলা হতো পাট। প্রবন্ধগানে গানের মাঝখানে তালের বোলবাণী উচ্চারিত হতো।
৬. তাল: প্রবন্ধগানের ছন্দ রক্ষার উপাদান হিসেবে তালের ব্যবহার হতো।
সকল প্রবন্ধ বা নিবদ্ধ গানে সকল অঙ্গ ব্যবহৃত হতো না। প্রবন্ধগানে কমপক্ষে দুটি অঙ্গ থাকতে হতো। অঙ্গের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে প্রবন্ধগানের জাতি নির্ধারিত হতো। এই জাতিগুলো হলো-
১. তারাবলী: এই প্রবন্ধগানে২টি অঙ্গ থাকতো।
২. পাবনী (ভবানী): এই প্রবন্ধগানে ৩টি অঙ্গ থাকতো।
৩. দীপনী: এই প্রবন্ধগানে ৪টি অঙ্গ থাকতো।
৪. আনন্দিনী: এই প্রবন্ধগানে ৫টি অঙ্গ থাকতো।
৫. মেদিনী: এই প্রবন্ধগানে ৬টি অঙ্গ থাকতো।
সঙ্গীতরত্নাকরে পাঁচটি মতান্তরিত জাতির কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো- শ্রুতি, নীতি, সেনা, কবিতা ও চম্পু।

এছাড়া প্রবন্ধগানকে ছন্দ ও তালের বিচারে দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। এগুলো হলো- প্রবন্ধগানের প্রকারভেদ:
প্রাচীন প্রবন্ধগানের নানা ধরনের প্রকরণ ছিল। এই প্রকরণগুলোকে- প্রধান তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো- সূড়, আলি বা আলিসংশ্রয় ও বিপ্রকীর্ণ।

বিপ্রকীর্ণ প্রবন্ধ

এই প্রবন্ধগানে উদ্‌গ্রাহ,  ধ্রুব ও আভোগ থাকে। এই গানে চারটি রাগ ও চারটি তাল ব্যবহৃত হয়। সঙ্গীতরত্নাকরে মোট ৩৬টি বিপ্রকীর্ণ প্রবন্ধের নাম পাওয়া যায়। এগুলো হলো- শ্রীরঙ্গ, শ্রীবিলাস, পঞ্চভঙ্গী, পঞ্চানন, উমাতিলক, ত্রিপদী, চতুষ্পদী, ষট্‌পদী, বস্তু, বিজয়, ত্রিপদ, চতুর্মুখ, সিংহনীল, হংসনীল, দণ্ডক, কপট, কন্দুক, ত্রিভঙ্গী, হরবিলাস, সুদর্শন, স্বরাংক, শ্রীবর্ধনী, হর্ষবর্ধন, বদন, চচ্চরী, চর্যা, পন্ধড়ী, রাহড়ী, বীরশ্রী, মঙ্গলাচারম ধবল, মঙ্গল, ওধী, লোলী, চোল্লরী ও দন্তী।
১.শ্রীরঙ্গ: এই প্রবন্ধ গানে ছয়টি অঙ্গই থাকতো। এই কারণে একে মেদনী জাতিতে ফেলা হয়। এতে চারটি রাগ ও চারটি তাল ব্যবহৃত হয়
২. শ্রীবিলাস: এই প্রবন্ধগানে ৫টি রাগ ও ৫টি তাল ব্যবহার করা হয়। গানের শেষে স্বরানুষ্ঠান হয়।
৩. পঞ্চভঙ্গী: এই প্রবন্ধগানের শেষে গানের মঙ্গলবাচক ধ্বনি বা তেনক। গাওয়া হতো। এই গানে দুটি রাগ ও দুটি তাল ব্যবহৃত হত।
৪. পঞ্চানন: এই গান অনেকটা পঞ্চভঙ্গীর মতো। তবে এই গানের শেষে আনদ্ধ বাদ্যের বোলবাণী উচ্চারণ করা হতো।
৫. উমাতিলক:  তিন প্রকার রাগ এবং তিন প্রকার তাল ব্যবহৃত হয়। এর শেষ গানের স্তুতিবাচক ছন্দময় পদ ব্যবহৃত হয়।
৬. ত্রিপদী: এই প্রবন্ধগানে  চারটি পাদ থাকে। এই প্রবন্ধে প্রথম দুটি পদ একই রকম হওয়াতে এদের একটি পদ বলে মনে হয়। সবমিলিয়ে এর মান দাঁড়ায় ত্রিপদীর মতো। এর প্রথম দুটি পদ উদগ্রাহ, বাকি দুটি পদ ধ্রুব। তবে ইচ্ছানুসারে এতে আভোগ ব্যবহার করা যায়। এই প্রবন্ধ তালহীন এবং করণটি ভাষায় এই গানের চর্চা আছে।
৭. চতুষ্পদী: বৃহদ্দেশীতে এই প্রবন্ধ গানের নাম পাওয়া যায়- চতুষ্পীঠিকা হিসেবে। এই প্রবন্ধে চারটি পাদ থাকতো। এর মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পাদের প্রত্যেকটিতে যোলোটি করে মাত্রা থাকতো এবং প্রথম ও তৃতীয় পাদের প্রত্যেকটিতে পনেরোট করে মাত্রা থাকতো। কল্লিনাথের মতে, এই প্রবন্ধের পূর্ব স্বরসংঘুক্ত এবং উত্তরার্ধে তেনক (মঙ্গলবাচক ধ্বনি) সংযুক্ত থাকতো। তেনক পরিবেশনের মধ্য দিয়ে এই গান শেষ হতো। এই প্রবন্ধে আভোগের পরিকল্পনাও রাখা হয়েছিল। এই গানে একই শব্দকে ভিন্নার্থে প্রয়োগ করা হতো। অলঙ্কার শাস্ত্রে শব্দের এরূপ প্রয়োগকে বলা হয়ে থাকে যমক।
৮. ষট্‌পদী: ৬টি পাদ নিয়ে গঠিত হয় যট্পদী প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধ কর্ণাট ভাষায় রচিত হয়।
এতে তাল ব্যবহৃত হয় না। এর প্রথম তিনটি পাদ হল উদ্গ্রাহ এবং শেষের তিনটি পাদ ধ্রুব। এটি তারাবলী জাতীয়।

৯.বস্তু:
বৃহদ্দেশীতে এই গানকে বস্তু নামে অভিহিত করা হয়েছে। বৃহদ্দেশীতে পাণ্ডুলিপিতে এই বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ পাঠ পাওয়া যায় নি। সঙ্গীতরত্নাকরে এই প্রবন্ধে পাঁচটি পাদ থাকে। এটি ত্রিধাতুক। এর প্রথম, তৃতীয় ও পঞ্চম পাদে ১৫টি মাত্রা এবং  দ্বিতীয় ও চতুর্থ পাদে ১২টি করে মাত্রা থাকতো। এই গানের প্রথমার্থের পরে স্বর ও পাট ব্যবহৃত হতো। দ্বিতীয় বা পঞ্চম পাদের পাটের পরে স্বর ও তেনক ব্যবহৃত হতো। এরপরে দোধক নামক ছন্দ ব্যবহৃত হতো। উল্লেখ্য দোধক ছন্দে তিনটি ভ গণ ব্যবহার হয়, এরপর দুটি গুরু বর্ণ থাকে। এই গানের সমাপ্তি হতো তেনক পরিবেশনের মধ্য দিয়ে।
১০. বিজয়: এই গান গাওয়া হত রাজাদের বিজয় উৎসবে। এতে থাকে তেন, স্বর, পাট,
পদ। এই গানে ব্যবহৃত হত বিজয়তাল। এর স্বরযুক্ত অংশটি উদ্গ্রাহ এবং পাট ও পদযুক্ত অংশটি ধ্রুব। এটি আনন্দিনী জাতীয়।
১১. ত্রিপথক:
এই প্রবন্ধে থাকে তিনটি পাদ। কল্লিনাথের মতে- এই প্রবন্ধের প্রথম দুটি উদ্গ্রাহ এবং তৃতীয় পাদ ধ্রুব। এতে আভোগও পাওয়া যায়। এটি আনন্দিনী জাতীয় প্রবন্ধ।
১২. চতুমুখ: এই গানে চারটি চরণ এবং চারটি বর্ণ (স্থায়ী, আরোহী, অবরোহী, সঞ্চারী) ব্যবহৃত হয়। এর প্রথম পাদদ্‌বয় উদ্‌গ্রাহ, দ্বিতীর পাদদ্বয় ধ্রুবব। এর আভোগ রচিত হয় পদান্তর দ্বারা। এটি ত্রিধাতুক, নিরুক্ত এবং বিরুদ বর্জিত হওয়। এটি পঞ্চাঙ্গযুক্ত আনন্দিনী জাতীয় প্রবন্ধ।
১৩. সিংহলীল:
বৃহদ্দেশীতে এই গানের বিবরণে বলা হয়েছে- এই গান সিংহলীল তালে পরিবেশিত হতো। এতে স্বর অংশের পরে তেনক বা মঙ্গলসূচক পদ পরিবেশন করা হতো। এর শেষাংশে বিরূদ বা ভণিতায় গীতরচয়িতার নাম যুক্ত হতো।
এই প্রবন্ধ গাওয়া হয় সিংহলীল তালে। এতে স্বর, পাট, বিরুদ, তেনক থাকে।
কল্লিনাথের মতে - এই প্রবন্ধের স্বর, পাট দারা গঠিত অংশ উদ্গ্রাহ এবং বিরুদ, তেনক দ্বারা গঠিত অংশ ধ্রুব। পদের সাহায্যে আভোগ সৃষ্টি হয়। এটি ত্রিধাতুক মেদিনী জাতীয় প্রবন্ধ।
১৪. হংসলীল:
গান হংসলীল তালে গাওয়া হয়। এর প্রথম পাদটি উদ্গ্রাহ এবং দ্বিতীয়
পাদটি ধ্রুব। পদান্তর করে আভোগ রচনা করা হয়। তাই এটি ত্রিধাতুক। এই প্রবন্ধে পদ, পাট, তাল এই প্রবন্ধে পাওয়া যায়। এটি ভাবনী জাতীয় প্রবন্ধ।
১৫. দণ্ডক:
বৃহদ্দেশীতে এই প্রবন্ধ সম্পর্কে বলা হয়েছে- দণ্ডক নামক ছন্দে স্বরপদসমাসযুক্ত গানের নাম দণ্ডকী। অর্থাৎ এই গান দণ্ডক ছন্দে, পদ এবং স্বর সহযোগে পরিবেশন করা হয়। উল্লেখ্য, এই ছন্দের প্রতিপাদে দুটি নগণ এ সাতটি র গণ থাকে। এর পূর্বার্ধ উদ্গ্রাহ এবং উত্তরার্ধ ধ্রুব। পদান্তর করে আভোগ রচনা করা হয়। এই কারণে দণ্ডক ত্রিধাতুক। এই প্রবন্ধে স্বর, পদ, তাল ব্যবহৃত হওয়ায় এটি ভাবনী জাতীয়।

১৬.
ম্পট:
এই প্রবন্ধ গাওয়া হয় ঝম্পট ছন্দে, ক্রীড়াতালে। কল্লিনাথের মতে, এই প্রবন্ধের প্রথম দুটি পাদ উদ্‌গ্রাহ এবং তৃতীয় পাদ ধ্রুব। কখনো কখনো আভোগ গাওয়া হয়। তবে এই গানকে ত্রিধাতুক হিসেবে মানা হয়। এটি নির্যুক্ত এবং তারাবলী জাতীয়।
১৭. কন্দুক:
এই প্রবন্ধের প্রথম পাদদ্বয় উদ্গ্রাহ এবং তৃতীয় পাদ ধ্রব। এটি নিরুক্ত এবং
দীপনী জাতীয প্রবন্ধ।

১৮. ত্রিভঙ্গি:  
বৃহদ্দেশীতে এই গান সম্পর্কে বলা হয়েছে- তিনপ্রকার বৃ্ত্তি সহযোগে বা পদ, স্বর এবং পাট সহযোগে পরিবেশিত হতো। এই তিনপ্রকার বৃত্তির প্রয়োগের কারণে এর নাম হয়েছিল ত্রিভঙ্গী।  এই প্রবন্ধ পাঁচ প্রকার।
    ১. প্রথম প্রকার ত্রিভঙ্গী তালে গাওয়া হয়।
    ২. দ্বিতীয় প্রকারে ত্রিভঙ্গী ছন্দ ব্যবহৃত হয়। 
    ৩. তৃতীয় প্রকার ত্রিভঙ্গীতে তিন রকম রাগ ও তিন রকম তাল ব্যবহৃত হয়।
    ৪. চতুর্থ প্রকার গাওয়া হয় তিন রকম ছন্দে।
    ৫. পঞ্চম প্রকারে তিনটি দেবতার স্তুতি সংযোজিত হয়।
১৯. হরিবিলাসক:
এই প্রবন্ধে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খণ্ডে যথাক্রমে বিরুদ, পাট এবং তেনকের অনুষ্ঠান হয়। এর প্রথম খণ্ড হলো উদ্‌গ্রাহ এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড হলো ধ্রুব। পদাস্তর দ্বারা আভোগ সৃষ্টি হয়। কল্লিনাথের মতে- এটি ত্রিধাতুক, নির্যুক্ত এবং আনন্দিনী জাতীয় প্রবন্ধ।
২০. সুদর্শন:
এটি অনেকটায়  হরিবিলাসক প্রবন্ধের মত। এতে পদ, বিরুদ এবং তেনকের
ব্যবহার দেখা যায়। এতে স্বর ও পাঠের ব্যবহার না থাকায় কলিনাথ এই প্রবন্ধকে দীপনী জাতীয় প্রবন্ধ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

২১. সরাঙ্ক: এই প্রবন্ধে পদ, স্বর এবং বিরুদ থাকে। এতে ক্রমায়ে তিনটি তালের ব্যবহার করা হয়। শারঙ্গদেবের মতে এতে মেলাপক বর্জন করা হয়। কল্লিনাথ এই প্রবন্ধের পদকে উদ্‌গ্রাহ,স্বরকে মেলাপক এবং বিরুদকে ধ্রুব নামে অভিহিত করেছেন। শারঙ্গদেবের মতে এই প্রবন্ধ মালবশ্রী রাগে পরিবেশিত হয়। এই প্রবন্ধে মেলাপক এবং আভোগ আছে বলে মেনে নিয়ে একে চতুরধাতুক প্রবন্ধ বলা হয়;। এটি নির্যুক্ত এবং দীপনী জাতীয় গান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২২. শ্রীবর্ধন:
এই প্রবন্ধে বিরুদ, পাট, পদ ও স্বর থাকে। এর বিরুদ ও পাট নিয়ে
উদ্গ্রাহ এবং পদ ও স্বর নিয়ে ধ্রুব অংশটি তৈরি হয়।
২৩: হর্ষবদন:
এই প্রবন্ধে পদ ও বিরুদ, স্বর, পাট থাকে। সিংহভূপালের মতে এই প্রবন্ধে শুধুমাত্র পদ ও বিরুদ থাকে।
২৪. বদন:
এই প্রবন্ধ গানে সংস্কৃত ছন্দের গণ অনুসরণ করে রচিত হয়।  ছ-গণ, প-গণ এবং দ-গণ-এর ব্যবহার হয়। কল্লিনাথের মতে এই মাত্রা গণ তিনটি হচ্ছে উদ্গরাহ। স্বর ও পাট রচিত হয় ধ্রুব।
২৫. চচ্চরী: এই প্রবন্ধ গান হিন্দোল রাগে গাওয়া হয়। এই গান বসস্তোৎসবে গাওয়া হয়। অনেকে ক্রীড়া তালে কেউ কেউ এই গান গেয়ে থাকেন। কল্লিনাথ বলেছেন, এতে উদ্‌গ্রাহ, ধ্রুব এবং আভোগ থাকে। এটি ত্রিধাতুক, নির্যুক্ত, তারাবলী জাতীয় প্রবন্ধ।
২৬. চর্যা:
এই প্রবন্ধ গানে পদ্ধড়ী ছন্দে বাঁধা হয়। আধ্যাত্মিক বিষয় অবলম্বনে এই গানগুলো রচিত হয়ে থাকে। কল্লিনাথের মতে এটি ত্রিধাতুক, নির্যুক্ত এবং তারাবলী জাতীয় প্রবন্ধ। চর্যাগীত দুই প্রকার। প্রকারে দুটি হলো- পূর্ণা ও অপূর্ণা।
২৭. পদ্ধড়ী:
এই প্রবন্ধ পদ্ধড়ী ছন্দে রচিত হয়। এতে বিরুদ, স্থর এবং পাট থাকে।
কল্লিনাথের মতে- এটি ত্রিধাতুক, নির্যুক্ত এবং আনন্দিনী জাতীয় প্রবন্ধ গান।

২৮. রাহড়ী: এই প্রবন্ধ গান সংগ্রাম উপলক্ষে রচিত স্ততিবাচক । এটি বীররসাত্মক এবং এতে থাকে বহু পাদ। এটি ত্রিধাতুক এবং তারাবলী জাতীয়।

২৯. বীরশ্রী: এই প্রবন্ধে উদ্গ্রাহে থাকে স্তুতিবাচক ছন্দময় পদ। কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়কে ছন্দময় পদ হিসেবে থাকে মেলাপক। এটি ত্রিধাতুক এবং ভাবনী জাতীয়।
৩০. মঙ্গলাচার:
এই প্রবন্ধ কৈশিকী রাগে, নিঃসারু তালে এবং স্বরাচরণ সহযোগে গাওয়া হয়।
এটি ত্রিধাতুক, নির্যুক্ত এবং ভাবনী জাতীয়। মঙ্গলাচার প্রকার। প্রকার তিনটি হলো- গদাজ, পদ্যজ এবং পদ্যজ-গদ্যজ।
৩১. ধবল:
এই প্রবন্ধে থাকে আশীর্বাদমূলক বাণী। এই প্রবন্ধের পূর্বার্ধ উদ্‌গ্রাহ এবং উত্তরার্ধ  ধ্রব। এছাড়া পৃথকভাবে আভোগ রচিত হয়। এটি তারাবলী জাতীয় প্রবন্ধ॥ এই প্রবন্ধ তিন প্রকার প্রকার তিনটি হলো- কীর্তি, বিজয় এবং বিক্রম।

৩২. মঙ্গল: এই প্রবন্ধ গান ছিল কল্যাণবাচক। এটি গাওয়া হতো বোট্টরাগ বা কৈশিকী রাগে। এর লয় হতো বিলম্বিত।

৩৩. ওবী: এটি ছিল আঞ্চলিক ভাষার গান। গানগুলোর বাণীতে অনুপ্রাস যুক্ত থাকতো। এই গানের শেষে “ওবী” পদটি গাওয়া হয়।

৩৪. লোলীপদ: এই গানের বাণী রচিত হতো প্রাকৃত ভাষায়। এটি অনেকটা ওবী প্রবন্ধের
মতই। এই গানের শেষে “লোলী'  পদটি গাওয়া হয়।

৩৫. ঢোল্লরী: লাটভাষায় রচিত গান। এই প্রবন্ধের শেষে 'ঢোল্লরী' পদ যুক্ত হয়। এই,
সম্পর্কে এর বেশি কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।

৩৬. দণ্ডী: এই গানে প্রচুর অনুপ্রাস থাকে। এই গানের শেষে “দণ্ডী'  পদটি গাওয়া হয়। এই দণ্ডী শব্দের কৌনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
বৃহদ্দেশী গ্রন্থে বর্ণিত অতিরিক্ত চারটি প্রবন্ধ গান।

  • পাটলী: এই গান ছিল স্বরবিন্যাসযুক্ত। এদে বিরুদ বা ভণিতাযুক্ত পদ থাকতো। এই গান ছিল বিভাষা গান। মূলত বিভাষা বলতে প্রাকৃত ভাষায় রচিত গানকে বুঝানো হয়েছে। ধারণা করা হয়- কর্ণাটক অঞ্চলের প্রাকৃত ভাষাকে বিভাষা বলা হয়েছে।
  • অথিলা: এই প্রবন্ধ গানের প্রতি পদের অর্থ এক একটি অঙ্গের মতো। মূল শ্লোকে 'পরুপ্রতিপদার্ধ' উল্লেখ আছে। এখানে পরু শব্দের অর্থ হলো অঙ্গ। এই গানের প্রতি পদের অর্ধ অঙ্গ অপর অর্থ অঙ্গের সাথে গ্রন্থব্দ্ধ থাকতো বলে- এর নামকরণ করা হয়েছিল অর্থিলা। এই গান তালে গাওয়া হতো।
  • হংসপদ: এই গানের একটি পদ রচিত হতো সংস্কৃত ভাষায়, অপর পদটি রচিত হতো- দেশী ভাষায়। ভারতকোষের মতে- এর উদাগ্রাহ রচিত হতো দেবভাষায় (সংস্কৃত) এবং ধ্রুবপদ পরিবেশিত হতো মনুষ্য ভাষায় (দেশী ভাষায়)।
  • শুকসারিত: এই গানে শুক ও সারি পক্ষীদ্বয়ের কথোপকথনের ভঙ্গীতে প্রশ্নোত্তরের আঙ্গিকে পরিবেশিত হতো। এতে দুই ধরনে তাল ব্যবহৃত হতো। এতে পাট ও বাদ্যাক্ষর যুক্ত করা হতো।
  • শরভলীল: এই গান ছিল অষ্টপদবিশিষ্ট। এতে স্বর এবং পাট তথা বাদ্যের বোলবাণী যুক্ত করা হতো। এই গানের প্রতি পদে একটি করে রাগ ও তাল দ্বারা নিবদ্ধ হতো। উল্লেখ্য পুরাণে শরভপদ বিশিষ্ট একটি পশুর নাম পাওয়া যায়। সম্ভবত এই পশুর নামানুসারে এই প্রবন্ধ গানের নামকরণ করা হয়েছিল।
  • শুক্চঞ্চু: এই প্রবন্ধগান রচিত হতো-দেশীয় ভাষায়। এই গানের প্রথমভাগে রাগাশ্রয়ী ছিল। গানটি গমক ও তাল সহকারে গীত হতো। এতে স্বর ও পাঠের ব্যবহার ছিল।
  • বিচিত্র: এই প্রবন্ধগানে দেশ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন ভাষয় রচিত হতো। এতে ব্যবহৃত হতো-স্বর, তাল পাট, তেনক ও বিরূদ। এই গানের বিচিত্র রূপের কারণে- এর নামকরণ করা হয়েছিল বিচিত্র প্রবন্ধ গান।
  • চতুরঙ্গ: এতে চার প্রকার রাগ এবং চার প্রকার ভাষায় পরিবেশিত হতো। এই কারণে এর নামকরণ করা হয়েছিল চতুরঙ্গ।
  • জয়সূচক: জয়সূচক গান ছিল। এই কারণে একে জয়সূচক প্রবন্ধ গান নামে অভিহিত করা হতো। এই গানে বিজয় নামক তাল ব্যবহার করা হতো।
  • হংসবিক্রান্ত: আটটি পাদ দ্বারা সৃষ্ট এই প্রবন্ধ গান চারটি খণ্ডে বিভক্ত ছিল। এই গানে আদি তাল ব্যবহৃত হতো।
  •  

     

    সালগ সুড় প্রবন্ধরবন্ধ
    সুড় বা শুদ্ধ সুড়, আলি এবং বিকীর্ণ প্রবন্ধ সঙ্গীতের মিশ্রিত রূপ পাওয়া যায় এই শ্রেণির প্রবন্ধ গানে।  'সালগ' শব্দটি “ছায়ালগ' শব্দ থেকে এসেছে। কল্লিনাথের মতে- যে সব গানে শুদ্ধ সঙ্গীতের ছায়পাত ঘটেছে সেইগুলিকে 'ছায়লগ' বলা যায়। উল্লেখ্য, শুদ্ধ গীতের ৮টি প্রকার রয়েছে। এগুলো হলো- জাতি, কপাল, কম্বল, গ্রামরাগ, উপরাগ, ভাষা, বিভাষা, অন্তর ভাষা।

    সালগসূড় প্রবন্ধ গানে- উদগ্রাহ (দুই অংশ), ধ্রুব ও আভোগের মাঝখানে একটি  ভিতরে একটি অতিরিক্ত ধাতু লক্ষ্য করা যায়। এই ধাতুটির নাম অন্তর। অন্তর অংশটুকু উচ্চস্বরে পরিবেশন করা হতো। এই গানের উদ্‌গ্রাহ দুটি খণ্ড এবং অন্তর দুইবার গাওয়ার রীতি ছিল। আবার আভোগের অংশ দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এর প্রথম ভাগের চেয়ে দ্বিতীয় ভাগ উচ্চস্বরে গাওয়া হতো। সব মিলিয়ে সালগ সুড়ের ভাগগুলোর বিন্যাস দাঁড়ায়- উদ্‌গ্রাহ (দুই খণ্ড), অন্তর, এবং আভোগ (দুই খণ্ড। এই গানে মেলাপক নেই। কালক্রমে উদ্গ্রাহ বর্জন করে সরাসরি ধ্রুব গাওয়ার রীতি প্রচলিত হয়। ফলে ধ্রুব থেকেই এই গান শুরু করা হতো। এই ধ্রুব পদ থেকেই ধ্রুপদ নামক গানের  প্রচলন হয়। আর অন্তর অংশটুকুর নাম দাঁড়ায় অন্তরা। অন্যদিকে অাভোগের প্রথম খণ্ডের নামকরণ করা হয় সঞ্চারী। বাকিটুকু আভোগ নামেই থেকে যায়। এই ধ্রুব গান থেকে উৎপত্তি ঘটেছিল ধ্রুবাগান।

    এই গান সাত প্রকার। প্রকারগুলো হলো-  ধ্রুব, মণ্ঠ, প্রতিমণ্ঠ  নিঃসারুক, অড্ডতাল, রাসক ও একতালী। উল্লেখ্য, শুদ্ধ সূড়ের একতলী থেকে এই একতলী পৃথক। সুলতান আলাউদ্দীনের রাজত্বকালে সুলতানের রাজদরবারে গোপাল নায়ক, ওই বৈজু বাওরা সালগসূড়ের ধ্রুবা গান পরিবেশন করতেন।
    সূত্র:
    • বৃহদ্দেশী। মতঙ্গ। রাজ্যেশ্বর মিত্র সম্পাদিত। সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার। ১৯২২
    • সঙ্গীতরত্নাকর। শার্ঙ্গদেব। সুরেশচন্দ্র কর্তৃক অনূদিত। ২২ শ্রাবণ ১৪০৮।