আলাউদ্দিন খিলজি
(রাজত্বকাল: ১২৯৬-১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দে)
লজি রাজবংশের দ্বিতীয় সুলতান

খিলজি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম সুলতান জালালউদ্দিন খিলজির ভাই শাহাবুদ্দিন খিলজির পুত্র।  সপ্তদশ শতাব্দীর গ্রন্থাকার হাজিউদ্দবীরের রচনা থেকে জানা যায়- ১৩০৩ থেকে ১৩০৯ খ্রিষ্টাব্দের আলাউদ্দীন যখন রণথম্ভোর দুর্গ আক্রমণ করেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ৩৪ বৎসর। এই বিচারে ধারণা করা হয়- আলাউদ্দিন ১২৬৬-৬৭ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ধারণা করা হয়, তিনি আফগানিস্তানের কালাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

শৈশবে আলাউদ্দিনের পিতার মৃত্যুর পর, জালালউদ্দিন খিলজির কাছে তিনি প্রতিপালিত হন। যতদূর জানা যায়, তিনি নিরক্ষর ছিলেন। তবে অশ্ব চালনা, যুদ্ধবিদ্যায় পারদ্র্শী ছিলেন। জালালউদ্দিন খিলজির রাজত্বলাভের সময় তিনি ব্যাপকিভাবে সহায়তা করেছিলেন। ১২৯০ খ্রিষ্টাব্দে জালালউদ্দিন সিংহাসন অধিকার করলে, আলাউদ্দিন আমির-তুজুক পদ লাভ করেন।

১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে বলবনের ভ্রাতুষ্পুত্র মালিক চজু বিদ্রোহ ঘোষণা করলে, আলাউদ্দিন এই বিদ্রোহ দমন করে খ্যাতি লাভ করেন। সুলতান জালালউদ্দিন এই বিজয়ের পুরস্কার স্বরূপ এলাহাবাদের নিকটবর্তী কারা-মানিকপুরের শাসনকর্তার পদ প্রদান করেন। এই সময় দিল্লীর আমিররা নানা কারণে জালালউদ্দিনের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন। এছাড়া পরাজিত মালিক চজুর অনচরবর্গ, জঙ্গীবাদী খালজি যুবকরা আলাউদ্দীনের সেনাবাহিনীতে যোগদান করলে, আলাউদ্দিনের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই সময় জঙ্গীবাদী খালজি সৈন্যরা এবং  মালিক চজু অনচরবর্গ, আলাউদ্দিনকে সিংহাসন দখলে উৎসাহিত করলেও, আলাউদ্দিন উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় করার সিদ্ধান্ত নেন।

আলাউদ্দিনের পারিবারিক অবস্থা সংকটময় ছিল।  হাজিউদ্দবীরের রচনা থেকে জানা যায়- আলাউদ্দিন প্রথমে বিবাহ করেছিলেন আলিজা খাঁর বোন মারুহ। পরে তিনি বিবাহ করেছিলেন জালালউদ্দিনের কন্যাকে। সুলতানের কন্যা হওয়ার সুবাদে, এই স্ত্রী এবং তাঁর মা আলাউদ্দিনকে নানাভাবে নিগৃহীত করতো। কারা-মানিকপুরের শাসনকর্তার হওয়ার পর তিনি, স্ত্রীকে দিল্লিতে রেখেই কর্মস্থলে এসেছিলেন। এর ফলে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি নিজেকে গুঁছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।

১২৯২ খ্রিষ্টাব্দে জালালউদ্দিনের অনুমতি নিয়েই ভিলসা নগর আক্রমণ করেন। এই নগরীর মন্দির এবং সম্পদশালী ব্যক্তিদের সম্পদ লুণ্ঠনের দ্বারা তাঁর রাজকোষ পূর্ণ করেন। এই সফল অভিযানের পর, তিনি অযোধ্যার শাসনকর্তার পদ লাভ করেন। কারা-মানিকপুর ও অযোধ্য মিলে তাঁর শাসন এলাকা সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে তিনি সম্পদশালী হয়ে ওঠতে থাকেন।

দেবগিরি প্রথম অভিযান
ভিলসা নগরের জয়ের পর তিনি রাজ্যলোভী ও ধনলোভী হয়ে ওঠেন। তিনি ভিলসা অভিযানের নামে একটি বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে দাক্ষিণাত্যের দেবগিরি আক্রমণ করেন। এই রাজ্যের রাজা রামচন্দ্র এই অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে, আলাউদ্দিনের সাথে সন্ধি করেন। এর বিনিময়ে রামচন্দ্র তাঁকে  সাত মণ স্বর্ণ, সাত মণ মুক্তা ও ৪০টি হাতি প্রদান করেন। এই সন্ধির সময় রামচন্দ্রের পুত্র শঙ্কর রাজধানীতে ছিলেন। তিনি রাজধানীতে ফিরে এসে এই সন্ধি অগ্রাহ্য করেন। ফলে উভ্য়ের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে শঙ্কর পরাজিত হয়ে, প্রচুর ধনসম্পদ ও ইলিচপুর প্রদেশ আলাউদ্দিনকে প্রদান করে সন্ধি করেন। এই যুদ্ধের পর আলাউদ্দিনকে সম্বর্ধিত করার জন্য জালালউদ্দিন কারা-মানিকপুরে আসেন। এই সময় কৌশলে তিনি জালালউদ্দিনকে হত্যা করে, নিজেকে সুলতান হিসেবে ঘোষণা দেন।

দিল্লির সিংহাসন দখলের পর-দিল্লির আমিরদের একাংশ জালালউদ্দিনকে হত্যা করার জন্য বিরোধিতা করেছিলেন। এছাড়া জালালউদ্দিনের বিধবা পত্নী মালিকা-ই-জাহান চেয়েছিলেন তাঁর পুত্র রুকনউদ্দিন ইব্রাহিম সিংহাসন লাভ করুক। কিন্তু জালালউদ্দিনের জ্যেষ্ঠপুত্র আরকাল খাঁ সিংহাসনের দাবিদার হয়ে ইব্রাহিমের বিরোধিতা করা শুরু করে। ফলে জালালউদ্দিনের অনুসারীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। আলাউদ্দিন সিংহাসন লাভের জন্য দিল্লিতে পৌঁছার আগেই বিপুল অর্থ ও প্রলোভনের মাধ্যমে এদের একটি বড় অংশকে নিজের পক্ষে আনতে সক্ষম হন। এছাড়া পথিমধ্যে সাধারণ মানুষদের অর্থ ও প্রচারণার মাধ্যমে নিজের পক্ষে আনতে সক্ষম হন। আলাউদ্দিন দিল্লি আক্রমণ করলে, ইব্রাহিম তাঁকে বাধা দেন এবং পরাজিত ও বন্দী হন। এই সময় আরকাল খাঁও বন্দী। আলাউদ্দিন এঁদের চক্ষু উৎপাটন করে হানসির দুর্গে নিক্ষেপ করেন। তিনি বিপক্ষের আমিরদের শাস্তির পাশাপাশি, অর্থের লোভে আলাউদ্দিনের পক্ষ নিয়েছিলেন, তাঁদেরও শাস্তি দেন।

জালালউদ্দিনের শাসনামলে যে সকল মোঙ্গল ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা গুজরাট থেকে ফেরার সময় উপযুক্ত পারিশ্রমিক না পাওয়া বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। এই বিদ্রোহ দমনের সময় প্রায় ৩০ হাজার নব্য-মুসলমান নিহত হয়।

আলাউদ্দিন দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর, প্রশাসনকে সুসংহত করেন। অভিজাতবর্গের আধিপত্য খর্ব করেন এবং জায়গির প্রথা বিলোপ করেন।

প্রথম মোঙ্গল আক্রমণ
১২৯৬ খ্রিষ্টাব্দে মোঙ্গলরা ভারত আক্রমণ করে। নতুন সুলতান হিসেবে এটা ছিল একটি বড় ধরনের সংকট। তারপরেই তিনি সেনাপতি জাফর খাঁ'কে মোঙ্গলদের মোকাবিলার জন্য পাঠান। জলন্ধরের কাছে উভয় বাহিনী মুখোমুখি হয়। এই যুদ্ধে মোঙ্গল সৈন্যরা পরাজিত হয়।

মোঙ্গলদের প্রথম আক্রমণ প্রতিহত করার পর, তিনি ক্ষমতাকে সুসংহত এবং সৈনবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করেন। এর ফলে মোঙ্গলদের দ্বিতীয় আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

দ্বিতীয় মোঙ্গল আক্রমণ
১২৯৭ মোঙ্গলরা দ্বিতীয়বার আক্রমণ করে। এবার তারা দিল্লির নিকটবর্তী সিরি নগরি দখল করে নেয়। এবারেও জাফর খাঁ' মোঙ্গলদের পরাজিত করে সিরি নগরী উদ্ধার করে।

এরপর প্রায় দুই বছর মোঙ্গলরা ভারত আক্রমণ থেকে বিরত থাকে। এই সময়ে আলাউদ্দিন তাঁর সেনাবহিনীর সংস্কার করে, একটি দক্ষ বাহিনীতে পরিণত করেন। এরপর তিনি পার্শ্বর্তী রাজ্যগুলো দখলে মনোযোগ দেন। এই পর্যায়ে তিনি গুজরাট ও রাজস্থানে দুটি অভিযান পরিচালনা করেন।

গুজরাট অভিযান
১২৯৭ খ্রিষ্টাব্দে গুজরাটের রাজা কর্ণদেবের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। এই অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন উলুগ খাঁ ও নসরৎ খাঁ। কর্ণদেবের রাণী কমলাদেবী বন্দী হন। কর্ণদেব তাঁর কন্যা দেবলাদেবীসহ দাক্ষিণাত্যের দেবগিরির রাজা রামচন্দ্রের আশ্রয় নেন। সেনাপতি নসরৎ খাঁ ক্যাম্বে বন্দর লুণ্ঠন করেন। এখান থেকে কাফুর নামক এক সুদর্শন খোজাকে দিল্লিতে আনেন। পরবর্তী কালে এই কাফুর নিজ দক্ষতায় সুলতানের প্রধান প্রধান মন্ত্রী ও সেনাপতি হয়েছিলেন।

রণথম্ভোর অভিযান
১২৯৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজস্থানের অন্তর্গত রণথম্ভোরে অভিযান চালান। সে সময়ে রণথম্ভোরের রাজা ছিলেন চৌহানবংশীয় রাজা তৃতীয় পৃথ্বীরাজের বংশধর হামিরদেব। এই রাজ্যটি পূর্বে সুলাতনি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এছাড়া বিদ্রোহী নব্য-মুসলমানদের অনেকে এই রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। রাজ্য উদ্ধার এবং নব্য-মুসলমানদের আশ্রয় দেওয়ার শাস্তি হিসেবে আলাউদ্দিন এই রাজ্য দখলের উদ্যোগ নেন। এই যুদ্ধে তিনি উলুগ খাঁ এবং নসরৎ খাঁয়ের নেতৃত্বে একদল সৈন্য প্রেরণ করেন। এই যুদ্ধে সুলতানের বাহিনী পরাজিত হয় এবং নসরৎ খাঁ নিহত হন। এরপর আলাউদ্দিন নিজেই রণথম্ভোর আক্রমণ করেন। প্রায় ১ বছর রণথম্ভোর অবরোধ করার পর, রাজপুত সৈন্যদের বিশ্বাসঘাতকতায় আলাউদ্দিন রণথম্ভোর জয় করতে সক্ষম হন। এই যুদ্ধে হামিরদেব সপরিবারে নিহত হবেছিলেন। এই সময় আলাউদ্দিনের ভ্রাতুষ্পুত্র আকাত খাঁ আলাউদ্দিনকে হত্যা করার চেষ্টা করলে, রক্ষীদের হতে ধৃত হন। পরে আকাত খাঁ তাঁর অনুচরদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া। এছাড়া এই সময় বদাউনে তাঁর দুই ভাগনেয় উমর খাঁ এবং মঙ্গু খাঁ  বিদ্রোহ করে। পরে এদের পরাজিত করে বন্দী করা হয়েছিল।

রণথম্ভোর অভিযানের সময়ই মোঙ্গলরা তৃতীয়বার আক্রমণ চালায় এবং পরাজিত হয়।

তৃতীয় মোঙ্গল আক্রমণ
১২৯৯ খ্রিষ্টাব্দে মোঙ্গলরা কুৎলু খাঁর নেতৃত্বে ভারত আক্রমণ করে। এবার এরা দিল্লির নিকটবর্তী অঞ্চলগুলো বিধ্বস্ত করে। এবারেও সুলতানি সৈন্যরা এদের পরাজিত করে। তবে এবারের যুদ্ধে জাফর খাঁ নিহত হন।

তৃতীয় মোঙ্গল আক্রমণের পর, মোঙ্গল বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এরা যথেষ্ঠ শক্তিশালী চতুর্থ আক্রমণ করেছিলে ১৩০৪ খ্রিষ্টাব্দে। এর ভিতরে রাজস্থানের বিভিন্ন রাজ্যে হানা দেওয়া শুরু করেন।

চিতোর অভিযান
এর পূর্বে ইলতুৎমিশ মেবার আক্রমণ করে সফল হতে পারেন নি। ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে আলাউদ্দিন মেবার আক্রমণ করেন। কারো কারো মতে- মেবারের রাণা রতনসিংহের পরমা সুন্দরী রাণী পদ্মিনীকে পাওয়ার জন্য এই আলাউদ্দিন মেবার আক্রমণ করেছিলেন। এই যুদ্ধে প্রায় ৫ মাস ধরে রাজপুত সেনাপতি গোরা ও বাদল সুলতানের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হন। এই যুদ্ধে রতন সিং আত্মসমপর্পণ করেন। এরপর রাজপুত রমণীরা অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। যুদ্ধ শেষে আলাউদ্দিন তাঁর পুত্র খিজির খাঁকে চিতোরের শাসনভার অর্পণ করে, দিল্লিতে ফিরে আসেন। কিন্তু রাজপুতদের ক্রমাগত আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে, খিজির খাঁ মেবার ত্যাগ করলে, আলাউদ্দিনস্থানীয় মালদেব নামক এক রাজপুতের হাতে শাসনভার অর্পণ করেছিলেন।

মালব অভিযান
১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে আলাউদ্দিন মালব অভিযান পরিচালনা করেন। এই যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন- আইন-উল-মুলুক নামক এক সেনাপতি। মালব-রাজ হরনন্দ পরাজিত হলে- উজ্জয়নী, চান্দেরী-সহ অন্যান্য অঞ্চল সুলতানী সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

চতুর্থ মোঙ্গল-আক্রমণ
১৩০৪ খ্রিষ্টাব্দে মোঙ্গলরা তার্ঘি খাঁর নেতৃত্বে ভারত আক্রমণ করে এবং দিল্লির প্রান্তে এসে উপস্থিত হয়। তারা সিরি নগরী দুই মাস অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে আলাউদ্দিন প্রতি-আক্রমণ চালিয়ে মোঙ্গলদের পরাজিত ও বিতারিত করতে সক্ষম হন।

মোঙ্গলদের ক্রমাগত আক্রমণে আলাউদ্দিন নতুন রাজ্য জয়ের পরিকল্পনা ত্যাগ করে, মোঙ্গলদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নেন। তিনি দিল্লি থেকে রাজধানি সিরিতে স্থানান্তরিত করে সেখানে সসৈন্যে অবস্থান নেন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের দীপলপুর ও সামানাতে দুর্গ নির্মাণ করে সেখানে সৈন্য মোতায়েন করেন। এই অঞ্চলের শাসনকর্তা হিসেবে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা মালিক গাজীকে দেওয়া হয়। মোঙ্গলদের আক্রমণের পথে প্রাচীন দুর্গগুলোর সংস্কার করা হয়। এছাড়া দিল্লি রক্ষার জন্য কয়েকটি নতুন দুর্গ নির্মাণ -সহ প্রতিরক্ষা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। 

পঞ্চম মোঙ্গল আক্রমণ
১৩০৫ খ্রিষ্টাব্দে মোঙ্গলরা আলি বেগ ও তার্ঘির নেতৃত্বে একটি বিশাল সেনবাহিনী নিয়ে, পাঞ্জাব আক্রমণ করেন এবং লাহোর অধিকার করেন। এই সময় এই আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য কাফুর মোঙ্গল বাহিনীর মুখোমুখী হন। সুলতানের বাহিনী মোঙ্গলদের পরাজিত করেন। এই যুদ্ধে  মোঙ্গল সেনপাতি আলি বেগ ও তার্ঘি নিহত হন। এই যুদ্ধে কাফুর বহু মোঙ্গল সৈন্যকে বন্দী করেন। মোঙ্গল বাহিনী এই পরাজয়ের গ্লানি দূর করার জন্য, কুবাকের নেতৃত্বে একটি বিরাট সৈন্যদল নিয়ে ভারতে আসেন। কুনাক সিন্ধু নদী অতিক্রম করে ব্যাপক লুটতরাজ করেন। এরপর এরা রাভি নদী পর্যন্ত দখল করে নেয়। এই সময় ইকবালমন্দ নামক সেনাপতির নেতৃত্বে এলদল মোঙ্গল সেনা দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে নাগোর দখল করেন। এখানে মোঙ্গলরা ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করলে, আলাউদ্দিন সেনাপতি কাফুরকে পাঠান। এই সময় সৈন্যদের উৎসাহিত করার জন্য প্রতিটি সৈন্যকে অতিরিক্ত ১ বছরের বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এছাড়া মালিক কাফুরকে সাহায্য করার জন্য মালিক তুঘলক, সাহানা-ই-বার্গা ও দীপালিপুরের জায়গিরকে পাঠান। রাভি নদীর তীরে উভয় সেনাদল মুখোমুখী হলে, প্রথমে কেউই আক্রমণ করতে সাহসী হয় নি। অবশেষে মোঙ্গলার অধৈর্য হয়ে প্রথম মোঙ্গলরা আক্রমণ শুরু করে। কিন্তু কাফুরের রণকৌশলে মোঙ্গল অচিরেই পরাজিত হয়ে, পালাতে শুরু করে। এই সময় মোঙ্গল সেনাপতি কুনাক-সহ বহু মোঙ্গল নরনারী বন্দী হয়। এদেরকে পরে দিল্লিতে পাঠানো হয়। এই যুদ্ধ জয়ের পর, কাফুর ও মালিক তুঘলক  নাগোরের দিকে অগ্রসর হন। ইতিমধ্যে কুবাকের পরাজয়ের সংবাদ পেয়ে মোঙ্গল সৈন্যরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ইকবালমান্দ ত্যাগ করে সিন্ধুনদের অপর তীরে চলে যায়। এই সুযোগে সুলতানের বাহিনী মোঙ্গলদের ধাওয়া করে, বহু সৈন্য হত্যা ও বন্দী করে। এই যুদ্ধে প্রায় ৫০-৬০ হাজার মোঙ্গলদের মধ্যে ৩-৪ হাজার জীবিত ছিল। এদের ভিতরে পুরুষদের হত্যা করা হয়ে এবং নারী ও শিশুদের দাস হিসেবে বিক্রয় করা হয়। এই আক্রমণ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়- আমির খসরুর রচিত খাজাইন-উল-ফুতুহ্ ও ইসামী রচিত ফুতুহ-উস-সালাতিন নামক গ্রন্থে। মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ জয়ের পর, দীপালপুরের নতুন শাসনকর্তা গাজী তুঘলক কাবুল, গজনী, কান্দাহার ও গরম্‌শির অঞ্চলে ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়ে মোঙ্গলদের ছোটো ছোটো শাসন এলাক বিধ্বস্ত করে এবং তাদের কর দিতে বাধ্য করে। তুঘলকের এই আক্রমণ প্রতিরোধ করার মতো মোঙ্গলসৈন্যদের ক্ষমতা ছিল। তুঘলক গজনী জয় করে সেখানকার মসজিদে আলাউদ্দিনের নামে খুতবা পাঠের করিয়েছিলেন।

মূলত পঞ্চম মোঙ্গল আক্রমণের পর মোঙ্গলরা আত্মরক্ষা করতে ব্যস্ত থাকায়,  আলাউদ্দিনের শাসনামলে নতুন কোন মোঙ্গল আক্রমণ হয় নি। এই পরিসরে তিনি দাক্ষিণ্যাত্যে অভিযান শুরু করেন।

দেবগিরি অভিযান দ্বিতীয় অভিযান
১৩০৬ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় অভিযান পরিচালনা করেন। উল্লেখ্য জালালুদ্দিনের সেনাপতি হিসেবে ১২৯২ খ্রিষ্টাব্দে  আলাউদ্দিন দেবগিরি আক্রমণ করে জয়লাভ করেছিলেন। এরপর দেবগিরির রাজা রামচন্দ্র কর দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এবং গুজরাটের পলাতক রাজা কর্ণদেবকে আশ্রয় দেয়। এই দুটি কারণে আলাউদ্দিন মালিক কাফুরকে দেবগিরি অভিযানে পাঠান। এই যুদ্ধে রামচন্দ্র বশ্যতা শিকার করে দিল্লিতে আনা হয়। সুলতান তাঁকে 'রায়রায়ণ' উপাধি প্রদান করেন। অন্যদিকে কর্ণদেবের কন্যা দেবলাদেবীকে দিল্লিতে এনে, আলাউদ্দিনের পুত্র খিজির খাঁ-এর সাথে বিবাহ দেওয়া হয়।

মারওয়ার অভিযান
১৩০৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজস্থানের আলাউদ্দিন মারওয়ার অভিযানে যান। এই সময় এই রাজ্যের রাজা ছিলেন শিতলদেব। দীর্ঘ কয়েক মাস অবরুদ্ধ থাকার পর, শিতলদেব সন্ধি করেন। এই সন্ধি অনুসারে সিওয়ান দুর্গ শিতলদেব নিজের অধিকারে রাখতে সক্ষম হলেও রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চল আলাউদ্দিনের অধিকারে আসে।

বরঙ্গল অভিযান
১৩০৮ খ্রিষ্টাব্দে মালিক কাফুর নেতৃত্বে বরঙ্গলের কাকতীয় বংশীয় রাজা দ্বিতীয় প্রতাপরুদ্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হয়। কয়েক মাস অবরুদ্ধ থাকার পর, প্রতাপরুদ্র প্রচুর ধনরত্ন প্রদান আত্মসমর্পণ করেন।

হোয়সল অভিযান
১৩১০ খ্রিষ্টাব্দে দাক্ষিণাত্যের হোয়সল রাজ্য আক্রমণ করেন। এই অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন মালিক কাফুর। মালিক কাফুর আকস্মিকভাবে বিশাল সেনাবাহিনী নেয়ে উপস্থিত হোয়সল রাজ্যে উপস্থিত হলে- রাজা বীর বল্লাল উপায়ন্তর না দেখে আত্মসমর্পণ করেন। এবং বাৎসরিক কর দিতে সম্মত হন।

জলর অভিযান
১৩১১ খ্রিষ্টাব্দে রাজস্থানের জলর রাজ্যে জয়ের অভিযান পরিচালিত হয়। রাজা কানেরাদেবের প্রচণ্ড বাধার মুখে সুলতানের বাহিনী পরাজিত হলেও, শেষ পর্যন্ত কানেরাদেব পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হন। জলর অভিযানের পর, আলাউদ্দিন রাজস্থানের অন্যান্য স্থান দখলের আর চেষ্টা করেন নি।

পাণ্ড্য অভিযান
১৩১১ খ্রিষ্টাব্দে হোয়সল রাজ্য অধিকার করার পর কাফুর দাক্ষিণ্যাত্যের পাণ্ড্যরাজ্য  আক্রমণ করেন। এই সময় পাণ্ড্যরাজ্যে ভ্রাতৃবিরোধ থাকায়, সহজেই কাফুর জয়লাভ করতে সক্ষম হন। কাফুর সেতুবন্ধ রামেশ্বর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে, রামেশ্বর মন্দির অধিকার করেন। এই সময় তিনি ‌এই মন্দির লুট করে বহু দিনের সঞ্চিত ধনসম্পদ অধিকার করেন।

দেবগিরি অভিযান তৃতীয় অভিযান
১৩১৩ খ্রিষ্টাব্দে রামচন্দ্রের পুত্র শঙ্কর কর দিতে অস্বীকার করায়, আলাউদ্দিন তৃতীয়বার দেবগিরি অভিযান চালান। এবারের সেনাপতি ছিলেন কাফুর। যুদ্ধে শঙ্কর পরাজিত ও নিহত হন। এই সময় বিদ্রোহী হোয়সল রাজ্য আক্রমণ করে দিল্লির সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।

শেষ দেবিগিরি অভিযানের পর থেকে আলাউদ্দিন নতুন কোনো রাজ্য জয়ে অভিযান চালান নি। ১৩১৫ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে তিনি সেনাপতি ও প্রধানমন্ত্রী কাফুরের পরামর্শে, শাহাবুদ্দিন ওমরকে উত্তরাধিকার করে যান। ১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দিল্লিতে মৃত্যবরণ করেন।

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বিকাশে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির অবদান
বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতে আলাউদ্দিন ছিলেন নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ। তিনি রাজ্যলোভে নিজের চাচা প্রতিপালক জালাউদ্দিনকে হত্যা করেছিলেন। সিংহাসনলাভের পর, জালালুদ্দিনের পরিবার ও বংশধরদের সাথে নির্মম আচরণ করেছিলেন এবং প্রতিটি রাজ্যজয়ের পরে, বিজিত রাজ্যে সৈন্যদের ব্যাপক হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণকে সমর্থন করেছিলেন। এতকিঢ়ুর পরে শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল অসামান্য। বিশেষ করে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের নবধারা হিসেবে ধ্রুবদের বিকাশ ঘটেছিল তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায়। এই ভারতীয় সঙ্গীতের এই নবধারা বিকাশের অন্যতম প্রাণপুরুষ ছিলেন- , হযরত আমির খসরু  ১২৯২ খ্রিষ্টাব্দে  আলাউদ্দিন দেবগিরি আক্রমণ করে জয়লাভ করেছিলেন। এরপর দেবগিরির রাজা রামচন্দ্র কর দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এবং গুজরাটের পলাতক রাজা কর্ণদেবকে আশ্রয় দেয়। এই দুটি কারণে আলাউদ্দিন মালিক কাফুরকে দেবগিরি অভিযানে পাঠান। খ্রিষ্টাব্দে সুলতানের আদেশে তাঁর সেনাপতি কাফুর দেবগিরি আক্রমণ করেন। ১৩১২ খ্রিষ্টাব্দে সুলতানের আদেশে তাঁর সেনাপতি কাফুর দেবগিরি আক্রমণ করেন। কাফুর এই যুদ্ধে রামচন্দ্রকে পরাজিত করেন। এই সময় অন্যান্য বন্দীদের সাথে ওই দরবারের সভাগায়ক গোপাল নায়ককে দিল্লিতে আনা হয়। তাঁর সঙ্গীত-প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে গোপাল নায়ককে তাঁর সভায় স্থান দিয়েছিলেন। তার রাজ-সভার অপর সঙ্গীতসাধক বৈজু বাওরাকে স্থান দিয়েছিলেন।


সূত্র: