হিন্দোল
উত্তর ভারতীয়
সঙ্গীত পদ্ধতিতে
কল্যাণ ঠাটের অন্তর্গত রাগ বিশেষ।
খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর ভিতরে ষড়্জ ও মধ্যম গ্রাম থেকে মোট ১৮টি গ্রাম রাগের
উদ্ভব হয়েছিল। এই রাগগুলো বিশেষ কিছু শর্ত অনুসরণে নাটকের
ধ্রুবা গান হিসেবে
ব্যবহৃত হতো। ভরত এই বিশেষ গ্রামরাগের আশ্রয়ে সৃষ্ট গানগুলোর নামকরণ করেছিলেন জাতি
গান।
খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয়-তৃতীয় শতাব্দীতে ভরতের পুত্র ও শিষ্য শার্দুল হিন্দোলকে
ভাষারাগ হিসেবে
উল্লেখ করেছেন। এই ভাষারাগ থেকে উৎপন্ন
বিভাষা রাগের
যে তালিকা দিয়েছিলেন- তা হলো- ভিন্নবলিতিকার, রবিচন্দ্রা, ভিন্নপৌরালী, দ্রাবিড়ী,
পিঞ্জরী, পার্বতী। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীতে যাষ্টিক ১৫ট ভাষা রাগের জনকের
তালিকায় হিন্দোলকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর ভিতরে দেশী সুরাবলম্বনে আরও বহুরাগের উদ্ভব হয়েছিল।
বৃহদ্দেশী গ্রন্থ থেকে জানা যায়- গীতভেদ অনুসারে গ্রামরাগগুলোকে কয়েকটি ভাগে
ভাগ করা হয়েছিল। এগুলো হলো-শুদ্ধা (
চোক্ষ),
ভিন্নকা
,গৌড়িকা
, রাগগীতি,
সাধারণী,
ভাষা ও
বিভাষা। হিন্দোল রাগটি ছিল রাগগীতির অধীনে। এই রাগের অধীনে ছিল ৫টি রাগ। এগুলো হলো-
বেসরী, প্রথমমঞ্জরী,
ছেবাটী, ষড়্জমধ্যমা,
মধুরী (মধুকরী)। [বৃহদ্দেশী।
পৃষ্ঠা: ১৯২]
প্রাচীন ভারতে এই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিচারে এই রাগটি উৎপন্ন হয়েছিল ষড়্জ
গ্রামের
ষাড়্জী ও
নৈষাদী এবং মধ্যম গ্রামের
গান্ধারী,
মধ্যমা, ও
পঞ্চমী। উভয় গ্রামের মিশ্রণ হলেও তিনটি মধ্যম গ্রামের প্রাধ্যনের কারণে একে
মধ্যম গ্রামের রাগ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ভরত, কোহল প্রমুখ সঙ্গীতাচার্যরা একে
মধ্যম গ্রামের রাগ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তারপরেও এই রাগের গ্রাম নিয়ে সংশয়
ছিল। কারণ ষড়্জ গ্রামে পঞ্চম ছিল চার শ্রুতির, পক্ষান্তরে মধ্যমগ্রামের পঞ্চম তিন
শ্রুতির। হিন্দোল মধ্যম গ্রামের রাগ হলেও ত্রিশ্রুতির ছিল। সেকালের হিন্দোলের
অংশস্বর, গ্রহস্বর ও ন্যাসস্বর ছিল ষড়্জ। একালের হিন্দোলের বাদী স্বর ধৈবত।
সেকালের হিন্দোলে ধৈবত ও ঋষভ বর্জিত ছিল। একালের হিন্দোলেও এই দুটি স্বর বর্জিত।
অর্থাৎ হিন্দোল ঔড়ব-ঔড়ব জাতির রাগ। নাট্যগীতি বা ধ্রবা গানে বীররসের গানে ব্যবহৃত
হতো। তবে কখনো কখনো শৃঙ্গার রসের গানে এই রাগ ব্যবহৃত হতো। ধ্রুবাগানে এই গান
পরিবেশিত হতো-
চচ্চৎপুট তালে চিত্র, বার্তিক ও দক্ষিণ মার্গে।
খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে লোচন শর্মার
রচিত 'রাগতরঙ্গিনী' গ্রন্থে হিন্দোলকে আদি রাগ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং এর
অধীনে ছিল ৫টি রাগিণী। এগুলো হলো-বেলাবলী, দেশাখ, অরু, রামকরী (রামকেলী), ললিতা ও
পটমঞ্জরী।
খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে, এই প্রাচীন রাগটি নতুন রূপ লাভ করেছিল। বর্তমানে এই রাগের প্রকৃতি বলা হয়
গম্ভীর। এই রাগে ঋষভ
ও পঞ্চম বর্জিত। এই রাগে বিস্তার হয় মধ্য ও তার সপ্তকে। এতে নিষাদ বক্রভাবে এবং
দুর্বলভাবে ব্যবহৃত হয়। এই রাগে গমকের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। অনেকে মনে করেন এর
বাদী গান্ধার এবং সমবাদী ধৈবত। এই বিচারে রাগটিকে পূর্বাঙ্গের বলে বিবেচনা করা হয়।
এই রাগের সাথে ঋষভ যুক্ত করলে,
সোহিনী'র
কাঠামো পাওয়া যায়।