১. গ্রহ: যে স্বর থেকে গান শুরু হয়। দুই
গ্রামে গ্রহস্বরের সংখ্যা ছিল ৬৩টি।
২. অংশ: একালের বাদীস্বরের মতো। এই স্বর অন্যান্য স্বর থেকে অধিক ব্যবহৃত হয়।
এই স্বরকে কেন্দ্র করে রাগের রস ও ভাবের সৃষ্টি হয়। দুই গ্রামে অংশস্বরের
সংখ্যা ছিল ৬৩টি।
৩. তার: এটি মূলত রাগের গতি। এর প্রয়োগ হয় রাগের প্রথম পাঁচ স্বরের উপর। মূলত
অংশ স্বর থেকে চতুর্থ স্বর পর্যন্ত অথবা পঞ্চম স্বর পর্যন্ত তারগতি হবে। অংশ
স্বর পঞ্চম বা সপ্তম পর্যন্ত হতে পারে।
৪. মন্দ্র: মন্দ্র গতি তিন প্রকার।
১. নিম্নগ্রামের অংশের উপর নির্ভরশীল।
২. ন্যাসের উপর নির্ভরশীল
৩. অপন্যাসের উপর নির্ভরশীল।
৫. ন্যাস: এই অংশে রাগের আলাপ বা বিকাশ ঘটে। এবং রাগের অংশবিশেষের বা
সম্পূর্ণ অংশের পূর্ণতা লাভের পর যে স্বরে সমাপ্তি ঘটে।
৬. অপন্যাস: যে স্বরে অংশের রাগের পদবিদারী অংশ সম্পন্ন হয়। উল্লেখ্য রাগের
অংশস্বর, সম্বাদী স্বর বা অনুবাদী স্বর এবং ন্যাস স্বরের সমন্বয়ে পদবিদারী গঠিত
হয়। যেমন- ইমন রাগে ন্ র গ হ্ম প যদি বিদারী হয়, তাহকে অপন্যাস হবে প।
৭. অল্পত্ব: যে স্বর রাগে অল্প ব্যবহৃত হয়। জাতিরাগে অল্পত্ব ছিল দুই ধরনের। এই
ধরণ দুটি হলো- অনভ্যাস ও লঙ্ঘন। যে স্বরের প্রায় ব্যবহৃত হয় না বা যে স্বর
বর্জন করা হয়। তাকে বলে অনভ্যাস। পক্ষান্তরে যে স্বর সামান্য ব্যবহার করা হয়,
তাকে বলা হয় লঙ্ঘন।
৮.বহুত্ব: যে স্বর অধিক ব্যবহার করা হয়।
৯. ষাড়বত্ব: যে রাগে ৬টি স্বর ব্যবহৃত হয়।
১০ ঔড়বত্ব: যে রাগে ৫টি স্বর ব্যবহৃত হয়। উল্লিখিত লক্ষণের বিচারে জাতি রাগ হতে
গেলে কমপক্ষে ৫টি স্বর থাকতেই হতো। অর্থাৎ আর্চিক, গাথিক, সামিক এবং
স্বরান্তরের সুরবিন্যাসকে জাতি রাগ হিসেবে গ্রহণ করা হতো না।
খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয়
শতাব্দীতে ভরতের নাট্যশাস্ত্রের গ্রামরাগগুলোকে জাতিগান হিসেবে উল্লেখ করা
হয়েছে। মূলত
জাতিগানগুলো ব্যবহৃত হতো নাটকে
ধ্রুবাগান হিসেবে। এর সুরের কাঠামো ছিল
গ্রামরাগ-ভিত্তিক। এই গ্রন্থে গ্রামরাগের দশটি লক্ষণ আর
জাতিগানের লক্ষণ একই ছিল। এই
কারণে
অনেকে সময়
জাতিগানকে জাতিরাগ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
ভরতের নাট্যশাস্ত্রে মোট ১৮ প্রকার
জাতিগানের
উল্লেখ পাওয়া যায়। এর ভিতরে সাতটি ছিল শুদ্ধজাতি ও এগারোটি ছিল বিকৃত জাতি। এর
সবগুলোই গ্রামরাগ। ভরতের সময় যে সকল গ্রামরাগ ভিত্তিক যে সকল গীতের প্রচলন ছিল, তার
সাথে আরও কিছু গ্রামরাগ যুক্ত হয়ে, গ্রামরাগের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। খ্রিষ্টীয়
ষষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত মতঙ্গের রচিত বৃহদ্দেশীতে এ সকল গ্রামরাগের শ্রেণিকরণ করা
হয়েছিল।
ভরত নির্দেশিত গ্রামভেদে ১৮ প্রকার জাতিগান।
- শুদ্ধ জাতি বা
শুদ্ধ রাগ: ভরতের শুদ্ধ জাতির গান ছিল ৭টি। এর ভিতরে ৪টি উৎপন্ন হয়েছিল ষড়্জ
গ্রাম থেকে। বাকি ৩টি উৎপন্ন হয়েছিল মধ্যম গ্রাম থেকে। উল্লেখ্য নাট্যশাস্ত্রে
গান্ধার গ্রামের কোনো উল্লেখ নেই। কারণ, ভরতের সময় গান্ধার গ্রামের ব্যবহার কমে
গিয়েছিল। বা গুরুত্বহীন বিবেচনায় তিনি গান্ধার গ্রামকে তাঁর আলোচনার বাইরে
রেখেছিলেন। ভরতের পরে দত্তিলম অবশ্য গান্ধার গ্রাম নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।
বৃহদ্দেশীতে শুদ্ধজাতিকে বলা হয়েছে চোক্ষগীতি।
- ষড়্জ গ্রামজাত জাতি: মোট ৭টি জাতি। এগুলো হলো-
ষাড়্জী,
আর্যভী,
ধৈবতী,
নৈষাদী,
ষড়্জ্জকৈশিকী,
ষড়্জোদীচ্যবতী এবং
ষড়্জমধ্যমা। এই রাগগুলো শুদ্ধ ও বিকৃত হিসেবে বিভাজিত ছিল।
- শুদ্ধ জাতি: এই জাতীয় গানে একটি মাত্রা জাতি শুদ্ধভাবে
পরিবেশিত হতো। শুদ্ধ শ্রেণির জাতিগুলো ছিল-
ষাড়্জী,
আর্যভী,
ধৈবতী,
নৈষাদী (নিষাদবতী)।
- বিকৃত জাতি: একাধিক জাতির সংমিশ্রণে সৃষ্ট জাতিগানে বিকৃত
জাতি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ষড়জ্ গ্রামের বিকৃত জাতিতে একাধিক জাতির
মিশ্রণ থাকলেও ষাড়জী জাতির প্রাধান্য রাখা হতো। যাড়্জী জাতির অন্তর্গত
বিকৃত জাতিগুলো হলো-
-
মধ্যম গ্রামজাত জাতি: মোট ১১টি জাতি। এগুলো হলো-
আন্ধ্রী,
কর্মারবী,
কৈশিকী,
গান্ধারপঞ্চমী,
গান্ধারী,
নন্দয়ন্তী,
মধ্যমা,
পঞ্চমী,
রক্তগান্ধারী,
গান্ধারোদীচ্যবা ও
মধ্যমোদীচ্যবা । এই রাগগুলো শুদ্ধ ও বিকৃত হিসেবে বিভাজিত ছিল।
বৃহদ্দেশীতে রাগভিত্তিক গীতকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। এই ভাগগুলো হলো-
- চোক্ষ বা শুদ্ধরাগ: এই গীতের জন্য নির্ধারিত ছিল-ষাড়ব, পঞ্চম, কৈশিক মধ্যম,
চোক্ষসাধারিত, এবং চোক্ষকৈশিক
- ভিন্নরাগ: এই গীতের জন্য নির্ধারিত ছিল- ভিন্নষড়্জ, ভিন্নতান,
ভিন্নকৈশিকমধ্যম, ভিন্ন কৈশিক ও ভিন্নপঞ্চম।
- গৌড়ীরাগ: গৌড়ীকৈশিকমধ্যম, গৌড়কৈশিক, গৌড়পঞ্চম
- রাগগীত: এই গীতের জন্য নির্ধারিত ছিল- টক্ক, সৌবীর, মালবপঞ্চম, বেসরষাড়ব,
বোট্ট, হিন্দোলক, টক্ককৈশিক, ও মালবকৈশিক।
- সাধারণী রাগ: এই গীতের জন্য নির্ধারিত ছিল- নর্ত, শক, ককুভ, হর্মাণপঞ্চম,
রূপাসাধারিত, গান্ধারপঞ্চম, ষড়্জ ও কৈশিক।
মূলধারার এই রাগগুলোর বাইরে লৌকিক গানের সূত্রে আরও কিছু রাগকে বিবেচনায় আনা
হয়েছিল। এই রাগগুলোকে বলা হয়েছে উপরাগ। উপরাগগুলো তৈরি হয়েছিল গ্রামরাগের ছায়া
অবলম্বনে। বৃহদ্দেশীতে এইরূপ তিনটি উপরাগের নাম পাওয়া যায়। এগুলো হলো- পঞ্চমষাড়ব,
রেবাগুপ্ত ও টক্কসৈন্ধব। শার্ঙ্গদেব তাঁর সঙ্গীতরত্নাকরে এর বাইরে আরো পাঁচটি
উপরাগের উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো- শকতিলক, কোকিলাপঞ্চম, ভাবনাপঞ্চম, নাগগান্ধার ও
নাগপঞ্চম।
বৃহদ্দেশীতে উল্লেখ করা হয়েছে- ভাষা গানের বিষয়। এখানে ভাষা ভেদের গানের
বিচারে- ভাষা হলো প্রকরণ। মূলত রাগ হিসেবে ভাষা হলো গ্রাম রাগের প্রকারভেদ। এই
শ্রেণির রাগগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো- মূল, সঙ্কীর্ণ, দেশজ ও
ছায়ামাত্রাশ্রবা।
খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে যাষ্টিক এই ভাষারাগের মূল গ্রামরাগ এবং এই গ্রামরাগ থেকে উৎপন্ন ভাষারাগগুলোর
পরিচয় দিয়েছেন। যাষ্টিক এই রাগগুলোকে গ্রামরাগ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। নিচে
গ্রামরাগ এবং এর অধীনস্ত ভাষারাগগুলোর তালিকা দেওয়া হলো। [বৃহদ্দেশী। পৃষ্ঠা: ১৯১]
-
টক্ক : বৃহদ্দেশীতে
যাষ্টিকের উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে- এই রাগের অধীনে ১৬টি ভাষারাগ ছিল। এগুলো হলো-
ত্রবণা,
ত্রবোণদ্ভবা,
বেরঞ্জিকা,
ছেবাটী,
মালবেসরী,
গুর্জরী,
সৌরাষ্ট্রিকা,
সৈন্ধবী,
বেসরিকা,
পঞ্চম,
রবিচন্দ্রিকা,
অম্বাহেরী,
ললিতা,
কোলাহলী,
মধ্যমগ্রামিকা,
গান্ধারপঞ্চমী।
শার্ঙ্গদেব তাঁর সঙ্গীতরত্নাকর গ্রন্থের রাগবিবেকাধ্যায়ের প্রথম প্রকরণে ২১
(খ)-৪৭-এ টক্ক রাগের ২১টি ভাষা রাগের নামোল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো- শ্রবণা
(ত্রবণা),
শ্রবণোদ্ভোবা (ত্রবোণদ্ভবা),
বৈরঞ্জী, মধ্যমগ্রামদেহা (মধ্যমগ্রামিকা),
মালবেসরী,
ছেবাটী,
সৈন্ধবী, কোলহলা
(কোলাহলী),
পঞ্চমলক্ষিতা, সৌরাষ্ট্রী (সৌরাষ্ট্রিকা),
পঞ্চমী (পঞ্চম),
বেগরঞ্জিনী,
গান্ধারপঞ্চমী, মালবী, তানবলিতা,
ললিতা,
রবিচন্দ্রিকা,
ভানা, অম্বাহেরিকা(অম্বাহেরী),
দোহ্যা ও বেসরী (বেসরিকা)
- মালবকৈশিক (রাগগীতির অন্তর্গত মূল রাগ): এই রাগের অধীনস্থ রাগের সংখ্যা
৮টি। এগুলো হলো- শুদ্ধা (পৌরালী), আদ্যবেসরিকা, হর্ষপুরী, মাঙ্গলী, সৈন্ধবী,
আভীরী, খঞ্জরী, গুঞ্জরী।
- ককুভ (সাধারণী গীতির অন্তর্গত মূল রাগ): এই রাগের অধীনস্থ রাগের সংখ্যা
৭টি। এগুলো হলো- কাম্বোজা, মধ্যমগ্রামিকা, সালবাহনিকা, ভাবর্ধনী, মুহরী,
শকমিশ্রিতা, ভিন্নপঞ্চমী
- হিন্দোল (রাগগীতির অন্তর্গত মূল রাগ): এই রাগের অধীনস্থ রাগের সংখ্যা
৫টি। এগুলো হলো- বেসরী, প্রথমমঞ্জরী, ছেবাটী, ষড়্জমধ্যমা, মধুরী (মধুকরী)।
- পঞ্চম (শুদ্ধ বা চোক্ষ গীতির অন্তর্গত মূল রাগ): এই রাগের অধীনস্থ রাগের
সংখ্যা ১০টি। এগুলো হলো- আভীরী, ভাবিনী, মাঙ্গালী, সৈন্ধবী, গুর্জরী,
দাক্ষিণাত্যা, আন্ধ্রী (অন্ধালী), তানোদ্ভবা, ত্রাবণী (ত্রাপণী) ও কৈশিকী।
- ভিন্নষড়্জ (ভিন্ন গীতির অন্তর্গত মূল রাগ): এই রাগের অধীনস্থ রাগের সংখ্যা
৯টি। এগুলো হলো- বিশুদ্ধা, দাক্ষিণ্যাত্যা, গান্ধারী, শ্রীকণ্ঠী, পৌরালী,
মাঙ্গলী, সৈন্ধবী, কালিন্দী ও পুলিন্দী।
- সৌবীর (রাগগীতির অন্তর্গত মূল রাগ): এই রাগের অধীনস্থ রাগের সংখ্যা
৪টি। এগুলো হলো- সৌবীরী, বেগমধ্যা, সারিতা ও গান্ধারী।
- ভিন্নপঞ্চম (ভিন্ন গীতির অন্তর্গত মূল রাগ): এই রাগের অধীনস্থ রাগের সংখ্যা
৪টি। এগুলো হলো- শুদ্ধভিন্না, বরাটী, ধৈবতভূষিতা এবং বিশালা।
- মালবপঞ্চম (রাগগীতির অন্তর্গত মূল রাগ): এই রাগের অধীনস্থ রাগের সংখ্যা
১টি। রাগটি হলো- ভাবিনী (লোকভাবিনী)
- বোট্ট (রাগগীতির অন্তর্গত মূল রাগ): এই রাগের অধীনস্থ রাগের সংখ্যা ১টি।
রাগটি হলো- মঙ্গল
- টক্ককৈশিক (রাগগীতির অন্তর্গত মূল রাগ): এই রাগের অধীনস্থ রাগের সংখ্যা
৩টি। এগুলো হলো-মালবা, ভিন্নললিতা ও দ্রাবিড়ী
- বেসরষাড়ব: (রাগগীতির অন্তর্গত মূল রাগ): এই রাগের অধীনস্থ রাগের সংখ্যা
২টি। এগুলো হলো- বাহ্যষাড়ব ও নাদ্যা।
- ভিন্নতান (ভিন্ন গীতির অন্তর্গত মূল রাগ): এই রাগের অধীনস্থ রাগের সংখ্যা
১টি। রাগটি হলো-তানোদ্ভবা।
- গান্ধারপঞ্চম (সাধারণী গীতের অন্তর্ভুক্ত রাগ): এই রাগের অধীনস্থ রাগের
সংখ্যা ১টি। রাগটি হলো-গান্ধারী।
- পঞ্চম ষাড়ব (উপরাগ): এর রাগের উপরাগের অন্তর্গত রাগ শক। এটি রেবাগুপ্ত নামক
উপরাগের অধীনস্থ রাগ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র:
- নাট্যশাস্ত্র (৪র্থ খণ্ড)। ভরত। বঙ্গানুবাদ: সুরেশচন্দ্র
বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ছন্দা চক্রবর্তী। নবপত্র প্রকাশন। ডিসেম্বর ২০১৪।
- বৃহদ্দেশী। মতঙ্গ। সম্পাদনা।
রাজ্যেশ্বর মিত্র। সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার। কলিকাতা ৭০০০০৬। ১৯৮২