গ্রামরাগ
ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতির একটি পারিভাষিক শব্দ।

বেদোত্তর যুগে গন্ধর্ব সঙ্গীতাচার্যরা শুদ্ধ স্বরের ভিত্তিতে একটি স্বরসোপান তৈরি করেছিলেন। তাঁর এর  নাম দিয়েছিলেন গ্রাম। কালক্রমে তিন ধরনের স্বরসোপান তৈরি হয়েছিল। এদের নাম ছিল ষড়্জ মধ্যম ও গান্ধার গ্রাম। প্রাতিটি গ্রামের সাতটি স্বর থেকে পৃথক স্বরসোপান তৈরি হয়েছিল। এর নাম দেওয়া হয়েছিল
মূর্চ্ছনা। এই মূর্চ্ছনার সাথে ১০টি বিধি যুক্ত করে যে সুকাঠামো তৈরি হয়েছিল, তাকে শাস্ত্রীয়ভাবে নামকরণ করা হয়েছিল গ্রামরাগ। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রচিত নারদের শিক্ষাগ্রন্থে ৭টি গ্রামরাগের পরিচয় পাওয়া যায়। এগুলো হলো- ষড়জ গ্রামরাগ, পঞ্চম গ্রামরাগ, কৈশিক গ্রামরাগ, কৈশিকমধ্যম গ্রামরাগ, মধ্যম গ্রামরাগ, সাধারিত গ্রামরাগ ও ষাড়ব গ্রামরাগ।

গ্রামরাগের
বিধি

১. গ্রহ: যে স্বর থেকে গান শুরু হয়। দুই গ্রামে গ্রহস্বরের সংখ্যা ছিল ৬৩টি।
২. অংশ: একালের বাদীস্বরের মতো। এই স্বর অন্যান্য স্বর থেকে অধিক ব্যবহৃত হয়। এই স্বরকে কেন্দ্র করে রাগের রস ও ভাবের সৃষ্টি হয়। দুই গ্রামে অংশস্বরের সংখ্যা ছিল ৬৩টি।
৩. তার: এটি মূলত রাগের গতি। এর প্রয়োগ হয় রাগের প্রথম পাঁচ স্বরের উপর। মূলত অংশ স্বর থেকে চতুর্থ স্বর পর্যন্ত অথবা পঞ্চম স্বর পর্যন্ত তারগতি হবে। অংশ স্বর পঞ্চম বা সপ্তম পর্যন্ত হতে পারে।
৪. মন্দ্র: মন্দ্র গতি তিন প্রকার।

১. নিম্নগ্রামের অংশের উপর নির্ভরশীল।
২. ন্যাসের উপর নির্ভরশীল
৩. অপন্যাসের উপর নির্ভরশীল।

৫. ন্যাস: এই অংশে রাগের আলাপ বা বিকাশ ঘটে। এবং রাগের অংশবিশেষের বা সম্পূর্ণ অংশের পূর্ণতা লাভের পর যে স্বরে সমাপ্তি ঘটে।
৬. অপন্যাস: যে স্বরে অংশের রাগের পদবিদারী অংশ সম্পন্ন হয়। উল্লেখ্য রাগের অংশস্বর, সম্বাদী স্বর বা অনুবাদী স্বর এবং ন্যাস স্বরের সমন্বয়ে পদবিদারী গঠিত হয়। যেমন- ইমন রাগে ন্ র গ হ্ম প যদি বিদারী হয়, তাহকে অপন্যাস হবে প।
৭. অল্পত্ব: যে স্বর রাগে অল্প ব্যবহৃত হয়। জাতিরাগে অল্পত্ব ছিল দুই ধরনের। এই ধরণ দুটি হলো- অনভ্যাস ও লঙ্ঘন। যে স্বরের প্রায় ব্যবহৃত হয় না বা যে স্বর বর্জন করা হয়। তাকে বলে অনভ্যাস। পক্ষান্তরে যে স্বর সামান্য ব্যবহার করা হয়, তাকে বলা হয় লঙ্ঘন।
৮.বহুত্ব: যে স্বর অধিক ব্যবহার করা হয়।
৯. ষাড়বত্ব: যে রাগে ৬টি স্বর ব্যবহৃত হয়।
১০ ঔড়বত্ব: যে রাগে ৫টি স্বর ব্যবহৃত হয়। উল্লিখিত লক্ষণের বিচারে জাতি রাগ হতে গেলে কমপক্ষে ৫টি স্বর থাকতেই হতো। অর্থাৎ আর্চিক, গাথিক, সামিক এবং স্বরান্তরের সুরবিন্যাসকে জাতি রাগ হিসেবে গ্রহণ করা হতো না।

খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে ভরতের নাট্যশাস্ত্রের গ্রামরাগগুলোকে জাতিগান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত জাতিগানগুলো ব্যবহৃত হতো নাটকে ধ্রুবাগান হিসেবে। এর সুরের কাঠামো ছিল গ্রামরাগ-ভিত্তিক। এই গ্রন্থে গ্রামরাগের দশটি লক্ষণ আর জাতিগানের লক্ষণ একই ছিল। এই কারণে অনেকে সময় জাতিগানকে জাতিরাগ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

ভরতের নাট্যশাস্ত্রে মোট ১৮ প্রকার জাতিগানের উল্লেখ পাওয়া যায়। এর ভিতরে সাতটি ছিল শুদ্ধজাতি ও এগারোটি ছিল বিকৃত জাতি। এর সবগুলোই গ্রামরাগ। ভরতের সময় যে সকল গ্রামরাগ ভিত্তিক যে সকল গীতের প্রচলন ছিল, তার সাথে আরও কিছু গ্রামরাগ যুক্ত হয়ে, গ্রামরাগের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত মতঙ্গের রচিত বৃহদ্দেশীতে এ সকল গ্রামরাগের শ্রেণিকরণ করা হয়েছিল।

ভরত নির্দেশিত গ্রামভেদে ১৮ প্রকার জাতিগান।

বৃহদ্দেশীতে রাগভিত্তিক গীতকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। এই ভাগগুলো হলো-

মূলধারার এই রাগগুলোর বাইরে লৌকিক গানের সূত্রে আরও কিছু রাগকে বিবেচনায় আনা হয়েছিল। এই রাগগুলোকে বলা হয়েছে উপরাগ। উপরাগগুলো তৈরি হয়েছিল গ্রামরাগের ছায়া অবলম্বনে। বৃহদ্দেশীতে এইরূপ তিনটি উপরাগের নাম পাওয়া যায়। এগুলো হলো- পঞ্চমষাড়ব, রেবাগুপ্ত ও টক্কসৈন্ধব।  শার্ঙ্গদেব তাঁর সঙ্গীতরত্নাকরে এর বাইরে আরো পাঁচটি উপরাগের উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো- শকতিলক, কোকিলাপঞ্চম, ভাবনাপঞ্চম, নাগগান্ধার ও নাগপঞ্চম।

বৃহদ্দেশীতে উল্লেখ করা হয়েছে- ভাষা গানের বিষয়। এখানে ভাষা ভেদের গানের বিচারে- ভাষা হলো প্রকরণ। মূলত রাগ হিসেবে ভাষা হলো গ্রাম রাগের প্রকারভেদ। এই শ্রেণির রাগগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো- মূল, সঙ্কীর্ণ, দেশজ ও ছায়ামাত্রাশ্রবা।

খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে যাষ্টিক এই ভাষারাগের মূল গ্রামরাগ এবং এই গ্রামরাগ থেকে উৎপন্ন ভাষারাগগুলোর পরিচয় দিয়েছেন। যাষ্টিক এই রাগগুলোকে গ্রামরাগ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। নিচে গ্রামরাগ এবং এর অধীনস্ত ভাষারাগগুলোর তালিকা দেওয়া হলো। [বৃহদ্দেশী। পৃষ্ঠা: ১৯১]


তথ্যসূত্র: