মূর্ছনা
ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রে নানা অর্থে মূর্ছনা শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন- গ্রাম-মূর্ছনা, স্বর-মূর্ছনা, বাদ্য-মূর্চ্ছনা, রাগ-মূর্ছনা ও তান-মূর্ছনা।

খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে নারদ তাঁর 'নারদীয় শিক্ষা'য় গ্রাম থেকে উৎপন্ন ২১টি মূর্চ্ছনাকে মোট তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। দেবতা ও গান্ধর্ব গণের মূর্চ্ছনার নাম একই ছিল, কিন্তু পিতৃগণের নাম ছিল ভিন্ন। প্রথম প্রপাঠকের তৃতীয় কণ্ডিকার ৭ থেকে ২৪ শ্লোকে এ বিষয়ে বলা হয়েছে-

নন্দী-বিশালা-সুমুখী-চিত্রা-চিত্রবতী-সুখা।
বলা যা চাথ বিজ্ঞেয়া দেবানাং সপ্তমূর্ছনাঃ॥
আপ্যায়নী-বিশ্বভৃতা-চন্দ্রা-হেমা-কপর্দিনী।
মৈত্রী-বার্হতী চৈব পিতৃণাং সপ্তমূর্ছনাঃ॥

*             *            *
উপজীবন্তি গন্ধর্বাদিবানাং সপ্তমূর্ছনাঃ। ২৩
পিতৃণাং মূর্ছনা সপ্ত তথা যক্ষা ন সংশয়ঃ।
ঋষিণাং মূর্ছনা সপ্ত যাস্তিমা লৌকিকাঃ স্মৃতা ॥২৪

মূর্চ্ছনা সংখ্যা দেবগণ পিতৃগণ গান্ধর্গণ
নন্দী আপ্যায়নী নন্দী
বিশালা বিশ্বভৃতা বিশালা
সুমুখী চন্দ্রা সুমুখী
চিত্রা হেমা চিত্রা
চিত্রবতী কপর্দিনী চিত্রবতী
সুখা মৈত্রী সুখা
বলা বার্হতী বলা

ভরতের নাট্যশাস্ত্রে প্রথম মূর্ছনা'র একটি সংজ্ঞা পাওয়া যায়। এই সংজ্ঞা অনুসারে- ক্রমযুক্ত স্বরসপ্তককে মূর্চ্ছনা বলে। পরবর্তী সময়ে মতঙ্গ তাঁর বৃহদ্দেশী গ্রন্থে- এর একটি স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। বৃহদ্দেশীতে প্রথম বলা হয়েছে- এই মূর্ছা থেকে মূর্ছনা হয়েছে। যে ক্রিয়াতে রাগ মোহগ্রস্থ হয়, তাই হলো মূর্ছনা। এর পরেই বলা হয়েছে- সপ্তস্বরের আরোহ ও অবরোহ ক্রম-প্রযুক্ত হলে, বিচক্ষণ ব্যক্তিরা তাঁকে মূরচ্ছনা বলে থাকেন। কিন্তু নান্যদেব বা নান্যভূপাল তাঁর ভরত-ভাষ্যম গ্রন্থে লিখেছেন- যে স্বর থেকে আরোহণ শুরু হয়ে, সেই স্বরেই যখন শেষ হবে তখন তাকে মূর্ছনা বলা হবে। এই স থেকে র্সা যদি আরোহণের শুরু হয়, তবে তা হবে স্বরাষ্টক।

বৃহদ্দেশীতে ১২টি স্বরের দ্বাদশস্বর মূর্চ্ছনার কথা উল্লেখ করেছেন। স্বর সংখ্যার বিচারে মূরচ্ছনাকে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন। ভাগ দুটি হলো- সপ্তস্বর মূর্চ্ছনা ও দ্বাদশদ্বর মূর্ছনা।

প্রাথমিক গ্রাম নির্ধারিত হয়েছিল শুদ্ধ স্বরের বিচারে। এই বিচারে মূর্চ্ছনাগুলো তৈরি হয়েছিল। গ্রামভেদে এসকল মূর্ছনার প্রত্যেকটির স্বতন্ত্র নাম ছিল

শুদ্ধ স্বরের মূর্চ্ছনারা নামসহ তালিক দেখুন

পরে শুদ্ধস্বরের সাথে যুক্ত হয়েছিল বিকৃত স্বরের মূর্চ্ছনা। বিকৃতস্বরের প্রয়োগের সৃষ্ট মূর্চ্ছনাকে বলা হয় সাধারণাকৃতা। মূলত শুদ্ধ স্বরের স্বরসপ্তকে অন্তর গান্ধার ও কাকলী নিষাদ যুক্ত করলে সাধরণাকৃত মূর্চ্ছনা তৈরি হয়। এই দুই স্বরের প্রয়োগের বিচারে মূর্চ্ছনা ছিল তিন প্রকার। এগুলো হলো- সাকাকলীক মূর্চ্ছনা, সান্তর মূর্চ্ছনা এবং সান্তর কাকলীক মূর্চ্ছনা।

প্রাচীন ভারতে স্বরসপ্তকের প্রাথমিক কাঠামোকে বলা হয় গ্রাম। প্রাচীন ভারতে গ্রাম ছিল ৩টি। এগুলো হলো- হলো- ষড়্জ গ্রাম, মধ্যম গ্রাম এবং গান্ধার গ্রাম। তিনটি গ্রামের বিচারে ৭টি স্বরে মোট ২১টি মূর্ছনা হয়। আবার দুটি গ্রামের বিচারে মূর্ছনার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪টি। আবার শুদ্ধ ও বিকৃত স্বরের সমন্বয়ে যে ১২ স্বরের সেট তৈরি হয়, সেখান থেকেও মূর্ছনা তৈরি হতে পারে।

সঙ্গীতরত্নাকর, নারদমত অনুসারে মূর্ছনাকে ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে। শুদ্ধ স্বরের বিচারে এই মূর্ছনার বিন্যাস ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। উল্লেখ্য মূর্ছনাতে কোনো স্বরকে দুইবার ব্যবহার করা হয় না। তবে যে স্বর থেকে মূর্ছনা শুরু হয়, সেই স্বরে এসে থামতে হয়। যেমন ―
স র গ ম প ধ ন ধ প ম গ র স। নিচের তালিকায় আরোহণ এবং অবরোহণ পৃথকভাবে দেখানোর জন্য অবরোহণের শেষ স্বর এবং অবরোহণের শুরুর স্বর লেখা হয়েছে।

প্রাচীন সঙ্গীত শাস্ত্রে প্রতিটি স্বর কয়েকটি শ্রুতি অধিকার করে থাকতো। সে সময়ে গান্ধার এবং নিষাদ এর জন্য নির্ধারিত ছিল দুই শ্রুতি এবং এদের অবস্থান ছিল শেষ শ্রুতিতে। যেমন- সেকালের গান্ধারের জন্য নির্ধারিত ছিল ৮ম ও ৯ম শ্রুতি। এদের নাম ছিল -রৌদ্রী ও ক্রোধা। শুদ্ধ গান্ধারের অবস্থান ছিল ৯ম তথা ক্রোধা শ্রুতিতে। যখন গান্ধার পরবর্তী দুটি শ্রুতি গ্রহণ করতো, তখন গান্ধার হতো চতুঃশ্রুতিক। তখন এই গান্ধারের অবস্থান হতো- ১১শ শ্রুতি তথা প্রসারণীতে। এই গান্ধারকে বলা হতো অন্তর গান্ধার।

নিষাদের জন্য নির্ধারিত ছিল ২২শ শ্রুতি তথা উগ্রা। শ্রুতি সারণীতে এই শ্রুতি ছিল সর্বশেষ স্থানে। এরপরে শ্রুতি-চক্রের শুরু হতো তীব্রা বা ১ম শ্রুতি থেকে। এই ১ম শ্রুতি থেকে পরবর্তী চার শ্রুতি ছিল ষড়্‌জের জন্য নির্ধারিত এবং ষড়্‌জের অবস্থান ছিল ৪র্থ শ্রুতি ছন্দোবতীতে। ফলে শুদ্ধ নিষাদ যখন দুই শ্রুতি গ্রহণ করে চতুঃশ্রুতি হয়ে যেতো, তখন তার অবস্থান হতো ২য় শ্রুতি তথা কমুদ্বতীতে। তখন এর নাম দেওয়া হয়েছিল বা কাকলি নিষাদ।

মূর্চ্ছনায় যখন কাকলী নিষাদের ব্যবহার করা হতো, তখন ষড়্‌জের দুটি শ্রুতি গ্রহণ করায়, ষড়্‌জের সাধারণত্ব ঘটতো। কাকলীযুক্ত মূর্চ্ছনায় (সকাকললীক মূর্চ্ছনা) শুদ্ধ নিষাদের পরিবর্তে কাকলী নিষাদ ব্যবহৃত হত।  অন্যদিকে যখন অন্তর গান্ধার যুক্ত হতো তখন তার নাম হতো সান্তর্ মূর্‌চ্ছনা। আর যে সকল মূর্চ্ছনায় কাকলী নিষাদ এবং অন্তর গান্ধার ব্যবহৃত হতো। তখন তার নাম ছিল সান্তর কাকলীক মূর্চ্ছনা।

দ্বাদশ স্বরের মূর্চ্ছনা
ষড়্‌জ, মধ্যম এবং গান্ধার গ্রামের স্বরগুলো নিয়ে একটি সমন্বিত মূর্‌ছনা সৃষ্টি করা। শিক্ষাকার নারদের  আমলেই মূলত গান্ধার গ্রামের বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে দ্বাদশস্বরের মূর্চ্ছনা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এই মূর্চ্ছনার ৭টি স্বরের সাথে আগে ও পরে পাঁচটি বাড়তি স্বর যুক্ত করে, দ্বাদশ স্বরের মূর্ছনা তৈরি করা হতো। যেমন-

ষড়্‌জগ্রামের শুদ্ধ মূর্ছনা সপ্তস্বরের মূর্ছনা দ্বাদশ স্বরের মূর্ছনা
উত্তরমন্দ্রা

স র গ ম প ধ ন

ধ্‌ ন্ স র গ ম প ধ ন র্স র্র র্গ

রজনী ন্ স র গ ম প ধ ন্ স র গ ম প ধ ন র্স র্র র্গ র্ম
উত্তরায়তা ধ্‌ ন্ স র গ ম প স র গ ম প ন র্স র্র র্গ র্ম র্প
শুদ্ধষড়্‌জা প্ ধ্‌ ন্ স র গ ম র গ ম ন র্স র্র র্গ র্ম র্প র্ধ
মৎসরীকৃৎ ম্ প্ ধ্‌ ন্ স র গ গ ম ন র্স র্র র্গ র্ম র্প র্ধ র্ন
অশ্বক্রান্তা গ্ ম্ প্ ধ্‌ ন্ স র   ন র্স র্র র্গ র্ম র্প র্ধ র্ন র্স
অভিরুদ্‌গতা র্ গ্ ম্ প্ ধ্‌ ন্ স  প ন র্স র্র র্গ র্ম র্প র্ধ র্ন স´´ র´´

তথ্যসূত্র: