নাদ
[নাদ অভিধান]

সাধারণ অর্থে- নাদ শব্দ বা ধ্বনির সমার্থক শব্দ। রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
নদ্ (অব্যক্ত ধ্বনি) + অ (ঘঞ্), ভাববাচ্য}। অব্যক্ত ধ্বনি হলো- যা কোনো বিশেষ ভাবকে ব্যক্ত করে না। মূলত ধ্বনি মাত্রেই অর্থহীন। মানুষ অর্থহীন বা অব্যক্ত ধ্বনিকে ভাবের সঙ্কেত হিসেবে প্রকাশ করলে, তা অর্থযুক্ত হয়ে যায়। মানুষের ভাষা বা ভাবের বিচারে নাদের সংখ্যা যত, অব্যক্ত নাদের সংখ্যা অনেক বেশি।

প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থাদি অনুসরণ করলে, দুই ধরনের নাদের সন্ধান পাওয়া যায়। এই ধরন দুটি হলো- আধ্যাত্মিক নাদ ও সাঙ্গীতিক নাদ।

আধ্যাত্মিক নাদ: ভারতীয় যোগশাস্ত্র মতে- জীবাত্মা, পরমাত্মা নাদব্রহ্ম। সনাতন হিন্দুধর্মে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর শক্তিরূপে বিরাজ করেন অনাহত নাদ পর্যায়ে। তাই'ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর' হলেন নাদস্বরূপ। সাধক যোগমার্গে এই নাদ অনুভব করতে পারেন। ধ্যানের মধ্য দিয়ে অনাহত নাদ যোগী শোনেন কিন্তু অন্যকে শোনাতে পারেন না। অনাহত নাদ যোগী অনুভব করতে পারেন, কিন্তু মনোরঞ্জনের জন্য তাতে পরিবর্তন আনতে পারেন না।

খ্রিষ্টীয় একাদশ শতাব্দীতে নারদের রচিত সঙ্গীতরত্নাকরে অনাহত নাদকে আকাশজাত ধ্বনি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে উৎপত্তির বিচারে আহত নাদকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো- নখজ, বারুজ, ধাতব ও দেহজ।

ধ্যানের মধ্য দিয়ে অনাহত নাদ যোগী শোনেন কিন্তু অন্যকে শোনাতে পারেন না। অনাহত নাদ যোগী অনুভব করতে পারেন, কিন্তু মনোরঞ্জনের জন্য তাতে পরিবর্তন আনতে পারেন না। আবার মানুষের চেতনার ভিতরে অনাহত নাদের উদ্ভব হতে পারে। বৃহদ্দেশীতে মতঙ্গ বলেছেন- নদন ক্রিয়া থেকে নাদ শব্দের সৃষ্টি'। তাঁর মতে নাদ পাঁচ প্রকার।
১. সূক্ষ্ম: এই গুহাবাসী। অর্থাৎ চৈতন্যের গভীরে এর অবস্থান।
২. অতিসূক্ষ্ম: এর অবস্থান হৃদয়ে। অর্থাৎ মনোলোকে এই নাদ অবস্থান করে।
৩. ব্যক্ত: এই নাদের অবস্থান কণ্ঠদেশে। এই নাদ কণ্ঠ দ্বারা প্রকাশিত হয় এবং তা মানুষের শ্রবণের যোগ্য। এই নাদের দ্বারা মানুষ ব্যক্তি মাত্রেই অন্যের কাছের তার মনোভাব প্রকাশ করতে পারে এবং অন্যের মনোভাব অনুভব করতে পারে।
৪. অব্যক্ত: এর অবস্থান তালুতে। এই নাদ মনের গভীরে চৈতন্যের দ্বারা অবস্থান করে। বাণীর ভিতর দিয়ে মনের ভিতরে যে ভাবের প্রকাশ ঘটে, বাক্‌যন্ত্রের সাহায্যে তা প্রকাশ করা যায় না।
৫. কৃত্রিম: এর অবস্থান মুখদেশে। এই নাদ মুখ থেকে বাণীরূপে প্রকাশিত হয়।

যোগশাস্ত্র মতে- অউম (ওঁ) ধ্বনির রয়েছে পাঁচটি স্তর। এর ভিত্তিতে নাদের প্রকরণ নির্ধারিত হয়েছে। যেমন-

১. বিন্দু: ব্রহ্ম এক থেকে বহু হতে ইচ্ছা করলেন। এই ইচ্ছা থেকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্পন্দনের সৃষ্টি হলো। এই স্পন্দনের দ্বারা সৃষ্টি নাদকে বলা হয় আন্তর-প্রণব বিন্দু। এর অপর নাম পরাশক্তি পরাবাক্।
২. সূক্ষ্ম: এই পরাবক সৃষ্টির প্রেরণায় অধিক স্পন্দিত হলে- ব্রহ্মের অন্তর থেকে বহির্মুখে প্রকাশিত হয়েছিল। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছিল সূক্ষ্ম নাদ। 
৩. অ-কার: এই সূক্ষনাদ আরও স্পন্দিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল অ-কার নাদ।
৪. উ-কার: নাদ ব্যাপ্ত হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল উ-কার নাদ
৫. ম-কার: অ-কার, উ-কার বর্ণরূপ ম-কারে পরিণত হয়েছিল। বিন্দু থেকে ম-কারে নাদ সৃষ্টির পর তা বিলীন হয়ে গিয়েছিল।

এই মতানুসারে পরাবাক থেকে সৃষ্ট সূক্ষ্ম নাদ তিনটি বর্ণ (অ-কার, উ-কার, ম-কার) উৎপন্ন হয়। যাকে ত্রি-বিন্দুর উৎস হিসেবে
'ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর'-কে কল্পনা করা হয়েছে। এই মতে ত্রি-বিন্দু থেকে অ-নাদ পৃথক হয়ে গেলে অনাহত নাদের সৃষ্টি হয়। ভারতীয় ধর্ম দর্শনে নাদের এই ধারণা অতীন্দ্রিয় মার্গের এবং ধর্ম বিশ্বাসের দাঁড়িয়ে আছে।

নাদকে কখনো কখনো অশ্রুত শব্দব্রহ্ম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সনাতন হিন্দু ধর্ম মতে- অনাহত নাদ শব্দশক্তিরূপী পরমব্রহ্ম, তাই এই নাদ স্বয়ম্ভূ। সুফি মতে- পরমধ্বনি বা 'আওয়াজ-ই মুতলাক'। জালালউদ্দীন রুমির মতে-  নৈশব্দ হলো আল্লাহর ভাষা। আধ্যাত্মিক সাধনার এই অনাহত নাদকে বলা হয় সুলতানুল আজ্‌কার। মানুষের স্বাভাবিক শ্রবণ ক্ষমতা দিয়ে এই নাদ শোনা যায় না। ধ্যানের মধ্য দিয়ে স্রষ্টার সাথে নৈঃশব্দ-ভাবের বিহার ঘটে- অনাহত নাদের মাধ্যমে।

ভরতের নাট্যশাস্ত্রে সাঙ্গীতিক নাদের  উৎপত্তি নিয়ে আলোচনা করা হয় নি। ৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মতঙ্গের রচিত সঙ্গীতবিষয়ক গ্রন্থে 'বৃহদ্দেশী' প্রথম সাঙ্গীতিক নাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের 'নাদোৎপত্তিপ্রকরণ' অধ্যায় থেকে জানা যায়, তা হলো-

প্রথম যে ধ্বনির উৎপত্তিস্থল হিসেবে 'বিন্দু' বলা হয়েছে। এই বিন্দু থেকে উৎপত্তি হয়েছে নাদ। অন্যত্র বলা হয়েছে- নাদ ভিন্ন গীত হয় না। নাদ ব্যতীত স্বরনির্ণয় সম্ভব নয়। নাদের সহযোগিতা ব্যতিরেকে নৃত্ত অনুষ্ঠিত হতে পারে না। সব দিক থেকেই এই জগৎ নাদাত্মকরূপে প্রতিভাত হয়। 

এই গ্রন্থে দেহজ নাদের পাঁচটি ভাগের উল্লেখ আছে। এগুলো হলো-

১.অতিসূক্ষ্ম: নাভিদেশ থেকে উৎপন্ন নাদ
২. সূক্ষ্ম: বক্ষোদেশ হতে উৎপন্ন নাদ
৩. পুষ্ট: কণ্ঠদেশ থেকে উৎপন্ন নাদ
৪. অপুষ্ট: মস্তকদেশ থেকে উৎপন্ন  নাদ
৫. কৃত্রিম: মুখদেশ থেকে উৎপন্ন নাদ।

খ্রিষ্টীয় ১১শ শতাব্দীতে নারদের রচিত সঙ্গীত মকরন্দ গ্রন্থে- আহত নাদের উৎপত্তির উৎস হিসেবে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই গ্রন্থে সাঙ্গীতিক নাদের উৎপত্তিস্থল হিসেবে তিনটি নাদের উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো-

দেহস্থ সূক্ষ্ণস্বর অত্যাধিক চড়া। কিন্তু যদি তা শ্রুতিগোচর হয়, তবে তা গায়নযোগ্য রূপে বিবেচিত হবে। সঙ্গীতমকরন্দে নাদকে আহত ও অনাহত নামে দুটি  ভাগে ভাগ করা হয়েছে। অনাহত নাদকে আকাশজাত ধ্বনি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে উৎপত্তির বিচারে আহত নাদকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো-

খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে শারঙ্গদেবের রচিত সঙ্গীতরত্নাকর নাদের আধ্যত্মিক ও সাঙ্গীতিক উভয় ধারণাকেই উপস্থাপন করা হয়েছে। তাঁর নাদ সম্পর্কিত ভাবনা ছিল পূর্ববর্তী সঙ্গীতজ্ঞদের মতই। শারঙ্গদেবের পরবর্তী পণ্ডিতো নাদ সম্পর্কিত ধারণা প্রায় একই রকম। উল্লেখিত গ্রন্থাদির বিচারে আমার নাদ সম্পর্কে যে সাধারণ ধারণা পাওয়া যায়, তা হলো-

সঙ্গীত শাস্ত্রে অনাহত নাদ' ও অপরটি 'আহত নাদ' সমন্বিত হয় কয়েকটি ধাপে। এগুলো হলো-

অনাহত নাদের সাথে ব্স্তুর কম্পনজাত কোনো সম্পর্ক নেই।  'আহত নাদ' মাধ্যমে মানুষ পরস্পরের মধ্যে শ্রবণযোগাযোগ স্থাপন করে থাকে। তবে সকল 'আহত নাদ মানুষ শুনতে পায় না।  

প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীতে এই শব্দ বা শব্দের অনুভবকে নাদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। প্রাচীন সঙ্গীত বিষয়ক উল্লেখযযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে পাওয়া যায়, খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর ভিতরে নারদের রচিত 'শিক্ষা' নামক গ্রন্থ ও  দ্বিতীয় শতাব্দীর পূর্ণাঙ্গ অভিনয় ও নৃত্যগীত বিষয়ক মহৎ গ্রন্থ 'নাট্যশাস্ত্র' রচনা করেছিলেন ভরত। উল্লেখিত গ্রন্থ দুটিতে নাদ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে  আলোচনা করা হয় নি।

৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মতঙ্গ রচিত 'বৃহদ্দেশী' গ্রন্থে নাদের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থমতে-

'নাদ ভিন্ন গীত সম্পাদিত হয় না, নাদ ব্যতীত স্বরনির্ণয় সম্ভব নয়। নাদের সহযোগিতা ব্যতিরেকে নৃত্ত অনুষ্ঠিত হতে পারে না। সবদিক থেকে থেকেই এই জগৎ নাদাত্মকরূপে প্রতিভাত হয়। ব্রহ্মা নাদরূপ স্মৃত হন, জনার্দন নাদ স্বরূপ, পরাশক্তি নাদরূপা, মহেশ্বরও নাদরূপ।...নাদ থেকে বিন্দু হয় এবং নাদ থেকেই সব কিছু বাঙ‌ময় হয়ে ওঠে।'

বৃহদ্দেশীর এই বিবরণে নাদকে বিমূর্ত শক্তি রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। যখন নাদ গীতের স্বরনির্ণয়ের নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তখন তা শব্দশক্তি। আর যখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, পরমব্রহ্ম, মহাদেব নাদরূপী তখন তা হয়ে ওঠে আধ্যাত্মিক ভাবনায় দৈবশক্তি।

আধুনিক শব্দবিজ্ঞানের মতে বস্তু কম্পিত হলে, শক্তির প্রকাশ ঘটে। এই শক্তির দ্বারা সৃষ্ট তরঙ্গরূপ ধ্বনি রূপে প্রকাশিত হয়। বস্তু যদি তার অভ্যন্তরীণ শক্তির দ্বারা আপনা-আপনি কম্পিত হতে থাকে এবং এর দ্বারা ধ্বনি তৈরি হয়, তাহলে তা হবে অনাহত নাদ। সনাতন হিন্দুধর্মে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর যখন শক্তিরূপে বিরাজ করেন অনাহত নাদ পর্যায়ে। সাধক যোগমার্গে এই নাদ অনুভব করতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ যা অনুভব করেন, তা আহত নাদ। ধ্যানের মধ্য দিয়ে অনাহত নাদ যোগী শোনেন কিন্তু অন্যকে শোনাতে পারেন না। অনাহত নাদ যোগী অনুভব করতে পারেন, কিন্তু মনোরঞ্জনের জন্য তাতে পরিবর্তন আনতে পারেন না। আবার মানুষের চেতনার ভিতরে অনাহত নাদের উদ্ভব হতে পারে। বৃহদ্দেশীতে মতঙ্গ বলেছেন- নদন ক্রিয়া থেকে নাদ শব্দের সৃষ্টি'। তাঁর মতে নাদ পাঁচ প্রকার। রকার।

১. সূক্ষ্ম: এই গুহাবাসী। অর্থাৎ চৈতন্যের গভীরে এর অবস্থান।
২. অতিসূক্ষ্ম: এর অবস্থান হৃদয়ে। অর্থাৎ মনোলোকে এই নাদ অবস্থান করে।
৩. ব্যক্ত: এই নাদের অবস্থান কণ্ঠদেশে। এই নাদ কণ্ঠ দ্বারা প্রকাশিত হয় এবং তা মানুষের শ্রবণের যোগ্য। এই নাদের দ্বারা মানুষ ব্যক্তি মাত্রেই অন্যের কাছের তার মনোভাব প্রকাশ করতে পারে এবং অন্যের মনোভাব অনুভব করতে পারে।
৪. অব্যক্ত: এর অবস্থান তালুতে। এই নাদ মনের গভীরে চৈতন্যের দ্বারা অবস্থান করে। বাণীর ভিতর দিয়ে মনের ভিতরে যে ভাবের প্রকাশ ঘটে, বাক্‌যন্ত্রের সাহায্যে তা প্রকাশ করা যায় না।
৫. কৃত্রিম: এর অবস্থান মুখদেশে। এই নাদ মুখ থেকে বাণীরূপে প্রকাশিত হয়।

গ্রন্থসূত্র: