নাদ
[নাদ অভিধান]

সাধারণ অর্থে- নাদ শব্দ বা ধ্বনির সমার্থক শব্দ। রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
নদ্ (অব্যক্ত ধ্বনি) + অ (ঘঞ্), ভাববাচ্য}। অব্যক্ত ধ্বনি হলো- যা কোনো বিশেষ ভাবকে ব্যক্ত করে না। মূলত ধ্বনি মাত্রেই অর্থহীন। মানুষ অর্থহীন বা অব্যক্ত ধ্বনিকে ভাবের সঙ্কেত হিসেবে প্রকাশ করলে, তা অর্থযুক্ত হয়ে যায়। মানুষের ভাষা বা ভাবের বিচারে নাদের সংখ্যা যত, অব্যক্ত নাদের সংখ্যা অনেক বেশি।

প্রাচীন ভারতের ঋষিরা শ্রবণযোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে '‌নাদ' শব্দ ব্যবহার করেছেন। এঁদের মতে নাদ বা শব্দ দুই ভাবে উৎপন্ন হতে পারে। এর একটি হলো ' অনাহত নাদ', অপরটি 'আহত নাদ সাধারণভাবে অনাহত নাদের সাথে ব্স্তুর কম্পনজাত কোনো সম্পর্ক নেই।  'আহত নাদ' মাধ্যমে মানুষ পরস্পরের মধ্যে শ্রবণযোগাযোগ স্থাপন করে থাকে। তবে সকল 'আহত নাদ মানুষ শুনতে পায় না। তাই সকল আহত নাদ  শ্রবণযোগাযোগ স্থাপন করতে পারে না।

প্রাচীন ভারতের ঋষিরা নাদকে শুধু শ্রবণযোগ্য শব্দের মধ্যে আবদ্ধ রাখেন নি। তাঁরা নাদের বৃহত্তর একটি অর্থ খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। এর ভিতরে ছিল ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরকে নাদাত্নক স্বরূপ সন্ধান। এঁদের কেউ কেউ একই সাথে সঙ্গীতের আদিম উপাদান হিসেবেও বিবেচনা করেছিলেন।

প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীতে এই শব্দ বা শব্দের অনুভবকে নাদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। প্রাচীন সঙ্গীত বিষয়ক উল্লেখযযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে পাওয়া যায়, খ্রিষ্টীয় ১০০-২০০ শতাব্দীর ভিতরে নারদের রচিত 'শিক্ষা' নামক গ্রন্থ ও  ২০০-৩০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পূর্ণাঙ্গ অভিনয় ও নৃত্যগীত বিষয়ক মহৎ গ্রন্থ 'নাট্যশাস্ত্র' রচনা করেছিলেন ভরত। ২০০-৩০০ খ্রিষ্টাব্দের অব্দের দিকে পূর্ণাঙ্গ অভিনয় ও নৃত্যগীত বিষয়ক মহৎ গ্রন্থ 'নাট্যশাস্ত্র' রচনা করেছিলেন ভরত। উল্লেখিত গ্রন্থ দুটিতে নাদ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে  আলোচনা করা হয় নি।

৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মতঙ্গ রচিত 'বৃহদ্দেশী' গ্রন্থে নাদের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থমতে-
'নাদ ভিন্ন গীত সম্পাদিত হয় না, নাদ ব্যতীত স্বরনির্ণয় সম্ভব নয়। নাদের সহযোগিতা ব্যতিরেকে নৃত্ত অনুষ্ঠিত হতে পারে না। সবদিক থেকে থেকেই এই জগৎ নাদাত্মকরূপে প্রতিভাত হয়। ব্রহ্মা নাদরূপ স্মৃত হন, জনার্দন নাদ স্বরূপ, পরাশক্তি নাদরূপা, মহেশ্বরও নাদরূপ।...নাদ থেকে বিন্দু হয় এবং নাদ থেকেই সব কিছু বাঙ‌ময় হয়ে ওঠে।'

বৃহদ্দেশীর এই বিবরণে নাদকে বিমূর্ত শক্তি রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। যখন নাদ গীতের স্বরনির্ণয়ের নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তখন তা শব্দশক্তি। আর যখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, পরমব্রহ্ম, মহাদেব নাদরূপী তখন তা হয়ে ওঠে আধ্যাত্মিক ভাবনায় দৈবশক্তি।

আধুনিক শব্দবিজ্ঞানের মতে বস্তু কম্পিত হলে, শক্তির প্রকাশ ঘটে। এই শক্তির দ্বারা সৃষ্ট তরঙ্গরূপ ধ্বনি রূপে প্রকাশিত হয়। বস্তু যদি তার অভ্যন্তরীণ শক্তির দ্বারা আপনা-আপনি কম্পিত হতে থাকে এবং এর দ্বারা ধ্বনি তৈরি হয়, তাহলে তা হবে অনাহত নাদ। সনাতন হিন্দুধর্মে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর যখন শক্তিরূপে বিরাজ করেন অনাহত নাদ পর্যায়ে। সাধক যোগমার্গে এই নাদ অনুভব করতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ যা অনুভব করেন, তা আহত নাদ। ধ্যানের মধ্য দিয়ে অনাহত নাদ যোগী শোনেন কিন্তু অন্যকে শোনাতে পারেন না। অনাহত নাদ যোগী অনুভব করতে পারেন, কিন্তু মনোরঞ্জনের জন্য তাতে পরিবর্তন আনতে পারেন না। আবার মানুষের চেতনার ভিতরে অনাহত নাদের উদ্ভব হতে পারে। বৃহদ্দেশীতে মতঙ্গ বলেছেন- নদন ক্রিয়া থেকে নাদ শব্দের সৃষ্টি'। তাঁর মতে নাদ পাঁচ প্রকার। রকার।

১. সূক্ষ্ম: এই গুহাবাসী। অর্থাৎ চৈতন্যের গভীরে এর অবস্থান।
২. অতিসূক্ষ্ম: এর অবস্থান হৃদয়ে। অর্থাৎ মনোলোকে এই নাদ অবস্থান করে।
৩. ব্যক্ত: এই নাদের অবস্থান কণ্ঠদেশে। এই নাদ কণ্ঠ দ্বারা প্রকাশিত হয় এবং তা মানুষের শ্রবণের যোগ্য। এই নাদের দ্বারা মানুষ ব্যক্তি মাত্রেই অন্যের কাছের তার মনোভাব প্রকাশ করতে পারে এবং অন্যের মনোভাব অনুভব করতে পারে।
৪. অব্যক্ত: এর অবস্থান তালুতে। এই নাদ মনের গভীরে চৈতন্যের দ্বারা অবস্থান করে। বাণীর ভিতর দিয়ে মনের ভিতরে যে ভাবের প্রকাশ ঘটে, বাক্‌যন্ত্রের সাহায্যে তা প্রকাশ করা যায় না।
৫. কৃত্রিম: এর অবস্থান মুখদেশে। এই নাদ মুখ থেকে বাণীরূপে প্রকাশিত হয়।

আধুনিক সঙ্গীতের ধারায় নাদকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটি হলো- অনাহত নাদআহত নাদ


অভিধান ও গ্রন্থসূত্র:
  • চলন্তিকা। রাজশেখর বসু। এমসি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিঃ। ১৪০৮। পৃষ্ঠা: ২৩৫
  • বঙ্গীয় শব্দকোষ (প্রথম খণ্ড)। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্য অকাদেমী। ২০০১। পৃষ্ঠা: ১১৯০।
  • বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান। মার্চ ২০০৫। পৃষ্ঠা: ৬৭৪।
  • বাঙ্গালা ভাষার অভিধান (দ্বিতীয় খণ্ড)। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস। সাহিত্য সংসদ। নভেম্বর ২০০০। পৃষ্ঠা: ১১৮০।
  • বাঙ্গালা শব্দকোষ। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি। ভূর্জপত্র। ১৩৯৭ বঙ্গাব্দ। পৃষ্ঠা: ৫০১।
  • বৃহদ্দেশী । মতঙ্গ। সম্পাদনা: শ্রীরাজ্যেশ্বর মিত্র। সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার। কলকাতা। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দ।
  • শব্দবোধ অভিধান। আশুতোষ দেব। দেব সাহিত্য কুটির। মার্চ ২০০০। পৃষ্ঠা: ৫০২।
  • শব্দসঞ্চয়িতা। ডঃ অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায়। নিউ সেন্ট্রাল বুক এজেন্সি প্রাঃ লিমিটেড। ২৩শে জানুয়ারি, ১৯৯৫। পৃষ্ঠা: ৪৯৪।
  • শব্দার্থ প্রকাশিকা। কেশবচন্দ্র রায় কর্মকার। দেব সাহিত্য কুটির। মার্চ ২০০০।
  • পৃষ্ঠা: ৩০৯।
  • সংসদ বাংলা অভিধান। বৈদ্যুতিন সংস্করণ। শিশির শুভ্র সম্পাদিত। পৃষ্ঠা: ৪৫৪।
  • সংস্কৃত বাংলা অভিধান। শ্রীঅশোক কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার। ১৪০৮ বঙ্গাব্দ। পৃষ্ঠা: ২৩৫।
  • সরল বাঙালা অভিধান (সপ্তম সংস্করণ, নিউবেঙ্গল প্রেস ১৯৩৬)। সুবলচন্দ্র মিত্র।
  • পৃষ্ঠা: ৭৩১।