১. সূক্ষ্ম: এই গুহাবাসী। অর্থাৎ চৈতন্যের গভীরে এর অবস্থান।
২. অতিসূক্ষ্ম: এর অবস্থান হৃদয়ে। অর্থাৎ মনোলোকে এই নাদ অবস্থান করে।
৩. ব্যক্ত: এই নাদের অবস্থান কণ্ঠদেশে। এই নাদ কণ্ঠ দ্বারা প্রকাশিত হয় এবং তা মানুষের শ্রবণের যোগ্য। এই নাদের দ্বারা মানুষ ব্যক্তি মাত্রেই অন্যের কাছের তার মনোভাব প্রকাশ করতে পারে এবং অন্যের মনোভাব অনুভব করতে পারে।
৪. অব্যক্ত: এর অবস্থান তালুতে। এই নাদ মনের গভীরে চৈতন্যের দ্বারা অবস্থান করে। বাণীর ভিতর দিয়ে মনের ভিতরে যে ভাবের প্রকাশ ঘটে, বাক্যন্ত্রের সাহায্যে তা প্রকাশ করা যায় না।
৫. কৃত্রিম: এর অবস্থান মুখদেশে। এই নাদ মুখ থেকে বাণীরূপে প্রকাশিত হয়।
যোগশাস্ত্র মতে- অউম (ওঁ) ধ্বনির রয়েছে পাঁচটি স্তর। এর ভিত্তিতে নাদের প্রকরণ নির্ধারিত হয়েছে। যেমন-
১. বিন্দু: ব্রহ্ম এক থেকে বহু হতে ইচ্ছা করলেন। এই ইচ্ছা থেকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্পন্দনের সৃষ্টি হলো। এই স্পন্দনের দ্বারা সৃষ্টি নাদকে বলা হয় আন্তর-প্রণব বিন্দু। এর অপর নাম পরাশক্তি পরাবাক্।
২. সূক্ষ্ম: এই পরাবক সৃষ্টির প্রেরণায় অধিক স্পন্দিত হলে- ব্রহ্মের অন্তর থেকে বহির্মুখে প্রকাশিত হয়েছিল। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছিল সূক্ষ্ম নাদ।
৩. অ-কার: এই সূক্ষনাদ আরও স্পন্দিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল অ-কার নাদ।
৪. উ-কার: নাদ ব্যাপ্ত হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল উ-কার নাদ
৫. ম-কার: অ-কার, উ-কার বর্ণরূপ ম-কারে পরিণত হয়েছিল। বিন্দু থেকে ম-কারে নাদ সৃষ্টির পর তা বিলীন হয়ে গিয়েছিল।
এই মতানুসারে পরাবাক থেকে সৃষ্ট সূক্ষ্ম নাদ তিনটি বর্ণ (অ-কার, উ-কার, ম-কার) উৎপন্ন হয়। যাকে ত্রি-বিন্দুর উৎস হিসেবে 'ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর'-কে কল্পনা করা হয়েছে। এই মতে ত্রি-বিন্দু থেকে অ-নাদ পৃথক হয়ে গেলে অনাহত নাদের সৃষ্টি হয়। ভারতীয় ধর্ম দর্শনে নাদের এই ধারণা অতীন্দ্রিয় মার্গের এবং ধর্ম বিশ্বাসের দাঁড়িয়ে আছে।
নাদকে কখনো কখনো অশ্রুত শব্দব্রহ্ম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সনাতন হিন্দু ধর্ম মতে- অনাহত নাদ শব্দশক্তিরূপী পরমব্রহ্ম, তাই এই নাদ স্বয়ম্ভূ। সুফি মতে- পরমধ্বনি বা 'আওয়াজ-ই মুতলাক'। জালালউদ্দীন রুমির মতে- নৈশব্দ হলো আল্লাহর ভাষা। আধ্যাত্মিক সাধনার এই অনাহত নাদকে বলা হয় সুলতানুল আজ্কার। মানুষের স্বাভাবিক শ্রবণ ক্ষমতা দিয়ে এই নাদ শোনা যায় না। ধ্যানের মধ্য দিয়ে স্রষ্টার সাথে নৈঃশব্দ-ভাবের বিহার ঘটে- অনাহত নাদের মাধ্যমে।
অনাহত নাদ:
আধুনিক শব্দবিজ্ঞানে
অনাহত নাদের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু মনোদর্শনে
আছে। মানুষের মনলোকে যে ধ্বনি শুধু অনুভব করা যায়, কিন্তু শ্রাব্য হয়ে ওঠে না,
তাই অনাহত নাদ। মানুষের মনের
ভিতরে যে সুর আপনা-আপনি ধ্বনিত হয়, তা শ্রবণেন্দ্রিয়ের জন্য নয়। তা আপন
অনুভূতিতে জাগ্রত হয়ে উঠে, তাই অনাহত নাদ মাত্রে নৈঃশব্দ।
সাধারণভাবে
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে আহত নাদকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটি হলো-
সঙ্গীত
শিল্পী তাঁর শিক্ষার ভিতর দিয়ে- সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনির ধারণা পান, তা তাঁর মনের
গভীরে থিতু বসে। তখন তাঁর জায়গা হয় স্মৃতিভাণ্ডারে। যখন কেউ মনে মনে স্বরালাপ
করেন, তখন স্মৃতি থেকে উত্থিত স্বরকে উত্তোলিত করেন। তাই এই ধ্বনির শুধুই আপন
অনুভবের। কোনো শিল্পী যখন তাঁর জানা গান পরিবেশন করেন, তখন তা তিনি মুখস্থ করা
গানই আওড়ান। এক্ষেত্রে শিল্পী সব সময় স্বরকে গভীর ধ্যানের মধ্য উচ্চারণ করেন,
তেমনটা হয় না। শিল্পী গান করতে করতে দর্শককে দেখেন, তালের দিকে মনোযোগী হন, বাণী
অংশ যাতে ভুল না হয় সেদিকে নজর দেন। এতকিছুর ভিতর দিয়ে যথার্থ মুখস্থ সুর গেয়ে
যান। কিন্তু ওই শিল্পী যদি মনে মনে স্বরালাপ করেন, তা হলে তাঁকে মনের গভীরে
অধীত স্বরজ্ঞান দিকে নজর দিতে হবে। সেখানে ফাঁকি চলে না। এই মনের গভীরে
স্থিতিশীল ধ্বনিই অনাহত নাদ। শিল্পী নিজে তা উপলব্ধি করেন, শোনেন, কিন্তু
অন্যকে শোনাতে পারেন না। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন- 'আমার মনের মাঝে যে গান
বাজে
শুনতে কি পাও গো'।
তা হতে পারে মনের সাঙ্গীতিক আবেগের কথা বলেন, কিম্বা
সুরাশ্রয়ী বাণীর কথা। যদি অক্ষরেই ধরি, তাহলে সত্যিই মনের মাঝে বাদিত গান অন্যকে
শোনানো যায় না।
মতঙ্গ রচিত 'বৃহদ্দেশী' গ্রন্থে নাদকে সঙ্গীতের ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই গ্রন্থ মতে- 'নাদ ভিন্ন গীত সম্পাদিত হয় না, নাদ ব্যতীত স্বরনির্ণয় সম্ভব নয়।'
প্রকৃত পক্ষে মনের ভিতরে ধ্বনির অনুভবে নাদের উদ্ভব না হলে, তা ব্যক্ত করা যায়
না।
মূলত কোনো সঙ্গীতশিল্পী
যখন কোনো সুরকে প্রকাশ করতে চান, তখন তাঁর মনের ভিতরে প্রথম বেজে উঠে অনাহত
নাদের সুর। সে সুর নৈশব্দের,
তাই
শ্রোতারা শোনেন না,
শোনেন তিনি নিজে।
শিল্পী মনের ভিতরে সৃষ্ট অনাহত সুর যখন কণ্ঠে বা যন্ত্র প্রকাশিত হয়, তখন তা
হয়ে যায় আহত নাদের সুর। একইভাবে মনের ভিতরে তৈরি হয় অনাহত ছন্দও।
মূলত
সঙ্গীত সাধনায় এই অনাহতের স্থান সুষ্পষ্ট না হলে, আহত নাদের সন্ধান পাওয়া যায়
না। অনেক সময় সঙ্গীত পরিবেশনের শুরুতে কণ্ঠপাত করেই শিল্পী বুঝতে পারেন, ঠিক
স্বরস্থানে শুরু হয় নি। সেক্ষত্রে শিল্পী দ্রুত তাঁর স্বরস্থান ঠিক করে নেন
মনের গভীরের অনাহত নাদের আদর্শে। চিত্রশিল্পীর মনের গভীরে যে ছবি থাকে,
ক্যানভাসে তাকেই প্রকাশ করে থাকেন। একে বলা যা- অচিত্রিত চিত্র। এ হলো ছবির
পিছনে ছবি। গানের ক্ষেত্রে অনাহত নাদ হলো- গানের পিছনের ধ্বনিরূপ। কোনো কোনো
গুরু তাঁর শিষ্যকে দীর্ঘদিন ধরে ষড়্জের সাধনা করান। মূলত তিনি শিক্ষার্থীর
মনের গভীরে অনাহত নাদের স্থান নির্ধারণ করে দেন।
আমরা যাদের সুর কানা বলি, তাঁরা মূলত মনের ভিতরে যথাযথভাবে উপযুক্ত অনাহত নাদের
জন্ম দিতে পারেন না। এবং বাগযন্ত্রে তাঁরা তা প্রকাশও করতে পারে না। একথা শুধু
সঙ্গীতের জন্যই নয়, সকল শিল্পকর্ম সৃষ্টির জন্য সত্য। যিনি ছবি আঁকেন তাঁর মনের
ভিতরে আগে ছবি আঁকা হয়ে যায়। তিনি যখন ছবিকে রঙ তুলতে প্রকাশ করতে যান, তখন তা
অনেক সময়ই মনের মতো হয় না। সঙ্গীত শিল্পীরা অহরহই বলে থাকেন, যেমনটা পরিবেশন
করতে চেয়েছিলেন তেমনটা হলো না। অর্থাৎ মনের গভীরে যে সঙ্গীতময় ধ্বনির উদ্ভব
হয়েছিল, তা বাক্প্রত্যঙ্গ দিয়ে প্রকাশ না করতে পারার আক্ষেপটাই সঙ্গীতশিল্পী
ব্যক্ত করেন।
মোট কথা, কোনো সঙ্গীতশিল্পী যখন কোনো সুরকে প্রকাশ করতে
চান, তখন তাঁর মনের ভিতরে প্রথম বেজে উঠে
সঙ্গীতোপযোগী অনাহত নাদ। সে
অনাহত নাদ নৈঃশব্দের বলেই, আর দশজন শ্রোতা তা শোনেন না।
শিল্পী মনের ভিতরে সৃষ্ট অনাহত সুর যখন কণ্ঠে বা যন্ত্র প্রকাশিত হয়, তখন তা
হয়ে যায় আহত নাদের সুর। একইভাবে মনের ভিতরে তৈরি হয় অনাহত ছন্দ। ফলে যে কোনো
সুর শৈল্পিক প্রকাশের ক্ষেত্রে দুটি স্তর অতিক্রম করতেই হয়।
আহত নাদ:
এই নাদ বস্তু জগতের শব্দ এবং যান্ত্রিক
প্রপঞ্চের একটি বিশেষ প্রকরণ। বস্তুর কম্পনে পার্শবর্তী মাধ্যমে যে শক্তি
উৎপন্ন হয় এবং ওই মাধ্যমে তরঙ্গাকারের ছড়িয়ে পড়ে। ফলে এক ধরনের যান্ত্রিক
প্রপঞ্চের সৃষ্টি হয়। এই যান্ত্রিক প্রপঞ্চ মূলত নাদ শক্তি রূপে বিরাজ করে।
যান্ত্রিক প্রক্রিয়া কম্পিত বস্তু থেকে উৎপন্ন কম্পনের সূত্রে যে শক্তি তৈরি হয়
এবং তা কোনো মাধ্যম্যের মধ্য দিয়ে সঞ্চালিত হলে, ওই মাধ্যমে তরঙ্গাকারে ছড়িয়ে
পড়ে। তরঙ্গাকারে সঞ্চালিত এই শক্তিই হলো আহত নাদ। ঘটমান ক্রিয়া হিসেবে শব্দ
জগতের অন্যান্য প্রপঞ্চের মতই একটি প্রপঞ্চ।
ভৌত জগতর আহত নাদ সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি হিসেবে গানের মৌলিক উপকরণ হিসেবে
আত্মপ্রকাশ করে। এই ধ্বনি মানুষের মনকে স্নিগ্ধ করে এবং একই সাথে মোহিত করে। এর
ভিতর দিয়ে মানুষের মনে আনন্দের সৃষ্টি হয়। আর বহুবিধ আনন্দের সুসমন্বয়ে সৃষ্টি
হয় সুর-সৌন্দর্য। যখন এই
সুর-সৌন্দর্য মানুষের আবাগানুভূতিকে আলোড়িত করে, তখন তা হয়ে উঠে রসময় এর
ভিতর দিয়ে সৃষ্টি হয় রসের। আর এর সাথে যখন যুক্ত হয় অলঙ্কার, সঙ্গীত শ্রীময়ী
হয়ে উঠে। তাই বলা যায়, সব মিলিয়ে ধ্বনি-সঙ্গীত হলো- নৈঃশব্দ,
শব্দ
ও সৌন্দর্য
রসের সুসম্বন্বিত ধ্বনিময় প্রকাশ।
ভরতের নাট্যশাস্ত্রে সাঙ্গীতিক নাদের উৎপত্তি নিয়ে আলোচনা করা হয় নি। ৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মতঙ্গের রচিত সঙ্গীতবিষয়ক গ্রন্থে 'বৃহদ্দেশী' প্রথম সাঙ্গীতিক নাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের 'নাদোৎপত্তিপ্রকরণ' অধ্যায় থেকে জানা যায়, তা হলো-
প্রথম যে ধ্বনির উৎপত্তিস্থল হিসেবে 'বিন্দু' বলা হয়েছে। এই বিন্দু থেকে উৎপত্তি হয়েছে নাদ। অন্যত্র বলা হয়েছে- নাদ ভিন্ন গীত হয় না। নাদ ব্যতীত স্বরনির্ণয় সম্ভব নয়। নাদের সহযোগিতা ব্যতিরেকে নৃত্ত অনুষ্ঠিত হতে পারে না। সব দিক থেকেই এই জগৎ নাদাত্মকরূপে প্রতিভাত হয়।
এই গ্রন্থে দেহজ নাদের পাঁচটি ভাগের উল্লেখ আছে। এগুলো হলো-
১.অতিসূক্ষ্ম: নাভিদেশ থেকে উৎপন্ন নাদ
২. সূক্ষ্ম: বক্ষোদেশ হতে উৎপন্ন নাদ
৩. পুষ্ট: কণ্ঠদেশ থেকে উৎপন্ন নাদ
৪. অপুষ্ট: মস্তকদেশ থেকে উৎপন্ন নাদ
৫. কৃত্রিম: মুখদেশ থেকে উৎপন্ন নাদ।
খ্রিষ্টীয় ১১শ শতাব্দীতে নারদের রচিত সঙ্গীত মকরন্দ গ্রন্থে- আহত নাদের উৎপত্তির উৎস হিসেবে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই গ্রন্থে সাঙ্গীতিক নাদের উৎপত্তিস্থল হিসেবে তিনটি নাদের উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো-
মন্দ্র নাদ- বক্ষোস্থলজাত
মধ্য নাদ- কণ্ঠস্থলজাত
তারস্থানীয় নাদ- মস্তকস্থল জাত
দেহস্থ সূক্ষ্ণস্বর অত্যাধিক চড়া। কিন্তু যদি তা শ্রুতিগোচর হয়, তবে তা গায়নযোগ্য রূপে বিবেচিত হবে। সঙ্গীতমকরন্দে নাদকে আহত ও অনাহত নামে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। অনাহত নাদকে আকাশজাত ধ্বনি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে উৎপত্তির বিচারে আহত নাদকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো-
নখজ: বীণাদি থেকে উৎপন্ন ধ্বনি
বায়ুজ: বেণু থেকে উৎপন্ন ধ্বনি
চরমজ: চামড়া দ্বারা আচ্ছাদিত মৃদঙ্গাদি থেকে উৎপন্ন ধ্বনি
ধাতব: ধাতু নির্মিত ঘনযন্ত্র থেকে উৎপন্ন ধ্বনি
দেহজ: কণ্ঠ থেকে উৎপন্ন ধ্বনি
খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে শারঙ্গদেবের রচিত সঙ্গীতরত্নাকর নাদের আধ্যত্মিক ও সাঙ্গীতিক উভয় ধারণাকেই উপস্থাপন করা হয়েছে। তাঁর নাদ সম্পর্কিত ভাবনা ছিল পূর্ববর্তী সঙ্গীতজ্ঞদের মতই। শারঙ্গদেবের পরবর্তী পণ্ডিতো নাদ সম্পর্কিত ধারণা প্রায় একই রকম। উল্লেখিত গ্রন্থাদির বিচারে আমার নাদ সম্পর্কে যে সাধারণ ধারণা পাওয়া যায়, তা হলো-
নাদ হলো ধ্বনি
আধ্যত্মিক ও সাঙ্গীতিক দর্শনের বিচারে নাদ দুই প্রকার। প্রকার দুটি হলো- অনাহত নাদ ও আহত নাদ
অনাহত নাদ বস্তুর কম্পনজাত নয় এবং শ্রবণেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে শোনা যায় না।
আহতনাদ, বস্ত আঘাত প্রাপ্ত বা আহত হলে কম্পিত হয় এবং এই কম্পনের সূত্রে সৃষ্ট শব্দ হলো আহত নাদ।
সঙ্গীত শাস্ত্রে অনাহত নাদ' ও অপরটি 'আহত নাদ' সমন্বিত হয় কয়েকটি ধাপে। এগুলো হলো-
অনাহত
নাদের সাথে ব্স্তুর কম্পনজাত কোনো সম্পর্ক নেই। 'আহত নাদ' মাধ্যমে মানুষ
পরস্পরের মধ্যে শ্রবণযোগাযোগ স্থাপন করে থাকে। তবে সকল
'আহত নাদ
মানুষ শুনতে পায় না।
প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীতে এই শব্দ বা শব্দের অনুভবকে নাদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
প্রাচীন সঙ্গীত বিষয়ক উল্লেখযযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে পাওয়া যায়,
খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর ভিতরে নারদের রচিত 'শিক্ষা' নামক গ্রন্থ ও
দ্বিতীয় শতাব্দীর পূর্ণাঙ্গ অভিনয় ও নৃত্যগীত
বিষয়ক মহৎ গ্রন্থ 'নাট্যশাস্ত্র' রচনা করেছিলেন ভরত। উল্লেখিত
গ্রন্থ দুটিতে নাদ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয় নি।
৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মতঙ্গ রচিত 'বৃহদ্দেশী' গ্রন্থে নাদের
বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এই গ্রন্থমতে-
'নাদ ভিন্ন গীত সম্পাদিত হয় না, নাদ ব্যতীত স্বরনির্ণয় সম্ভব নয়। নাদের সহযোগিতা ব্যতিরেকে নৃত্ত অনুষ্ঠিত হতে পারে না। সবদিক থেকে থেকেই এই জগৎ নাদাত্মকরূপে প্রতিভাত হয়। ব্রহ্মা নাদরূপ স্মৃত হন, জনার্দন নাদ স্বরূপ, পরাশক্তি নাদরূপা, মহেশ্বরও নাদরূপ।...নাদ থেকে বিন্দু হয় এবং নাদ থেকেই সব কিছু বাঙময় হয়ে ওঠে।'বৃহদ্দেশীর এই বিবরণে নাদকে বিমূর্ত শক্তি রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। যখন নাদ গীতের স্বরনির্ণয়ের নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তখন তা শব্দশক্তি। আর যখন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, পরমব্রহ্ম, মহাদেব নাদরূপী তখন তা হয়ে ওঠে আধ্যাত্মিক ভাবনায় দৈবশক্তি।
আধুনিক শব্দবিজ্ঞানের মতে বস্তু কম্পিত হলে, শক্তির প্রকাশ ঘটে। এই শক্তির দ্বারা সৃষ্ট তরঙ্গরূপ ধ্বনি রূপে প্রকাশিত হয়। বস্তু যদি তার অভ্যন্তরীণ শক্তির দ্বারা আপনা-আপনি কম্পিত হতে থাকে এবং এর দ্বারা ধ্বনি তৈরি হয়, তাহলে তা হবে অনাহত নাদ। সনাতন হিন্দুধর্মে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর যখন শক্তিরূপে বিরাজ করেন অনাহত নাদ পর্যায়ে। সাধক যোগমার্গে এই নাদ অনুভব করতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ যা অনুভব করেন, তা আহত নাদ। ধ্যানের মধ্য দিয়ে অনাহত নাদ যোগী শোনেন কিন্তু অন্যকে শোনাতে পারেন না। অনাহত নাদ যোগী অনুভব করতে পারেন, কিন্তু মনোরঞ্জনের জন্য তাতে পরিবর্তন আনতে পারেন না। আবার মানুষের চেতনার ভিতরে অনাহত নাদের উদ্ভব হতে পারে। বৃহদ্দেশীতে মতঙ্গ বলেছেন- নদন ক্রিয়া থেকে নাদ শব্দের সৃষ্টি'। তাঁর মতে নাদ পাঁচ প্রকার। রকার।
১. সূক্ষ্ম: এই গুহাবাসী। অর্থাৎ চৈতন্যের গভীরে এর অবস্থান।
২. অতিসূক্ষ্ম: এর অবস্থান হৃদয়ে। অর্থাৎ মনোলোকে এই নাদ অবস্থান করে।
৩. ব্যক্ত: এই নাদের অবস্থান কণ্ঠদেশে। এই নাদ কণ্ঠ দ্বারা প্রকাশিত হয় এবং তা মানুষের শ্রবণের যোগ্য। এই নাদের দ্বারা মানুষ ব্যক্তি মাত্রেই অন্যের কাছের তার মনোভাব প্রকাশ করতে পারে এবং অন্যের মনোভাব অনুভব করতে পারে।
৪. অব্যক্ত: এর অবস্থান তালুতে। এই নাদ মনের গভীরে চৈতন্যের দ্বারা অবস্থান করে। বাণীর ভিতর দিয়ে মনের ভিতরে যে ভাবের প্রকাশ ঘটে, বাক্যন্ত্রের সাহায্যে তা প্রকাশ করা যায় না।
৫. কৃত্রিম: এর অবস্থান মুখদেশে। এই নাদ মুখ থেকে বাণীরূপে প্রকাশিত হয়।
- চলন্তিকা। রাজশেখর বসু। এমসি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিঃ। ১৪০৮। পৃষ্ঠা: ২৩৫
- বঙ্গীয় শব্দকোষ (প্রথম খণ্ড)। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্য অকাদেমী। ২০০১। পৃষ্ঠা: ১১৯০।
- বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান। মার্চ ২০০৫। পৃষ্ঠা: ৬৭৪।
- বাঙ্গালা ভাষার অভিধান (দ্বিতীয় খণ্ড)। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস। সাহিত্য সংসদ। নভেম্বর ২০০০। পৃষ্ঠা: ১১৮০।
- বাঙ্গালা শব্দকোষ। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি। ভূর্জপত্র। ১৩৯৭ বঙ্গাব্দ। পৃষ্ঠা: ৫০১।
- বৃহদ্দেশী । মতঙ্গ। সম্পাদনা: শ্রীরাজ্যেশ্বর মিত্র। সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার। কলকাতা। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দ।
- শব্দবোধ অভিধান। আশুতোষ দেব। দেব সাহিত্য কুটির। মার্চ ২০০০। পৃষ্ঠা: ৫০২।
- শব্দসঞ্চয়িতা। ডঃ অসিতকুমার বন্দোপাধ্যায়। নিউ সেন্ট্রাল বুক এজেন্সি প্রাঃ লিমিটেড। ২৩শে জানুয়ারি, ১৯৯৫। পৃষ্ঠা: ৪৯৪।
- শব্দার্থ প্রকাশিকা। কেশবচন্দ্র রায় কর্মকার। দেব সাহিত্য কুটির। মার্চ ২০০০।
পৃষ্ঠা: ৩০৯।- সংসদ বাংলা অভিধান। বৈদ্যুতিন সংস্করণ। শিশির শুভ্র সম্পাদিত। পৃষ্ঠা: ৪৫৪।
- সংস্কৃত বাংলা অভিধান। শ্রীঅশোক কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার। ১৪০৮ বঙ্গাব্দ। পৃষ্ঠা: ২৩৫।
- সরল বাঙালা অভিধান (সপ্তম সংস্করণ, নিউবেঙ্গল প্রেস ১৯৩৬)। সুবলচন্দ্র মিত্র।
পৃষ্ঠা: ৭৩১।