অনাহত নাদ
ভারতীয় শব্দ-দর্শন ও সঙ্গীতশাস্ত্রের বিচারে,
নাদের একটি প্রকরণ।
সমার্থক শব্দ: অনাঘাত নাদ।
ভারতীয় শব্দ-দর্শনে ধ্বনি বা শব্দের অপর নাম
নাদ
। এর অপর নাম
অশ্রুত শব্দব্রহ্ম)।
সনাতন হিন্দু ধর্ম মতে- অনাহত নাদ শব্দশক্তিরূপী পরমব্রহ্ম, তাই এই নাদ স্বয়ম্ভূ। মানুষের স্বাভাবিক শ্রবণ
ক্ষমতা দিয়ে এই
নাদ শোনা যায় না।
মানুষের মনের ভিতরে যে সুর আপনা-আপনি ধ্বনিত হয়, তা শ্রবণেন্দ্রিয়ের জন্য
নয়। তা আপন অনুভূতিতে জাগ্রত হয়ে উঠে, তাই অনাহত নাদ মাত্রে নৈঃশব্দ।
ধ্যানের মধ্য দিয়ে এই স্রষ্টার সাথে যে নৈশব্দ ভাবের বিহার ঘটে।
জালালউদ্দীন রুমি তাই বলেছিলেন- নৈশব্দ হলো আল্লাহর ভাষা।
বীন্দ্রনাথ যখন বলেন- 'আমার মনের মাঝে যে গান বাজে',
তখন তিনি অনাহত নাদের গানের কথাই বলেন।
মতঙ্গ রচিত 'বৃহদ্দেশী'
গ্রন্থে নাদকে সঙ্গীতের ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই গ্রন্থ মতে- 'নাদ
ভিন্ন গীত সম্পাদিত হয় না, নাদ ব্যতীত স্বরনির্ণয় সম্ভব নয়।' প্রকৃত পক্ষে
মনের ভিতরে ধ্বনির অনুভবে নাদের উদ্ভব না হলে, তা ব্যক্ত করা যায় না।
মূলত কোনো সঙ্গীতশিল্পী যখন কোনো সুরকে প্রকাশ করতে চান, তখন তাঁর মনের
ভিতরে প্রথম বেজে উঠে অনাহত নাদের সুর। সে সুর নৈশব্দের,
তাই
শ্রোতারা
শোনেন না,
শোনেন তিনি নিজে। শিল্পী মনের ভিতরে সৃষ্ট অনাহত সুর যখন কণ্ঠে বা যন্ত্র প্রকাশিত
হয়, তখন তা হয়ে যায় আহত নাদের সুর। একইভাবে মনের ভিতরে তৈরি হয় অনাহত
ছন্দও।
আমরা যাদের সুর কানা বলি, তাঁরা
মূলত মনের ভিতরে যথাযথভাবে উপযুক্ত অনাহত নাদের জন্ম দিতে পারেন না। এবং বাগযন্ত্রে তাঁরা তা
প্রকাশও করতে পারে না। একথা শুধু সঙ্গীতের জন্যই নয়, সকল শিল্পকর্ম সৃষ্টির
জন্য সত্য। যিনি ছবি আঁকেন তাঁর মনের ভিতরে আগে ছবি আঁকা হয়ে যায়। তিনি যখন
ছবিকে রঙ তুলতে প্রকাশ করতে যান, তখন তা অনেক সময়ই মনের মতো হয় না। সঙ্গীত
শিল্পীরা অহরহই বলে থাকেন, যেমনটা পরিবেশন করতে চেয়েছিলেন তেমনটা হলো না।
অর্থাৎ মনের গভীরে যে সঙ্গীতময় ধ্বনির উদ্ভব হয়েছিল, তা বাক্প্রত্যঙ্গ দিয়ে
প্রকাশ না করতে পারার আক্ষেপটাই সঙ্গীতশিল্পী ব্যক্ত করেন।
সঙ্গীতশাস্ত্রে সঙ্গীত পরিবেশনের প্রক্রিয়া তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়। ধাপ তিনটি হলো
ধাপ:
এই ধাপে
অনাহত
নাদের ভিতর দিয়ে সুর ও ছন্দের জন্ম সৃষ্টি হয়।
দ্বিতীয়
ধাপ:
প্রথম ধাপের
অনুভবকে আহত নাদের
মাধ্যমে প্রকাশের
জন্য শিল্পী কণ্ঠ বা যন্ত্রের মাধ্যমে প্রকাশ ঘটে।
এই পর্যায়ে আহত নাদের মাধ্যমে
অনাহত নাদের
প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয়।
তৃতীয়
স্তর:
প্রকাশিত আহত নাদের সাথে
ভাবের বা রসের সঞ্চার
ঘটিয়ে
শ্রোতাকে মুগ্ধ করার
চেষ্টা করা হয়।