ভারতীয় স্বর পদ্ধতি
Indian musical note

ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতিতে স্বরাষ্টকের অন্তর্ভুক্ত ব্যবহারিক সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি। প্রাচীনভারতে বীণার ৩৬ ইঞ্চি সুষম তারের সটান দশায় উৎপন্ন টঙ্কার ধ্বনিকে ধরা হয়েছিল আদি স্বর। এই স্বরকে বলা হয়েছিল ষড়্‌জ। এরপর এই তারের মধ্যস্থানে অর্থাৎ ১৮ ইঞ্চি বরাবর বাঁধ দিয়ে যে ধ্বনি উৎপন্ন হয়েছিল, তার নাম দেওয়া হয়েছিল- তার সপ্তকের ষড়্‌জ। এরপর উভয় তারের বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দিয়ে দিয়ে বিভিন্ন স্বর নির্ধারণ করা হয়েছিল।

মূলত বীণার তারের বিভাজিত অংশানুসারে ভারতীয় সঙ্গীতবিশারদরা শ্রুতি ও স্বরের সন্ধান করেছিলে। এক্ষেত্রে ৩৬ ইঞ্চি সটান তারের আদি সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিকে করা হয়েছিল। এরপর শ্রুতির সাথে ব্যবহারিক সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনির সমন্বয় করে নির্ধারণ করেছিলেন ৭টি শুদ্ধ স্বর। পরে এই ৭টি স্বরের সাথে যুক্ত হয়েছিল বিকৃত স্বরসমূহ। এই বিকৃতস্বরগুলোকে নাম দেওয়া হয়েছিল- কোমল, অতি কোমল, অনুকোমল, কড়ি নামে।

ভারতীয় সঙ্গীতে স্বরের ক্রমবিবর্তনের ধারা
ভারতীয় সঙ্গীতে স্বর বা শ্রুতি নির্ধাণ প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয়েছিল ক্রমবিবর্তনের ধারায়। এই ধারার সূত্রপাত হয়েছিল বৈদিক আমলে। এর প্রাথমিক নমুনা পাওয়া যায়, সামবেদে। এই বেদে সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিকে 'যম' নামে অভিহিত করা হয়েছে। সাম-এর বাণী অংশ ছিলো মন্ত্র বা মন্ত্রের অংশ। একে বলা হতো 'যোনি', এর অর্থ হলো- কারণ। ঋকপ্রাতিশাখ্যে শৌণিক সাম-এর স্বরগুলিকে 'যম' উল্লেখ করছেন। সামবেদের ৫৮৫টি যোনি নিয়ে আর্চিক গঠিত।

ভাবগত দিক থেকে সামবদের যম শব্দটির সাথে পতঞ্জলি রচিত যোগশাস্ত্র উল্লেখিত যম-এর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। পতঞ্জলি রচিত যোগশাস্ত্রে,অষ্টাঙ্গের প্রথম অঙ্গ হলো― যম। যোগশাস্ত্রেকে বলা হয়, নৈতিক আচরণ বিধি। অর্থাৎ ব্যক্তি তাঁর পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখে কীরূপ আচরণ করবে, তার বিধিই হলো যম। মূলত যম হলো সংযম বিধি। সহজ, সরল, অনাড়ম্বড়  এবং লালসাহীন দশায় জীবনকে উপভোগ করাই হলো যম। সংযমের মধ্য দিয়ে জীবনকে উপভোগ করার মধ্য, জীবনের অর্থ খুঁজে পাবার সাধনাই হলো, যমের চর্চা। অন্যদিকে ধ্বনিই সঙ্গীতকে নিয়ন্ত্রণ করে বা সংযত করে, তাই স্বরের অপর নাম যম বলা হয়। যম হলো যে কোনো স্বরের সাধারণ নাম। পরে প্রতিটি স্বরের নামকরণের মধ্য দিয়ে সঙ্গীতের স্বরমালার পত্তন ঘটেছিল। ভাষার ক্ষেত্রে প্রতিটি ধ্বনিমূল ধরে নামকরণ করার সূত্রে বর্ণ (অ, আ, ক, খ ইত্যাদি) তৈরি হয়েছিল। তেমনি স্বরের নামকরণের মধ্য দিয়ে সঙ্গীতের বর্ণ সৃষ্টি হয়েছিল। একালের স র গ ম প ইত্যাদি হলো এককটি স্বরের নাম বা বর্ণ। যদি বলা যায়, মালকোষ রাগে পাঁচটি বর্ণ ব্যবহৃত হয়, তাহলে বর্ণগুলো নাম হবে স, জ্ঞ, ম, দ ও ণ।

প্রাচীন ভারতের সাম-এর সঙ্গীতাচার্যরা প্রথম দিকে তিনটি সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি বা স্বরের উচ্চারণের স্থান নির্ধারণ করেছিলেন। এই স্বরস্থানগুলো হলো- সামবেদের শুরুর দিকে ঋষিরা এই তিনটি স্বরস্থানকে ব্যবহার করতেন আবৃত্তিকে সুরেলা করার জন্য। অনেকটা গ্রামবাংলার পুঁথি পাঠের মতো এর চলন ছিল। কালক্রমে সুর-বৈচিত্র্যে লোকসুরের দ্বারা প্রভাবিত সামগান সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। সেকালের সঙ্গীতগুরুরা প্রাথমিকভাবে সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনির উচ্চতা এবং নিম্নতার সীমা নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তী সময় তাঁরা লক্ষ্য করেছিলেন, একটি স্বর থেকে ক্রমান্বয়ের উপরের দিকে উঠলে বা খাদের দিকে নামলে একটি সীমা পাওয়া যায়। যে সীমায় পৌঁছালে স্বরস্থান যেন পূর্ণতা পায়। এই পূর্ণতার আকাঙ্ক্ষা থেকেই তাঁরা পরবর্তী সময়ে সপ্তকের সীমা নির্ধারণ করেছিলেন। এই সীমার ভিতরে বৈচিত্র্য আনার সূত্রে ধীরে ধীরে একটি একটি করে অন্যান্য সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি স্থান পেয়েছিল। এই ভাবে ঋষিরা সপ্তকের ভিতরে বহু সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি
সন্ধান পেয়েছিলেন। এই সকল সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনির ভিতরে যেগুলোকে শ্রবণের মাধ্যমে পৃথকভাবে শনাক্ত করা যায়, সেগুলোর নাম দিয়েছিলেন শ্রুতি।

এইভাবে আলাদা করে শনাক্ত করা যায় এমন ব্যবহারিক সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিকে ভারতীয় ঋষিরা নাম দিলেন স্বর। একথা বলতে বাধা নেই, সঙ্গীতের স্বরের চর্চার ভিতর দিয়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি প্রাথমিক রূপ ফুটে উঠেছিল।

পরবর্তী সময়ে সঙ্গীতগুরুরা স্বরের সংজ্ঞা নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন। শার্ঙ্গদেবের সঙ্গীতরত্নাকরে পাওয়া যায় এমনি একটি সংজ্ঞা। এই মতে- 'শ্রুতিসমূহের অনন্তর অনুরণনাত্মক যে স্নিগ্ধ ধ্বনি উৎপন্ন হয়, যে ধ্বনির অপর কোনও সহকারী কারণের অপেক্ষা না করিয়া স্বতই শ্রোতার চিত্তরঞ্জন করে তাহাকেই স্বর বলে।' সঙ্গীতরত্নাকরে এই সংজ্ঞা স্বরের কোনো পূর্ণাঙ্গ ধারণা দেয় না। তবে এই সংজ্ঞা থেকে সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনির ধারণা সুষ্পষ্টভাবে ধরা পরে। যেমন- সামবেদের সঙ্গীতঋষিরা সামগানে ব্যবহৃত তিনটি স্বরস্থান (উদাত্ত, স্বরিত, অনুদাত্ত) থেকে ৭টি শুদ্ধ স্বরের ধারণা পেয়েছিলেন। তাঁরা এঁরা এই স্বরগুলোর নাম দিয়েছিলেন- ক্রুষ্ট, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, মন্দ্র ও অতিস্বার্য। সেকালের লৌকিক গানে এই স্বরগুলো ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রকাশ পেয়েছিল। এই লৌকিক স্বরগুলো হলো ষড়্জ,  ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ। 

যাজ্ঞবল্ক্য ও অন্যান্য ঋষিদের মতে অনুদাত্ত থেকে ঋষভ ও ধৈবত, উদাত্ত থেকে নিষাদ ও গান্ধার, স্বরিত থেকে ষড়্‌জ, মধ্যম ও পঞ্চমের সৃষ্টি হয়েছিল।
সামগানের স্বরের সাথে লৌকিকগানের স্বর সমন্বয়ের সময়, নারদ এই সাতটি স্বরকে যেভাবে সাজিয়েছিলেন তা হলো

 

সামগানের স্বর ও লৌকিক স্বরের তুলনামূলক অবস্থান

সামগানের স্বর

লৌকিক স্বর

প্রথম মধ্যম
দ্বিতীয় গান্ধার
তৃতীয় ঋষভ
চতুর্থ ষড়্‌জ
মঞ্চম (মন্দ্র) ধৈবত
ষষ্ঠ (অতিস্বার্য) নিষাদ
সপ্তম (ক্রুষ্ট) পঞ্চম

 

 

মতঙ্গমুনি তাঁর বৃহদ্দেশী গ্রন্থে স্বরে নামগুলোর উৎস হিসেবে কোহলের মত উদ্ধৃত করে বলেছেন-
                   ষড়জং বদতি ময়ুর ঋষভং চাতকো বদেৎ             
                   অজা বদতি গান্ধারং ক্রৌঞ্চো বদতি মধ্যমম
                   পুষ্পসাধারণে কালে কোকিল: পঞ্চমং বদেৎ।
                   সর্বদা চ তথা দেবি ! নিষাদং বদতি গজ।

অর্থাৎ ময়ূর ষড়জ স্বর, চাতক ঋষভ স্বর, ছাগ গান্ধার স্বর, সারস মধ্যম স্বর, বসন্তকালে কোকিল পঞ্চম স্বর, বর্ষাকালে ভেক ধৈবত স্বর এবং হস্তি নিষাদ স্বর উচ্চারণ করে।

[বৃহদ্দেশী। ড: প্রদীপ কুমার ঘোষ দ্বারা সম্পাদিত। কলকাতা" রিসার্চ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ান মিউসিকোলজি, ১৯৮৬, ১০]


আধুনিককালের স্বরবিন্যাস হলো
ষড়্‌জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ। এর সংক্ষেপে এগুলো উচ্চারণ করা হয় সা, রে, গা, মা, পা, ধা এবং নি। শাস্ত্রমতে এগুলিকে শুদ্ধস্বর বলা হয়। এর ভিতর সা এবং পা -এর স্থান সুনির্দিষ্ট। এই কারণে এই দুটি স্বরকে
অচলস্বর বলা হয়। বাকি ৫টি শুদ্ধস্বর মূর্ছনা বা শ্রুতিবিন্যাসের তারতম্যে বিকৃত হয়। এই বিকৃত স্বরগুলি হলো কোমল ঋষভ, কোমল গান্ধার, কড়ি মধ্যম, কোমল ধৈবত, কোমল নিষাদ। নিচে ক্রমানুক্রমিক স্বর তালিকা দেওয়া হলো।
 

অনুক্রমিক নির্দেশে স্বরের অবস্থান

শাস্ত্রীয় নাম

ব্যাবহারিক নাম

ষড়্‌জ সা
কোমল ঋষভ রে (কোমল রে)
ঋষভ রে
কোমল গান্ধার গা (কোমল)
গান্ধার গা
মধ্যম মা
কড়ি মধ্যম মা(কড়ি/তীব্র)
পঞ্চম পা
কোমল ধৈবত ধা (কোমল)
ধৈবত ধা
কোমল নিষাদ নি (কোমল)
নিষাদ নি


ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রে এই স্বরগুলো ২২টি
শ্রুতির উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো বিশেষ স্বরের একটি উপরে বা নিচের অবস্থানে গেলে এই শ্রুতি অনুভব করা যায়। প্রাচীন ভারতের সঙ্গীততত্ত্বে স্বরগুলোকে শ্রুতি অনুসারে বিভাজনের ক্ষেত্রে মতভেদ ছিল। নিচে সঙ্গীতপারিজাত ও সঙ্গীতরত্নাকরের তুলনামূলক সারণী দেওয়া হলো-
 

শ্রুতি সংখ্যা ও নাম জাতি         সঙ্গীতপারিজাত  সঙ্গীতরত্নাকর
. তীব্রা   দীপ্তা  তীব্র নিষাদ   কৈশিকী নিষাদ
. কুমুদ্বতী  আয়তা তীব্রতর নিষাদ কাকলি নিষাদ
. মন্দা মৃদু  তীব্রতম নিষাদ চ্যুত ষড়্‌জ
. ছন্দোবতী   মধ্যা ষড়্‌জ (স)
. দয়াবতী  করুণা পূর্ব ঋষভ
. রঞ্জনী  মধ্যা  কোমল ঋষভ
. রক্তিকা  মৃদু ঋষভ বা পূর্ব গান্ধার শুদ্ধ ঋষভ
. রৌদ্রী দীপ্তা  তীব্রতর ঋষভ/কোমল গান্ধার
৯. ক্রোধা আয়তা শুদ্ধ গান্ধার শুদ্ধ গান্ধার
১০. বজ্রিকা   দীপ্তা  তীব্র গান্ধার সাধারণ গান্ধার
১১. প্রসারিণী আয়তা তীব্রতর গান্ধার অন্তর গান্ধার
১২. প্রীতি  মৃদু  তীব্রতম গান্ধার চ্যুত মধ্যম
১৩. মার্জনী  মধ্যা  মধ্যম/অতি তীব্রতম গান্ধার শুদ্ধ মধ্যম
১৪. ক্ষিতি মৃদু তীব্র মধ্যম
১৫. রক্তা মধ্যা  তীব্রতর মধ্যম
১৬. সন্দীপিনী আয়তা তীব্রতম মধ্যম মধ্যমগ্রামোক্ত বা কৌশিক পঞ্চম
১৭. আলাপিনী করুণা পঞ্চম পঞ্চম
১৮. মদন্তী করুণা পূর্ব ধৈবত
১৯. রোহিণী আয়তা কোমল ধৈবত
২০. রম্যা মধ্যা  ধৈবত/পূর্ব নিষাদ  শুদ্ধ ধৈবত
২১. উগ্রা  দীপ্তা  তীব্র ধৈবত বা কোমল নিষাদ
২২. ক্ষোভিণী মধ্যা  তীব্র নিষাদ/তীব্রতর নিষাদ শুদ্ধ নিষাদ


শ্রুতিতে স্বরের অবস্থান নিয়ে মতটা বর্তমানে প্রচলিত আছে তা হলো-
 

শ্রুতি সংখ্যা ও নাম

প্রচলিত স্বর

প্রচলিত আকারমাত্রিক স্বরচিহ্ন

. তীব্রা  

ষড়্‌জ

. কুমুদ্বতী 

অতি কোমল ঋষভ

. মন্দা

কোমল ঋষভ

. ছন্দোবতী  

অনুকোমল ঋষভ

. দয়াবতী 

শুদ্ধ ঋষভ

. রঞ্জনী 

অতি কোমল গান্ধার

জ্ঞ
. রক্তিকা 

কোমল গান্ধার

জ্ঞ
. রৌদ্রী

গান্ধার

৯. ক্রোধা

-

 
১০. বজ্রিকা  

শুদ্ধ মধ্যম

১১. প্রসারিণী

-

 
১২. প্রীতি 

কড়ি মধ্যম

হ্ম
১৩. মার্জনী 

-

 
১৪. ক্ষিতি

পঞ্চম

১৫. রক্তা

অতি কোমল ধৈবত

১৬. সন্দীপিনী

কোমল ধৈবত

১৭. আলাপিনী

অনুকোমল ধৈবত

১৮. মদন্তী

শুদ্ধ ধৈবত

১৯. রোহিণী

অতি কোমল নিষাদ

২০. রম্যা

কোমল নিষাদ

২১. উগ্রা 

নিষাদ

২২. ক্ষোভিণী

-

 


ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রে সাতটি শুদ্ধ স্বরের সেটকে বলা হয় সপ্তক। পাশ্চাত্য রীতিতে একে বলা হয় অক্টেভ। পাশ্চাত্য রীতিতে আদি স্বর যে কম্পাঙ্কের হয়, তার দ্বিগুণিতক কম্পাঙ্ক পর্যন্ত একটি সীমানা টানা হয়। ফলে সাতটি স্বরের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮টি (সা রা গা মা পা ধা না র্সা)। কিন্তু ভারতীয় পদ্ধতিতে শেষের দ্বিগুণিতক কম্পাঙ্ককে বাদ দিয়ে গণনা করা হয়। ফলে স্বরের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭টি (সা রা গা মা পা ধা না)।
 

পাশ্চাত্য সঙ্গীতে সপ্তকের স্থান নির্ধারিত হয় স্কেলের দ্বারা। এই স্কেলের শুরু স্বর A । এর কম্পাঙ্ক ৪৪০। ভারতীয় পদ্ধতির সপ্তক নির্ধারিত হয় মধ্য সপ্তকের ষড়্‌জ থেকে। এর কম্পাঙ্ক নির্দিষ্ট নয়। তাই ভারতীয় সঙ্গীত শিল্পীদের কাছে ষড়্‌জের অবস্থান অনুভূতির বিষয়। অবশ্য আধুনিক কালের ভারতীয় শিল্পীরা পাশ্চাত্য যন্ত্রের দ্বারা ষড়্‌জ তথা স্কেলটা দেখে নেন। 
 

ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রের স্বরনির্ধারণ পদ্ধতি

আদিতে ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রে স্কেলের মতো, সুনির্দিষ্ট কম্পাঙ্ক ভিত্তিক কোনো ধ্বনিসীমা ছিল না। ফলে তাঁরা সুবিধামতো একটি সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনিকে আদ্যস্বর তথা ষড়্‌জ বিবেচনা করে, স্বরসপ্তক রচনা করতেন। বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ সঙ্গীতশিল্পীর নিজস্ব স্বরবোধের উপর নির্ভরশীল।

খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে মতঙ্গের রচিত বৃহদ্দেশীতে শ্রুতি বিষয়টি আরও বিস্তারিতভাবে বরণনা করা হয়েছে। তবে বর্ণনার অনেক কিছুই আধুনিক সঙ্গীততত্ত্বে গৃহীত হয় নি। শব্দের রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে মতঙ্গ বলেছেন-শ্রবণার্থক "শ্রু" ধাতুর উত্তর "ক্তি" প্রত্যয় যোগ করে শ্রুতি শব্দ সমুদ্ভূত হয়েছে। মতঙ্গ প্রথম দুটি বীণার তারে টংকার তুলে শ্রুতি পরিমাপের বিষয়টি বর্ণনা করেছিলেন। তিনি এক্ষেত্রে সমান মাপের দণ্ড এবং তারের দুটি বীণার সাহায্য নিয়েছিলেন। একই পদ্ধতিতে স্বরের অবস্থানও নির্ণয় করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে এই পদ্ধতি অনুসরণেই বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছিল- পণ্ডিত অহোবল ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তাঁর রচিত 'সঙ্গীত পারিজাত' গ্রন্থে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

তাঁর
পদ্ধতিতে ৩৬ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য তারের সটান দশায় উৎপন্ন ধ্বনিকে মুদারার ষড়্জ হিসেবে ধরা হয়েছিল। পরবর্তীকালে পণ্ডিত শ্রীনিবাস তাঁর "রাগতত্ত্ব বিবোধ' গ্রন্থে প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক ধ্বনিকে শনাক্ত করার বিষয়টি উপস্থাপন করেছিলন। তিনি তারের দৈর্ঘ্য এবং তারে টঙ্কারের উৎপন্ন কম্পাঙ্কের সাথে সমন্বয় করেছিলেন। এই সূত্রে তিনি যে ধ্বনিসীমা নির্ধারণ করেছিলন, তা ছিল ২৪০ থেকে ৪৮০ কম্পাঙ্ক। এই ধ্বনি সীমার আদ্য ধ্বনি ২৪০ হার্টজকে মুদারা সপ্তক হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। এই বিচারে যে তিনটি ধ্বনি সীমা তৈরি নির্ধারিত হয়েছিল, তা হলো-

উদারা: ১২০ থেকে ২৪০ হার্টজ (মুদারার যড়্‌জ)
মুদারা: ২৪০ থেকে ৪৮০ হার্টজ (তারার ষড়্‌জ)
তারা: ৪৮০ থেকে ৯৬০ হার্টজ (অতি তারার ষড়্‌জ)

যন্ত্র হিসেবে বীণা ততযন্ত্র। এর ব্রিজের দিকের অংশকে বলা হয় পূর্বমেরু ও উপরের দিকটাকে বলা হয় অন্ত্য মেরু। শ্রীনিবাস এই দুই মেরুকে অবলম্বন করে ৩৬ ইঞ্চি একটি সুষম তার সটান বেঁধে, মুক্তভাবে টঙ্কার তুলে যে ধ্বনিটি পেয়েছিলেন, তার নাম দিয়েছিলেন মধ্য সপ্তকের ষড়্‌জ। পরবর্তী সময়ে তারের টানকে কম্পাকের বিচারে নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৪০ হার্টজ। এই বিচারে মধ্য সপ্তকের ষড়্‌জের যে মান দাঁড়িয়েছিল, তা হলো-

'৩৬ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের বীণার তারে যখন ২৪০ কম্পাঙ্কের যে সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি তৈরি হবে, তা হবে মধ্য সপ্তকের ষড়্‌জ।

শ্রীনিবাস এরপর এই তারের মাঝ বরাবর অর্থাৎ ১৮ ইঞ্চি তারে যে টঙ্কার তুল ছিলেন, তাঁকে তার সপ্তকের ষড়্‌জ হিসেবে শনাক্ত করেছেলেন। তখন এর কম্পাঙ্ক দাঁড়িয়েছিল  ৪৮০ হার্টজ।
 


এই প্রক্রিয়া
শ্রীনিবাস পরবর্তী ধাপে ১৮ ইঞ্চি তারে মাঝখানে চেপে টঙ্কার তুলে যে ধ্বনিটি পেলেন তার নাম দিলেন মধ্য সপ্তকের মধ্যম। এক্ষেত্রে পূর্বমেরু থেকে মধ্যমের জন্য তারের দৈর্ঘ্য হয়েছিল ১৮+ ৯= ২৭ ইঞ্চি।


আবার ১৮ ইঞ্চি দীর্ঘ তারকে সমান তিন ভাগে করেছিলেন। প্রতিটি ভাগে ছিল ৬ ইঞ্চি। শ্রীনিবাস তারার সা অর্থাৎ ১৮ ইঞ্চি থেকে ৬ ইঞ্চি যুক্ত করে তিনি ২৪ ইঞ্চি দীর্ঘ তার নির্ধারণ করেছিলেন। এই ২৪ ইঞ্চি তারের টঙ্কার থেকে উৎপন্ন ধ্বনিকে তিনি পঞ্চম হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন। এর সাথে আরও ৬ ইঞ্চি যুক্ত করে তারের দৈর্ঘ্য নিরুপণ করেছিলেন ৩০ ইঞ্চি। এই ৩০ ইঞ্চি দীর্ঘ তার থেকে উৎপন্ন ধ্বনিকে তিন শনাক্ত করেছিলেন গান্ধার হিসেবে।

এরপর তিনি র্সা থেকে পঞ্চমের মধ্যবর্তী ১২ ইঞ্চি তারকে সমান চার ভাগে ভাগ করেছিলেন। সা থেকে পা-এর দিকে ৪ ইঞ্চি অগ্রসর হয়ে ৩২ ইঞ্চি তারকে ঋষভ হিসেবে শনাক্ত করেছিলেন।

এরপর তিনি প থেকে র্স-এর ১২ ইঞ্চি তারকে সমান ৬ ভাগে ভাগ করেন। এর ফলে প্রতি ভাগে পড়ে ২ ইঞ্চি। র্সা থেকে পা-এর দিকে দুই ইঞ্চি যুক্ত ২০ ইঞ্চিতে নিষাদের অবস্থান নির্দিষ্ট করেন। শাস্ত্রীয় মতে ঋষভ থেকে ধৈবতের অবস্থান দেড় গুণ উচ্চে। এই বিচারে ধৈবতের অবস্থান দাঁড়ায়

        ৩২ ¸৩/২= ২১.১/৩ ইঞ্চি।

এই প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে তিনি মধ্যসপ্তকের স্বরগুলো মান নির্ণয় করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে স্বর নির্ধরাণের ক্ষেত্রে
তারের দৈর্ঘ্যের বিষয়ে শ্রীনিবাসের সাথে পণ্ডিত ভাতখণ্ডে একমত হতে পারেন নি। ভাতখণ্ডে তাঁর ভিন্নমত প্রকাশ করেছিলেন তাঁর 'অভিনব রাগমঞ্জরী' গ্রন্থে। নিচে শ্রীনিবাস এবং ভাতখণ্ডের স্বর নির্ধারণের তুলনামূলক সারণি তুলে ধরা হলো
 

স্বরের নাম তারের দৈর্ঘ্য (ইঞ্চি)
শ্রীনিবাসের মত ভাতখণ্ডের মত
ষড়্জ ৩৬ ৩৬
কোমল ঋষভ ৩৩.১/৩ ৩৪
 ঋষভ
কোমল গান্ধার   ৩০
গান্ধার ৩০ ২৮.২/৩
 মধ্যম ২৭ ২৭
তীব্র মধ্যম ২৫.১/২ ২৫.১/২
কোমল ধৈবত ২২.২/৩ ২২.১/৩
ধৈবত ২১.১/৩ ২১.১/৩
 কোমল নিষাদ   ২০
নিষাদ ২০ ১৯.১/৯

 

স্বরজ্ঞান: সঙ্গীশাস্ত্রে স্বরজ্ঞান একটি বিশেষ পারভাষিক শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ হলো স্বরের জ্ঞান। কিন্তু সঙ্গীত শাস্ত্রের এই শব্দটি বিশেষ কতকগুলো ধারণার সমষ্টিগত জ্ঞান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। যেমন-

১. যে কোনো স্বর হলো যথার্থ সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি। এর ভিত্তি হলো স্বরের মৌলিক ধ্বনির ধারণা। ধরা যাক একটি স্বরের মৌলিক ধ্বনির কম্পাঙ্ক ৪৪০ হার্টজ। এই ধ্বনিটিকে যদি ষড়্‌জ ধরা হয়, তাহলে এক্ষেত্রে স্বরজ্ঞানের প্রথম শর্তটি হবে এই মৌলিক ধ্বনি হিসেবে ৪৪০ হার্টজ্-কে যথাযথভাবে অনুভব করা। শ্রবণের এই যথাযথ অনুভব করার জ্ঞান হবে স্বরজ্ঞানের প্রাথমিক জ্ঞান।

২. মূল সুরের সাথে উপসুরগুলো যুক্ত হয়ে যে সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি সৃষ্টি হবে, তা অনুভবের একটি বিশেষ গুণ দ্বারা বিবেচিত হবে। নান্দনিকতার বিচারে এই গুণগুলো হবে- শ্রুতিমধুর, মনোরঞ্জনকারী ও স্নিগ্ধ। মৌলিক ধ্বনির বিচারে স্বরেকে চিহ্নিত করতে পারা এবং নান্দনিকতার বিচারে তা ধ্বনিসৌন্দর্যে মূল্যায়ন করতে পারার মাধ্যমে স্বরজ্ঞানের দ্বিতীয় জ্ঞানের ধারণা জন্ম নেবে।

বাজারে সস্তা কিছু হারমোনিয়াম পাওয়া যায়, যেগুলোতে স্বরস্থান ঠিক থাকলেও দেখা যায়, এর ধ্বনিগুণ শ্রুতিমধুর, মনোরঞ্জনকারী ও স্নিগ্ধ হয় না। অনেক সময় সঙ্গীতগুরুরা এই জাতীয় হারমোনিয়ামের ধ্বনিকে বলে থাকেন- 'স্বরে আছে সুরে নেই। এর অর্থ হলো- কম্পাঙ্কের বিচারে স্বরের অবস্থান ঠিক আছে কিন্তু স্বরগুলো 'শ্রুতিমধুর, মনোরঞ্জনকারী ও স্নিগ্ধ' নয়। একথায় একে বলা হয়  মিষ্টি সুর নয়। কণ্ঠসঙ্গীতের ক্ষেত্রেও এরূপ দেখা যায়। অনেকের কণ্ঠস্বর স্বরে থাকে, কিন্তু মিষ্টি হয় না, অর্থাৎ সুরে থাকে না। তাই যে কোনো গানের সুরকে শ্রুতিমধুর করতে হলে 'মিষ্টত্ব' এবং কর্কশতার পার্থক্য জানতে হবে।

৩. স্বর মাত্রেই কোনো স্কেলের অংশ। ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রে এর আদ্য স্বরকে বলা হয় ষড়্‌জ। এক্ষেত্রে প্রথমে ষড়্‌জকে যথাযথভাবে শনাক্ত করার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। এরপর এই স্বরকে কণ্ঠে বা বাদ্যযন্ত্রে প্রকাশ করার কৌশল অর্জন করতে হবে। কিছুদিন গান শেখার পর, কোনো যোগ্য গুরুর কাছে তালিম নিতে গেলে, অনেক সময় তাঁরা শিক্ষার্থীকে বলে থাকেন তোমার 'সা' লাগছে না। এর অর্থ হতে পারে শিক্ষার্থী যথাযথ মৌলিক ধ্বনি উৎপন্ন করতে পারছে না বা উৎপন্ন মৌলিক ধ্বনি মিষ্টি হচ্ছে না। আবার এমনটাও হতে পারে যে, দুটোর কোনোটাই হচ্ছে না। এই ক্ষেত্রে স্বরজ্ঞানের তৃতীয় ধাপ হবে যথাযথভাবে ষড়্জকে চিনতে পারার জ্ঞান।

৪. স্বরজ্ঞানের চতুর্থ পর্যায়কে বলা যায়, স্কেলের বিচারে স্বরগুলোর তুলনামূলক জ্ঞান। এর প্রাথমিক বা ভিত্তি স্বর হলো ষড়্জ। এই স্বরের বিচারে অন্যান্য স্বরকে যথাযথভাবে চিনতে পারা। অনেক শিক্ষার্থীই আছেন, যাদের চট করে কোমল ধৈবত গাইতে বললে, 'সারেগামাপা' গেয়ে 'দা'তে পৌঁছায়। একবারে পারে না। এটাও ঘটে স্বজ্ঞানের অভাবে।

৫. স্পর্শহীন স্বর উচ্চারণ বিধি। অনেক সময়ই লক্ষ্য করা যায়, একটি স্বর উচ্চারণের সময় এর আগের স্বরের স্পর্শ করে আসে। অর্থাৎ বলা পা, কিন্তু ধ্বনিত হয় প। সত্যিকার অর্থ স্পর্শহীন স্বর উচ্চারণ করাটা প্রায় অসম্ভব। কারণ শুরুতে স্বরধ্বনি কম্পিত হলে- তার প্রাথমিক অবস্থায় একটি ধ্বনির রেশ তৈরি হয়। অভিজ্ঞ শিল্পীর কণ্ঠে আদি ধ্বনি এতটাই নিয়ন্ত্রণে রাখেন যে, শ্রোতা এই অনাকাঙ্ক্ষিত ধ্বনিটি শুনতেই পান না।


তথ্যসূত্র: