√ সো (অবসান করা)+ মন্ (মনিন্), কর্তৃবাচ্য
...যজ্ঞসম্পাদনার্থ যে সকল ঋক গীত হয়'।
উল্লেখিত শব্দের বিশ্লেষণে 'সাম' শব্দের উৎকৃষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। মূলত
ভক্তিমূলক গান হিসেবে সেমেটিক ভাষায় এই জাতীয় গানের অস্তিত্ব ছিল। দাউদের রচিত এরূপ
বহুগান হিব্রু বাইবেলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। সংকলিত এই গ্রন্থের হিব্রু নাম ছিল
সেফের তেহিল্লিম (sefer tehillim)।
এর অর্থ ছিল প্রশস্তি-গ্রন্থ। ধারণা করা হয় এই সঙ্গীত-সংকলনটি খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয়
শতাব্দীর আগেই রচিত হয়েছিল। এতে ছিল নবী দাউদের
(আনুমানিক ১০১০-৯৭০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
৭৩টি গান, আসাফের ১২টি গান এবং কোরাহ-বংশীয় বাদক দলের ১১টি গান। হিব্রু থেকে গ্রিক
ভাষার বাইবেল রচনার সময় এর
নাম দেওয়া হয়েছিল প্সাল্মই (Psalmoi)।
পরে এই শব্দ থেকে গ্রিক শব্দ
psalmos শব্দের উৎপত্তি ঘটেছিল। এই গানের সাথে সংঙ্কলনের
এর অর্থ গ্রহণ করা হয়েছিল- 'এমন ধর্মসঙ্গীত যা তারযন্ত্রের সাথে গীত হয়ৱ। এই সময় সেমেটিক ভাষা থেকে
ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষায় কৃতঋণ শব্দ হিসেবে যুক্ত হয়েছিল psalmos শব্দ। ল্যাটিন ভাষায় এর নাম হয়েছিল psalmus। আর
প্রাচীন ইংরেজি ভাষায় শব্দটি প্রবেশ করেছিল psealm হিসেবে।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ থেকে ১৫০০ অব্দের ভিতরে ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাগোষ্ঠী যখন ভারতে
আর্য ভাষা-ভাষী হিসেবে প্রবেশ করেছিল, তখন প্রাক্-বৈদিক ধর্মদর্শন এবং
ধর্মানুষ্ঠানের নির্ধরিত গানের ব্যবহার তাদের জানা ছিল। বৈদিক যুগে ভাষার বিবর্তনে
psealm হয়ে গিয়েছিল সাম গান। বাংলায় বাইবেল অনুবাদের সময়
এই গানকে সামসঙ্গীত নামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
বৈদিক যুগের রাজা-মহারাজার পূণ্যসঞ্চয়, সুনাম অজর্ন বা বড় ধরণের
বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় পুরোহিতদের শরণাপন্ন হতেন। পুরোহিতরা বিষয়ের গুরুত্ব
অনুসারে রাজাদেরকে যজ্ঞের পরামর্শ দিতেন। যজ্ঞানুষ্ঠান যাঁর জন্য করা হতো, তাঁদের
বলা হত যজমান। আর যে সকল ঋষিরা এই যথাবিহিত নিয়ম অনুসরণ করে যজ্ঞানুষ্ঠান সম্পন্ন
করতেন, তাঁদেরকে বলা হতো ঋত্বিক। যজ্ঞানুষ্ঠান হতো সাড়ম্বরে, তাতে থাকতো বিপুল
আয়োজন। ফলে এককভাবে কোনো ঋষির পক্ষে যজ্ঞানুষ্ঠান পরিচালনা সম্ভব ছিল না। তাই
অন্যান্য
ঋত্বিকরা একজন প্রধান ঋত্বিকের অধীনে অন্যান্য ঋত্বিকদের কর্মক্ষমতা বা পারদর্শিতার বিচারে
যজ্ঞের বিভিন্ন অংশ পরিচালনা করতেন। এই অনুষ্ঠানের প্রশস্তি পাঠকারীর ঋত্বিকদের বলা
হতো - হোতা। এই যজ্ঞানুষ্ঠানে কিছু
ঋষি গান পরিবেশন করতেন। এঁদের বলা হত- উদ্গাতা। সঙ্গীতোপযোগী এই পাঠের
সংকলনের নাম ছিল সাম-সংহিতা। এর বাইরে ছিল গদ্যে রচিত ব্রাহ্মণ।
কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ছন্দোবদ্ধ
শ্রুতিসমূহের সংকলনের নাম দিয়েছিলেন বেদ। বিদ্ অর্থাৎ জ্ঞান আর জ্ঞানগ্রন্থ হলো-
বেদ। আর গদ্যে রচিত জ্ঞান অংশের নাম দেওয়া হয়েছিল ব্রাহ্মণ। গদ্য-পদ্যে মেশানো
এই সাথে পরবর্তী সময়ে যুক্ত হয়েছিল, আরণ্যক, উপনিষদ।
কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ- বিষয়াঙ্গের বিচারে প্রাথমিকভাবে বেদকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। এই
ভাগ তিনটি হলো-
এর বাইরে তিনি সাঙ্গীতিক আদর্শের বিচারে অতিরিক্ত
অপর একটি বেদ যুক্ত করেছিলেন। এর নাম দেওয়া হয়েছিল সামবেদ। মূলত
যজ্ঞানুষ্ঠানে যে সকল
ছন্দোবদ্ধ ঋকসমূহ সুর-সহযোগে পরিবেশিত হতো- তার নাম ছিল সাম গান।
আর সামগানের সংকলনই হলো সামবেদ। উল্লেখ, বেদের ছন্দোবদ্ধ মন্ত্রের নাম ছিল ঋক এবং
এর সুরাংশ ছিল সাম। ছান্দোগ্য, মাণ্ডূক্য, বৃহদারণ্য
উপনিষদের আদর্শকি রূপ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায়।
বৈদিক সাম শব্দের বিশ্লেষণ
উপনিষদে সাম শব্দটিকে 'সা' এবং 'অমঃ'
দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ঋষিরা মনে করতেন- এই সা এবং অমঃ নিয়ে জগৎ সংসার সবকিছু
সৃষ্টি হয়েছে। এই সা বাক্য বা ঋক রূপে অধিষ্ঠিত হলে তার সাথে নানা রূপে অমঃ (প্রাণ)
যুক্ত হয়ে সাম তৈরি হয়। ছান্দোগ্য উপনিষদের ষষ্ঠ খণ্ডের ১-৪ শ্লোকে বলা হয়েছে-
বৃহদারণ্য উপনিষদের তৃতীয় ব্রাহ্মণে প্রাণের সর্ব্ব্যাপিত্বের মহিমা উপস্থাপন করা হয়েছে। তাই বলা হয়েছে- প্রাণই বৃহস্পতি, বাক্যই প্রাণ ২১। প্রাণই সাম , বাক্যই সাম। সা এবং অম দুই প্রাণ। সাম ২২।
তাই উপনিষদের ঋষিরা সামকে মুখ্য মন্ত্র হিসেবে গ্রহণ
করেছিলেন। এবং এই সামকে তাঁরা গীতে পরিণত করেছিলেন। উদ্গাথা নামক বৈদিক গায়করা
ঋকগুলোকে গীত রূপে পরিবেশন করতেন যজ্ঞস্থল বা আর্যপল্লীর বিভিন্ন ধর্মীয়
অনুষ্ঠানাদিতে।
সাম-কাব্য ও সাম গান
আদিতে রচিত বেদমন্ত্র বা ঋকগুলো আবৃত্তি করা হতো- আর্যপল্লীর ছোটখাটো যজ্ঞ বা
পূজাতে। শুরুর দিকে আবৃত্তি ছিল কোনো একটি সুরেলা
ওম্
ধ্বনি দিয়ে। এরপর ওই ধ্বনিকে অবলম্বন করে ঋক আবৃত্তি করা
হতো। সম্ভবত ধ্বনি বৈচিত্র্যের প্রেরণায় তা বিস্তার লাভ করেছিল তিনটি স্বরস্থানে।
সামগানের প্রারম্ভিক কালের তিনটি স্বর-
উদাত্ত, অনুদাত্ত এবং স্বরিত নামে অভিহিত করেছেন। মূলত এই তিনটি স্বর ছিল স্বরস্থান।
একালের তারা (উদাত্তা), মন্দ্র (অনুদাত্ত) এবং মধ্য (স্বরিত)।
নারদীয় শিক্ষায় বলা হয়েছে- স্বরতি স্বরকে উদাত্ত ও অনুদাত্তের মধ্যবর্তী স্বরকে বুঝানো হয়েছে। স্বরিতের দুটি প্রকারভেদের নাম ছিল- প্রচিত ও নিঘাত। সুরেলা আবৃত্তি যখন ধীরে গানে রূপান্তরিত হলো- তখন এই তিনটি স্বরস্থান থেকে চারটি সঙ্গীতোপযোগী ধ্বনি যুক্ত তৈরি হয়েছিল সাতটি শুদ্ধ স্বর। এই সূত্রে সামাগানের স্বর-সংখ্যার ভিত্তিতে যে পরিচয় দেওয়া হয়েছে স্বরান্তরের ভিত্তিতে। এখানে অন্তর হলো অবশিষ্ট। যেমন একান্তর হলো- সপ্তস্বরের ছয়টি স্বর বাদ দিলে অবশিষ্ট একটি স্বর যেমন-
এই বিচরে বাকি স্বরসংখ্যাত্তিক জাতি নির্ধিরিত হয়েছে।
স্বরের দেহস্থ অবস্থান: স্বর সমূহ উচ্চারণে দেহস্থ তিনটি অবস্থানের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো-
বৈদিক স্বরের নাম
নারদীয় শিক্ষা থেকে জানা যায় বৈদিক সাতটি স্বরের নাম জানা যায়। এগুলো হলো- প্রথম,
দ্বিতীয়, তৃতীয় চতুর্থ, মন্দ্র, ক্রুষ্ট ও অতিস্বার। বৈদিক স্বরের প্রথম স্বর ছিল
একালের মধ্যম। বৈদিক গানের রীতি ছিল- উচ্চ স্বর থেকে নিম্নগামী হওয়া। বেদভেদে
স্বরপ্রয়োগে ভিন্নতা ছিল। যেমন সামবেদের স্বর ছিল মধ্যম, ঋগ্বেদের জন্য ছিল-
গান্ধার। এই বেদে দ্বিতীয় স্বর ছিল ঋষভ, তৃতীয় স্বর ছিল ষড়্জ।
বৈদিক স্বর লৌকিক স্বরে বিচারে স্বর অবস্থান ছিল নিম্নরূপ-
| লৌকিক স্বর | বৈদিক স্বর |
| মধ্যম | প্রথম |
| গান্ধার | দ্বিতীয় |
| ঋষভ | তৃতীয় |
| ষড়্জ | চতুর্থ |
| মন্দ্র ধৈবত | পঞ্চম |
| মন্দ্র নিষাদ | ষষ্ঠ |
| মন্দ্র পঞ্চম | সপ্তম |
লক্ষ্ণীয় বিষয় বৈদিক গানে ষড়্জের পরে বব্যবহৃত হতো ধৈবত, তারপরে নিষাদ ব্যবহৃত হতো। পঞ্চম ব্যবহৃত হতো তার পরে। এই স্বর নির্ধারণের জন্য আদর্শ ধ্বনি মান গ্রহণ করতো বাঁশী।
আধুনিক মতে- স্বরের স্থান নির্ধরণ করা হয়, শ্রুতির ভিত্তিতে।
নারদীয় শিক্ষায় পাঁচটি জাতির শ্রতির উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলো হলো- দীপ্তা,
আয়তা, করুণা, মৃদ্য, ও মধ্যা।
চর্চার বিচারে সামগানগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। এগুলো হলো-
উত্তরার্চিকের ত্রিপদী মন্ত্রের প্রথম ভাগ ছিল- পূর্বার্চিকের। এর সাথে আরও তিনটি
পদ যুক্ত করে তৈরি হতো প্রগাথা। এর সাথে অতিরিক্ত দুটি পদের নাম ছিল গাথা।
বিষয়ানুসারে সামগানের নানারূপ ভাগ ছিল। যেমন-
সামগানের বাক্য অংশ, ঋক, এর সুরাংশ সাম। এই সূরের আদি ধ্বনি হলো। ঋক ও সামের সমন্বয়ে সৃষ্ট সামগান যখন যজ্ঞস্থলে দেবস্তুতিতে ব্যবহৃত হতো- তখন তাকে বলা হতো উদ্গীথ গান। এই উপনিষদের প্রথম খণ্ডের তৃতীয় অধ্যায়ের বলা হয়েছে- উদ্গীথের সুর বা অক্ষরসংখ্যা ৩টি। এগুলো উৎ, গীঃ এবং থ। এই তিনটি অক্ষর প্রতীকী। নানা কারণে এই অক্ষরসমূহ নানা অর্থে প্রকাশিত হয়েছে। যেমন-
শুরুর দিকে সামবেদের যজ্ঞীয় ঋষিদের একটি দল, প্রার্থনা সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। এই গানই সামগান নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। সামগান পরিবেশনকারীদের বলা হলো উদ্গাথা। এদের পরিবেশিত গানগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। এগুলো হলো- গ্রামগেয়, অরণ্যগেয় উহ্য এবং উহ। এসকল গানের ভিতরে গ্রামগেয় গানগুলো ছিল- মূলত লোকগান। এই গান গৃহবাসী সাধারণ মানুষের গান। এই গান থেকে তৈরি হয়েছিল গান্ধর্ব বা মার্গসঙ্গীত।
উৎ গীঃ থ প্রাণ
বাক্ অন্ন দৌঃ অন্তরীক্ষ পৃথিবী আদিত্য বায়ু অগ্নি সামবেদ যজুর্বেদ ঋগ্বেদ
২. ওম্ ধ্বনির মধ্য দিয়ে- উদ্গীথ গানের শিল্পীরা তাঁদের কণ্ঠকে সুস্থির আনার
সুযোগ লাভ করতেন।
৩. ওম্ ধ্বনিকে শিল্পীরা আধ্যত্মিক দর্শনে দেখতেন। ওঙ্কার ধ্বনি সমার্থ ধ্বনি
হিসেব এই ধ্বনির মাধ্যমে ঋষিরা পরমব্রহ্মের বন্দনা করতেন। ছন্দোগ্য উপনিষদের
নির্দেশও ছিল- 'ওম্' অক্ষরকে উদ্গীথ
রূপে উপাসনা করিবে। সব মিলিয়ে ওম ধ্বনি ছিল একসাথে সাঙ্গীতিক এবং আধ্যত্মিক চেতনার
বাহক।
৪. যজ্ঞানুষ্ঠানের কোলাহলকে স্তব্ধ করে দিয়ে সাঙ্গীতিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ওম্
ধ্বনি অপরিহার্য ধ্বনি হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
ঋগ্বেদের দশমণ্ডলীর প্রথম মণ্ডলে রয়েছে ১৯১টি সূক্ত এবং ২০০৬টি ঋক্। এর দ্বিতীয় থেকে সপ্তম মণ্ডলীর বেশিরভাগ মন্ত্র গায়ত্রী, ত্রিষ্টূপ এবং যাজ্ঞিক ছন্দে রচিত হয়েছিল যাজ্ঞিক পুরোহিতদের জন্য। অষ্টমণ্ডলীর (প্রথাগতমণ্ডল) উদগাত্রী পুরোহিতদের জন্য রচিত হয়েছিল।
সামগানের বাদ্যযন্ত্র: বৈদিক গ্রন্থাদিতে পাওয়া যায়, নানাধরনের বাদ্যযন্ত্রের কথা। এ সকল যন্ত্রের তালিকায় পাওয়া যায় নানা ধরনের চামড়ার দ্বার আচ্ছাদিত বাদ্যযন্ত্র, তন্ত্রীযুক্ত বীণা এবং বাঁশীর কথা। চামড়ায় আচ্ছাদিত বা আনদ্ধ যন্ত্র হিসেবে ঋগ্বেদে পাওয়া যায় যে সকল বাদ্যযন্ত্রের নাম পাওয়া যায়, তাহলো-
সাম গান ও সামবেদ
সামবেদের এর তিনটি শাখা রয়েছে। এগুলো হলো-
সামবেদের স্ত্রোতগুলো দুটি ভাগে বিভাজিত। ভাগ দুটি হলো-আর্চিক এবং স্তৌভিক।
সামগানের বিবর্তন:
সামগানের চর্চা মহাকাব্যিক (খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৩০০ অব্দ) যুগে ছিল। আরণ্যগেয়, উহ
ও উহ্য ছিল গোপন গান। সম্ভবত এ গান লোকসমাজের বাইরে চর্চিত হতো। কালক্রমে তা
বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু গ্রামগেয় গানের চর্চা লোকসমাজে ছিল। এই গানের বিকাশ ও
উন্নীত হয়েছিল- গন্ধর্বদের সঙ্গীত চর্চার মধ্য দিয়ে। এবং
গান্ধর্ব গানের
বিকাশের সূত্রে বৈদিক তথা সামগান বিলুপ্ত হয়ে যায়।
সামবেদ, উপনিষদসমূহ বা অন্যান্য গ্রন্থাদিতে সামগানের সামগ্রিক
রূপ রেখা পাওয়া যায় না।