গান্ধর্ব সঙ্গীত
প্রাচীন ভারতের সঙ্গীত বিশেষ। গন্ধর্বজাতির সাথে সম্পর্কিত বা গন্ধর্বদের দ্বারা বিকশিত সঙ্গীতকে বলা গান্ধর্ব-সঙ্গীত।

বর্তমান আফগানিস্তান পাকিস্তানের কাবুল ও সোয়াত নদীর তীরে, খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০-১২০০ অব্দের থেকে গান্ধার রাজ্য গড়ে উঠেছিল। অনেক সময় এই রাজ্যকে প্রাচীন ভারতের ১৬ জনপদের অন্যতম জনপদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনিতে এই রাজ্যের দুটি বিখ্যাত নগরী কথা জানা যায়। এই নগর দুটি হলো- তক্ষশীলা  ও পুস্করাবতী।

গন্ধর্বদের মাধ্যমে গান্ধর্ব-গানের বিকাশ শুরু হয়েছিল বৈদিক যুগের শেষের দিকে, অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দের দিকে। ধারণা করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৫০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময় তথা বৈদিকোত্তর যুগে রচিত হয়েছিল বাল্মীকি রামায়ণ। এই সময় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বৈদিক গানের পাশাপাশি আর্যপল্লীর দেশী গান ও অনার্য লোকগানের চল ছিল। এদের ভিতরে গন্ধর্বরা সঙ্গীতে সবচেয়ে অগ্রগামী ছিল। এদের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছিল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আদি রূপ।

রামায়ণের যুগে গন্ধর্ব সঙ্গীত

রামায়ণের যুগে সামগানের প্রচলন ছিল। কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডের ২৮তম সর্গের ৫৪তম শ্লোকে সামগানের উল্লেখ পাওয়া যায়। উত্তরকাণ্ডের ১৬তম সর্গের ৩৩-৩৪তম শ্লোকে অনার্য (রাক্ষস) মহাদেবের স্তুতি করেছেন সামগানের দ্বারা। বাল্মীকি রামায়ণের আদিকাণ্ডের চতুর্থ সর্গে উল্লেখ আছে, বাল্মীকি রামের দুই পুত্র কুশী ও লবকে রাম-সীতার চরিত্রসহ রাবণ-বধ নামক কাব্য শেখান। কুশীলব এই কাব্য পাঠ করা ও গান হিসেবে পরিবেশন করার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে রামায়ণের এই অধ্যায়ে বলা হয়েছে- এই পাঠ ও গান মধুর, দ্রুত, মধ্য ও বিলম্বিতরূপে ত্রিবিধ-প্রমাণ-সংযুক্ত ষড়্‌জ ও মধ্যম প্রভৃতি সপ্তস্বর-সংযুক্ত, বীণালয় বিশুদ্ধ এবং শৃঙ্গার, করুণ, হাস্য, রৌদ্র, ভয়ানক ও বীর প্রভৃতি সমুদয়-রসসংযুক্ত। স্থান ও মূর্চ্ছনাভিজ্ঞ, গান্ধর্ব্ববিদ্যাভিজ্ঞ কুশী ও লব তাহা গাহিতে লাগিলেন। সুন্দরকাণ্ডের প্রথম সর্গে ১৭০তম অধ্যায়ে রয়েছে- হনুমান সীতাকে রাবণের নিকট থেকে এনে রামের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আকাশপথে যাত্রা করেন। এই যাত্রাপথের বর্ণনায় পাওয়া যায় -'গীতনিপুণ গন্ধর্বগণে সমাবৃত..'।

এই অংশ থেকে ধারণা করা যায়- রামায়ণের যুগে গান্ধর্বগানের প্রচলন ছিল। এই গানে সপ্তসুর, গ্রাম, মূর্চ্ছনার ব্যবহার ছিল। নাট্যশাস্ত্রে বর্ণিত রসসমূহের গন্ধর্বগানে প্রয়োগ করা হতো। তবে রামায়ণের যুগে রাগের উৎপত্তি ঘটেছিল কিনা এ বিষয়ে সুষ্পষ্ট কোনো উল্লেখ নেই। কুশী ও লব ছিলেন চারণ গায়ক। আর্য-অনার্য গানের প্রভাব তাদের গানে ছিল বলে অনুমান করা যায়। এই দুই সঙ্গীতশিল্পী গান শেখার পর, গুরু বাল্মীকির আদেশে এঁরা সুর ও ছন্দে রামায়ণের কাহিনি পরিবেশন করতেন- লোকসুরে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রধান উপকরণ রাগের উৎপত্তি তখনো হয় নি।

রাময়ণে যুগে প্রচলিত বেশকিছু বাদ্যযন্ত্রের নাম পাওয়া যায়। আদিকাণ্ডের পঞ্চম স্বর্গের ১৮তম শ্লোকে রয়েছে- দুন্ধুভি, মৃদঙ্গ, বীণা ও পণব।

জাতকের যুগে গন্ধর্ব সঙ্গীত
খ্রিষ্টপূর্ব ৫৬৭ বা ৫৬৩ অব্দে গৌতমবুদ্ধের জন্ম হয়েছিল- রামায়ণের যুগে। মৃত্যু হয়েছিল ৪৮৭-৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। গৌতমবুদ্ধের পূর্বজীবনের কাহিনিগুলো রচিত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে। প্রায় ৫০০টি জাতকের মধ্যে ১৫টি জাতকে গান সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায়। এই জাতকগুলো হলো- নৃত্য, ভেরীবাদক, বিশ্বম্ভর, কুশ, অসদৃশ্য, সর্বদ্রষ্ট, গুপ্তিল, ভদ্রঘট, বীণাস্থূণা, চুল্লু-প্রলোভন, ক্ষান্তিবাদি, কাকবতী, শঙ্খ, মৎস, বিদুরপণ্ডিত। এসকল জাতকে সঙ্গীতে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। গুপ্তিল জাতকে উত্তম ও মধ্যম মূর্ছনার নাম পাওয়া যায়। এ সকল গ্রন্থে কোনো রাগের নাম পাওয়া যায় না।

মূলত বৌদ্ধ ধর্মের দ্রুত বিকাশে, সনাতন ধর্মাবলম্বীরা কোনঠাসা হয়ে পড়েছিল। গন্ধর্বরা ছিল মূলত বৈদিক ধর্মে দীক্ষিত। এঁরা সঙ্গীতকে গ্রহণ করেছিল ধর্মাচরণের অনুষঙ্গ হিসেবে। বৌদ্ধ ধর্ম সঙ্গীত-চর্চা নিষিদ্ধ ছিল না। এঁদের ধর্মগুরুরা গানের মধ্য দিয়ে ভক্তি প্রকাশের চেয়ে ধ্যন ও জ্ঞানের  চর্চার মধ্য দিয়ে নির্বাণ লাভের চেষ্টায় নিমগ্ন হয়ে পড়েছিল।

গান্ধর্ব গানের স্থবির কাল

গান্ধর্ব রাজ্যের স্বাভাবিক পরিস্থিতি বার বার বিঘ্নিত হয়েছে বহিরাগতদের দ্বারা। এই অঞ্চল মূলত পারশ্যের রাজাদের কাছে একটি লোভনীয় অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল। এছাড়া অন্যান্য জাতিদের ভারত আক্রমণের প্রাথমিক অঞ্চল হিসেবেও গান্ধার রাজ্যকে প্রাথমিক আক্রমণের আঘাত সহ্য করতে হয়েছে। বৈদিক যুগোত্তর কালের প্রথম দিকে এই অঞ্চল আক্রমণের শিকার হয়েছিল- পারশ্যের রাজাদের দ্বারা। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০-৪৬৫ অব্দের ভিতরে পারশ্যে রাজারা এই অঞ্চলে অনেকগুলো সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। ঐতিহাসিক প্লিনির মতে খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০-৫৩০ অব্দের ভিতরে পারশ্য সম্রাট কাইরাস ভারতে কয়েকবার আক্রমণ করেন এবং কপিশা নগরী দখল করতে সমর্থ হন। আরিয়ান নামক অপর একজন ঐতিহাসিকের মতে- কাইরাস কাবুল ও সিন্ধু নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল দখল করে নেন এবং এই অঞ্চল থেকে কর আদায় করতেন। কাইরাসের তৃতীয় উত্তরসূরী সম্রাট প্রথম দারায়ুস খ্রিষ্টপূর্ব ৫২২ অব্দ থেকে ৪৮৬ অব্দের ভিতরে গান্ধার, সিন্ধু-উপত্যাকা এবং পাঞ্জাব দখল করেন। এরপর জারেক্সিস খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৬ অব্দ পর্যন্ত এই অঞ্চলের উপরে আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হন। এই সময় এই অঞ্চলের অন্যান্য এলাকার সাথে তক্ষশিলাও পারশিকদের অধিকারে ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০৫ অব্দের দিকে চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন তক্ষশীলা পরিদর্শন করেন এবং এই স্থানকে অত্যন্ত পবিত্র এলাকা হিসাবে উল্লেখ করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে আলেকজান্ডার সিন্ধু নদ পার হয়ে তক্ষশিলায় প্রবেশ করেন। এই সময় তক্ষশিলার রাজা অম্ভি আলেকজান্ডারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে তক্ষশিলায় অভ্যর্থনা করেন। এরপর অভিসার জাতির নেতাও আলেকজান্ডারের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে। এরপর আলেকজান্ডার তক্ষশিলা থেকে পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে ঝিলম নদী পার হয়ে পুরুর রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন। আলেকজান্ডারের ভারত ত্যাগের আগে ঝিলম ও বিপাশা নদীর মধ্যাভাগের অঞ্চল পুরুকে এবং সিন্ধু ঝিলম নদীর মধ্যভাগের অঞ্চল অম্ভির কাছে ছেড়ে দেন। এরপর চন্দ্রগুপ্তের গুরু এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কৌটিল্যের (চাণক্য)  পৃষ্ঠপোষকতায় তক্ষশিলায় রাজত্বের পত্তন করেন চন্দ্রগুপ্ত। কালক্রমে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বিশাল রাজত্বের অধিকারী হন। চন্দ্রগুপ্ত তাঁর পুত্র বিন্দুসারে কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পর, তক্ষশীলাবাসী রাজশক্তির অত্যাচরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিন্দুসারে নির্দেশে তাঁর যুবরাজ অশোক তক্ষশীলার বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করেন। খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩ অব্দের দিকে অশোক রাজত্ব লাভ করেন। তখন মৌর্য রাজাদের রাজধানী ছিল পাটালীপুত্র। কিন্তু তক্ষশিলা বৌদ্ধ সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল।

খ্রিষ্টাপূর্ব ১৮৫ অব্দের দিকে শেষ মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করেন তাঁর সেনাপতি পুষ্যমিত্র। এই সময় মৌর্য সম্রাট বৃহদ্রথের আত্মীয় যজ্ঞসেন বিদর্ভের স্বাধীন রাজা হিসাবে ঘোষণা দেন। পুষ্যমিত্রের সাথে যজ্ঞসেনের বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হলে, যজ্ঞসেন পরাজিত হন। পরে যজ্ঞসেনের দুই আত্মীয়ের ভিতর বিদর্ভরাজ্যকে ভাগ করে দেওয়া হয়। পুষ্যামিত্রের রাজত্বকালে গ্রিকরা তাঁর রাজ্য আক্রমণ করলে, গ্রিকরা পরাজিত হয়। পুষ্যামিত্র বৌদ্ধধর্ম-বিদ্বেষী ছিলেন। ফলে তাঁর সময় তক্ষশীলা গুরুত্ব হারাতে থাকে। অনেকে মনে করেন এই সময় তক্ষশীলারা বৌদ্ধ-স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৯ অব্দে পুষ্যামিত্র পরলোক গমন করার পর, তাঁর পুত্র অগ্নিমিত্র বিদিশার ক্ষমতা দখল করেন এবং বিদর্ভরাজকে পরাজিত করেন। অগ্নিমিত্রের পর পর এদের উত্তরপুরুষরা রাজত্বের সমৃদ্ধিকে বজায় রাখতে ব্যর্থ হন। এই বংশের শেষ সম্রাট সুমিত, মুলাদেব নামক এক আততায়ীর হাতে নিহত হন। এরপর এই অঞ্চলে শুঙ্গবংশের রাজত্ব শুরু হয়। এই রাজবংশের রাজত্বকালে গ্রিকরা তক্ষশীল দখল করে নেয়। এরপর শকদের কাছে গ্রিকরা ক্ষমতা হারায় এবং তক্ষশিলা শকদের অধীনে চলে যায়।  এপর শকদের উৎখাত করে ভারতে আধিপত্য বিস্তার করে কুষাণ রাজবংশ। কুষাণদের রাজ্য বিস্তারের সময় তক্ষশীলা ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তী সময় কুষাণ রাজবংশের শাসনমলেই তক্ষশিলা আবার তার পুরানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে থাকে। কালক্রমে তক্ষশীলা বৌদ্ধদের বিহার ও শিক্ষাকেন্দ্রে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠে। বৌদ্ধ রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে, হিন্দু রাজারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তশালী হয়ে উঠে। বৌদ্ধধর্ম-বিদ্বেষী রাজাদের দ্বারা তক্ষশীলা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এছাড়া পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-ছাত্র হীন কাঠামোতে পরিণত হয়। এবং তক্ষশীলা জন-পরিত্যাক্ত নগরীতে পরিণত হয়।

৪৫০ খ্রিষ্টাব্দে তক্ষশীলায় সর্বশেষ আক্রমণটি আসে হুনদের পক্ষ থেকে। এরপর পুরো তক্ষশীলা ধীরে ধীরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এই সময়ের ভিতরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছিল। এসব রাজ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- কোশল, অবন্তী, বৎস, মগধ, চেদি, মৎস্য, শৌরসেন, গান্ধার, কাম্বোজ, অস্বক, ইত্যাদি। প্রাচীন গ্রন্থাদি অনুসরণে এসকল রাজ্যের ভিতর গান্ধার ছাড়া, অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গীতচর্চা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় না। পুরাণ ও অন্যান্য সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থাদিতেও গন্ধর্ব গানের পরিচয় পাওয়া যায়। মূলত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বৈদিক গান ও অনার্য লোক গানের চর্চা ছিল। এদের ভিতরে গান্ধার অঞ্চলের গান উৎকৃষ্ট পর্যয়ে পৌঁছেছিল। বিশেষ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিকাশ ঘটেছিল গন্ধর্ব নারদ, হাহা, হুহু প্রমুখ সঙ্গীতগুরুদের মাধ্যমে।

এই সময়ের মধ্যে মহাভারত ও বেশ কিছু পুরাণ রচিত হয়েছিল। এ সকল গ্রন্থাদিতে গন্ধর্বদের সঙ্গীত চর্চা অব্যাহত ছিল, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

পৌরাণিক যুগের গন্ধর্ব-সঙ্গীত
পুরাণসমূহের ভিতরে সর্বপ্রাচীন পুরাণ হিসেবে পাওয়া মার্কেণ্ডে পুরাণকে মান্য করা হয়। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে মার্কণ্ডেয় পুরাণের রচনা করেছিলেন বেদব্যাস। তবে এই বেদব্যাস এবং মহাভারতের রচয়িতা বেদব্যাস একই ব্যক্তি ছিলেন না।  মার্কেণ্ড ঋষির নামানুসারে রচয়িতা এর নামকরণ করেছিলেন 'মার্কেণ্ডয় পুরাণ'।

এই পুরাণের প্রথম অধ্যায়েই নৃত্যগীতের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেখানে ইন্দ্র দেবর্ষি নারদকে প্রসঙ্গান্তরে অনুরোধ করেন যে- সভায় উপস্থিত রম্ভা, মিশ্রেকেশী, উর্বশী, তিলোত্তমা, ঘৃতাচী, মেনকা প্রভৃতির মধ্যে যে কাউকে নৃত্য পরিবেশন করার জন্য নারদ আদেশ করতে পারেন। এরপর নারদ অপ্সরাদের উদ্দেশ্যে বলেন যে- 'তোমাদের ভিতরে নিজেকে সকলের চেয়ে রূপ, গুণ ও ঔদার্যশালিনী বলে জ্ঞান আছে- সেই আমার সামনে নৃত্য করুক। কেন না গুণরূপহীনা রমণীর কোনো সিদ্ধিলাভ সম্ভব নয়।' মূলত এই অধ্যায়ে নৃত্যশিল্পী হতে গেলে প্রাথমিক ভাবে রূপ (দেহগত সৌন্দর্য), গুণ (যথাযথ নৃত্য পরিবেশনের ক্ষমতা) এবং নৃত্য শিল্পীর উদারভাবে নিজেকে নিবেদন করা অর্থে বলা হয়েছে ঔদার্যশালিনী।

২৩তম অধ্যায়ে নাগরাজ অশ্বতর কঠোর তপস্যার দ্বারা দেবী সরস্বতীকে তুষ্ট করেন। দেবী তাঁকে এবং তার ভাই কম্বলকে বর দিয়ে বলেন যে- '‌নাগরাজ, তোমরা দুজনে, সপ্তস্বর, সপ্তগ্রামরাগ, সপ্তবর্গ, সপ্তগীত ও সপ্তমুর্চ্ছনা, একান্নটি তাল, তিনটি গ্রাম পরিবেশন করতে পারবে'। এর বাইরে সরস্বতী দুই ভাইকে- চার প্রকার পদ, তিন প্রকার তাল, তিন প্রকার লয়, তিন প্রকার যতি, চার প্রকার তোদ্য দান করেন। এই অধ্যায় থেকে এসকল বিষয়ে বিস্তারিতভাবে কিছু যায় না। এমনকি উল্লেখিত স্বর, গ্রামরাগ ইত্যাদির নামও পাওয়া যায় না।

১০৬ সংখ্যক অধ্যায়ের শেষে- সূর্যের তেজ প্রশমিত করার সূত্রে সঙ্গীতশিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- 'এরপর, ষড়্‌জ, মধ্যম, গান্ধার ও তানত্রয় বিশারদ এবং গন্ধর্বনিপুণ হাহাহুহু, নারদ ও তুম্বুরু মিলিত হয়ে- মূর্চ্ছনা ও তাল সহযোগে সুখপ্রদ বাক্যে স্তবগানে প্রবৃত্ত হলেন।' এ ছাড়া এই অধ্যায়ে পাওয়া যায় বেশকিছু বাদ্যযন্ত্রের নাম। এই তালিকায় যে নামগুলো পাওয়া যায়, তাহলো- বেণু, বীণা, দর্দ্দুর, পণব, পুষ্কর, মৃদঙ্গ, পটহ, আনক, দেবদুন্দুভি ও শঙ্খ। এই অনুষ্ঠানে গন্ধর্বরা গান এবং অপ্সরারা নৃত্য পরিবেশন করেছিলেন।

মার্কণ্ডেয় পুরাণের সূত্রে জানা যায়, পৌরাণিক যুগের খ্রিষ্টীয় ৩য় শতাব্দীতে ষড়্‌জ, মধ্যম ও গান্ধার গ্রাম এবং সাত প্রকার মূর্চ্ছনার প্রচলন ছিল। সেই সাথে এই সময়ের সাতটি গ্রাম রাগের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। সেকালের গান্ধার গানের প্রচলন ছিল। হাহাহুহু, নারদ ও তম্বুরুকে গন্ধর্বনিপুণ শিল্পী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

বায়ুপুরাণে সঙ্গীত

প্রাচীনত্বের বিচারে বায়ুপুরাণকে দ্বিতীয় স্থান দেওয়া হয়। এই পুরাণের রচনাকাল ধরা হয় আনুমানিক খ্রিষ্টীয় তৃতীয় থেকে পঞ্চম শতাব্দী। এই পুরাণের ৮৬তম ও ৮৭তম অধ্যায়ে সঙ্গীত বিষয়ক তথ্যাদি পাওয়া যায়।

৮৬তম অধ্যায়ে সঙ্গীতের স্বরমণ্ডল সম্পর্কে বলা হয়েছে- স্বর সাতটি, গ্রাম তিনটি, মূর্ছনা ২১টি এবং ৪৯টি তান নিয়ে স্বরমণ্ডল গঠিত হয়। স্বরমণ্ডের স্বরগুলো হলো- ষড়্‌জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ। বায়ু পুরাণে ৩টি গ্রামের নাম পাওয়া যায়। এগুলো হলো- ষড়্‌জ গ্রাম, মধ্যম গ্রাম ও গান্ধার গ্রাম। এই গ্রামের মূর্ছনাগুলো হলো-
ষড়্‌জ গ্রাম:: উত্তরমন্দ্রা, রজনী, উত্তরা আয়তা ‌ও শুদ্ধষড়ুজা। বাকি দুটি ২টি মূর্ছনার নাম পাওয়া যায় না। মধ্যম গ্রাম: সৌবীরী, হরিণাস্যা, কলোপবলা, শুদ্ধ মধ্যমা, শাঙ্গী, পাবনী ও দৃষ্টকা।
গান্ধার গ্রাম: আগ্নিস্টোমিক, বাজপেয়িক, পৌণ্ড্রক, আশ্বমেধিক, রাজসূয়, চক্রসুবর্ণক, গোসন, মহাবৃষ্টিক, ব্রহ্মদান, প্রাজাপত্য, নাগপক্ষাশ্রয়, গোতর, হয়কান্ত, মৃগকান্ত, বিষ্ণুক্রান্ত, সূর্যকান্ত, সাবিত্র, অর্ধসাবিত্র, সর্বোতভদ্র, সুকর্ণ, সুতন্ত্র, বিষ্ণুবর, সাগর, বিজয়, হংস, অঘাত, বিকল, উপনীত, বিনত, শ্রী, অভিমন্যু, ও পুণ্যরক।
বায়ু পুরাণে যে সকল মূর্চ্ছনার নাম পাওয়া যায়, সেগুলো প্রকৃতপক্ষে মূর্ছনা না তান, এ নিয়ে সংশয় আছে। বায়ু পুরাণে কিছু মূর্চ্ছনার নামের অর্থ এবং এদের অধিদেবতার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন-
সৌবীরী: ব্রহ্মা সৌবীরীরা সাথে গান্ধারী গান করেন। অধিদেবতা ব্রহ্মা
হরিয়াশ্যা: হরিদেশে উৎপন্ন। এর অধিদেবতা ইন্দ্র
কলোপনতা: মরুদগণ স্বরমণ্ডল থেকে কর (হাত) প্রসারণ করে এই মূর্চ্ছনা গ্রহণ করেছিলেন। অধিদেবতা মরুদগণ।
শুদ্ধ মধ্যমা: মরুদেশজাত। এর স্বর শুদ্ধমধ্যম। অধিদেবতা গন্ধর্ব।
মার্গী: সিদ্ধগণের পথ পরিদর্শনকালের সময় মৃগের (হরিণ) সাথে বিচরণ করে। অধিদেবতা মৃগেরন্দ্র।
রজনী: রজোগুণ দ্বারা মূর্চ্ছানা যোজিত হয়। অধিদেবতা ষড়্‌জ।
উত্তরমন্দ্রা: উত্তর তালও প্রথম তালের মতো। অধিদেবতা ধ্রুব।
উত্তরায়ণ: বিস্তার ও উত্তরত্ব প্রযুক্ত ধৈবত। অধিদেবতা শ্রাদ্ধীয় পিতৃগণ
শুদ্ধ ষড়ুজিক: মহর্ষিগণ শুদ্ধ ষড়ুজ স্বরে অগ্নিয় উপাসনা করেন।
যাক্ষিকা: যক্ষীগণ পঞ্চম স্বরের মূর্চ্ছনা দ্বারা সাধুগণের মোহ জন্মিয়েছিলেন।
অহিমূর্চ্ছনা: এই মূর্চ্ছনা শ্রবণে বিষধর অহি (সাপ) মুগ্ধ হয়ে পড়ে। অধিদেবতা বরুণ। এই মূর্ছনা জলমধ্যে লীন ছিল। জলদেবতা বরুণ এই মূর্চ্ছনা উদ্ধার করেছিলেন।
শকুম্ভক: কিন্নরগণ পাখির সুরের অনুকরণে গাওয়া হয়। অধিদেবতা পক্ষিরাজ।
মন্দনী: স্নাতক ঋষিদের মনো দ্রবীভূত করে করে। অধিদেবতা বিশ্বদেবগণ।
অশ্বক্রান্তা: এর গতি অশ্বের ন্যায় এবং এই মূর্চ্ছনা শ্রবণে অশ্বগণ প্রীত হয়। অধিদেবতা অশ্বিনীকুমারদ্বয়।
বিশুদ্ধা গান্ধারী: গান্ধার রাগে ব্যবহৃত হয়। অধিদেবতা গন্ধর্ব।
উত্তরা গান্ধারী:
গন্ধারী স্বরের পরে এর উদ্ভব হয়েছিল। অধিপতি বসুগণ
এই পুরাণের ৮৭ অধ্যায়ে তিনশত অলঙ্কারের কথা বলা হয়েছে। অলঙ্কারে সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- নিজ নিজ অনুগুণ বর্ণ ও পদসমূহের যোগবিশেষকে অলঙ্কার বলা হয়। অর্থাৎ পদ ও বাক্য যুক্ত হলে, অলঙ্কার প্রকাশ পায়। এই অধ্যায়ে স্বরের উৎপত্তিস্থল হিসেবে মন্দ্র, মধ্য ও তারা স্বরের স্থান হিসেবে বলা হয়েছে, যথাক্রমে বক্ষ, কণ্ঠ ও মস্তক। প্রকৃতিগতভাবে বর্ণ চার প্রকার। তবে এর বিচারও চারপ্রকার।  কিন্তু দেবতাদের বর্ণ ১৬ প্রকার। কিন্তু বর্ণতাত্ত্বিকদের মতে- বর্ণ চার প্রকার। এগুলো হলো- এছাড়া আরও চারটি বর্ণের উল্লেখ রয়েছে এই গ্রন্থে। এগুলো হলো- স্থাপনী, ক্রমরেজিনী, প্রমাদ ও অপ্রমাদ। এরপর বায়ুপুরাণ স্বরের বিচার করা হয়েছে। এগুলো হলো- উষ্ট্রলেখ্য, আবর্ত্ত, কুমার, শ্যেন, সবিন্দু।

কলাপ্রমাণে ১২ ধরণের বিন্দুর উৎপন্ন হয়। এদের ভিতরে দ্বিকলাত্মককে বলা হয়- ঘ্রাসিত স্বর। এর উচ্চারণে দুটি স্বর পরিত্যক্ত হয়।আর চার কলাত্মককে বলা হয়েছে মক্ষিপ্রচ্ছাদন।

বায়ুপুরাণে গানকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে-  ভাগ দুটি হলো-  প্রকার দুটি হলো- গীত ও বহির্গীত।
গীত: স্বরসমূহের যথাযথ আলাপনে গীতের সৃষ্টি হয়ে।
বহির্গীত: গীত যদি তার নির্দিষ্ট স্বরের মধ্য দিয়ে অন্য স্বরে পৌঁছায়, তখন তাকে বহির্গীত বলা হয়। এর অধিপতি পঞ্চদেবতা। ধ্বনিময় সঙ্গীতের আদি, মধ্য ও অন্ত্যে অলঙ্কার কৌশলের মধ্যে বিচিত্র রীতিতে প্রকাশ পায়। পদানুক্রমে সাতটি স্বর থেকে অপরাপর কতকগুলো শব্দের বা স্বরের সৃষ্ট হয়।
গীত ও বহির্গীত ছাড়া বায়ু পুরাণে মদ্রকগীতের উল্লেখ রয়েছে। পঞ্চম, মধ্যম, ধৈবত, নিষাদ ও ষড়্‌জ স্বরগুলোতে ঐ ধরণের মদ্রক করা যায়। এই গানে স্বরান্তর গীত হয় না। প্রকৃত গীতে (কণ্ঠসঙ্গীত)  ও বাঁশীর সুরে প্রযুক্ত গান্ধারাংশ অনুসারে অপরান্তিক ও আট রকমের 'শুল্ল' নামক গানের প্রকারভেদ তৈরি হয়। অপরান্তিক ও আট রকমের 'শুল্ল' গীতের কোনো বিবরণ বায়ু পুরাণে পাওয়া যায় না।

উল্লেখিত গ্রন্থাদি অনুসারে গন্ধর্বসঙ্গীতের ধারণা পাওয়া যায়- অগোছালোভাবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রসঙ্গক্রমের গীত-বাদ্য-নৃত্যের কথা পাওয়া যায়। প্রকৃত সঙ্গীত শিক্ষার উপযোগী গ্রন্থের হলো- নারদের 'শিক্ষা নামক গ্রন্থ। সম্ভবত খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর দিকে গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল। নারদ মূলত গন্ধর্ব গানেরই পরিচয় দিয়েছেন এই গ্রন্থে। এই গ্রন্থ থেকে যে সকল সঙ্গীতবিষয়ক যে সকল তথ্য পাওয়া যায়, তা হলো- বৈদিকযুগের সঙ্গীত বিষয়ক পাঠ পাওয়া যায় বিভিন্ন 'শিক্ষা' গ্রন্থে। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য শিক্ষাগুলো ছিল- পাণিনীয় শিক্ষা, যাজ্ঞবল্ক্য শিক্ষা, মাণ্ডূক্য শিক্ষা ও নারদীয় শিক্ষা।

নারদীয় শিক্ষা
ধারণা করা হয় খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে নারদ এই রচনা করেছিলেন 'শিক্ষা' নামক গ্রন্থ। তিনি মুলত খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রচলিত বিধিগুলোকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

শিক্ষা গ্রন্থ থেকে জানা যায় সামগানের পরিচয়। মূলত তিনি গানকে সামবেদ ও ছান্দগ্য উপনিষদের আলোকে এই ব্যাখ্যা করেছেন। এই গানে পাওয়া যায় লৌকিক গানের পরিচয়। মূলত বৈদিক গানের আমলে পৃথক গান হিসেবে লৌকিক গান বিকশিত হয়েছিল। নারদ তাঁর গ্রন্থে বৈদিক গানের বাইরে লৌকিক গান নিয়ে আলোচনা করেছেন- দুটি ভাগে ভাগ করে। এই একটি হলো- মার্গ সঙ্গীত। এই সঙ্গীত ছিল বিধিবদ্ধ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। দ্বিতীয় ভাগে ছিল দেশী গান। উভয় গানের বিচারে নারদ গ্রাম, মূর্চ্ছনা অলঙ্কার নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তিনি স্বরমণ্ডল নিয়ে প্রথম আলোকপাত করেন। তাঁর মতে- সাতটি স্বর, তিনটি গ্রাম, ২১টি মূর্চ্ছনা এবং ৫১টি তানের সমবেত রূপ হলো স্বরমণ্ডল। ধারণা করা হয়- তিনটি গ্রামের (ষড়্‌জ, মধ্যম, গান্ধার) ভিতরে গান্ধার গ্রামের ব্যবহার ছিল না।

নারদীয় শিক্ষায়, স্বরের স্থান হিসেবে নারদ উল্লেখ করেছেন- উর, কণ্ঠ, শির (উদারা, মুদারা, তারা)। এই সময়ে স্বরগুলোর বৈদিক নামের পরিবর্তে লৌকিক নামে (ষড়্জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত, নিষাদ) পরিচিত হয়ে উঠেছিল। এছাড়া স্বরের সংখ্যার উপর গানের জাতি (আর্চিক, গাথিক, সামিক, স্বরান্তর ঔড়ুব, ষাড়ব ও সম্পূর্ণ) নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।

নারদীয় শিক্ষায় ৫টি শ্রুতির নাম পাওয়া যায়। এই শ্রুতিগুলো হলো- দীপ্তা, আয়তা, করুণা, মৃদু ও মধ্যা।

নারদ বৈদিক ও লৌকিক গানের ১০টি প্রকার গুণের কথা উল্লেখ করেছেন। এই গুণগুলো হলো- রক্ত, পূর্ণ, অলঙ্কৃত, প্রসন্ন, ব্যক্ত, বিক্রুষ্ট, শ্লক্ষ্ণ সুকুমার ও মধুর। এই ১০টি গুণের দ্বারা সমন্বিত রূপ তালকে পূর্ণ রূপ প্রদান করে। যে সকল দোষ থাকলে গান সুমুধুর হয় না, তার তালিকা নারদ এই গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এগুলো- শঙ্কিত, কম্পিত, কাকস্বরবৎ কর্কশ, অতি উচ্চ, তীক্ষ্ণ, বিরস ও ব্যকুলিত।

নারদ বৈদিক ও লৌকিক সাত স্বরের উৎপত্তির উৎস এবং শরীরের স্থানকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। এই সাথে স্বরগুলোর অধিদেবতাদের নাম উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে- এই উৎপত্তির উৎস এবং শরীরের স্থানগুলো হলো-
স্বরের নাম উৎস (পশুপাখির কণ্ঠস্বর) শরীরের স্থান অধি দেবতা
ষড়্‌জ ময়ুর কণ্ঠ অগ্নি
ঋষভ বৃষ শির অগ্নি
গান্ধার ছাগ নাসিকা সোম (সন্দ্র)
মধ্যম সারস উরু বিষ্নু
পঞ্চম কোকিল উরু, শির কণ্ঠ নারদ
ধৈবত হাতি ললাট তম্বরু
নিষাদ ঘোড়া সর্বসন্ধি তন্বুরু

নাট্যশাস্ত্র ও গন্ধর্ব গান।
এই গ্রন্থের অষ্টাবিংশ থেকে  ত্রয়স্ত্রিংশ অধ্যায় পর্যন্ত সঙ্গীত-বিষয়ক বিবরণ পাওয়া যায়। অষ্টাবিংশ অধ্যায়ে চার প্রকার বাদ্যযন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো- এ সকল যন্ত্র ব্যবহৃত হতো গন্ধর্ব গানে।  নারদের মতে গন্ধর্ব গান গঠিত হয় ততবাদ্যযন্ত্রের দ্বারা। তবে অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের সহায়তা প্রয়োজন ছিল। স্বরের উৎপত্তি-স্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে- বীণা ও কণ্ঠস্বর। তাল ব্যবহৃত হতো অবনদ্ধ বা তালযন্ত্রের মাধ্যমে। স্বর, তাল ও পদের সমন্বয়ে যত গান সৃষ্টি হয়, সেগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো- স্বরগন্ধর্ব, তালগন্ধর্ব ও পদগন্ধর্ব। এই ভাগগুলো হলো- স্বর গন্ধর্ব, তাল গন্ধর্ব ও পদ গান্ধার্ব। [২৮।১১-১২]

নাট্যশাস্ত্রে গন্ধর্ব গানকে  তিনটি ভাগ করা হয়েছে। গন্ধর্ব গানের স্বর সংখ্যা ছিল ৭টি। এগুলো হলো- ষড়্‌জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম. মধ্যম, ধৈবত ও নিষাদ। শ্রুতিসমূহের ব্যবধানের বিচারে চারশ্রেণির স্বর হতে পারে। এই স্বরগুলো হলো- বাদী সংবাদী, অনুবাদী ও বিবাদী। গন্ধর্ব গানে শ্রুতি ছিল ২২টি। গ্রামভেদে এই শ্রুতিতে স্বর বিন্যাস ছিল ভিন্নতর। যেমন- দুই গ্রামে মূর্ছনার সংখ্যা ছিল- ১৪টি। এইগুলো আবার ৪টি ভাগে বিভক্ত ছিল। এগুলো হলো- মূর্ছনা-ভিত্তিক তানের সংখ্যা ছিল ৮৪টি।

গ্রামভেদে জাতির সংখ্যা নানা রকম ছিল। মোট জাতির সংখ্যা ১৮টি। এর ভিতরে ৭টি ছিল শুদ্ধ জাতি এবং ১১টি বিকৃত জাতি। জাতিসমূহের লক্ষণ ছিল ১০টি। এগুলো হলো- গ্রহ, সম্বাদী, অংশ. ন্যাস ইত্যাদি। গন্ধর্ব গানে ৩৩টি অলঙ্কারে কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ সকল অলঙ্কার স্থায়ী, মিশ্র, আরোহী ও অবরোহীভেদে ভিন্ন ভিন্ন রূপে ব্যবহৃত হতো।

নাট্যশাস্ত্রে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে ধ্রুবা গান নিয়ে
তথ্যসূত্র: