চ্যবন
ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা { পৌরাণিক সত্তা | কাল্পনিকসত্তা | কল্পনা | সৃজনশীলতা | দক্ষতা | জ্ঞান | মনস্তাত্ত্বিক বিষয় | বিমূর্তন | বিমূর্ত-সত্ত | সত্তা |}

হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে
 
জনৈক ঋষি

ভৃগুর ঔরসে পুলোমার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন ভৃগুর সাথে পুলোমার বিবাহের আগে, এক রাক্ষস পুলোমাকে বিবাহ করার জন্য পুলোমা'র পিতার কাছে প্রস্তাব পাঠান উল্লেখ্য এই রাক্ষসের নামও পুলোমা ছিল পুলোমার পিতা কন্যাকে রাক্ষস-পুলোমার হাতে সমর্পণ না করে, ভৃগুর সাথে বিবাহ দেন যথাসময়ে পুলোমা ভৃগু কর্তৃক গর্ভবতী হন ভৃগু সুপুত্রের আশায় সবসময় স্ত্রীকে যত্নে রক্ষা করতে থাকেন একদিন ভৃগুর ঘরের প্রতিষ্ঠিত অগ্নি উপর স্ত্রীর দেখাশোনার ভার দিয়ে স্নানের জন্য ঘরের বাইরে যান এই সময় রাক্ষস-পুলোমা ভৃগুপত্নীকে হরণ করে নিয়ে যেতে থাকেন এই সময় অকালে ভৃগুপত্নী'র গর্ভস্থ সন্তান চ্যবন ভূমিষ্ঠ হয় শিশু চ্যবনের তেজে এই পুলোমা রাক্ষস ভস্মীভূত হয়

র্মদা নদীর তীরস্থ বৈদূর্য পর্বতে ইনি দীর্ঘকাল তপস্যা করতে করতে বৃদ্ধ হয়ে যান এই সময় তাঁর দেহ বল্মীকে (উঁই ঢিবি) এবং লতাপাতা দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে একবার রাজা শর্যাতি ও তাঁর চার হাজার স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে এই পর্বতে বিহার করতে আসেন শর্যাতি সুকন্যা নামক এক কন্যা চ্যবনের ঢিবির কাছে এলে ইনি ক্ষীণ কণ্ঠে এই কন্যাকে আহ্বান করেন এই কন্যা ঋষির ডাক শুনতে না পেয়েই কৌতুহলবশত ঢিবির কাছে আসেন ঢিবির মধ্যে ইনি শুধু চ্যবনের উজ্জ্বল দুটি চোখ দেখতে পান। কৌতুহলবশত সুকন্যা তা কাঁটা দিয়ে পরীক্ষা করতে গেলে, ঋষির চোখ মারাত্মকভাবে আহত হয় চ্যবন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে রাজার সকল সৈন্যদের মলমূত্র ত্যাগ বন্ধ করে দেন এই কারণে রাজশিবিরে হাহাকার উপস্থিত হলে রাজা শর্যাতি এর কারণ অনুসন্ধান করতে থাকেন পরে প্রকৃত বিষয় অবগত হয়ে ঋষির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে আসেন চ্যবন শর্ত দেন যে, যদি সুকন্যার সাথে তাঁর বিবাহ দেওয়া হয় তবেই তিনি ক্ষমা করবেন রাজা অবশেষে তাতেই রাজি হন

একবার সুকন্যা নগ্ন হয়ে স্নান করছিলেন এমন সময় দেব-চিকিৎস অশ্বিনীকুমারদ্বয় তাঁকে দেখে মুগ্ধ হয়ে সঙ্গম প্রার্থনা করেন কিন্তু সুকন্যা দেবতাদের জানান যে তিনি স্বামীর প্রতি অনুরক্তা এরপর অশ্বিনীকুমারদ্বয় তাঁকে বলেন যে তাঁরা চ্যবনের যৌবন দান করবেন কিন্তু চ্যবনের যৌবনপ্রাপ্তির পর সুকন্যাকে তাঁদের মধ্য থেকে যাঁকে নির্বাচন করবেন তিনিই তাঁর পরবর্তী স্বামী হবেন সুকন্যা এই কথা চ্যবনকে জানালে চ্যবন তাতেই রাজি হন এরপর অশ্বিনীকুমারদ্বয় চ্যবনকে নিয়ে নিকটস্থ জলে ডুব দেন এবং তিনজনই অত্যন্ত সুদর্শনরূপে সুকন্যার সামনে উপস্থিত হন সুকন্যা এর মধ্য থেকে চ্যবনকেই চিনে নেন চ্যবন সন্তুষ্ট হয়ে অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে যজ্ঞে সোমপায়ী করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেন

এরপর চ্যবনের অনুরোধে তাঁর শ্বশুর শর্যাতি একটি যজ্ঞের আয়োজন করেন উক্ত যজ্ঞে চ্যবন অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে সোমরস দিতে অগ্রসর হলে ইন্দ্র তাঁকে বাধা দিয়ে বলেন, অশ্বিনীকুমারদ্বয় সোমরসের অযোগ্য কারণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয় মূলত দেব-চিকিৎসক তারা দেবতাদের কর্মচারী মাত্র সে কারণে তাদের সোমপানের অধিকার নেই এরপর চ্যবন জোর করে অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে সোমরস দিতে গেলে ইন্দ্র বজ্রাঘাতের উদ্যোগ নেন কিন্তু চ্যবন ইন্দ্রের হাত স্তব্ধ করে দিয়ে-মন্ত্রপাঠ করে অগ্নিতে আহুতি দিলে মদ নামক এক দেবতার উদ্ভব হয় উক্ত দেবতা ইন্দ্রকে গ্রাস করতে উদ্যত হলে ইন্দ্র চ্যবনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের সোম পানের অধিকারকে স্বীকৃতি দেন এরপর চ্যবন ইন্দ্রের বাহুমুক্ত করে দেন এবং শর্যাতির যজ্ঞ শেষ করে সস্ত্রীক বনে গমন করেন এখানে তাঁদের প্রমতি নামক এক পুত্র জন্মগ্রহণ করে

ইনি একবার ব্রতধারী হয়ে বার বৎসর গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থলে জলের মধ্যে বাস করেন এই সময় জলচর প্রাণীদের সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠে একবার মাছেদের সাথে ইনি জেলেদের জালে ধরা পড়েন ইনি মরণাপন্ন মাছদের দেখে দুঃখিত হয়ে জেলেদের কাছে বলেন যে তিনি মাছেদের সাথে প্রাণত্যাগ করবেন বা মাছেদের সাথে বিক্রিত হবেন এই সংবাদ পেয়ে রাজা নহুষ তাঁকে উদ্ধার করতে আসেন চ্যবন রাজাকে জেলেদের যথাযথ মূল্য দিতে বলেন রাজা এর মূল্য নিরূপণ করতে গিয়ে সমগ্র রাজ্য দিতে অগ্রসর হলেও চ্যবন তাতে সম্মত হন না পরে এক ব্রাহ্মণের পরামর্শে একটি গাভী দ্বারা মাছ কেনেন চ্যবন মনে করতেন গাভীর তূল্য কোন ধন নেই তাই এই মূল্যে তিনি রাজী হন চ্যবন উক্ত গাভী জেলেদের দান করে এবং নহুষকে আশীর্বাদ করে আশ্রমে চলে যান

ইনি ব্রহ্মার কাছে জানতে পারেন যে, ক্ষত্রিয় কুশিক বংশ থেকে তাঁর বংশে ক্ষত্রিয় আচার সংক্রামিত হবে এই কারণে কুশিকবংশ ধ্বংস করার উদ্যোগ নেন ইনি প্রথমে কুশিকের কাছে গিয়ে তাঁর সাথে বসবাস করতে ইচ্ছা করলেন কুশিক তাঁকে সম্মান দেখিয়ে রাজ্যের সকল গাভী ও ধনসম্পদ দিতে চাইলেন কিন্তু চ্যবন তাতে অসম্মত হয়ে একটি ব্রতানুষ্ঠান করতে ইচ্ছা করলেন এবং উক্ত অনুষ্ঠানের পরিচর্যা করার জন্য সস্ত্রীক কুশিককেই প্রার্থনা করলেন কুশিক তাতে রাজী হলে চ্যবন ব্রতানুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করলেন এই অনুষ্ঠানের জন্য তিনি নানারূপ দ্রব্য প্রার্থনা করলেন কুশিক যথাসাধ্য সে সকল দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে দিতে লাগলেন চ্যবন তাদের কোন ত্রুটি বের করতে না পেরে কুশিক এবং তাঁর স্ত্রীকে রথ টানতে বলেন এঁরা উভয়ই রথ টানতে থাকলে চ্যবন চাবুক মেরে উভয়কেই ক্ষতবিক্ষত করে তোলেন এরপরেও এঁরা যথাসাধ্য পরিশ্রমে রথ টানতে থাকলে চ্যবন রথ থেকে নেমে উভয়কেই সুস্থ করে তোলেন এরপর চ্যবন উভয়কেই পরদিন তাঁর গঙ্গাতীরস্থ আশ্রমে উপস্থিত হওয়ার জন্য বলে অন্তর্হিত হন কুশিক তাঁর স্ত্রীকে সাথে নিয়ে উক্ত আশ্রমে গেলে গন্ধর্বপুরীর মত একটি চমৎকার প্রাসাদ দেখতে পান কিন্তু কিছুক্ষণ পর এই প্রাসাদ অদৃশ্য হয়ে যায় এরপর রাজা-রানী ব্রাহ্মণের তপস্যার প্রশংসা করতে থাকলে চ্যবন তাঁদের সামনে এসে বর প্রার্থনা করতে বলেন কিন্তু কুশিক বলেন যে, তাঁর মত ঋষির সংস্পর্শে এসে তাঁরা দগ্ধ হন নি এটাই তাদের বড় পুরস্কার

এরপর রাজা চ্যবনের কাছে তাঁর এই অদ্ভুত আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইনি ব্রহ্মার ভবিষ্যৎ বাণী ব্যক্ত করেন সব শুনে কুশিক ব্রাহ্মণত্ব লাভের আশা ব্যক্ত করেন চ্যবন এর উত্তরে বলেন যে, ব্রাহ্মণত্ব দুর্লভ, তার চেয়ে দুর্লভ ঋষিত্ব এরপর চ্যবন বলেন যে রাজার অধস্তন তৃতীয় পুরুষ বিশ্বামিত্র ব্রাহ্মণত্ব লাভ করবেন ভৃগুবংশে ঔর্ব নামক এক ঋষি জন্মাবেন তাঁর পুত্র ঋচীক সমস্ত ধনুর্বেদ অর্জন করে তাঁর পুত্র জমদগ্নিকে দান করবেন জমদগ্নির সাথে কুশিকের নাতনীর বিবাহ হবে এদের পুত্র পরশুরাম ক্ষত্রিয়ের আচরণ করবে এবং কুশিকের অপর নাতি বিশ্বমিত্র ব্রাহ্মণত্ব লাভ করবে