গঙ্গারিডাই
খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর দিকে প্রাচীন বাংলার একটি
জাতি গোষ্ঠী। গ্রিক এবং ল্যাটিন লেখকদের লেখা থেকে এই জাতি সম্পর্কে জানা যায়।
বিভিন্ন লেখক এই জাতিকে নানান বানানে উল্লেখ করেছেন। এই নামগুলো হলো
গঙ্গারিডে
(Gangaridae), 'গঙ্গারিদুম'
(Gangariridum)
ও 'গঙ্গারাইডেস' (Gangarides)।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে
আলেকজান্ডার
ভারতের দিকে
যাত্রা করেন। আর
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬
অব্দে আলেকজান্ডার সিন্ধু নদ পার হয়ে
তক্ষশীলায় প্রবেশ করেন।
আলেকজান্ডারের সময়ে ভারতে আগত গ্রিক ঐতিহাসিকরা
গঙ্গারিডাই
নামক একটি শক্তিশালী রাজার কথা উল্লেখ করেছেন। এই জাতি সম্পর্কে গ্রিক ও ল্যটিন
লেখকদের যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা হলো−
-
'গঙ্গারিডাই
রাজ্যের বিশাল হস্তী-বাহিনী ছিল। এই বাহিনীর জন্যই এ রাজ্য কখনই বিদেশী রাজ্যের
কাছে পরাজিত হয় নাই। অন্য রাজ্যগুলি হস্তী-বাহিনীর সংখ্যা এবং শক্তি নিয়ে
আতংকগ্রস্ত থাকিত'।..."গঙ্গার
শেষ অংশের প্রস্থ ৮ মাইল, এবং যেখানে এটি সবথেকে কম প্রস্থের সেই স্থানে এর
গভীরতা প্রায় ১০০ ফুট। সেই মানুষরা যারা সেই সুদুর প্রান্তে থাকেন তারা হলেন
গঙ্গারিডাই। এদের রাজার ১০০০ অশ্বারোহী, ৭০০ হস্তি এবং ৬০০০০ পদাতিক সৈন্য
নিয়ে সজ্জিত সেনাবাহিনী আছে " -
মেগাস্থিনিস (৩৫০-২৯০ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ ) আলেকজান্ডারের সেনাপতি ও বন্ধু
সেলুকাসের রাজত্বকালে গ্রিক দূত হিসাবে ভারতে এসেছিলেন।
-
'ভারতের সমূদয় জাতির মধ্যে গঙ্গারিডাই সর্বশ্রেষ্ঠ। এই গঙ্গারিডাই রাজার সুসজ্জিত
ও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত চার হাজার হস্তী-বাহিনীর কথা জানিতে পারিয়া আলেকজান্ডার
তাহার বিরূদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হইলেন না' - ডিওডোরাস (৯০-৩০খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ)
-
‘গঙ্গা নদী উত্তর হতে দক্ষিণ দিকে
প্রবাহিত এবং গঙ্গারিডাই রাজ্যের পূর্ব সীমানায় সমূদ্রে মিলিত হইয়াছে।’ -
মেগাস্থিনিস
-
‘গঙ্গা নদীর মোহনায় সমূদয় এলাকা
জুড়িয়া গঙ্গারিডাই রাজ্য’ -টলেমি
-
‘গঙ্গারিডাই রাজ্যের ভিতর দিয়া গঙ্গা
নদীর শেষ অংশ প্রবাহিত হইয়াছে’- প্লিনি
টলেমি গঙ্গারিডাই- এর অবস্থান সম্পর্কে
জানা যায়, গঙ্গার পাঁচটি মুখ সংলগ্ন প্রায় সমূদয় এলাক গঙ্গারিডাইরা দখল করে রেখেছিল।
‘গাঙ্গে’ নগর ছিল এর রাজধানী। তার বর্ণনাকৃত চারটি দ্রাঘিমা ডিগ্রি সমূদ্র উপকূলের
সর্ব পশ্চিম থেকে সর্ব পূর্ব নদীমুখ পর্যন্ত অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করছে। কার্যতঃ এর
অর্থ হলো ‘গঙ্গারিডাই’ বঙ্গপোসাগরের উপকৃলবর্তী গঙ্গার সর্বপশ্চিম এবং সর্বপূর্ব
নদীমুখ পযর্ন্ত বিস্তৃত ছিল। লক্ষ্য করা যায়, ভাগীরথীর (তমলুক এর নিকটে)
এবং পদ্মার (চট্টগ্রামের নিকটে) নদীমুখের দ্রাঘিমা রৈখার পার্থক্য ৩৫ ডিগ্রির
সামান্য কিছু বেশি। তাই টলেমির তথ্যানুযায়ী গঙ্গারিডাই-কে শনাক্ত করা যায় বর্তমান
ভারতের পশ্চিমবাংলা ও বাংলাদেশে গঙ্গার প্রধান দুটি শাখার মধ্যবর্তী অঞ্চলটিতে।
জনৈক গ্রিক নাবিক তাঁর Periplous tes Erythras
Thalasses (Periplus Maris Erythraei)
গ্রন্থে বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন উড়িষ্যা উপকূলের পূর্বে অবস্থিত গাঙ্গে দেশের কথা
উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে- নদীর নামে গাঙ্গে ছিল একটি বাণিজ্য শহর।
গঙ্গারিডাই শব্দের উৎপত্তি গঙ্গারিড থেকে। ধারণা করা হয় গঙ্গারিড ভারতের গঙ্গাহৃদ
বা গঙ্গাহৃদি শব্দের গ্রিক রূপ। অর্থাৎ গঙ্গা হৃদয়ে যার - যে ভূমির বক্ষে গঙ্গা
প্রবাহিত। ঐতিহাসিক অতুল সুরের মতে গঙ্গাহৃদ থেকে গঙ্গারিডি তার থেকে গঙ্গারাঢ়ি ও
তার থেকে রাঢ় শব্দটি এসে থাকতে পারে।
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক নীহারঞ্জন রায় তাঁর বাঙালির ইতিহাস (আদি পর্ব) গ্রন্থে লিখেছেন-
‘গঙ্গারিডাই-রা যে গাঙ্গেয় প্রদেশের লোক এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই, কারণ গ্রিক লাতিন
লেখকরা এ সম্বন্ধে একমত।
দিয়োদারাস-কার্টিয়াস-প্লুতার্ক-সলিনাস-প্লিনি-টলেমি-স্ট্ট্যাবো প্রভৃতি লেখকদের
প্রাসঙ্গিক মতামতের তুলানামূলক বিস্তৃত আলোচনা করিয়া হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী মহাশয়
দেখাইয়াছেন যে গঙ্গারিডাই বা গঙ্গারাষ্ট্র গঙ্গা-ভাগীরথীর পূর্বতীরে অবস্থিত ও
বিস্তৃত ছিল।’
প্লিনির মতে ‘গঙ্গারিডাই রাজ্যের ভিতর দিয়ে গঙ্গা নদীর শেষ অংশ প্রবাহিত হয়েছে ।
গঙ্গার দক্ষিণ অংশের অধিবাসীদের গাত্রবর্ণ ছিলো কালো এবং রৌদ্রে পোড়া, কিন্তু তারা
ইথিওপিয়ানদের মতো কালো ছিল না।’ এই বিবরণ থেকে অনুমান করা যায়- এরা ছিল
নেগ্রিটো,
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড ও
দ্রাবিড়
জনগোষ্ঠীর মিশ্র জাতি।
সূত্র :
ভারতের ইতিহাস। অতুল চন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।
বাংলা বিশ্বকোষ। চতুর্থ খণ্ড। নওরোজ কিতাবিস্তান। নভেম্বর ১৯৭৬।