চাণক্য
অনুমান করা হয়, তিনি তাঁর
খ্রিষ্টপূর্ব ৩৭০-২৮৩ অব্দের ভিতরে জীবিত ছিলেন। তাঁর জন্মস্থান চাণকা থেকে তাঁর
নাম হয়েছিল চাণক্য। তাঁর পিতামাতার দেওয়া নাম ছিল বিষ্ণুগুপ্ত। তাঁর জন্ম হয়েছিল
কূটিলা গোত্রে। এই কারণে তিনি ছদ্মনাম নিয়েছিলেন কৌটিল্য। অনেকের মতে রাষ্টশাসনের
ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত কৌশলী ছিলেন। এই অর্থে তিনি কৌটিল্য নাম পেয়েছিলেন। আলোর মতো
দীপ্তিময় বুদ্ধির জন্য তিনি অংশুল নামে অভিহিত হয়ে থাকেন।
তিনি প্রাচীন তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতির অধ্যাপক ছিলেন।
তিনি মৌর্য সম্রাট
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য-এর রাজ্যত্ব লাভের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। কথিত আছে
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য-শৈশবে
তাঁর পিতাকে হারান। এরপর তাঁর মা তাঁর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেন এক গো-পালককে।
কিন্তু এই গো-পালক চন্দ্রগুপ্তকে এক শিকারীর কাছে বিক্রয় করেন। এই শিকারীটিও তাঁকে
গো-চারণে নিযুক্ত করেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনি স্থানীয় রাখাল বালকদের নেতা হয়ে
উঠেন। এই সময়
তক্ষশীলাবাসী চাণক্য (কৌটিল্য), চন্দ্রগুপ্তের দেহে রাজ-সদৃশ চিহ্ন দেখে
শিকারীর কাছ থেকে চন্দ্রগুপ্তকে ক্রয় করেন। এরপর চাণক্য তাঁকে
তক্ষশীলায় নিয়ে আসেন। এরপর চাণক্য তাঁকে রাষ্ট্রবিদ্যা এবং সমরবিদ্যায় শিক্ষিত
করে তোলেন। এরপর চাণক্য উচ্চাশিক্ষার তাঁকে পাটালিপুত্রে পাঠান। এই সময়
পাটালিপুত্রের রাজা ছিলেন নন্দরাজ ধননন্দ।
নন্দরাজ অত্যন্ত অত্যাচারী
রাজা ছিলেন। এই কারণে পাটালিপুত্রের অধিবাসীরা ধননন্দের উপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে
উঠেছিল। নন্দরাজ কর্তৃক অপমানিত হয়ে চাণক্য বিন্ধ্যাপর্বতের জঙ্গলে আশ্রয়
নিয়েছিলেন। অন্যদিকে
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে
আলেকজান্ডার
ভারতের দিকে
যাত্রা করেন। আর
খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬
অব্দে
আলেকজান্ডার সিন্ধু নদ পার হয়ে তক্ষশিলায় প্রবেশ করেন।
চন্দ্রগুপ্ত নন্দরাজকে উৎখাত করার লক্ষ্যে গ্রিকদের সাহায্য পাওয়ার জন্য
আলেকজান্ডারের শিবিরে যান।
আলেকজান্ডার প্রথমে তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের
উদ্ধত ব্যবহারের জন্য, তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যু দণ্ডাদেশ প্রদান
করেন। কিন্তু কৌশলে তিনি গ্রিক সৈন্যদের হাত থেকে পালিয়ে বিন্ধ্যাপর্বতের গভীর
জঙ্গলে আশ্রয় নেন। এই বনে উভয়ের দেখা হওয়ার পর, উভয়ই নন্দরাজের পতনের লক্ষ্যে একমত হন।
প্রাথমিকভাবে সৈন্য সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে চাণক্য চন্দ্রগুপ্তকে সাহায্য
করেন।
এরপর চন্দ্রগুপ্ত নন্দরাজের
বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। প্রথম দুটি যুদ্ধে চন্দ্রগুপ্ত পরাজিত হয়ে অরণ্যে
আশ্রয় নেন। তৃতীয় বারের যুদ্ধে তিনি নন্দরাজের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন। অনেকে মতে
আলেকজান্ডারের ভারত ত্যাগের পর, যে গ্রিক সৈন্যরা ভারতের
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল শাসন করছিলেন, তাঁরা চন্দ্রগুপ্তকে এই যুদ্ধে সাহায্য করেছিলেন।
আনুমানিক ৩২৪-৩২৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত নন্দরাজকে পরাজিত করে
রাজত্ব লাভ করেন। মহাবংশ-টীকা গ্রন্থ মতে নন্দরাজ যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন।
অন্যমতে চন্দ্রগুপ্ত নন্দরাজকে কিছু সামান্য আসবাবপত্র ও তাঁর পরিবারপরিজনসহ
নন্দরাজকে পাটালিপুত্র থেকে বিতারিত করেছিলেন।
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য-
চাণক্যকে গুরু, উপদেষ্টা ও মন্ত্রণাদাতা হিসেবে গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি চন্দ্র
গুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন।
চাণক্যকে প্রাচীন ভারতের প্রথম অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করা হয়। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে তাঁর অর্থনীতি তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। অনেক ঐতিহাসিক চাণক্যকে "ভারতের মেকিয়াভেলি" নামে অভিহিত করেছেন। তাঁর রচিত 'অর্থশাস্ত্র' গুপ্ত রাজবংশের শাসনের শেষ দিকে তাঁর বইটি হারিয়ে যায়। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্রন্থটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল।