১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের
যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।এই সময় তিনি কৃষকদের কল্যাণের জন্য 'কলকাতা
কৃষি সমিতি' তৈরি করেন। শামসুদ্দীন মন্ত্রিসভায় দলগত সদস্য হিসেবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৩৯
খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন এবং তমিজউদ্দীন মুসলিম লীগে যোগদান করেন।
মন্ত্রী পরিষদের নলিনীরঞ্জন সরকার ১৯৩৯ সালের ২০ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন। এই বছরে
তিনি লাহোর প্রস্তাবের
কার্যনির্বাহী কমিটির সাথে ফজলুল হক ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে মার্চ সর্বভারতীয় মুসলিম
লীগের লাহোর অধিবেশনে,
মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ফজলুল হককে দিয়ে পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন
করিয়েছিলেন।
১৯১৮-১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রূপে দায়িত্ব
পালন করেন। এছাড়া ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের দিল্লি অধিবেশনে সভাপতিত্ব
করেন।
১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ফজলুল হক জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য মতিলাল
নেহরু, চিত্তরঞ্জন দাস ও অন্যান্য বিশিষ্ট নেতাদের নিয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস
কর্তৃক গঠিত পাঞ্জাব তদন্ত কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই বছরেই তিনি খিলাফত
আন্দোলনে যোগদান করেন। কংগ্রেস-গৃহীত অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্কিত
ব্রিটিশ পণ্য ও উপাধি বর্জনের তিনি সমর্থন করেন। কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায়ের
পশ্চাৎপদ অবস্থার কথা বিশেষভাবে বিবেচনা করে তিনি স্কুল ও কলেজ বর্জনের পরিকল্পনার
বিরোধিতা করেছিলেন। তাই তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করেন।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে বেঙ্গল জোতদার ও রায়ত এসোসিয়েশন গড়ে তুলে প্রজাদের সংগঠিত করার
ক্ষেত্রেও ফজলুল হক নেতৃত্ব দান করেন। এই বছরেই তিনি বাংলা
প্রাদেশিক সম্মেলনের মেদিনীপুর অধিবেশনের সভাপতিত্ব করেন। এই বছরেই
কাজী
নজরুল ইসলাম ও মুজাফ্ফর আহমদের সাথে মিলে তিনি নবযুগ নামে একটি দৈনিক
পত্রিকা প্রকাশ করেন। সরকার বিরোধী নীতির কারণে এ পত্রিকার জামানত বহুবারই
বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। ফলে দীর্ঘদিনব্যাপী এ দৈনিক পত্রিকা চালানো তাঁর পক্ষে
সম্ভব হয় নি।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রায় ছয়মাসের জন্য তিনি শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন।
এই সময়ে তিনি শিক্ষা সংক্রান্ত অবকাঠামো সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি বহু
কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন। বিশেষ করে মুসলিম এডুকেশনাল ফান্ড গঠন করে তিনি যোগ্য মুসলমান
ছাত্রদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে তৈরি করেছিলেন। এছাড়া মুসলমান ছাত্রদের ফারসি ও
আরবি শিক্ষাদানের জন্য তিনি বাংলায় একটি পৃথক মুসলমান শিক্ষা পরিদপ্তরও গঠন
করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সকল সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলমান
ছাত্রদের জন্য আসন সংরক্ষণেরও তিনি ব্যবস্থা করেছিলেন।
১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গীয় প্রজাতন্ত্র আইন পাশের
মাধ্যমে প্রজারা কিছু অধিকার ফিরে পায়।
১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রাদেশিক পরিষদের
নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রজা পার্টি আত্মপ্রকাশ করে। জুলাই মাসে বঙ্গীয়
আইন পরিষদের ২৫ জন মুসলিম সদস্য সম্মিলিতভাবে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি গঠিত হয়।
নির্বাচনের পর বঙ্গীয় আইন পরিষদের ১৮ জন মুসলিম সদস্য নিয়ে ফজলুল হকের নেতৃত্বে
প্রজা পার্টি শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রজা পার্টির
প্রতিষ্ঠাকালীন নেতাদের মধ্যে আবদুর হাকিম, তমিজউদ্দিন খান, বাহাদুর আজিজুল হক, শাহ
আবদুল হামিদ, ফজলুল্লাহ, মোহাম্মদ হোসেন উল্লেখযোগ্য। আর নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির
নেতাদের মধ্যে বিচারপতি স্যার আবদুর হাকিম, মওলানা আকরাম খাঁ, হোসেন শহীদ
সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, শামসুদ্দীন আহমেদ, তমিজুউদ্দীন খান, মৌলভী আবদুল
করিম অন্যতম। প্রজা পার্টি প্রথম থেকেই কৃষক ও শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার নীতি গ্রহণ
করে। অন্যদিকে প্রজা সমিতি গ্রামে গ্রামে কৃষকের অধিকারের পক্ষে কাজ করতে থাকে এবং
জমিদারদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে কৃষকদের সোচ্চার করতে থাকে। ১৯৩০ থেকে কৃষক ও প্রজা সমিতি গঠিত
হতে থাকে। পরে বিভিন্ন জেলার কৃষক সমিতি প্রজা সমিতির সাথে একাত্মতা পোষণ করতে থাকে।
১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে
মুহম্মদ আলী জিন্নাহ সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি হন। কিন্তু
জিন্নাহ'র সকল সিদ্ধান্তে তিনি খুশি হতে পারেন নি। ফলে
জিন্নাহ'র সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য
তীব্রতর হয়ে ওঠে।
১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কৃষক প্রজা
পার্টি (কে.পি.পি) নামে দল তৈরি করেন। এরপর কৃষকদের অধিকার পুনরুদ্ধার, মহাজন ও
জমিদারদের অত্যাচার থেকে কৃষকদের রক্ষার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। ফলে
তিনি দ্রুত কৃষকদের ভিতরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন।
এই বছরে ফজলুল হক প্রজা সমিতির সভাপতি নিযুক্ত
হন। এরপর তিনি সকল প্রজা ও কৃষক সমিতিগুলোকে একত্রিত করে কৃষক
প্রজা পার্টি গঠন করেন। এই দলের সভাপতি
হন ফজলুল হক। সম্পাদক হন
শামসুদ্দিন আহমদ। কৃষক প্রজা পার্টি গঠিত হওয়ার পর তারা লোকাল বোর্ড ও জেলা বোর্ডে
প্রতিযোগিতা করে আশাতীত সাফল্য পায়। অতঃপর ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারত শাসন আইনে
আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটি সাংগঠনিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে।
১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ফজলুল হক তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারের খসড়া তৈরি করেন এবং তাঁর নির্বাচনী
প্রচারাভিযানের সময় তিনি
মুহম্মদ আলী জিন্নাহ'র নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের তীব্র বিরোধিতা করেন।
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টি
স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়। কৃষক প্রজা পার্টি ফজলুল হককে
সভাপতি ও রজব আলী তরফদারকে সেক্রেটারি নিযুক্ত করে পার্লামেন্টারি বোর্ড গঠন করে।
কর্মসূচী প্রণয়নের ক্ষেত্রে কৃষক প্রজা পার্টি বাংলার জনসাধারণের অর্থনৈতিক ও
সামাজিক ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে। কৃষক প্রজা পার্টি মোট ১৪ দফা
কর্মসূচি ঘোষণা করে। এগুলো হলো-
ক্ষতিপূরণ ছাড়া জমিদারি প্রথা বিলোপ, প্রজাস্বত্ব আইন প্রবর্তন, খাজনা ও ঋণ মওকুফ,
নজর-সেলামি-আবওয়াব বাতিল, মহাজনী আইন বাতিল, কৃষকদের জন্য সুদ মুক্ত ঋণ চালু, খাল
খননের মাধ্যমে সেবা সুবিধা সৃষ্টি, প্রতি থানায় হাসপাতাল স্থাপন, পূর্ব বাংলার
পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন, বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু, শাসন
ব্যয় হ্রাস, মন্ত্রিদের বেতন ১০০০ টাকা নির্ধারণ, সব নিষ্পেষণমূলক আইন বাতিল ও
রাজবন্দিদের মুক্তি, ঋণ সালিশি বোর্ড গঠন করে বার্ষিক ৪ ভাগ হারে ঋণ প্রদান ও পাট
চাষে সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে পাটের সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ।
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের বঙ্গীয় বিধান সভা নির্বাচনে তিনি
খাজা নাজিমুদ্দিনকে পরাজিত করেন। ১১৭ টি সংরক্ষিত মুসলিম আসনের মধ্যে কৃষক
প্রজা পার্টি পায় ৩৬টি আসন, যা প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৩০.৭৬ ভাগ।
এই
নির্বাচনে কংগ্রেস প্রথম, মুসলিম লীগ দ্বিতীয় এবং কৃষক প্রজা পার্টি
তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিল। মুসলিম লীগ পেয়েছিল ৩৫টি আসন, যা মোট ভোটের ২৯.৯১ শতাংশ। যদিও বিশেষ স্বার্থ
প্রতিনিধিত্ব করার কারণে মুসলিম লীগ বরাদ্দকৃত আরও ৪টি আসনসহ মোট ৩৯টি আসন লাভ
করে। আর স্বতন্ত্র ৪১ জন প্রার্থী জয়লাভ করে যা মোট প্রদত্ত ভোটের ৩৫.০৪
শতাংশ।
অপেক্ষাকৃত নবীন দল হয়েও কৃষক প্রজা পার্টি গ্রামাঞ্চলে কংগ্রেস ও মুসলিম
লীগের চেয়ে ভালো ফলাফল করে। এমনকি খুলনা, বাকেরগঞ্জ, নোয়াখালী, ময়মনসিংহের সব
কয়টি আসন পায় কৃষক প্রজা পার্টি। তবে প্রকৃতপক্ষে মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা
পার্টির চেয়ে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে ছিল স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এ থেকেই বোঝা
যায় মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টির নির্বাচনের আগে তৃণমূলে সাংগঠনিক দুর্বলতা
ছিল। তবে যাই হোক, সার্বিক বিবেচনায় নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে কৃষক শ্রমিক পার্টির
৩৫ আসন পাওয়া সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। পরবর্তীতে ৩৭ জন স্বতন্ত্র মুসলিম আসনের
সদস্যদের মধ্যে ২১ জন মুসলিম লীগে, ১৬ জন কৃষক শ্রমিক পার্টিতে যোগ দেয়। পরিশেষে
বঙ্গীয় বিধান সভা নির্বাচনে কংগ্রেস ৬০, মুসলিম লীগ ৫৯ ও কৃষক শ্রমিক পার্টি ৫৫
আসনের মালিক হয়।
এই বছরের এপ্রিল মাসে, এ.কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত
কৃষক প্রজা পার্টি এবং মুসলিম লীগের কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। মূলত হক-কংগ্রেস
মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেসের
কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এ ধরনের মন্ত্রিসভা গঠনে রাজি না হওয়ায় ফজলুল হক অত্যন্ত হতাশ হন।
শেষ পর্যন্ত তিনি মুসলিম লীগের সঙ্গে কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন করতে বাধ্য হন। এর
ফলে বঙ্গদেশে মুসলিম লীগের প্রভাব বিস্তারের দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল। কোয়ালিশন দলের
নেতারূপে ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ১লা এপ্রিল ফজলুল হক বাংলা সরকারের
মুখ্যমন্ত্রী রূপে অধিষ্ঠিত হন। ১৫ই অক্টোবর লক্ষ্ণৌতে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম
লীগের যোগদান করেন।
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই মার্চ তমিজউদ্দীন খানের নেতৃত্বে প্রজা পার্টির ১৩ সদস্যের
একটি দলছুট গোষ্ঠী কোয়ালিশনের প্রতি তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে। গান্ধী ও
শরৎ বসুর প্ররোচনায় তফসিলি সম্প্রদায়ের ১৫ জন সদস্য সরকারি দল ত্যাগ করলে ১৮ মার্চ আরেকটি দলত্যাগের ঘটনা ঘটে। এরপর ২২ জুন মন্ত্রী এবং আইনসভায় প্রজা
পার্টির উপনেতা নওশের আলী মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ না করে এবং কোয়ালিশনের প্রতি
সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে মুসলিম লীগের উপর হকের নির্ভরশীলতা আরও বেড়ে যায়।
আগষ্ট মাসে মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে কংগ্রেস-প্রস্তাবিত বেশ
কয়েকটি অনাস্থা প্রস্তাব আইনসভায় পেশ করা হয়। অবশ্য ২৫ জন ইউরোপীয় সদস্যের দৃঢ়
সমর্থন লাভ করে শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিসভা টিকে যায়। ১৭ই
নভেম্বর শামসুদ্দীন ও তমিজউদ্দীনকে মন্ত্রিসভায় যোগদানে রাজি করাতে সক্ষম হন। এই
বছরে তিনি
করোটিয়া সাদাত কলেজ
পরিদর্শন করেন এবং কলেজের জন্যে মোটা অংকের অনুদান বরাদ্দ করেন। উল্লেখ্য, ওই বছরই
কলেজটি ডিগ্রি কলেজে উন্নীত করা হয়।
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে মুসলিম লীগ শহর ও গ্রামাঞ্চলের সর্বত্রই তাদের জনপ্রিয়তা
বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল।
১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে
জিন্নাহ'র নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ফজলুল হক ভাইসরয়ের
প্রতিরক্ষা পরিষদে যোগদান করেন। এই কারণে
জিন্নাহ'র তাঁকে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করেন এবং
কোয়ালিশন দল থেকে লীগকে প্রত্যাহার করেন। এর ফলে সাম্প্রদায়িকভাবে বিভক্ত রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে নতুনভাবে
রাজনৈতিক মৈত্রী গঠনের এক অভূতপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছিল।
১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ২রা ডিসেম্বর ফজলুল হক পদত্যাগ করেন। এরপর তিনি প্রজা পার্টির প্রগতিশীল ও
অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিবর্গ, কংগ্রেসের বসু গ্রুপ সহ অধিকাংশ হিন্দু সদস্য এবং
হিন্দু মহাসভার রক্ষণশীল সংস্কারবাদীদের নিয়ে বিস্তৃত ভিত্তির একটি প্রগতিশীল
কোয়ালিশন গঠন করতে সক্ষম হন। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই ডিসেম্বর শ্যামা-হক
মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। নতুন
এই কোয়ালিশন সরকারের স্থায়িত্বকালে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় ছিল। কিন্তু
প্রাদেশিক গভর্নর স্যার জন হার্বাটের (১৯৩৯-১৯৪৩) চক্রান্তে প্রগতিশীল কোয়ালিশনের
কর্মসূচি বানচাল হয়ে যায়।
মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিলিত হয়ে হক মুসলমানদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বার্থের
বিরুদ্ধে কাজ করছেন, এমন প্রচারণা চালিয়ে মুসলিম লীগ- শ্যামা-হক মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করার জন্য গভর্ণরের কাছে আবেদন
করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রে জাপানি
আক্রমণের ভয়, সামরিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে বাস্তবায়িত
'প্রত্যাখ্যান নীতি' বদ্বীপ এলাকায় বেশ কষ্টকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। ২৬শে অক্টোবর এক বিধ্বংসী
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস উপকূলবর্তী এলাকায় আঘাত হানে। এই সময় কিন্তু আমলাতান্ত্রিক
জটিলতায় ত্রাণ তৎপরতা ব্যাহত হয়। ৩ আগষ্ট ঢাকা কারাগারে বেশ কয়েকজন
কয়েদি গুলিবিদ্ধ হয়। এ সবই শ্যামা-হক মন্ত্রী সভার বিপক্ষে চলে যায়।
৯ আগষ্ট কংগ্রেস ভারত ছাড় আন্দোলন শুরু করলে প্রশাসন আরেকটি প্রচণ্ড
চাপের সম্মুখীন হয়। এই সূত্রে ব্যাপক ব্রিটিশ নিপীড়ন শুরু হলে- ভারতের সকল প্রদেশে
প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এই অবস্থায় শ্যামা
মুখোপাধ্যায় পদত্যাগ করেন।
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী আইনসভায় প্রকাশ করেন যে, অবাধ ক্ষমতার আবরণে
গভর্নর বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রিসভা প্রদত্ত পরামর্শ অগ্রাহ্য করেছেন এবং তিনি সে সবের
তালিকাও পেশ করেন। গভর্নর এসব অভিযোগ সহজভাবে গ্রহণ করেন নি এবং প্রধানত তাঁর
উদ্যোগেই ২৪ ও ২৭ মার্চ আইনসভায় অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করা হয়। দুবারই সামান্য
ব্যবধানে হলেও প্রস্তাবগুলি নাকচ হয়ে যায়। তাঁর আদেশ কার্যকর করতে ২৮ মার্চ
গভর্নর হককে একটি তৈরি পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষরের নির্দেশ দেন এবং শাসনতন্ত্রের ৯৩
ধারা বলে তিনি নিজেই প্রদেশের প্রশাসনিক দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এক মাস পর
খাজা নাজিমুদ্দিনকে মুখ্যমন্ত্রী করে লীগের প্রাধান্য বিশিষ্ট একটি মন্ত্রিসভা নিয়োগ
করা হয়।
১৯৪৩ এর পরবর্তী সময় তিনি প্রবলভাবে দ্বিজাতিতত্ত্ব-এর বিরোধিতা করতে থাকেন।
মুসলিম লীগের আধিপত্য ক্ষুণ্ণ করার জন্য তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের
মুখ্যমন্ত্রী ডা: খান সাহেব এবং সিন্ধুর মুখ্যমন্ত্রী আলাহ বখ্শ ভারতীয়দের কাছে
অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে যুক্তভাবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে
একটি তারবার্তা পাঠান। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য ফজলুল হক প্রথম উদ্যোগ
গ্রহণ করেন। ত্রুটিপূর্ণ লাহোর প্রস্তাবের প্রতি বাঙালি মুসলমানদের মনোযোগ আকর্ষণ
করে তিনি জোরালোভাবে এর বিরুদ্ধে তাঁর মতামত প্রকাশ করেন। এর ফলে ফজলুল হক ও মুসলিম লীগের মধ্যে তিক্ততা
চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে।
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল থেকে
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট পর্যন্ত ফজলুল হক অবিশ্রান্তভাবে মুসলিম লীগের বিরোধিতা করেন। এর ফলে
তিনি বাংলার রাজনীতির মূলধারা থেকে উত্তরোত্তর ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ১১৭টি আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ
১১০টি আসন লাভ করে এবং হকের কে.পি.পি মাত্র চারটি আসন পায়। এ চার আসনের মধ্যে তিনি
নিজে দুটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দুটি আসনেই জয়লাভ করেন। হোসেন শহীদ
সোহ্রাওয়ার্দী বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন। তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা তখনও শীর্ষে
থাকলেও রাজনৈতিকভাবে তিনি একাকী হয়ে পড়েন।
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই আগস্ট কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। সে সময় হক
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার করতে এবং কলকাতার পার্ক সার্কাসে তাঁর হিন্দু
প্রতিবেশীদের রক্ষা করতে চেষ্টা করেন। লীগ-নেতৃবৃন্দের অনুরোধে তিনি ১৯৪৬
খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে পুনরায় মুসলিম
লীগে যোগদান করেন।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের দেশ-বিভক্তির ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি লক্ষ্য করে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত
হন। কলকাতা থেকে ফিরে তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করতে শুরু করেন। ১৯৪৭
খ্রিষ্টাব্দে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভোকেট জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের
ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে
প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আন্দোলন শুরু করে। বিক্ষোভ প্রদর্শনকারী ছাত্রদের উপর পুলিশ
লাঠিচার্জ করলে ফজলুল হক আহত হন। এই সময় তিনি মুসলিম লীগবিরোধী আন্দোলনের একজন
বিশিষ্ট নেতারূপে আবির্ভুত হন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারি
ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গণ
অভ্যুত্থানের সূচনা হয়। এই অবস্থায় ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের
২৭শে জুলাই তিনি 'শ্রমিক-কৃষক দল' প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও সোহ্রাওয়ার্দীকে
নিয়ে তিনি যুক্তফ্রন্ট গঠন
করেন।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে
২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট লাভ করে ২২৩ আসন। এর মধ্যে আওয়ামী মুসলীম লীগ পায়
১৪৩টি আসন।
১৯৫৪
খ্রিষ্টাব্দের যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভায়
বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের সাথে
ফজলুল হক ও কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতৃবৃন্দ।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনের পর এ.কে ফজলুল হক পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন।
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে তাঁকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হন এবং ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে এই পদ থেকে অপসারিত করা
হয়। এরপর থেকেই তিনি
রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে এপ্রিল ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়। কাজী
নজরুল ইসলাম এভেনিউর দক্ষিণপ্রান্তে শিশু একাডেমির পশ্চিম পাশে তিন নেতার মাজারের
মধ্যে একটি হল তাঁর সমাধি।
সূত্র: