১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে মে (১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ)
তৎকালীন বঙ্গদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী
কলকাতা
থেকে বহুদূরে
বর্ধমান
জেলার
চুরুলিয়া
গ্রামের প্রায় অখ্যাত কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। নজরুলের জন্মসংক্রান্ত তথ্যাবলী পরের অধ্যায়ে যুক্ত করা
হয়েছে। এই অধ্যায়ে নজরুলের পূর্ব-পুরুষদের বিষয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হয়েছে।
নজরুল ইসলামের বাস্তুভিটা ও বংশ পরিচয়
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়- মোগল সম্রাট শাহ্ আলমের সময় কাজী নজরুল
ইসলামের পূর্বপুরুষেরা পাটনার হাজীপুর থেকে বর্ধমানের আসানসোল মহকুমার
চুরুলিয়া গ্রামে আসেন। বর্তমানে
চুরুলিয়া হলো-
ভারত
প্রজাতন্ত্রের
পশ্চিমবঙ্গ নামক
প্রদেশের
বর্ধমান বিভাগের অন্তর্গত
পশ্চিম-বর্ধমান জেলা'র
আসনসোল
মহকুমার জামুরিয়া সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের অন্তর্গত
অজয় নদের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত একটি গ্রাম।
উল্লেখ্য, মোগল সাম্রাজ্যের ষোড়শ সম্রাট শাহ আলম দুটি পর্যায়ে রাজত্ব
করেছিলেন। প্রথম পর্যায়ে তাঁর রাজত্বকাল ছিল- ১৭৬০-১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এরপর মুহাম্মদ শাহ বাহাদুর
প্রথম রাজত্ব করেন ১৭৮৮ থেকে ১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে শাহ আলম দ্বিতীয়
রাজত্ব লাভ করেন ১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে। এরপর ১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি
সিংহাসনে বহাল ছিলেন। মাঝের একটি বছর বাদ দিলে মোটা দাগে রাজত্ব কাল দাঁড়ায়- ১৭৬০
থেকে ১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই বিচারে ধারণা করা যায়, নজরুলের পূর্বপুরুষরা
চুরুলিয়ায়
এসেছিলেন ১৭৬০ থেকে ১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে।
এই গ্রামের যেখানে নজরুলের বাস্তুভিটা হিসেবে উল্লেখ করা হয়, তার পূর্ব দিকে রাজা
নরোত্তম সিংহের গড় আর দক্ষিণ দিকে হাজী পালোয়ানের 'পীরপুকুর'। কথিত আছে হাজী
পালোয়ান স্থানীয় অধিবাসীদের জলকষ্ট দুরীকরণের জন্য এই পুকুরটি খনন করেছিলেন। এই পীর
পুকুরের পাড়ে রয়েছে হাজী পালোয়ানের কবর, যা মাজার হিসেবে লোকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতো।
এর পশ্চিম পাশে ছিল একটি মসজিদ। নজরুলের পূর্ব-পুরুষরা এই মাজার এবং মসজিদের
তত্ত্ববধায়ক ছিলেন।
অধিকাংশ নজরুল গবেষক এবং জীবনীকারদের মতে, নজরুলের পূর্ব-পুরুষরা চুরুলিয়ায় বসতি
স্থাপন করেছিল আয়মাদার হিসেবে। উল্লেখ্য, ভারতে মুসলিম শাসনামলে বিশিষ্ট ধার্মিক
ব্যক্তিদের নিষ্কর ভূমি দান করা হতো। এই ভূমিকে বলা হতো আয়মা। আর আয়মা ভোগকারী
ব্যক্তিকে বলা হতো আয়মাদার। এই বিচারে বলা যায়, চুরুলিয়ায় আসা নজরুলের পূর্ব-পুরুষরা
বিশিষ্ট ধার্মিক ব্যক্তি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। এঁরা নিষ্কর জমি ভোগ করতেন।
এঁরা ধর্মাচরণ এবং সম্ভবত ধর্ন প্রচারের জন্য
মসজিদ ও মক্তব তৈরি করেছিলেন। সম্রাটের সহযোগিতার সূত্রে এঁদের আর্থিক সমস্যা না
থাকারই কথা।
নজরুলের বংশ পদবী 'কাজী'র সাথে আয়মাদারের কোনো সম্পর্ক ছিল বলেই ধারণা করা যায়।
কারণ, ধার্মিক ব্যক্তি হিসেবে আয়মাদার নিষ্কর জমি ভোগ করতেন, এজন্য কাজী পদবী
প্রদান করা হতো না। সেকালের সুলতান বা সম্রাটরা বিচারালয়ে যাঁরা বিচার কাজ করতেন,
তাঁদেরকে কাজী পদ দেওয়া হতো। এটি মূলত পেশাদারী পদবী। সম্ভবত নজরুলের
পূর্ব-পুরুষরদের কেউ পাটনা থাকাকালে 'কাজী' পদবী লাভ করেছিলেন। এঁদের বংশধর হিসেবে
যাঁরা সে সময় চুরুলিয়ায় এসেছেলেন, তখন সেটা ছিল একটি হিন্দু-প্রধান এলাকা।
মুসলমান শাসনামলে ভারতের বহুস্থানে মুসলিমপ্রধান এলাকায় পরিণত হয়েছিল। কিন্তু
বর্ধমানে তেমনটি ঘটে নি। মুসলমান শাসকরা এরূপ আয়মাদার তৈরি করে, হিন্দু-প্রধান
এলাকায় ইসলাম ধর্মের বিস্তারে উৎসাহ দিয়েছিল। তারপরেও দেখা যায়, বর্ধমানে ১৯০১
খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শতকরা ১৭.১ জন ইসলামধর্মী ছিল। চুরুলিয়া মুসলমানরা কোথা
থেকে এসেছিল, এ নিয়ে ইংরেজদের তেমনটা উৎসাহ ছিল না। জেসিকে পিটার্সন, ১৯১০
খ্রিষ্টাব্দের
Bengal District Gazetteer,
vol XXIII (Bwadwan)-এ,
চুরুলিয়ায় আগত মুসলমানদের উৎসকে অজ্ঞাত হিসেবেই উল্লেখ করেছিলেন। তবে তাঁর লেখা থেকে
জানা যায়, এঁরা স্থানীয় নরোত্তমের ভেঙে পড়া দুর্গ থেকে ইঁট সংগ্রহ করে, ঘরবাড়ি মসজিদ
তৈরি করেছিল। এর মধ্য দিয়ে হিন্দু প্রধান চুরুলিয়ায় গ্রামে মুসলিম মহল্লার
সূত্রপাত হয়েছিল। এঁরা ছিলেন একক বা গুটি কয়েক পরিবার মাত্র। কাজীর মতো ভারিক্কি
চালের বিচার ব্যবস্থার প্রয়োজনও ছিল না। তাছাড়া চুরুলিয়াতে কাজীর দরবার যে ছিল এমন
কোনো প্রমাণও পাওয়া যায় না।
নজরুলের পিতামহের নাম ছিল কাজী আমিনউল্লাহ
এবং পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ। কাজী ফকির আহমদের দুই স্ত্রী ছিল।
- প্রথম স্ত্রীর গর্ভে এক কন্যা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এঁর নাম
ছিল সাজদন্নেসা।
- দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম ছিল জাহেদা খাতুন।
জাহেদা খাতুনের পিতার নাম মুনশী তোফায়েল আলী।
এঁর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিল ৬টি সন্তান। এঁরা হলেন- কাজী সাহেবজান, কাজী
আলী হোসেন, উম্মে কুলসুম, একটি পুত্র সন্তান (নাম পাওয়া যায় নি)। এঁরা সকলেই শৈশবে মৃত্যুবরণ
করেন। এরপর কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম হয়। পিতামাতার সন্তান হারানোর দুঃখের মধ্যে
তাঁর জন্ম। সম্ভবতঃ সেই কারণেই নজরুলের ডাক নাম রাখা হয় দুখু মিঞা। ছোট বেলায় কেউ
কেউ তাঁকে ক্ষ্যাপা বলে ডাকাতেন, কেউ আদর করে বলতেন নজর আলী। প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়
তাঁর 'কাজী নজরুল' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- 'পূর্বে নজরুল ইসলাম সাহেবের এক ভাই
চুরুলিয়াতে গুণ্ডাদের হাতে মারা যান'।
নজরুলের অন্যান্য স্বজনদের মধ্যে ছিলেন তাঁর বাবার চাচাতো
ভাই বজলুর করিম, যিনি নজরুলের পিতার মৃত্যুর পর, তাঁর মা
জাহেদা খাতুনকে বিবাহ করেছিলেন।
নজরুল পারিবারিকভাবে দরিদ্র
পরিমণ্ডলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পারিবারিক এই অর্থ-সংকটের কারণ হিসেবে আমরা কয়েকটি
বিশেষ বিষয় উল্লেখ করতে পারি। যেমন-
১.
কাজী পরিবার চুরুলিয়া যখন নতুন বসতি গড়ে তুলেছিলেন, তখন তাঁদের কাছে ছিল মোগল
সম্রাটের দেওয়া অনুদান। নিষ্কর জমি এবং এবং অনুদানের সূত্রে, হয়তো শুরুটা খারাপ
ছিল না। ইংরেজ আমলে তাঁদের নিষ্কর জমির
উপর স্বল্প মাত্রার খাজনা আরোপ করা হয়েছিল। সম্ভবত এর দ্বারা এঁদের আর্থিক অবস্থায়
প্রথম বড় ধাক্কা লেগেছিল।
২. স্থানীয়ভাবে কিছু কিছু মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বা কাজীদের দেখাদেখি
কিছু বহিরাগত মুসলমান হয়তো চুরুলিয়া ঘর বেঁধেছিল। ধর্মাচারণের মাধম্যে কাজীদের
কিছু ভক্তও তৈরি হয়েছিল। ফলে মোল্লাগিরি থেকে অর্থাগম হতো। কিন্তু ১৭৬৫
খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা সরকারি ভাষা ফার্সির বদলে ইংরেজি চালু করে। ফলে ভারতের
বহু মুসলমান পণ্ডিতদের জীবনে পেশাগত সংকট নেমে আসে। সে সময়ে মানুষ ফারসি শেখার
জন্য মৌলবীদের কাছে যাওয়া বন্ধ করে দিল। এর ধাক্কাও চুরুলিয়ার কাজী পরিবারে এসে
লেগেছিল।
৩. বর্ধমানের এই অঞ্চল এক ফসলী আবাদ হতো। ফলে এই অঞ্চলের মানুষ এমনিতেই যথেষ্ঠ
ধনী ছিল না। কাজীরা নিষ্কর ভূমি কতটা লাভ করেছিল তা জানা যায় না। কিন্তু
নজরুলের পিতা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রায় ৪০ বিঘা জমি লাভ করেছিলেন। তবে এ জমির
জন্য খাজনা দিতে হতো। নজরুলের পিতা এ জমিটুকুও ধরে রাখতে পারেন নি। তিনি পাশা
খেলে তিনি অনেক জমি খুইয়ে ছিলেন। এছাড়া পুরানো আভিজাত্যের জের ধরে তখনও এঁরা
যথেষ্ঠ দানখয়রাত করতেন।
নজরুলের জন্ম থেকে
তাঁর জন্মবর্ষের চক্র অনুসরণ করে, কয়েকটি পর্বে ভাগ করে তথ্যাদি উপস্থাপন করা হয়েছে।
নিচে এই পর্বের তালিকা দেওয়া হলো।