কলকাতা
ভিন্ন বানান: কলিকাতা, কোলকাতা।
ইংরেজি: পুরানো বানান
Calcutta ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ইংরেজি বানান নির্ধারণ করেন Kolkata। বর্তমানে ইংরেজি এই বানানেই লেখা হয়।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ নামক প্রদেশের রাজধানী। এই শহরটি পশ্চিমবঙ্গের প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্তর্গত। কলকাতা নামক জেলার জেলা সদর এই শহরে অবস্থিত।
 

কলকাতা নামকরণ

কলকাতা নামক গ্রামের নামকরণের বিষয়ে মতভেদ আছে। ভাষাতাত্ত্বিক সুকুমার সেন-এর মতে, 'কলিকাতা' – এই পরগণা নামটি এসেছে ফার্সিতে গৃহীত দুটি আরবি শব্দের সংযোগে, - 'কলি' (qali) মানে "অস্থির; নির্বোধ", এবং 'কাতা' (qatta) মানে 'বদমাইস দল' বা 'খুনেরা'। উল্লেখ্য সে সময়ে গঙ্গার পূর্ববর্তী ভাগের খাড়ি ও জঙ্গল অধ্যুসিত এলাকায় জলদস্যু, স্থল-ডাকাতি ও বিবিধ দেশী-বিদেশী ডাকাত দল এই অঞ্চলে লুকিয়ে থাকতো। কালক্রমে এই অঞ্চল দুর্বৃত্তদের এলাকা হিসেবে কলিকাতা নামকরণ হয়। কোনো কোনো মতে 'কালীক্ষেত্র' শব্দ থেকে এই গ্রামের নাম কলিকাতা হয়েছিল। পৌরাণিক কালী দেবী ডাকাতদের আরাধ্যা দেবী হিসেবে পূজিতা হতেন। এই বিচারে এই অঞ্চলে কালীদেবীর আরাধ্য এলাকা হিসেবে কলিকাতা হয়েছিল। এই মত সুকুমার সেন-এর মতকেই সমর্থন করে। অন্য মতে, নদীর খাড়ি এবং জলাশয়ের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে লম্বা স্থলভূমি তৈরি করেছিল। স্থানীয় 'কিলকিলা' শব্দ ব্যবহৃত হতো 'চ্যাপ্টা অঞ্চল' অঞ্চল হিসেবে। পরে এই  অর্থানুসারে এই অঞ্চলের নাম হয় কলকাতা। কেউ কেউ মনে করেন, খাল (নালা) শব্দটির সঙ্গে কাট্টা (খনন করা) শব্দটি যুক্ত হয়ে কলকাতা নামটি সৃষ্টি করেছে। কোনো কোনো গবেষক এও মানে করেন যে,  এই অঞ্চলে উন্নত মানের কলি (কলিচুন) ও কাতা (নারকেল দড়ি) উৎপাদিত হত। সেই থেকে কলকাতা নামের উৎপত্তি।

 

কলকাতার অবস্থান ভূ প্রকৃতি
কলকাতা শহর ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পূর্বদিকে ২২°৩০′ উত্তর অক্ষাংশ ও ৮৮°৩০′ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলে অবস্থিত।  ২০০৬ সখ্রিষ্টাব্দের হিসেব অনুযায়ী বৃহত্তর কলকাতা নামে পরিচিত শহরের নগরাঞ্চলীয় বিস্তারের মোট আয়তন ১৭৫০ বর্গকিলোমিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই শহরের গড় উচ্চতা ১.৫ মিটার (৫ ফুট) থেকে ৯ মিটারের (৩০ ফুট) মধ্যে। শহরের উত্তর-দক্ষিণ অংশের বিস্তার ঘটেছে হুগলি নদীর পাড় বরাবর। উল্লেখ্য শহরের এই অংশের বেশিরভাগ এলাকাই একসময় জলাজমি ছিল। এর অধিকাংশই ভরাট করে জনবসতি গড়ে উঠেছে। আর বাকি অংশ এখন 'পূর্ব কলকাতা জলাভূমি' নামে পরিচিত। এই জলাভূমিটি রামসার কনভেনশন অনুযায়ী একটি "আন্তর্জাতিক গুরুত্বসম্পন্ন জলাভূমি"।

সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমির বেশিরভাগ এলাকার মতো, কলকাতার মাটি ও জল মূলত পলিজ প্রকৃতির। শহরের মাটির তলায় কাদা, পলি, বিভিন্ন ক্রমের বালি ও নুড়ি নিয়ে গঠিত কোয়্যাটারনারি যুগের পললস্তর দেখা যায়। পললস্তরগুলি দুটির কাদার স্তরের মধ্যে বদ্ধ রয়েছে। নিচের কাদার স্তরটির গভীরতা ২৫০ মিটার (৮২০ ফুট) থেকে ৬৫০ মিটার (২,১৩৩ ফুট) এবং উপরের কাদার স্তরটির গভীরতা ১০ মিটার (৩৩ ফুট) থেকে ৪০ মিটার (১৩১ ফুট)। ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডসের হিসেব অনুযায়ী, কলকাতা শহর তৃতীয় ভূ-কম্পী ক্ষেত্রের অন্তর্গত, যার মাত্রা ১ (I) থেকে ৫ (V) (ভূমিকম্পের বৃদ্ধিপ্রবণতা অনুসারে)। আবার রাষ্ট্রসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির রিপোর্ট অনুযায়ী বায়ুপ্রবাহ ও ঘূর্ণিঝড় ক্ষেত্র হিসেবে কলকাতা “অতি উচ্চ ক্ষয়ক্ষতি-প্রবণ” এলাকা।

 


আয়তন(কিলোমিটারে): ১৪৮০ বর্গ কি.মি।  পৌর এলাকা ১৮৫ বর্গ কি.মি.।
লোকসংখ্যা: ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের লোক গণনা অনুসারে ৪৫,৮০,৫৪৪ জন।
জনঘনত্ব: ২৪,৭৬০ জন/ বর্গ কি.মি.
নরনারী অনুপাত: পুরুষ ১০০০ জন, স্ত্রী ৯৫৬ জন।
স্বাক্ষরতার হার: ৮১.৩১ শতাংশ।
মাতৃভাষা: বাংলা-৫৫ শতাংশ, হিন্দি-২০ শতাংশ, ইংরেজি-১০ শতাংশ, অন্যান্য-১৫ শতাংশ।
সর্বভারতীয় ক্রম: জনসংখ্যা এবং আয়তনে ভারতের সপ্তম বৃহত্তম শহর।

কলকাতার কালানুক্রমিক ইতিহাস

বাংলার প্রাচীন ইতিহাসে কলকাতা নামক স্থানের কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। কলকাতা'র প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়, ১৪৯৫ খ্রিষ্টাব্দে রচিত বিপ্রদাসের রচিত 'মনসা মঙ্গল' কাব্যে। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে লিখিত আইন-ই-আকবর গ্রন্থে রাজা টোডরমলের রাজস্ব তালিকায় মহাল কলকতার নাম পাওয়া যায়। এ সময় কলকাতা ছিল নিতান্তই গণ্ডগ্রাম। বর্তমান কলকাতা নগরীর পত্তন হয়েছিল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে।

কলকাতা নগরের জন্মের সাথে পূর্বভারত তথা বঙ্গদেশ ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি আধিপত্য বিস্তারের ইতিহাস ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। ঐতিহাসিকদের মতে ১৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দে মোগল সম্রাট ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বঙ্গদেশে বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান করে। ১৬৩৯ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সিস ডে নামক জনৈক ইংরেজ বণিক চন্দ্রগিরির রাজার কাছ থেকে মাদ্রাজের ইজারা লাভ করে। এই সময় এই বণিক মাদ্রাজের সেন্ট জর্জ নামক একটি দুর্গ এবং বাণিজ্যকুঠি তৈরি করেন। এরপর ইংরেজরা মসুলিট্টমের পরিবর্তে মাদ্রাজে তাদের বাণিজ্যক কেন্দ্র স্থানান্তর করে। ১৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজ ও ইংরেজদের ভিতরে সন্ধি হয়। এই সময় তৎকালীন বোম্বাই শহরকে পর্তুগিজরা বাণিজ্যিক রাজধানীতে পরিণত করেছিল।


১৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজরা  পাটনা এবং কাশিমবাজার-এ বাণিজ্যকুঠি নির্মাণ করে। এই দুটি কুঠির মাধ্যমে ইংরেজরা রেশমী কাপড়, সুতীবস্ত্র, সোরা, চিনি সংগ্রহ করে ইউরোপে রফতানি করতো। ১৬৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সনদ অলিভার ক্রমওয়েল নবায়ন করেন। এই নবায়নের ফলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠে। ১৬৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন প্রতিনিধি হিসেবে জেমস হার্ট ঢাকা প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে বাংলায় ইংরেজ আগমন শুরু হয়। এই বৎসরেই বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে মাদ্রাজকে সুসংহত করে। ১৬৬১ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় চার্লস পর্তুগিজ রাজকন্যা ক্যাথরিন ব্রাগাঞ্জাকে বিবাহ করেন। ফলে ইংল্যান্ডের রাজা বোম্বাই শহর পরতুগিজ রাজার কাছ থেকে যৌতুক হিসেবে লাভ করেন। পরে দ্বিতীয় চার্লস বোম্বাই শহরকে বাৎসরিক দশ পাউন্ডের বিনিময়ে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে ন্যস্ত করেন। ইতিমধ্যে মারাঠারা সামরিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠে এবং মোগল শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো ক্ষমতা অর্জনে সক্ষম হয়। এরা ১৬৬৪ সুরাট আক্রমণ করে ব্যাপক লুট তরাজ চালায়। এছাড়া বঙ্গদেশে মোগল আধিপত্যও দুর্বল হয়ে পড়ে। এই কারণে ইংরেজরা তাদের কুঠিগুলোকে সুরক্ষিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ১৬৬৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম মারাঠা আক্রমণের পর, বোম্বাই কুঠির প্রেসিডেন্ট ও গভর্নর স্যার জর্জ ওক্সেডেন ইংল্যান্ড সরকারের কাছে নিজেদের রক্ষা করার উপযোগী অস্ত্রধারণের অধিকারের কথা জানায়। ইংল্যান্ড থেকে এরা সে অধিকার লাভও করে। ইংরেজরা নিজেদেরকে সুরক্ষিত করার আগেই ১৬৭০ খ্রিষ্টাব্দে মারাঠারা পুনরায় সুরাট আক্রমণ করে লুটতরাজ করে।
 

ঙ্গদেশে কোম্পানির ব্যাপক বিস্তারের কারণে, ১৬৮১ খ্রিষ্টাব্দে, কোম্পানি বেঙ্গল এজেন্সি (Bengal Agency  নামে নতুন প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু করার উদ্যোগ নেয়। সেই সূত্রে বেঙ্গল এজেন্সির প্রথম গভর্নর হন উইলিয়াম হেজেস (William Hedges)। তিনি গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান ১৬৮১ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা ডিসেম্বর। ১৬৮৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত  তিনি এই পদে থাকেন। এই সময় কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত জব চার্নক-এর সাথে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়। ফলে কোম্পানি সুচারুরূপে বঙ্গদেশের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে নি। এই অবস্থায় মাদ্রাসের ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে উইলিয়াম জিফোর্ড (William Gyfford) বাংলার গরভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৬৮৪ খ্রিষ্টাব্দের  ১৭ই জুলাই এই জন এই পদে নিয়োগ পান জন বিড (John Bead)।  ১৬৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ আগষ্ট জন বিড মৃত্যুবরণ করলে, নতুন গভর্নর হন জব চার্নক (Job Charnock)।

মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব-এর শাসনাধীন বঙ্গদেশের শাসনকর্তা মীরজুমলার মৃত্যু হয় ১৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দে। এরপর বাংলার শাসনকর্তা হন শায়েস্তা খাঁ। তিনি সে সময়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলে পর্তুগিজদের ঘাঁটি ছিল। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে শায়েস্তা খাঁ আরাকানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চট্টগ্রামকে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপর শায়েস্তা খাঁ পর্তুগিজ দস্যুদেরকে বিতারিত করে সন্দীপ দখল করে নেন। এরপর শায়েস্তা খাঁ কোম্পানির কার্যক্রমের উপর নজর দেন। াংলায় ইংরেজ কুঠি স্থাপনের পর থেকে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইংরেজরা বিশেষ সুবিধা লাভ করতে পারে নি। মোগল কর্মকর্তারা নানাভাবে কোম্পানির কর্মচারীরাদের কাছ থেকে কর আদায় করতো। ফলে ইংরেজদের সাথে মোগলদের সংঘাত সৃষ্টি হয়। মোগলরা হুগলীর ইংরেজ কুঠি আক্রমণ করে। ইংরেজরা জব চার্নকের নেতৃত্বে হুগলী ত্যাগ করে সুতানটিতে আশ্রয় নেয়। মোগলরা পুনরায় আক্রমণ করলে, জব চার্নক সুতানটি পরিত্যাগ করে বালেশ্বরে চলে যায়। এরপর মোগলবাহিনী বালেশ্বর অধিকার করে।

১৬৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজরা হুগলী দখলের চেষ্টা করে। এর ফলে মোগল সৈন্যদের সাথে ইংরেজ সৈনিকদের যুদ্ধে হয়। এই যুদ্ধে ইংরেজরা পরাজিত হয়ে হুগলী ত্যাগ করে। ১৬৮৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার শাসনকর্তা শায়েস্তা খাঁ, কোম্পানির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জব চার্নককে, কলকাতার ২০ মাইল দক্ষিণে উলুবেড়িতে বাণিজ্যকুঠি নির্মাণের অনুমতিও দেন। ১৬৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজরা তাদের বাণিজ্যিক কেন্দ্র সুরাট থেকে বোম্বাইতে স্থানন্তরিত করে। বোম্বাই উপকূলে মোগল সৈন্যদের সাথে ইংরেজদের যুদ্ধ শুরু হলে শায়েস্তা খান, জব চার্নককে দেওয়া অনুমতি প্রত্যাহার করে নেন। এছাড়া এই সময় কোম্পানির সৈন্যরা ক্যাপ্টেন হিথ-এর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম দখল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ১৬৮৯ খ্রিষ্টাব্দে মোগল যুদ্ধ জাহাজ সিদি ইয়াকুবের নেতৃত্বে বোম্বাই নগরী অবরোধ করে। প্রায় ১ বৎসর অবরুদ্ধ থাকার পর, কোম্পানির সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে। ইংরেজরা সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। মোগল সম্রাট তাদের ক্ষমা করেন এবং ইংরেজদের পুনরায় বাণিজ্য করার অনুমতি প্রদান করেন। এই সময় কোম্পানির পক্ষ থেকে সম্রাটকে দেড় লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রদান করা হয়। এই বৎসরে বাংলার শাসনকর্তা ইব্রাহিম খাঁ জব চার্নবকে মাদ্রাজ থেকে ডেকে এনে বাৎসরিক তিন হাজার টাকার বিনিময়ে বাংলায় বাণিজ্য করার অধিকার দেওয়া হয়। একই সাথে জব চার্নবকে বাংলার জমিদারি ক্রয় করার অধিকার দেওয়া হয়। ১৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে জব চার্নক বঙ্গদেশে কোম্পানি বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেব হিসাবে এই সুতানুটি, গোবিন্দপুর এবং কলিকাতাকে নির্বাচন করেন।

সে সময়ের খাস কলকাতা বলতে বুঝায় সুতানুটি, গোবিন্দপুর এবং কলিকাতা নামক তিনটি গ্রামের সমন্বিত অঞ্চল। গ্রাম তিনটির এর আঞ্চলিক বিস্তার ছিল-

১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দের দৃশ্যানুসারে অঙ্কিত ছবি

এই সময়ে বাণিজ্যের আধিপত্য নিয়ে ওলন্দাজ, পর্তুগিজ এবং ফরাসি কোম্পানিগুলোর মধ্যে যে দ্বন্দ্ব ছিল, তারই সূত্রে ইংরেজরা গোবিন্দপুরে একটি দুর্গ নির্মাণের পরিকল্পনা করে।

১৬৯৮ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি আওরঙ্গজেবের পৌত্র আজিম-উস্-শানের কাছ থেকে ১৬ হাজার টাকায় সুতানুটি, কলকাতা এবং গোবিন্দপুরের মালিকানা ক্রয় করেন। এই বছরের ১০ই নভেম্বর এই স্থানের জমির মালিকদের কাছ থেকে জমি ক্রয় করে মাত্র ১৩০০ টাকায়। এই গ্রাম তিনটির জন্য কোম্পানি মোগল সম্রাটকে বার্ষিক কর ১২৮১ টাকা ৮ আনা প্রদান করতো। এই বন্দোবস্তে কোম্পানি এই তিনটি গ্রামের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র নাম কলকাতা ব্যবহার করা শুরু করেছিল। ফলে কিছু দিনের ভিতরে কলকাতা নামের ভিতরে সুতানুটি ও গোবিন্দপুর হয়ে পড়ে কলকাতার অংশ মাত্র।

বাণিজ্যিক নিরাপত্তার জন্য কোম্পানি একটি দুর্ নির্মাণের জন্য মোগল সম্রাটের কাছে আবেদন করেছিল। কিন্তু সম্রাটের অনুমতি লাভে ব্যর্থ হয়। ১৬৯৫ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে মোগল শাসনের বিরুদ্ধে মেদেনীপুরের চেতোয়া-বর্দারের জমিদার শোভা সিংহ বিদ্রোহ করে এবং বর্ধমানের কৃষ্ণরাম রায়ের জমিদারিতে আক্রমণ চালায় এবং শোভা সিংহ ব্যাপক লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড চালায়। এই বিদ্রোহের অজুহাতে কোম্পানি নিজেদের নিরাপত্তার জন্য দুর্গ নিরমাণের অনুমতি পায়। ১৬৯ খ্রিষ্টাব্দে জন গোল্ডসবর্গ (
John Goldsborough) -এর তত্ত্বাবধানে ভাগিরথীর তীরে দূর্গ স্থাপনের উদ্যোগ নেন । স্যার চার্লস (Sir Charles Eyre) আইয়ার এই নির্মাণ শুরু করেন এই বৎসর থেকে। ১৭০১ খ্রিষ্টাব্দে জন বিয়ার্ড  (John Beard) উত্তর-পূর্বাংশের দুর্গপ্রাচীর সংযোজন করেন। ১৭০২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দুর্গের মধ্যভাগে গভর্নমেন্ট হাউস (ফ্যাক্টরি) নির্মাণ শুরু করেন এবং ১৭০৬ খ্রিষ্টাব্দে এই নির্মাণ কাজ শেষ হয়। উল্লেখ্য এর মূল ভবনটি ছিল দোতলা। মূলত এই দুর্গটি ছিল একই সাথে সেনানিবাস এবং আঞ্চলিক সেনাসদর দফ্তর।

১৭০০ খ্রিষ্টাব্দে আজিম-উস-শান মৃগয়ার জন্য বেলভেডিয়র ভবন তৈরি করেছিলেন। পরে তা ১৮৫৮ থেকে ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভবনটি 'ছোট লাটভবন' নামে ব্যবহৃত হতো।

ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি বিপুল পরিমাণ মুনাফা করলে, ইংল্যান্ডে এদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেব একটি নতুন ব্যবসায়ী দল ঐক্যবদ্ধ হয়। এই নব্য দলের নাম রাখা হয়
the English Company Trading to the East Indies। এই দলের প্রভাবে, ১৬৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট আইন পাশ করে একটি নতুন কোম্পানিকে বাণিজ্য সুবিধা প্রদান করা হয়।  এই কোম্পানি দূত হিসেবে স্যার উইলিয়াম নরিশ সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাছে আসেন। কিন্তু ঔরঙ্গজেবের কাছ থেকে বাণিজ্যিক সুবিধা লাভে ব্যর্থ হন। এর ফলে এই নব্য কোম্পানটি ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ১৭০৮ খ্রিষ্টাব্দে উভয় কোম্পানি একত্রিত হয় একটি মিশ্র কোম্পানিতে পরিণত হয়। এই কোম্পানির নতুন নাম হয়The United Company Marchants of England Trading to the East Indiesএরপর কোম্পানি কোলকাতা কেন্দ্রিক একটি শক্তিশালী বাণিজ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। এই লক্ষ্যে ১৭১৫ খ্রিষ্টাব্দে কোম্পানির তরফ থেকে জন সুরম্যান-কে সম্রাট ফরুকশিয়ারের দরবারে পাঠানো হয়। দুই বৎসর আলোচনার পর ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট তিন হাজার টাকার বিনিময়ে কোম্পানি বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতি পায় এবং কোম্পানি নিজেদের নামে মুদ্রা প্রকাশের অনুমতি লাভ করে।

এরপর ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে একটি বাণিজ্য এলাকায় পরিণত হয়। স্থানীয় ব্যবসায়ী ধনী ব্যাক্তি এবং ইংরেজরা পাকা বাড়ি তৈরি করা শুরু করে। স্থানীয় ভাবে বিচার-আচারের জন্য, ১৭২৬ খ্রিষ্টাব্দে বিচার বিভাগীয় কার্যক্রমের জন্য, রয়্যাল চার্টারের মাধ্যমে 'মেয়র্স কোর্ট চালু হয়।

১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা নবাব সিরাজউদ্দৌলা'র সাথে ইংরেজদের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। এরপর নবাবের সৈন্যরা ইংরেজদের কাসিমবাজার কুঠি দখল করে। ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ১৬ই জুন নবাবের সৈন্যরা কলকাতা আক্রমণ করে এবং ২০ জুন কোলকাতা দখল করতে সক্ষম হয়। এরপর লর্ড ক্লাইভ এবং ওয়াটসন তামিল নাড়ু থেকে কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য অগ্রসর হয়। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন ইংরেজদের সাথে নবাবের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে নবাবের কতিপয় সেনাপতিদের বিশ্বাসঘাতকতায় ইংরেজরা জয় লাভ করে। এই যুদ্ধের ইংরেজদের প্রধান নায়ক হিসেবে লর্ড ক্লাইভকে ধরা হয়। ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে ক্লাইভ দেশে ফিরে গেলে ইংরেজরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এই কারণে ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে এবং কোম্পানির গভর্নর নিযুক্ত হন।

১৭৬৫ খ্রিষ্টব্দের ১লা  আগষ্ট দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করেন। এর ফলে বিহার-ওড়িশার প্রকৃত শাসন ক্ষমতা লাভ করে, নবাবের নামে মাত্র অস্তিত্ব থাকে। পূর্ব ভারতের এই অঞ্চলে যে শাসন-ব্যবস্থা চালু হয় তা দ্বৈত শাসন নামে পরিচিত। নবাবের হাতে থাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব, আর রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের পূর্ণ কর্তৃত্ব পায় কোম্পানি। এই সূত্রে কলকাতা কোম্পানির প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয়।

১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ঘোষিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে কলকাতার চারপাশের জলাভূমিগুলি ভরাট করা হয়। এই সময়ে হুগলি নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠে গভর্নমেন্ট প্লেস বা অফিসপাড়া। লর্ড ওয়েলেসলির (গভর্নর-জেনারেল ১৭৯৭-১৮০৫) শাসনকালে শহরটির উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছিল। তাঁর আমলেই কলকাতার অধিকাংশ সরকারি ভবনের নির্মাণকার্য শুরু হয়।

১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দে, কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হয়। এছাড়া ভাগিরথীর তীরে স্থাপিত দূর্গটির সংস্কার সম্পন্ন হয় এই বছরে। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে এর নামকরণ করা হয় 'ফোর্ট উইলিয়াম'। উল্লেখ্য ইংল্যান্ডের তৎকালীন রাজা উইলিয়াম চতুর্থের নামানুসারে এই নামটি গ্রহণ করা হয়েছিল।

১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কলকাতাকে কোম্পানি শাসিত অঞ্চলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

১৭৮১ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতা মাদ্রাসা (অধুনা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) চালু করেন।

১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে স্যার উইলিয়াম জোন্সা প্রতিষ্ঠা করেন গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান 'এশিয়াটিক সোসাইটি'।

১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা শহরকে ৩১টি থানায় ভাগ করা হয়েছিল।

১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ইঞ্জিনিয়ার কর্নেল কিডের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয় শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন।

১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এই সময় এই কলেজে  আরবি, হিন্দুস্তানি, ফারসি, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষা শেখানো হতো। 

১৮০২ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড ওয়েলসলি প্রায় ১৩ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেন লাটভবন।

১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দে নগরবাসীর অর্থায়নে নির্মিত হয় টাউন হল।

 

১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয় করেন। উল্লেখ্য ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জুন থেকে 'হিন্দু কলেজ' 'প্রেসিডেন্সি কলেজ' পরিচয়ে কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপান্তরিত করার দাবি উত্থাপন করা হয়। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়।

১৮৩০-এ কলকাতা ডকিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা পায়।

১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দে টিপু সুলতানের পুত্র নবাবজাদা গোলাম মহম্মদ তৈরি করেন টিপু মসজিদ।

১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু হয়। এই ব্যবস্থায় বিচারবিভাগীয় প্রশাসনের বদলে সাতজন বেতনভোগী সদস্যের একটি বোর্ড গঠন করা হয়। এদের নির্বাচিত করেন শহরের করপ্রদানকারী বাসিন্দারা। এই বোর্ডকে শহরের উন্নতি এবং রাস্তা বা নর্দমার সংরক্ষণের জন্য সম্পত্তি ক্রয় এবং অধিকারে রাখার ক্ষমতা প্রদান করা হয়।

১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতা ও গৌহাটির মধ্যে নৌ-যোগাযোগের জন্য স্টিমার চালানোর ব্যবস্থা করে।

১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে এই বোর্ডের বদলে নতুন চার সদস্যের বোর্ড তৈরি করা হয়। এদের ভিতর দু’জন সরকার দ্বারা নিযুক্ত আর দু’জন নির্বাচিত হন। এই সময়ে বসবাস, আলো, ঘোড়া বা গাড়ি ব্যবহারের জন্য কর ধার্য করা হয়।

১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে ইষ্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের চীফ ইঞ্জিনিয়ার হাওড়া ষ্টেশনের জন্য প্রস্তাব দেন। কিন্তু স্টেশনের জন্য জমি সংগ্রহ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তা ছাড়া গঙ্গার উপরে সেতু তৈরির অসুবিধাও ছিল। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে রেললাইন পাতার কাজ শুরু হয়েছিল হাওড়া থেকে রাণিগঞ্জ পর্যন্ত। এই সময় বালী খাল, শ্রীরামপুর অঞ্চল ঘন জঙ্গলে ভরা ছিল। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই আগষ্ট হাওড়া থেকে হুগলী পর্যন্ত প্রথম ট্রেন চালানো হয়েছিল।

১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং-এর আমলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় কলকাতায় বসবাসরত ব্রিটিশ ও ভারতীয় সংস্কৃতির মিশ্রণে শহুরে বাঙালিদের মধ্যে এক নব্য বাবু শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছিল। এঁরা ছিলেন মূলত উচ্চবর্ণীয় হিন্দু, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি। পেশাগতভাবে এঁরা ছিলেন জমিদার, সরকারি কর্মচারী, আইনজীবী, শিক্ষক ইত্যাদি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণ সূচনা হয়েছিল কলকাতা শহর। বাংলার এই নবজাগরণ শুধু বাংলা নয়, সমগ্র ভারতের পথপ্রদর্শক হয়েছিল। এই আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২–১৮৩৩), হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯–১৮৩১), রামতনু লাহিড়ী (১৮১৩–১৮৯৮), মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭–১৯০৫), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০–১৮৯১), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮–১৮৯৪), রামকৃষ্ণ পরমহংস (১৮৩৬–১৮৮৬), কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮–১৮৮৪), স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩–১৯০২) প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। এই ধারাকে পরবর্তী সমুন্নত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র বসু-সহ বহু বুদ্ধিজীবী বাঙালি।

১৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ইস্টর্ন রেলওয়ে কলকাতা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত ১১১ মাইল দীর্ঘ রেলপথ তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
 
১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে, ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশন কোম্পানি- কলকাতা ও গৌহাটির মধ্যে নৌ-যোগাযোগের বাণিজ্যিক অধিকার লাভ করে। এই সময় সরকারি স্টিমার পরিসেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা-কুষ্টিয়া রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়।

১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে নতুন পৌর বোর্ড তৈরি হয়। এই বোর্ড নিজস্ব উপ-পৌরপ্রধান নির্বাচন করেন। এই সময় নিয়মিত স্বাস্থ্য আধিকারিক, স্থপতি, আমিন, কর-সংগ্রাহক বা নিয়ামক নিয়োগ করা হয়। এই সময়েই পয়ঃপ্রণালি এবং জলসরবরাহ সেবা উৎকর্ষতা লাভ করে।

১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে কসাইখানা স্থাপিত হয়।
১৮৬ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত হয় আলিপুর চিড়িয়াখানা

১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা হাইকোর্ট ভবন নির্মিত হয়।

১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা নিউ মার্কেট প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া বড় বড় রাস্তাগুলির সাথে পায়ে হাঁটার উপযোগী ফুটপাথ তৈরি হয়। এই সময়ে বসবাসের জন্য কর দশ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ৭২ জন কমিশনার (পৌর প্রতিনিধি) সমন্বিত নতুন পৌর প্রতিষ্ঠান (কর্পোরেশন) স্থাপিত হয়। এর মধ্যে ৪৮ জন নির্বাচিত এবং ২৪ জন সরকার কর্তৃক নিয়োজিত। এই সময়েই হাওড়া ও শিয়ালদায় দুটি প্রান্তিক রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যে সংযোগকারী হ্যারিসন রোডটি নির্মিত হয়।

১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে বেলেঘাটা থেকে ডায়মন্ড হারবার ট্রেন লাইনের সংযোগ হয় । এই বছর রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম একটি জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করেন। এরই সূত্রে ধীরে ধীরে কলকাতা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই সময়ে কলকাতা কেন্দ্রিক সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন গড়ে উঠে। ধীরে এই সংগঠনের কার্যক্রম সমগ্র বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে সরকার একে অধিগ্রহণ করে নাম রাখে ইষ্টার্ণ বেঙ্গল রেলওয়ে। এই সময় নর্থ বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে এবং সাউথ ইস্টার্ণ রেলওয়েকে একীভূত করা হয়। তার পরে একে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের সাথে যুক্ত করে নাম রাখা হয় বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম রেলওয়ে। এই সময়ে রানাঘাট এবং বনগার মধ্যে রেল যোগাযোগ চালু হয়।

১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে নৈহাটি এবং ব্যান্ডেলের ভিতর একটি জুবলি রেলসেঁতু তৈরি হয়।

১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে বেলেঘাটা এবং বজবজ-এর মধ্য রেলসংযোগ হয়।

১৮৯৬-এ কর্পোরেশনের নিজস্ব মোহরচিহ্ন তৈরি হয়। এতে দেখানো হয় একজোড়া হাড়গিলে পাখি তাদের পা দিয়ে একটি মুকুট বহন করছে।

১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে কলকাতায় ব্যাপক গণবিক্ষোভ ও ব্রিটিশ দ্রব্য বয়কট (স্বদেশী আন্দোলন) শুরু হয়। এই বছরের
১লা ডিসেম্বর হাওড়া নতুন রেলস্টেশন ষ্টেশনের উদ্বোধন হয়।

১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে এটি জনসাধরণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়।

১৯২৩ সালে ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্টের অধীনে কলকাতার স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন কর্তৃপক্ষ কলকাতা পৌরসংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে এই পৌরসংস্থার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। পরবর্তীকালে সুভাষচন্দ্র বসু, বিধানচন্দ্র রায়, আবুল কাশেম ফজলুল হক প্রমুখ বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এই পদ অলংকৃত করেছিলেন।

রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাংলার প্রথম স্থানীয় স্ব-শাসন মন্ত্রী করে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে এ সম্পর্কে আইন প্রণয়ন করা এই সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। এই আইনের সাহায্যে প্রতিষ্ঠানের গঠনতন্ত্রে গণতান্ত্রিক ধারা সংযোজিত করে স্ব-শাসন-ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয় এবং সরকারি হস্তক্ষেপ লঘু করা হয়। মানিকতলা, কাশীপুর, চিৎপুর, গার্ডেন রিচ তথা নতুন বন্দর এলাকাকে সংযুক্ত করে বৃহত্তর কলকাতার রূপদান করা হয়। এই আইনের বলে এই প্রথম মহিলাদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয় শাসনপ্রণালিতে। তার প্রতি সম্মান জানাতে কলকাতা পৌরপ্রতিষ্ঠান তার প্রধান দপ্তরের লাগোয়া রাস্তার নামকরণ করে রাষ্ট্রগুরুর নামে।

১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে বালি ব্রিজ বা ওয়েলিংডন ব্রিজের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিজটির কাজ শেষ হয়। তৎকালীন বড় লাট ওয়েলিংডনের নামানুসারে এই ব্রিজের নামকরণ করা হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপানি সেনাবাহিনী একাধিকবার কলকাতা শহর ও বন্দরে বোমা নিক্ষেপ করেছিল। কলকাতায় জাপানি বোমাবর্ষণের প্রথম ও শেষ ঘটনাটি ঘটে যথাক্রমে ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর এবং ১৯৪৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর। এই যুদ্ধের সময় কলকাতায় লক্ষাধিক মানুষ অনাহারে মারা যান।

১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের দাবিতে এক ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কলকাতায় চার হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান। ভারত বিভাগের সময়ও বহু মানুষ সাম্প্রদায়িকতার শিকার হন। দেশভাগের পর বহুসংখ্যক মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি জমান এবং সেই দেশের লক্ষ লক্ষ হিন্দু কলকাতায় চলে আসেন। এর ফলে কলকাতা একটি রিফুজি নগরে পরিণত হয়েছিল।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গদেশের পশ্চিমাংশের হিন্দু প্রধান এলাকা নিয়ে গঠিত হয় পশ্চিমবঙ্গ। এই সময় কলকাতা পশ্চিম বঙ্গের প্রাদেশিক রাজধানীতে পরিণত হয়। তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দু শরণার্থীদের ব্যাপক হারে পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশের কারণে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় একাধিক কার্যকরী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেন। এই সময় কলকাতার জনসংখ্যার চাপ কমাতে শহরের উপকণ্ঠে চব্বিশ পরগনায় (অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা) লবণহ্রদ (অধুনা বিধাননগর) ও নদিয়া জেলায় কল্যাণী নামে দুটি পরিকল্পিত উপনগরী গড়ে তোলা হয়। এছাড়া কলকাতা বন্দরের সাহায্যার্থে সহযোগী হলদিয়া বন্দর নির্মিত হয়। হুগলি নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনাও গৃহীত হয়।

১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত হয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নৃত্য, নাটক, সংগীত ও চারুকলা আকাদেমি। উদয় শংকর, অহীন্দ্র চৌধুরী ও রমেশ বন্দ্যোপাধ্যায় যথাক্রমে নৃত্য, নাটক ও সংগীতের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরে অবশ্য উদয় শংকর তাঁর পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।

১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আসন্ন রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেন। এই সূত্রে তৈরি হয় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি চালু হয় ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শৈ বৈশাখ (রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে)।

১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে ব্যাপক বিদ্যুৎ বিভ্রাট, ধর্মঘট ও জঙ্গী নকশাল আন্দোলনের ফলে শহরের পরিকাঠামো ব্যবস্থা গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের বহুসংখ্যক মানুষ শরণার্থী হিসাবে কলকাতায় আশ্রয় নিলে শহরের অর্থনীতির উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়।

১৯৫১ ও ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার কর্পোরেশন আইন সংশোধন করা হয়। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকার শেষবার এই আইন সংশোধন করেন। সংশোধিত নতুন আইন কার্যকর হয় ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৯২ সালে

১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় সংবিধানের ৭৪তম সংশোধনী বিল পাস হলে কলকাতা পৌরসংস্থা সামাজিক ন্যায় ও আর্থিক উন্নয়নের স্বার্থে পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষমতা পায়।
২০০১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার ইংরেজি নাম ‘ক্যালকাটা’ বদলে ‘কলকাতা’ করা হলে ‘কলিকাতা পৌরসংস্থা’ নামের পরিবর্তে ‘কলকাতা পৌরসংস্থা’ নামটি চালু হয়।


সূত্র:

https://www.kmcgov.in/KMCPortal/jsp/KMCPortalHome1_bn.jsp