বাংলা ভাষার পারিবারিক পরিচয় |
বাংলা
বাঙালির ভাষার নাম বাংলা।
ইংরেজি : Bengali, Bangla।
ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের একটি
উল্লেখযোগ্য ভাষা। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা রাজ্য এবং
আসামের কাছাড়, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দির স্থানীয় ভাষা। এছাড়া বাংলা ঝাড়খণ্ডের দ্বিতীয়
ভাষা। আফ্রিকার সিয়েরে লিওনের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। এছাড়া ভারতের
প্রায় সকল প্রদেশেই বাংলা ভাষাভাষীরা বসবাস করে। ভারতবর্ষের বাইরে মধ্যপ্রাচ্য,
মায়ানমার, মালোয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইংল্যান্ড, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা প্রভৃতি দেশে বিশাল সংখ্যক বাঙালি বসবাস করে।
মানুষের কথিত ভাষার
ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা পরিবারের অন্তর্গত
ইন্দো-ইরানিয়ান
ভাষা
উপ-পরিবারের একটি শাখার নাম−
ভারতীয়-আর্য ভাষা।
এই শাখার উপশাখা
পূর্বাঞ্চলীয়
আর্য ভাষা। এই উপশাখার প্রধান ধারার ভাষা হলো সংস্কৃতি।
এই সময় ভারতবর্ষের নেগ্রিটো, প্রোটোঅস্ট্রালয়েড, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় জাতির মানুষের
সংমিশ্রণে সংকর জাতিসত্তার সৃষ্টি হয়েছিল। আর এদের ভাষার সংমিশ্রণে, ভারতের বিভিন্ন
স্থানে আদিম প্রাকৃত ভাষার উদ্ভব ঘটেছিল। মোটা দাগে আর্য-ভাষাভাষীদের সাথে তুলনা
করে, প্রাচীন ভারতের সমগ্র ভাষারূপকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।
১. ভারতীয়-আর্য ভাষা: এর আদিম রূপ বৈদিক-ভাষা। পরে সংস্কারের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল সংস্কৃত ভাষা।
২. অনার্য ভাষা: আর্যদের আগমনের আগে ভারতবর্ষে বসবাসকারীদের ভাষাসমূহ এবং এই সকল ভাষার সংমিশ্রণে স্থানীয় আদিম প্রাকৃত ভাষা।
বৈদিক যুগে আর্যরা আদিম অধিবাসীদের দস্যু বা
অসুর নামে অভিহিত করতো। ঋগ্বেদের অসুররা ছিল মূলত গাঙ্গেয় উপত্যকায়
'দাস' গোষ্ঠীর লোকেরা। ধারণা করা হয়, এই দাসরাই ছিল পূর্বভারতের বঙ্গীয় অঞ্চলের
আদিবাসী। এরা অনার্য ভাষায় কথা বলতো, বেদকে এবং বেদের দেবতাদের মান্য করতো না।
আর্যরা গাঙ্গেয় উপত্যাকায় ক্রমাগত যুদ্ধের দ্বারা 'অসুর'-দের পরাজিত করে
আর্য-রাজ্যের বিস্তার ঘটায়। ঋগ্বেদের আমলে আর্যরা ভারতবর্ষকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ
করেছিল। ভাগ তিনটি হলো ব্রহ্মাবর্ত (আর্যবর্ত), মধ্যদেশ ও দক্ষিণাবর্ত। ঐতরেয়
ব্রাহ্মণ এবং অর্থব বেদে পাঁচটি ভাগ পাওয়া যায়। এগুলো হলো-মধ্য দিশ, প্রাচ্য দিশ,
দক্ষিণা দিশ, প্রতীচী দিশ ও উদীচী দিশ। এর বাইরে অনার্য সংস্কৃতি-সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল
মগধ (দক্ষিণ বিহার) ও অঙ্গ। এর ভিতরে মগধ অঞ্চলে যে ভাষা প্রচলিত ছিল, তাকে
সাধারণভাবে বলা হয় মাগধি। ভাষাতত্ত্বে এর নাম
মাগধী প্রাকৃত।
বৈদিক সংহিতায় মাগধী ভাষাকে বলা হয়েছে অসংস্কৃত প্রাকৃত ভাষা।
খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীর দিকে আর্যরা তাদের রাজ্য বিস্তার ঘটিয়ে মগধ পর্যন্ত
চলে আসে। এই সময় থেকে মগধে বেদ-অগ্রাহ্যকারী পণ্ডিতদের আধিপত্য ছিল। সাধারণ মানুষের
উপর এই পণ্ডিতদের আধিপত্য ছিল। তবে আর্য-সংস্কৃতির চর্চা ছিল এদের ভিতরে। মূলত এদের
দ্বারাই মগধে বৈদিক শব্দের অনুপ্রবেশ শুরু হয়েছিল। এই পরিবেশের ভিতরে
আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪০ অব্দের দিকে বৈশালীর নিকট কুন্দগ্রামের এক ক্ষত্রিয় বংশে
জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীর জন্মগ্রহণ করেন। বেদ বিরোধী পরিবেশে ভিতর জন্মগ্রহণ
করলে, বৈদিক ভাষা এবং সংস্কৃতির ধারাকে অনুসরণ করতেন। ধর্ম প্রচারের জন্য তিনি যখন
বঙ্গীয় রাঢ় অঞ্চলে আসেন তখন, স্থানীয় অনার্যরা তাঁকে মেনে নিতে পারে নি। যতদূর জানা
যায়, মহাবীর রাঢ়ে এলে স্থানীয় মানুষেরা তাঁর পিছনে কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল।
আর্য-অনার্যের এই সংঘাত এতটাই প্রবল ছিল যে, সেকালে অনার্যরা আর্যদেরকে কথা বলার
যোগ্য ব্যক্তি মনে করতো না। পক্ষান্তরে আর্যরা মগধ বা বঙ্গদেশে এলে, দেশে ফিরে
প্রায়শ্চিত্ত করতে হতো। উল্লেখ্য,
খ্রিষ্ট-পূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে- বিশিষ্ট বৈয়াকরণ পতঞ্জলি তাঁর
'মহাভাষ্যে'
গ্রন্থে প্রাচীন ভারতীয় প্রাকৃত ভাষাকে অপভ্রংশ নামে অভিহিত
করেছিলেন। তিনি সংস্কৃত ভাষার বিচারে প্রাকৃতজনের ভাষাকে অধঃপতিত ভাষা
হিসেবে এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।
তাঁর মতে- অপভ্রংশ ছিলো
শাস্ত্রহীনের ভাষা
বা
অশিষ্ট
লোক-সাহিত্যের ভাষা হলো।
মূলত ক্ষত্রিয় মৌর্য বংশের রাজাদের আমলে, বঙ্গদেশ মগধ রাজ্যের অধিকারে আসে। বিশেষ
করে সম্রাট
অশোক
(খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৩-২৩২ অব্দ)-এর
সময়ে বঙ্গদেশে আর্য-সংস্কৃতি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার ঘটে। এই সময় সংস্কৃত শব্দের
ব্যাপক অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকে। এই সময় বৌদ্ধ-ধর্ম বঙ্গদেশে প্রধান ধর্মে পরিণত
হয়েছিল। এই ধারা নতুন রূপ নেয়
গুপ্ত রাজবংশ (২৪০ থেকে ৫১০ খ্রিষ্টাব্দ) -শাসনামলে। এই সময় বৈদিক ধর্মের বিকাশ
ঘটে। ফলে বেদ, উপনিষদ, সংহিতা, পুরাণ ইত্যাদির চর্চার মধ্য দিয়ে বঙ্গদেশে সংস্কৃত
শব্দের দ্বারা প্রাকৃত-শব্দের প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া প্রবল হয়ে উঠে। ব্রাহ্মণ
পণ্ডিতরা বিশুদ্ধ উচ্চারণ এবং বানানে সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করত। অন্যদিকে সাধারণ
মানুষ সংস্কৃত শব্দে উচ্চারণ বিভ্রাট ঘটিয়ে অর্ধ-তৎসম আর তদ্ভব শব্দের জন্ম দেওয়া
শুরু করেছিল। এরই ভিতর দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল যে ভাষারূপ,
আধুনিক কালের ভাষাবিজ্ঞানীরা এর নামকরণ করেছেন
মাগধি
অপভ্রংশ বা মাগধি অবহট্।
মূলত এই অপভ্রংশ ভাষার বিকাশ ঘটেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ থেকে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দের
ভিতরে। পরে এই ভাষা অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন রূপ লাভ করে। এসকল ভাষার প্রকৃতি অনুসারে মাগধি
অপভ্রংশকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটি হলো-
পূর্বাঞ্চলীয় মাগধী
অপভ্রংশ
এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় মাগধি।
পূর্বাঞ্চলীয় মাগধী
অপভ্রংশ
দুটি উপগোত্রে ভাগ হয়ে যায়। এই ভাগ দুটি হলো
বাংলা-অহমিয়া
ভাষা উপ-গোত্র এবং ওড়িয়া উপগোত্র। পরে
বাংলা-অহমিয়া
ভাষা উপগোত্রটি বিভাজিত হয়ে বাংলা এবং অহমিয়া ভাষায় পরিণত হয়।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদি নমুনা
চর্যাগীতিকে ধরা হয়। এর সময়সীমাকে মোটা দাগে বিবেচনা করা হয় ৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ।
তখন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাসাহিত্যের যে নমুনা পাওয়া গেছে, সংখ্যার বিচারে
তা বিপুল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্রমবিবর্তনের ধারায় এ সকল সাহিত্য অমূল্য
রত্নস্বরূপ। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের এ সকল নমুনায় প্রাপ্ত শব্দসমূহের
একটি বিরাট অংশ ভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারায় নানারূপে পরিবর্তিত হয়েছে। অতিক্রান্ত
সময়ের ধারা অনুসরণে বহু শব্দ বর্জিত হয়েছে, বহু শব্দ নতুন যুক্ত হয়েছে। বাংলা ভাষার
এই ক্রমবিবর্তনের রূপরেখা অনুসরণ ও উপলব্ধি করতে হলে প্রয়োজন এসকল সাহিত্যের পাঠ
এবং শব্দরূপ অনুসরণ করা। তবে এই রূপরেখা অনুসরণের জন্য প্রয়োজন একটি কালানুক্রমিক
সূচি।
[ দেখুন:
বাংলা সাহিত্যের কালানুক্রমিক সূচি]
বাংলাভাষার প্রকৃতি ও প্রাসঙ্গিক ব্যাকরণ
সূত্র :
ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। রূপা। বৈশাখ ১৩৯৬।
ভাষার ইতিবৃ্ত্ত। সুকুমার সেন। আনন্দ পাবলিশারস্ প্রাইভেট লিমিটেড। নভেম্বর
১৯৯৪।
বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত। ডঃ মুহম্মদ শহীদউল্লাহ। মাওলা ব্রাদার্স। জুলাই ১৯৯৮
বাংলা সাহিত্যের কথা। ডঃ মুহম্মদ শহীদউল্লাহ। মাওলা ব্রাদার্স।
সাধারণ ভাষা বিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা। ডঃ রামেশ্বর শ।
http://en.wikipedia.org/wiki/Indo-Aryan_languages
http://en.wikipedia.org/wiki/Magadhi_Prakrit