প্রাগৈতিহাসিক ভাষা ভাষা সঙ্কেত‒
|
মাগধী ভাষা
খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকে
খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর ভিতরে এই ভাষার প্রচলন ছিল। সম্রাট অশোক নিজেকে মাগধ নামে
অভিহিত করেছেন। সংস্কৃত নাট্যকাররা এই ভাষাকে
অশিক্ষিত, নিম্নশ্রেণীর মানুষের মুখের কথায় ব্যবহার করেছেন। কালিদাস গৌরবিনী রাজকন্যাকে 'মাগধী' সম্বোধন করেছেন। প্রাচীন
সুতনুকা প্রত্নলিপিতে এর নিদর্শন রয়েছে। জাতিগত পরিচয়ের সূত্রে মাগধী ভাষাকে কয়েকটি
ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন শাকরি, চণ্ডালি, শাবরি ইত্যাদি।
কালিদাসের নাটকে ব্যবহৃত মাগধি ভাষায় রচিত কিছু অংশ।
অধ এক্কশশিং দিঅশে মএ লোহিদমশ্চকে খণ্ডশো কপপিদে। যাব তশ্শ উদলব্ভন্তলে এদং মহালদণভাশুলং অংগুলীঅঅং পেশ্কামি। পশ্চ্য ইধ বিক্কঅস্তং ণং দংশঅন্তেষ্যেব গদীদে ভাবমিশ্শেহিং। এত্তিকে দাব এদশ্শ আগমে। অধুনা মালেধ কুট্টেধ বা।
বাংলা: এখন একদিন রুই মাছ খণ্ড খণ্ড করিয়া কুটিতেছিলাম। তাহার উদরাভ্যন্তরে এই মহারত্নোজ্জ্বল অঙ্গুরীয়কটি দেখি। পরে বিক্রয়ের জন্য দেখাইবার সময়ে আপনারা আমাকে ধরিয়াছেন। এইটুকু ইহার ব্যাপার। এখন আপনারা মারুন বা কাটুন।
[সূত্র: ভাষার ইতিবৃত্ত/সুকুমার সেন। আনন্দ পাবলিশার্স। ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দ। পৃষ্ঠা: ১০৬-১০৭]
বর্তমানে এই ভাষাটি ভারতের বিহার রাজ্যের প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের জনগণনা অনুসারে এই ভাষায় প্রায় লোক সংখ্যা ছিল ১৪,০০০,০০০ জন। ভারতের বিহারের গয়া, ভাগলপুর, পূর্ব পাটনা, ঝাড়খণ্ডের উত্তর ছোট নাগপুর বিভাগ, হাজারিবাগ জেলা, এবং পশ্চিম বাংলার মালদহ জেলায় এই ভাষার প্রচলন আছে। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের ভারতের জনগণনাতে মাগধী ভাষাকে হিন্দির উপভাষা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি ভাষাবিজ্ঞানীরা এটিকে ইন্দো-আর্য ভাষার পূর্ব দলের একটি ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
কোনো সংস্কৃত শব্দ মাগধীতে এসে ধ্বনিগত পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনকে একটি সাধারণ ধারায় ফেললে যে বিধি পাওয়া যায়, তা হলো‒
মানুষের কথিত ভাষার
ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা পরিবারের অন্তর্গত
ইন্দো-ইরানিয়ান
ভাষা
উপ-পরিবারের একটি শাখার নাম−
ভারতীয়-আর্য ভাষা।
এই শাখার উপশাখা
পূর্বাঞ্চলীয়
আর্য ভাষা। এই উপশাখার প্রধান ধারার ভাষা হলো সংস্কৃতি।
স্থানীয় প্রাকৃতজনের ভাষার (অনার্য ভাষা) সংমিশ্রণে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা
ধরনের মিশ্র ভাষার উদ্ভব হয়। এই সূত্রে বর্তমান ভারতের দক্ষিণ বিহারের মগধ অঞ্চলে
যে ভাষার জন্ম হয়, তাকে সাধারণভাবে বলা হয় মাগধি। ভাষাতত্ত্বে এর নাম
মাগধী প্রাকৃত।
কালক্রমে এই ভাষা বিবর্তিত হয়ে নতুনভাবে বিকশিত হয়। উল্লেখ্য,
খ্রিষ্ট-পূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে- বিশিষ্ট বৈয়াকরণ পতঞ্জলি তাঁর
'মহাভাষ্যে'
গ্রন্থে প্রাচীন ভারতীয় প্রাকৃত ভাষাকে অপভ্রংশ নামে অভিহিত
করেছিলেন।
তিনি সংস্কৃত ভাষার বিচারে প্রাকৃতজনের ভাষাকে অধঃপতিত ভাষা
হিসেবে এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।
তাঁর মতে- অপভ্রংশ ছিলো
শাস্ত্রহীনের ভাষা
বা
অশিষ্ট
লোক-সাহিত্যের ভাষা হলো।
আধুনিক কালের ভাষাবিজ্ঞানীরা এর নামকরণ করেছেন
মাগধি
অপভ্রংশ বা মাগধি অবহট্।
পরে এই ভাষা অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন রূপ লাভ করে। এসকল ভাষার প্রকৃতি অনুসারে মাগধি
অপভ্রংশকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটি হলো-
পূর্বাঞ্চলীয় মাগধী
অপভ্রংশ
এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় মাগধি। নিচে মাগধী ভাষার বিবর্তনের ধারায় ভাষার
ক্রমবিবর্তনের ঝক দেওয়া হলো।
উপগোষ্ঠী:
মাগধী
অপভ্রংশ বা মাগধী অবহট্ট
গোত্র:
উপগোত্র:
ভাষা: বাংলা
ভাষার ক্রমবিবর্তেনের ধারায় মাগাধি প্রাকৃত বা মাগধি ভাষা থেকে উৎপন্ন হয়েছে
ভোজপুরী, মৈথিলি, ওড়িয়া, বাংলা এবং অসমিয়া। ভারতের অঞ্চলের বিচারে এই ছয়টি ভাষার
আদি রূপ হিসেবে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এর পশ্চিমাঞ্চলের প্রাকৃতকে বলা হয়
'পশ্চিম-মাগধি'। আর পূর্বাঞ্চলের মাগধিকে বলা হয় পূর্বাঞ্চলীয় মাগধি।
সুনীতিকুমার চট্টোপধ্যায়ের মতে: " মাগধী
প্রাকৃত থেকেই বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে" এবং "মাগধী প্রাকৃতে"র পূর্বতর রূপ হচ্ছে
"গৌড় প্রাকৃত"।
ড. শহীদুল্লাহর মতে: "গৌড়ীয় প্রাকৃত হতেই গৌড়ীয় অপভ্রংশের মাধ্যমে বাংলা ভাষার
উদ্ভব হয়েছে "।
এর তিনটি আঞ্চলিক রূপ আছে। এই রূপ তিনটি হলো- মধ্য মাগধী, উত্তরাঞ্চলীয় মাগধী এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় মাগধী। এই ভাষার লিপি হলো 'দেবনাগরী'।
সূত্র :
ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। রূপা।
বৈশাখ ১৩৯৬।
ভাষার ইতিবৃ্ত্ত। সুকুমার সেন। আনন্দ পাবলিশারস্ প্রাইভেট লিমিটেড। নভেম্বর
১৯৯৪।
বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত। ডঃ মুহম্মদ শহীদউল্লাহ। মাওলা ব্রাদার্স। জুলাই ১৯৯৮
সাধারণ ভাষা বিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা। ডঃ রামেশ্বর শ।
http://en.wikipedia.org/wiki/Indo-Aryan_languages
http://en.wikipedia.org/wiki/Magadhi_Prakrit