দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
ইংরেজি: World War II, Second World War, WWII, WW2

১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত
ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকা ব্যাপী ছড়িয়ে পড়া যুদ্ধকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামে অভিহিত করা হয়।  ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বরে জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে। এই আক্রমণ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সময়কাল। কিন্তু এর আগে ইউরোপ ও এশিয়ায় এমন কিছু সংঘর্ষ হয়েছিল, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশ হিসেবে বিবেচনা করলে অত্যুক্তি হয় না। সে সময়ের সকল পরাশক্তিই এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। এই শক্তিগুলো দুটি মেরুতে বিভক্ত ছিল। এর একদিকে ছিল অক্ষশক্তি। এই ভাগে ছিল জার্মানি, জাপান, ইতালি। অন্যদিকে ছিল মিত্রপক্ষ। এই পক্ষে ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকা এবং অন্যান্য সহযোগী রাষ্ট্রসমূহ। যুদ্ধের প্রথম দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানের পক্ষে থাকলেও, জার্মান কর্তৃক সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের পর, সোভিয়েত ইউনিয়ন মিত্রশক্তির পক্ষে চলে যায়। এই যুদ্ধে প্রায় ৫ কোটি থেকে সাড়ে ৮ কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্-পরিস্থিতি
এই যুদ্ধের চূড়ান্ত রূপ লাভের পূর্বে জাপান পূর্ব এশিয়ায় শক্তিশালী সামরিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে এরা প্রজাতন্ত্রী চীনে আক্রমণ করে। এর ভিতর দিয়ে জাপান ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে চলে গিয়েছিল। জার্মানের সর্বাধিনায়ক হিটলার নানান চুক্তি অগ্রাহ্য করে করে, শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠিক রূপ দিয়েছিল। হিটলারে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন বেশ আগে থেকে।

১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে হিটলার আন্তর্জাতিক চুক্তি অমান্য করে, রাইন অঞ্চলে সৈন্য মোতায়েন করেন। এই বৎসরের সেপ্টেম্বর মাসে নুরেমবার্গে নাৎসি দলের অষ্টম দলীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় । এর নাম ছিল "Rally of Honour" (Reichsparteitag der Ehre)। এই অধিবেশনে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য জার্মানীর অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য একটি চারশালা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এই বৎসরের শেষের দিকে একটি গোপন বিজ্ঞতির মাধ্যমে, তিনি জার্মান সেনাবাহিনীকে চারবছর পরের কোনো এক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে নভেম্বর জার্মানির রাজধানী বার্লিনে, জার্মানির নাৎসী নেতা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোয়াকিম ভন রিববেনট্রপ জার্মান ও জাপানের রাষ্ট্রদূত কিন্টোমো মুশাকোজি 'কমিন্টার্নবিরোধী চুক্তি'তে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে কমিন্টার্নের বিরুদ্ধাচারণ ছাড়াও উল্লেখ করা হয় যে যদি জার্মান বা জাপান রাশিয়া কর্তৃক আক্রান্ত হয়, তবে উভয় দেশ পরস্পরের পাশে এসে দাঁড়াবে।

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ৬ নভেম্বরে ইতালি কমিন্টার্নবিরোধী শিবিরে যোগদান করে। এর ফলে জার্মান, জাপান ও ইতালি'র ত্রিদেশীয় জোট তৈরি হয়। পরে এই জোট অক্ষশক্তি নামে পরিচিতি লাভ করে। 

১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে চীন-জার্মান চুক্তি বাতিল করে এবং
মাঞ্চুরিয়ায় জাপানের পুতুল সরকারকে জার্মান স্বীকৃত দেয়। এই বৎসরের ১২ মার্চ অস্ট্রিয়াকে জার্মানের অংশ হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং অস্ট্রিয়া দখল করে নেয়। ২৮-২৯ মার্চে, বেশ কিছু গোপন আলোচনার সূত্রে চেকোশ্লোভাকিয়ার জার্মান বংশোদ্ভুত
Sudeten Heimfront চেকোশ্লোভাকিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ জার্মানীর সাথে যুক্ত করতে সম্মত হয়। ২৯ সেপ্টেম্বর ব্রিটেন ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালির প্রতিনিধিরা মিউনিখে চেকোশ্লোভাকিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ জার্মানীকে দেওয়ার চুক্তি করে। ৩০সে সেপ্টেম্বর দ্বিপাক্ষিক ইঙ্গো-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি করে। উল্লেখ্য ৬ই ডিসেম্বর জার্মানির সাথে অনুরূপ চুক্তি করে ফ্রান্স। ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ১লা অক্টোবর জার্মান বাহিনী চেকোস্লোভাকিয়া'র সুদেতস অঞ্চলে প্রবেশ করে।

১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ভিতর জার্মান
বাহিনী সমগ্র চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে নেয়। এরপর বসন্তকালে এরা লিথুনিয়ার  ক্লাইপেদা জেলা দখল করে। এই সময় জার্মান রুমানিয়ার সাথে একটি অর্থনৈতিক চুক্তি করে। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ২১ মার্চ জার্মানি পোল্যান্ডের কাছে ডানজিগ বন্দরের দাবি করে। একই সাথে পোলিশ করিডোরে মোটর বাইক ও রেলপথ তৈরির অধিকার দাবি করে। উল্লেখ্য, পোলিশ করিডোর বা ডানজিগ করিডোর ছিল পোলিশ ভূখণ্ডের একটি সংকীর্ণ এলাকা। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ভার্সাইচুক্তি অনুসারে এই ভূখণ্ডের অধিকার পেয়েছিল পোল্যান্ড। এই করিডোরের মাধ্যমে পোল্যান্ড বাল্টিক সাগরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতো। পোলিশ গদানস্ক এবং তৎসংলগ্ন ভূখণ্ড নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত ছিল। সে সময়ে এর নাম ছিল 'স্বাধীন ডানজিগ শহর'। এর রক্ষণাবেক্ষণ করতো তৎকালীন জাতিপুঞ্জ। হিটলারের দাবি পোল্যান্ড অস্বীকার করে, ৩রা এপ্রিল হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণের পরিকল্পনার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয়। জার্মান এই আক্রমণের নাম দিয়েছিল 'শুভ্র পরিকলপনা'। ১১ই এপ্রিল যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য হিটলার একটি নির্দেশপত্রে স্বাক্ষর করে। ২৮শে এপ্রিল জার্মান ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে স্বাক্ষরিত জার্মান-পোল্যান্ড অনাক্রমণ চুক্তি বাতিল করে দেন হিটলার। ২৩ আগষ্ট জার্মান-সোভিয়েত ইউনিয়ন অনাক্রমণ চুক্তি করে। ৩১ আগষ্ট পোল্যান্ডের সীমানার নিকটবর্তী গ্লেইভিৎস-একটি যুদ্ধ শুরুর একটি সাজানো ঘটনা ঘটায়। হিটলারের নির্দেশে কিছু জার্মান আসামিকে পোল্যান্ডের সেনাসদস্যের পোশাক পরিয়ে হত্যা করা হয়। এরা স্থানীয় একটি বেতার কেন্দ্রের মাইক্রোফোনের কাছে গোলাগুলি করে। এই শব্দ বেতার প্রচারিত হয়। একই সাথে পোলিশ ভাষায় কিছু বিবৃতি দেওয়া হয়। এই বিবৃতির একটি অংশ ছিল- 'জার্মানির বিরুদ্ধে পোল্যান্ডের যুদ্ধ ঘোষণার সময় এসেছে।' হিটলার-এর নির্দেশে জার্মানীর সকল বেতার কেন্দ্র থেকে এই সংবাদ প্রচার করা হয়। এই অজুহাতে জার্মান ১লা সেপ্টেম্বর পোল্যান্ড আক্রমণ করে। এরই মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু: পোল্যান্ড আক্রমণ
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ আগষ্ট পোল্যান্ডের সীমানার নিকটবর্তী গ্লেইভিৎস-একটি যুদ্ধ শুরুর একটি সাজানো ঘটনার সূত্র ধরে,  ১লা সেপ্টেম্বর পোল্যান্ড আক্রমণ করে। এরই মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। পোল্যান্ডকে রক্ষা করার জন্য ৩রা সেপ্টেম্বর ফ্রান্স ও পোল্যান্ড জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর ফলে পোল্যান্ড ও জার্মানির ভিতরকার যুদ্ধ চারদেশের যুদ্ধে পরিণত হয়। ১৭ই সেপ্টেম্বর সোভিয়েত রাশিয়া তার সীমান্ত দিয়ে পোল্যান্ড আক্রমণ করে। ৬ অক্টোবর পোল্যাণ্ডের কর্ক দুর্গ পতনের পর, পোল্যান্ড জার্মান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ভাগাভাগী হয়ে যায়। [বিস্তারিত: জার্মান-পোল্যান্ড যুদ্ধ]

সোভিয়েত ফিনল্যান্ড যুদ্ধ
পোল্যান্ডের পতনের পর
জার্মান ও মিত্রবাহিনীর ভিতর যুদ্ধ কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। এরই ভিতর সোভিয়েত ইউনিয়ন সৈন্য লিথুনিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়ায় প্রবেশ করে। এরা ফিনল্যান্ড দখলের উদ্যোগ নিলে, ফিনল্যান্ড প্রচণ্ডভাবে রুখে দাঁড়ায়। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিনল্যান্ড আক্রমণ করার ভিতর দিয়ে এই বিশ্বযুদ্ধ নতুন মোড় নেয়।  ফিন লোকবল খুবই কম হলেও দেশরক্ষার জন্য তাঁরা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এদের সহায়ক ছিল ফিনল্যান্ডের প্রচণ্ড শীত। সোভিয়েত বাহিনী যত সহজে ফিনল্যান্ড দখল করবে বলে ধারণা করেছিল, অচিরেই তা ভুল প্রমাণিত হয়। সোভিয়েতদের এই আগ্রাসনের কারণে  ১৪ই ডিসেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে তাদেরকে বহিষ্কার করা হয়। শীতের তীব্রতা কিছুটা কমে এলে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি থেকে সোভিয়েত বিমান, ট্যাঙ্ক ও স্লেজবাহিত সেনাবাহিনী একযোগে ফিনদের প্রতিরক্ষা রেখায় আঘাত হানা শুরু করে। ৬ই মার্চ শান্তির জন্য আবেদন করে। এর ফলে তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা পায় বটে, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের আগের দাবী অনুযায়ী,  ফিনল্যান্ড লেলিনগ্রাদের কাছাকাছি বেশকিছু এলাকার মালিকানা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে ২ লক্ষ ফিন সৈন্যের মধ্যে ৭০ হাজার সৈন্য মারা যায়। ়।

ডেনমার্ক ও
নরওয়ে যুদ্ধ
নরওয়ে বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তার ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য। সুইডেনের কিরুনা খনি থেকে গরমকালে বাল্টিক সাগর দিয়ে এবং শীতকালে নরওয়ের বরফমুক্ত নারভিক বন্দর ও নরওয়ের রেলপথ দিয়ে লোহা চালান যেত জার্মানীতে। প্রথমে হিটলার নরওয়েকে নিরপেক্ষ থাকতে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু মিত্রপক্ষ নারভিকের ঠিক বাইরের সমুদ্রে মাইন পেতে রাখার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনাটি ফাঁস হয়ে গেলে হিটলার ফ্রান্স আক্রমণের ইচ্ছা স্থগিত রেখে নরওয়ে অভিযানের নির্দেশ দিল। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই এপ্রিল
কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই জার্মান ডেনমার্কে আক্রমণ করে। যুদ্ধের শুরুতেই জার্মান বাহিনী নারভিকসহ গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলি দখল করে নেয়। একই সাথে এরা বিমানবন্দরগুলিতে প্যারাশ্যুট বাহিনী অবতরণ করিয়ে বিমানবন্দর দখল করে নেয়। এরপর জার্মান বাহিনী অতর্কিতে শহরগুলো দখল করে নেয়। এরপর ডেনমার্ক আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এরপর জার্মান বাহিনী নরওয়ের দিকে জর দেয়। কিন্তু ১৪ই এপ্রিল মিত্রবাহিনী নরওয়েতে পৌঁছায়।  জার্মান বাহিনীর আক্রমণের মুখে মে মাসেই পিছু হটে যায়। ২৭শে মে পর্যন্ত যুদ্ধ চলার পর, মিত্রবাহিনী নরওয়ে থেকে চলে যায়। এরপর নরওয়ে বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং রাজা সপ্তম হাকোন ব্রিটেনে আশ্রয় নেন।

জার্মানীর ফ্রান্স অভিযান
 নরওয়ের অভিযান চলাকালেই ফ্রান্স আক্রমণের হলুদ নকশা তৈরি করা হয়। এই পরিকল্পনার মধ্যে ছিল প্রথমে লুক্সেমবার্গ, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডকে নিজেদের অধিকারে আনা এবং এরপর ফ্রানস আক্রমণ করা।


সূত্র :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। ভিক্তর
ি