জার্মান-পোল্যান্ড যুদ্ধ (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ)

জার্মান-পোল্যান্ড যুদ্ধকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠানিকতা বলা হয়। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি
যুদ্ধের সূত্রে এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। আর এই সূত্রের সাথে গভীর সম্পর্ক ছিল ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ভার্সাইচুক্তির। এই চুক্তি অনুসারে ডানজিগ করিডোরের অধিকার পেয়েছিল পোল্যান্ড। এই করিডোরের মাধ্যমে পোল্যান্ড বাল্টিক সাগরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতো। পোলিশ গদানস্ক এবং তৎসংলগ্ন ভূখণ্ড নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত ছিল। সে সময়ে এর নাম ছিল 'স্বাধীন ডানজিগ শহর'। এর রক্ষণাবেক্ষণ করতো তৎকালীন জাতিপুঞ্জ। হিটলার ডানজিগ নগরটি দাবি করেছিল পোল্যান্ডের কাছে। পোল্যান্ড এই দাবি অস্বীকার করে। এই দাবি অস্বীকার করেছিল সে, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ভরসায়।

১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা এপ্রিল জার্মান সর্বাধিনায়ক
হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণের পরিকল্পনার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন। জার্মান সেনাবাহিনী এই আক্রমণের নাম দিয়েছিল 'শুভ্র পরিকলপনা'। ১১ই এপ্রিল যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য হিটলার একটি নির্দেশপত্রে স্বাক্ষর করে। ২৮শে এপ্রিল জার্মান স্বাক্ষরিত জার্মান-পোল্যান্ড অনাক্রমণ চুক্তি (১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দ) বাতিল করে দেন হিটলার। ২৩ আগষ্ট জার্মান-সোভিয়েত ইউনিয়ন অনাক্রমণ চুক্তি হয়। ৩১ আগষ্ট পোল্যান্ডের সীমানার নিকটবর্তী গ্লেইভিৎস-একটি যুদ্ধ শুরুর একটি সাজানো ঘটনা ঘটায়। হিটলারের নির্দেশে কিছু জার্মান আসামিকে পোল্যান্ডের সেনাসদস্যের পোশাক পরিয়ে হত্যা করা হয়। এরা স্থানীয় একটি বেতার কেন্দ্রের মাইক্রোফোনের কাছে গোলাগুলি করে। এই শব্দ বেতার প্রচারিত হয়। একই সাথে পোলিশ ভাষায় কিছু বিবৃতি দেওয়া হয়। এই বিবৃতির একটি অংশ ছিল- 'জার্মানির বিরুদ্ধে পোল্যান্ডের যুদ্ধ ঘোষণার সময় এসেছে।' হিটলার-এর নির্দেশে জার্মানীর সকল বেতার কেন্দ্র থেকে এই সংবাদ প্রচার করা হয়। এই অজুহাতে জার্মান ১লা সেপ্টেম্বর পোল্যান্ড আক্রমণ করে। এরই মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।

 জার্মান ও পোল্যান্ডের তুলনামূলক সামরিক শক্তি

ভোর ৪টা ৪৫ মিনিটে জার্মান বিমান বাহিনী পোল্যান্ডের বিমানবন্দর, রেলজংশন, প্রশাসনিক ভবনে বোমা বর্ষণ করে ধ্বংস করে দেয়। এরপর জার্মান ট্যাঙ্ক বহর সীমান্তের পোলিশ বাধা তছনছ করে এগিয়ে যেতে থাকে। এই অবস্থায় ব্রিটেন ও ফ্রান্স ১লা সেপ্টেম্বর ভার্সাইচুক্তি পুনর্বিবেচনা করার জন্য কূটনৈতিক আলোচনা শুরু করে। কিন্তু জার্মানরা এ বিষয়ে কোনো পাত্তাই দেয় নি। এই সময় সমঝোতার কথা শুনে, হিটলার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলিন সম্পর্কে বলেছিলেন...'ছাতাওয়ালা এই লোকটি' বেখ্‌র্টেসগাডেন-এ আমার কাছে আসুক না,... আমি ওকে পাছায় লাথি মেড়ে সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দেব। এবং ওই দৃশ্য দেখার জন্য যথা সম্ভব বেশি সংখ্যক সাংবাদিক ডেকে আনতে ভুলব না'।

ব্যর্থ হয়ে, ৩রা সেপ্টেম্বর পোল্যান্ডের সাথে চুক্তি অনুসারে ব্রিটেন ও ফ্রান্স আনুষ্ঠানিকভাবে জার্মানির বিরুদ্ধ যুদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু কার্যত এরা যুদ্ধক্ষেত্রে এই সময় কোনো সেনা তৎপরতা দেখায় নি। এরই ভিতরে ৭ সেপ্টেম্বর পূর্ব প্রাশিয়া থেকে আক্রমণ চালিয়ে জার্মানরা নারেভ নদী পর্যন্ত পৌঁছে যায়। অন্যদিকে ৮ই সেপ্টেম্বর দক্ষিণ দিকের বাহিনীগুলো সাইলেসিয়া থেকে অগ্রসর হয়ে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশো'র কাছে পৌঁছে যায়। এই অবস্থায় ৯ই সেপ্টেম্বর ফ্রান্সের বাহিনী একটি আক্রমণ চালায়, কিন্তু কোনো সুফল পাওয়ার আগেই ১২ই সেপ্টেম্বর এরা যুদ্ধ বন্ধ করে দেয়। আর এই দিনই হিটলার যুদ্ধক্ষেত্রে পরিদর্শনের জন্য ওয়ারশো'র কাছাকাছি অঞ্চলগুলো পর্যবেক্ষণ করেন। হিটলার ওয়ার্সোর উপর আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধির আদেশ দিয়ে চলে যান।
 
এই অবসরে উত্তর ও দক্ষিণ বাহিনী রাজধানীকে একটি আক্রমণ বলয়ের ভিতরে নিয়ে আসে। ১৬ সেপ্টেম্বর এই দুই বাহিনী মিলিত হয়ে একটি বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হয়। এই সময় পোলিশ নাগরিকদের অধিকাংশ রুমানিয়ার দিকে পালিয়ে যায়। এই সময়ের ভিতরে প্রচণ্ড বিমান আক্রমণ করে ওয়ারশোকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়। জার্মান বাহিনী এই ওয়ার্শোর এই যুদ্ধে ১১৫০টি বিমান ব্যবহার করেছিল। ৯-১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওয়ারশোর পশ্চিনদিকের
Bzura নদীর তীরে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। পোল্যান্ডের এই দুর্দশার ভিতরে ১৭ই সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন পোল্যান্ড আক্রমণ করে। শেষ পর্যন্ত পোল্যান্ডের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে ৬ অক্টোবরে ৬ পোল্যাণ্ডের কর্ক দুর্গ পতনের পর।

এই যুদ্ধে পোলিশ বাহিনীর ৬৫,০০০ হাজার ৩ শত সৈন্য নিহত হয়। আহত হয়েছিল ১ লক্ষ, ৩৩ হাজার ৭ শত জন। জার্মানদের হাতে বন্দী হয়েছিল ৪ লক্ষ ২০ হাজার সৈন্য আর সোভিয়েতদের হাতে বন্দী হয়েছিল ২ লক্ষ ৪০ হাজার। আর প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার সৈন্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। অন্যদিকে জার্মান বাইনীর সৈন্য নিহত হয়েছিল ১০ হাজার ৬ শত, আহত হয়েছিল ৩০ হাজার ৩ শত, নিখোঁজ হয়েছিল ৩ হাজার ৪ শত জন।

যুদ্ধ শেষে জার্মান অধিকৃত পোল্যান্ডের পজনান, পমেরানিয়া, সাইলেসিয়া ও লদ্‌জ প্রদেশ এবং কেলেৎসে ও ওয়ার্শো প্রদেশের একাংশকে জার্মানভূমি হিসেবে ঘোষণা করা হলো। অবশিষ্ট অংশ জার্মান সাম্রাজ্যের প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করা হলো। এই অঞ্চলের শাসক হিসেবে নিয়োজত হলে ফ্রাঙ্ক। পোল্যান্ডের বাকি অংশ চলে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশে। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে সোভিয়েত ইউনিয়ন পোল্যান্ডের অধিকৃত অংশ সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে।


সূত্র :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। ভিক্তর
ি