জার্মান-পোল্যান্ড যুদ্ধ (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ)
জার্মান-পোল্যান্ড যুদ্ধকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠানিকতা বলা হয়। ১৯৩৬
খ্রিষ্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি
জার্মান ও পোল্যান্ডের তুলনামূলক সামরিক শক্তি
জার্মান
বাহিনী: মোট ৬২ ডিভিশন সৈন্য। এর ভিতরে ৭টি ট্যাঙ্ক ডিভিশন ও ৪টি
মোটোরবাহিত ডিভিশন ছিল। ২৮০০ ট্যাঙ্ক, ৬০০০ কামান ও মর্টার কামান, ২,০০০টি
বিমান (১ম ও ৪র্থ বিমানবহর)। সর্বমোট লোক ছিল ১৬ লক্ষ।
পুরো সেনাবাহিনী দুটো ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। ভাগ দুটো ছিলো
উত্তর বাহিনী: তৃতীয় বাহিনী (পূর্ব-প্রাশিয়ায়) এবং চতুর্থ বাহিনী (পমেরানিয়ায়া)। এই বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন- কর্নেল-জেনারেল
দক্ষিণ বাহিনী: অষ্টম, দশম ও চতুর্দশ বাহিনী (সাইলেসিয়ায়)। এই বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন- কর্নেল-জেনারেল
এছাড়া এই
যুদ্ধের জন্য পৃথকভাবে একটি নৌ-শক্তি পৃথক করে রাখা ছিল। এতে ছিল ২টি
যুদ্ধজাহাজ, ৭টি ডুবোজাহাজ, বেশকিছু ডেস্ট্রয়ার, মাইন সু্ইপার এবং নৌবাহিনীর
কিছু বিমান। তিনটি অতিরিক্ত ক্রুজার, ডেস্ট্রয়ার ফ্লোটিলা এবং টর্পেডো ফোটিলা।
এই নৌবাহিনী রাখা হয়েছিল, যুদ্ধকালীন সময়ে পোল্যান্ডের বাণিজ্যজাহাজ এবং বাইরে
থেকে আসা যেকোনো রসদবাহী জাহাজ ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য।
পোল্যান্ড বাহিনী: মোট ৬২ ডিভিশন সৈন্য। এর ভিতরে ছিল ৩৯টি পদাতিক ডিভিশন ও ১১টি অশ্বারোহী ব্রিগেড, ৩টি ইনফেন্ট্রি মাউন্টেন ব্রিগেড ও ২টি সাঁজোয়া মোটোরবাহিত ব্রিগেড। জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর ৮০টি ব্যাটেলিয়ন। এদের সেনাবাহিনীতে ছিল ২২০টি হাল্কা ট্যাঙ্ক ও ৬৫০টি ট্যাঙ্কেট আর সাঁজোয়া গাড়ি। ৪৩০০টি কামান এবং মর্টার কামান। ৮০০টি জঙ্গী বিমান। আর ১৬টি যুদ্ধজাহাজ এবং সাহায়ক জাহাজ। মোট লোকসংখ্যা ছিল ১০ লক্ষ। জার্মানীর দ্রুত আক্রমণের কারণে, এই বাহিনীকে বিন্যস্ত করার সুযোগ পায় নি। যেমন এদের ৪টি ডেস্ট্রয়ারের ভিতরে ইংল্যান্ডে ছিল ৪টি। পাঁচটি ডুবোজাহাজ, একটি মাইন প্ল্যান্টার, পাঁচটি মাইন সুইপার এবং অন্যান্য সহায়ক জাহাজগুলো গদিনিয়া সামরিক নী-ঘাঁটিতে ছিল।
ভোর ৪টা ৪৫ মিনিটে জার্মান বিমান বাহিনী পোল্যান্ডের বিমানবন্দর, রেলজংশন, প্রশাসনিক ভবনে বোমা বর্ষণ করে ধ্বংস করে দেয়। এরপর জার্মান ট্যাঙ্ক বহর সীমান্তের পোলিশ বাধা তছনছ করে এগিয়ে যেতে থাকে। এই অবস্থায় ব্রিটেন ও ফ্রান্স ১লা সেপ্টেম্বর ভার্সাইচুক্তি পুনর্বিবেচনা করার জন্য কূটনৈতিক আলোচনা শুরু করে। কিন্তু জার্মানরা এ বিষয়ে কোনো পাত্তাই দেয় নি। এই সময় সমঝোতার কথা শুনে, হিটলার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলিন সম্পর্কে বলেছিলেন...'ছাতাওয়ালা এই লোকটি' বেখ্র্টেসগাডেন-এ আমার কাছে আসুক না,... আমি ওকে পাছায় লাথি মেড়ে সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দেব। এবং ওই দৃশ্য দেখার জন্য যথা সম্ভব বেশি সংখ্যক সাংবাদিক ডেকে আনতে ভুলব না'।
ব্যর্থ
হয়ে, ৩রা সেপ্টেম্বর পোল্যান্ডের সাথে চুক্তি অনুসারে ব্রিটেন ও ফ্রান্স
আনুষ্ঠানিকভাবে জার্মানির বিরুদ্ধ যুদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু কার্যত এরা
যুদ্ধক্ষেত্রে এই সময় কোনো সেনা তৎপরতা দেখায় নি। এরই ভিতরে ৭ সেপ্টেম্বর
পূর্ব প্রাশিয়া থেকে আক্রমণ চালিয়ে জার্মানরা নারেভ নদী পর্যন্ত
পৌঁছে যায়। অন্যদিকে ৮ই সেপ্টেম্বর দক্ষিণ দিকের বাহিনীগুলো সাইলেসিয়া থেকে অগ্রসর
হয়ে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশো'র কাছে পৌঁছে যায়। এই অবস্থায় ৯ই সেপ্টেম্বর
ফ্রান্সের বাহিনী একটি আক্রমণ চালায়, কিন্তু কোনো সুফল পাওয়ার আগেই ১২ই সেপ্টেম্বর
এরা যুদ্ধ বন্ধ করে দেয়। আর এই দিনই হিটলার যুদ্ধক্ষেত্রে পরিদর্শনের জন্য ওয়ারশো'র
কাছাকাছি অঞ্চলগুলো পর্যবেক্ষণ করেন। হিটলার ওয়ার্সোর উপর আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধির
আদেশ দিয়ে চলে যান।
এই অবসরে উত্তর ও দক্ষিণ বাহিনী রাজধানীকে একটি আক্রমণ বলয়ের ভিতরে নিয়ে আসে। ১৬
সেপ্টেম্বর এই দুই বাহিনী মিলিত হয়ে একটি বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হয়। এই সময় পোলিশ
নাগরিকদের অধিকাংশ রুমানিয়ার দিকে পালিয়ে যায়। এই সময়ের ভিতরে প্রচণ্ড বিমান আক্রমণ
করে ওয়ারশোকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়। জার্মান বাহিনী এই ওয়ার্শোর এই যুদ্ধে
১১৫০টি বিমান ব্যবহার করেছিল। ৯-১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওয়ারশোর পশ্চিনদিকের
Bzura
নদীর তীরে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। পোল্যান্ডের এই
দুর্দশার ভিতরে ১৭ই সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন পোল্যান্ড আক্রমণ করে। শেষ পর্যন্ত
পোল্যান্ডের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে ৬ অক্টোবরে
৬ পোল্যাণ্ডের কর্ক দুর্গ পতনের পর।
এই যুদ্ধে পোলিশ বাহিনীর ৬৫,০০০ হাজার ৩ শত সৈন্য নিহত হয়। আহত হয়েছিল ১ লক্ষ, ৩৩ হাজার ৭ শত জন। জার্মানদের হাতে বন্দী হয়েছিল ৪ লক্ষ ২০ হাজার সৈন্য আর সোভিয়েতদের হাতে বন্দী হয়েছিল ২ লক্ষ ৪০ হাজার। আর প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার সৈন্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। অন্যদিকে জার্মান বাইনীর সৈন্য নিহত হয়েছিল ১০ হাজার ৬ শত, আহত হয়েছিল ৩০ হাজার ৩ শত, নিখোঁজ হয়েছিল ৩ হাজার ৪ শত জন।
যুদ্ধ শেষে জার্মান অধিকৃত পোল্যান্ডের পজনান, পমেরানিয়া, সাইলেসিয়া ও লদ্জ প্রদেশ এবং কেলেৎসে ও ওয়ার্শো প্রদেশের একাংশকে জার্মানভূমি হিসেবে ঘোষণা করা হলো। অবশিষ্ট অংশ জার্মান সাম্রাজ্যের প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করা হলো। এই অঞ্চলের শাসক হিসেবে নিয়োজত হলে ফ্রাঙ্ক। পোল্যান্ডের বাকি অংশ চলে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশে। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে সোভিয়েত ইউনিয়ন পোল্যান্ডের অধিকৃত অংশ সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে।
সূত্র :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। ভিক্তর
মাৎসুলেনকো।
প্রগতি
প্রকাশন।
মস্কো।১৯৮৭।