হিটলারের পিতা এলোইস হিটলার |
ক্লারা (Klara Pölzl) |
শিশু এ্যাডলফ হিটলার |
|
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৯১৮), সৈনিক হিটলার |
হিটলার, এ্যাডলফ
১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে
এপ্রিল জার্মানির বাভারিয়ার রাজ্যের সীমান্তের ওপারে, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির
সালজবার্গ-এর ১৫, ব্রাউনাউ ইন-এ তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল ক্লারা (Klara
Pölzl)।
হিটলারের পিতার বৈবাহিক ঘটনা।
এলোইস হিটলারের প্রথম স্ত্রীর নাম ছিল আন্না গ্লাস্ল-হোরের। এই স্ত্রী অসুস্থ হয়ে
পড়লে, ১৯ বৎসর বয়সী ফ্রান্সিস্কা মাৎজেল্সবার্গার নামক চাকরানীর সাথে এলোইস-এর
সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠে। কিন্তু রোমান কাথালিক মতে তিনি মাৎজেল্সবার্গার-কে
বিবাহ করতে ব্যর্থ হন। কিন্তু মাৎজেল্সবার্গার-এর সাথে এলোইসের সম্পর্ক অটুট ছিল।
এর ভিতর ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ক্লারা পোলজ্ল (Klara
Pölzl) এই পরিবারে
পরিচারিকা হিসেবে যোগদান করেন। মূলত ক্লারা ছিল এলোইস-এর দূর সম্পর্কীয় ভাতিজি। এই
সূত্রে ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের ৭ নভেম্বর আন্না গ্লাস্ল-হোরের-এর সাথে তাঁর বিবাহ
বিচ্ছেদ হয়। অবশ্য এই বিবাহ বিচ্ছেদও গির্জা অনুমোদন করে নি। ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দের ১৩
জানুয়ারি এলোইস এবং মাৎজেল্সবার্গার-এর প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। এর নাম রাখা হয়েছিল
এলোইস মাৎজেল্সবার্গার। ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ৬ এপ্রিল রোগে ভুগে আন্না
গ্লাস্ল-হোরের মৃত্যুবরণ করেন। ২২শে মে তিনি
মাৎজেল্সবার্গার-কে বিবাহ করেন। এরপর মাৎজেল্সবার্গার দ্বিতীয় সন্তান প্রসবের জন্য
ভিয়েনা যান এবং সেখানে এ্যাঞ্জেলা হিটলারের জন্ম হয়। এই সময় তিনি ফুসফুসের
দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হন। তাঁকে র্যান্সহোফেন গ্রামে এনে রাখা হয়। এই সময়
তাঁর দেখাশোনার জন্য ক্লারা (Klara
Pölzl)-কে পুনরায় আনা
হয়। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ আগষ্ট মাৎজেল্সবার্গার মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ক্লারা
গৃহকর্তী হিসেবে থেকে যান। এর কিছুদিন পর ক্লারা এলোইসের দ্বারা গর্ভবতী হন। এরপর
তিনি ক্লারাকে বিবাহ করার উদ্যোগ নিলে, দূর সম্পর্কীয় ভাতিজি বলে গির্জা বাধা দেয়।
পরে ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জানুয়ারি গির্জা এই বিবাহে বাধা দেয়। বিবাহের ৫ মাস পরে
অর্থাৎ ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই মে তাঁর প্রথম পুত্র গুস্তাভের জন্ম দেন। ১৮৮৬
খ্রিষ্টাব্দের ২৫ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয় তাঁর দ্বিতীয় কন্যা সন্তান আইডা। ১৮৮৭
খ্রিষ্টাব্দে তাঁর তৃতীয় সন্তান ওট্টো জন্মগ্রহণের পরপরই মারা যায়। এই বৎসরের ৮
ডিসেম্বর মাসে ডিফথেরিয়া রোগে ওট্টো মারা যায়, আর ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ২ জানুয়ারিতে
কন্যা আইডা মারা যায়। এরপর ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন এ্যাডলফ
হিটলার।
তাঁর বয়স যখন ৩ বৎসর, তখন তাঁর পিতামাতা জার্মানীর পাস্সাউ-তে চলে আসেন। এই তিনি জার্মানির নিম্ন বাভারিয়ার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা শেখেন। ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে হিটলারের পিতামাতা চলে আসেন আপার অস্ট্রিয়ার লিন্ৎস শহরের নিকটবর্তী লেয়োন্ডিং-এ বসবাস শুরু করেন। ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পিতা সরকারী কাস্টম্স থেকে অবসর গ্রহণের পর, লিন্ৎস শহরের নিকটে ল্যাম্ববিস-এ জায়গাজমি কিনে ফার্ম তৈরি করেন। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে এঁদের পুরো পরিবার ল্যাম্ববিস-তে চলে আসে। এখানেই হিটলারের বাল্যকাল অতিবাহিত হয়। বাবাকে তিনি খুব পছন্দ করতেন না বরং ভয় করতেন। কিন্তু মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ছিল।
৮ বৎসর বয়সে তিনি স্থানীয় গির্জায় সঙ্গীতের প্রাথমিক পাঠ নেন। এই সময় তিনি গির্জায় কোরাস গানে কণ্ঠ মেলাতেন। এই সুত্রে তাঁর পরিবারের লোকজন তাঁকে পাদরি বানানোর প্রচেষ্টাও গ্রহণ করেছিলেন। ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁদের পরিবার লেয়োন্ডিং-এ আবার ফিরে আসে। এই সময় তাঁর ছোটো ভাই এডমুন্ড মারা যায়।
১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর বাবা মারা যান। ফলে বাবার রেখে যাওয়া পেনশন ও সঞ্চয়ের অর্থ দিয়েই তাঁর কোনমতে সংসারের ব্যয়ভার বহন করতেন। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। ফলে আর্থিক সঙ্কটের করাণে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এক সময় তিনি ভিয়েনায় চিত্রশিল্পী হওয়ার জন্য। কিছুদিন পর তিনি আবার নিজ শহর লিন্ৎসে ফিরে আসেন। এখানে আর্থিক সুবিধা লাভের সুযোগ না পেয়ে তিনি আবার ভিয়েনায় যান। এখানে তিনি অস্ট্রিয়ার "একাডেমি অফ ফাইন আর্টস"-এ ভর্তি পরীক্ষা দেন। কিন্তু সুযোগ পেতে ব্যর্থ হন। তারপরেও তিনি যতটুকু অঙ্কনবিদ্যা আয়ত্ব করেছিলেন, তার দ্বারাই রোজগারপাতি শুরু করেন। এ সময় তিনি পোস্টকার্ড ও বিজ্ঞাপনের ছবি এঁকে সামান্য উপার্জন করতেন।
১৯১৩
খ্রিষ্টাব্দে তিনি মিউনিখে
আসেন। ১৯১৪
খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি
মাসে তিনি অস্ট্রীয় সামরিক বাহিনীতে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা
করেন। স্বাস্থ্যগত কারণে
তিনি এই সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে ব্যর্থ হন।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর
দিকে তিনি অস্ট্রিয়ান নাগরিক হিসেবে বাবারিয়ান সৈন্যবাহিনীতে
স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ছিলেন ১৬তম বাভারিয়ান
রিজার্ভ ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টে। যুদ্ধের পুরোটা সময় জার্মানি
বাহিনীর সাথে ছিলেন। যুদ্ধে সাহসিকতা ও বীরত্বের স্বীকৃতি
স্বরূপ ১৯১৪
খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর
মাসে সেকেন্ড ক্লাস আয়রন ক্রস লাভ করেন।
এরপর বেশ কিছুদিন বিশ্রামে ছিলেন।
এরপর সুস্থ হয়ে তিনি আবার যুদ্ধে যান।
১৯১৬
খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে আহত হন এবং দুই মাস বিলৎজ (Beelitz)
হাসপাতালে কাটিয়ে তিনি আবার তাঁর রেজিমেন্টে যোগদান করেন।
১৯১৮
খ্রিষ্টাব্দে আগস্ট
মাসে
তাঁকে ফার্স্ট ক্লাস আয়রন ক্রস দেয়া হয়।
এরপর তিনি করপোরাল
পদ লাভ করেন। ১৯১৮
খ্রিষ্টাব্দের
১৮ই মে তিনি 'ব্ল্যাক উন্ড ব্যাজ' পদক
লাভ করেন। অক্টোবরের এক যুদ্ধে
তিন আহত হন। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে
১৫ অক্টোবর মাস্টার্ড গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে সাময়িক অন্ধ হয়ে যান। এইবারে হাসপাতালে
থাকা অবস্থায় জার্মান পরাজয় মেনে নেয়। এই পরাজয় তাঁকে তীব্রভাবে আঘাত করেছিল।
হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে হিটলার রাজনীতিতে যোগ দেন।
১৯১৯
খ্রিষ্টাব্দের মে-জুনের দিকে জার্মানির
বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে মিউনিখের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হন।
এই সময় জার্মানির মিউনিখ শহরে একটি ছোট রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। এই
দলের নাম ছিল-জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি"
[German Workers' Party (DAP)]
। হিটলার এই দলটিতে
সামরিক রাজনৈতিক এজেন্ট হিসেবে
কাজ শুরু করেন। তার কাজ ছিল সৈন্যদের ভিতরে এই দলের আদর্শ
প্রচার করা। ভালো কাজের জন্য এই বৎসরের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি এই দলের ৫৫তম
সদস্যপদ লাভ করেন।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে পরে এই দলের নতুন নাম দেওয়া হয়। Nationalsozialistische
Deutsche Arbeiterpartei (National Socialist German
Workers Party – NSDAP)।
এই দলেরই অপর নাম
নাৎসি। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মার্চ সেনাবাহিনী থেকে
তিনি বহিষ্কৃত হন। এরপর থেকে তিনি নিজেকে এই দলের সেবায় উৎসর্গ করেন।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মিউনিখে প্রায় ৬০০০ লোকের জনসভায় ভাষণ দিয়ে জনগণকে উজ্জীবিত করেন। জুন মাসে তিনি এবং তাঁর রাজনৈতিক গুরু এখার্ট (Eckart) দলের জন্য তহবিল-উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁদের এই কার্যক্রম শুরু হয় বার্লিন থেকে। এই সময় দলের কিছু পরিচালক German Socialist Party (DSP)-এর সাথে তাঁদের দলকে একত্রিত করার উদ্যোগ নেন। ১১ই জুলাই হিটলার মিউনিখে ফিরে, এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং দলত্যাগ করেন। ইতিমধ্যে দলের ভিতর হিটলারের জনপ্রিয়তা এতটাই বৃদ্ধি পয়েছিল যে, সে সময় হিটলার দলত্যাগের কারণে মূল দলই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। ফলে হিটলারের কাছে দলত্যাগের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার জন্য দলের পক্ষ থেকে বলা হয়। হিটলার এক ঘোষণায় জানান যে দলের চেয়ারম্যান ড্রেক্সলার (Drexler)-কে পদত্যাগ করতে হবে এবং মিউনিখে দলের প্রধান কার্যালয় হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে। হিটলারের এই প্রস্তাবে দলের পরিচালক পরিষদ রাজি হলে, তিনি ২৬ জুলাই পুনরায় দলে যোগদান করেন। এই সময় তাঁর দলের নতুন সদস্য সংখ্যা হয় ৩৬৮০। এই সময় তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। কিন্তু তিনি সুকৌশলে এই সকল বিরুদ্ধবাদীদের মুখ বন্ধ করে দেন। শেষ পর্যন্ত দলের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে তিনি অবিশ্বাস্য ভোটে জয় লাভ করেন। উল্লেখ্য এই নির্বাচনে তাঁর বিরুদ্ধে মাত্র এক ভোট পড়েছিল। এরপর থেকে নিয়মিত ভাষণ এবং জনসংযোগ করে দলের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করে দলকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। দলের ভিতর একমাত্র জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠার সূত্রে তিনি ফুয়েরার (Führer, দলনেতা) নামে অভিহিত হন।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে হিটলারের নেতৃত্বে এই দলটি একটি আক্রমণাত্মক দলে পরিণত হয়। এই সময় বিপক্ষ দলগুলোকে বাক্যের দ্বারা আঘাতের পাশাপাশি দৈহিক আক্রমণ চালানো শুরু করে। একই সাথে জার্মান জাতি এবং আর্যজাতিসত্তার রক্ষার জন্য এই দলটি সক্রিয় হয়ে উঠে। একই সাথে এই দল ইহুদী-বিদ্বেষী মনোভাব তীব্রভাবে ব্যক্ত করা শুরু করে। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ভিতর এই দলটি জার্মানির উল্লেখযোগ্য দলে পরিণত হয়।
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ইতালির মুসেলিনি জাতীয় ফ্যাসিস্ট দলের মাধ্যমে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতায় আসেন। হিটলার মুসেলিনির ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একই কায়দায় জার্মানির ক্ষমতা দখলের উদ্যোগ নেন। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্স জার্মানির শিল্প সমৃদ্ধ রাঢ় অঞ্চল দখল করে নেয়। এর ফলে জার্মানিতে অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে। এই সময় জার্মানির উইলহেম কুনো (Wilhelm Cuno)-র সরকার পদত্যাগ করে। এই সময় জার্মান কমুনিষ্ট পার্টি ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। এর ফলে নাৎসি পার্টির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। এই সময় এই দলের নিবন্ধনকৃত সদস্যের সংখ্যা দাঁড়ায় ২০,০০০। এই সময় এই দল সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের উদ্যোগ নেয়। এই সময় নাৎসি দলের সদস্য না হয়েও প্রাক্তন জেনারেল এনরিখ লুডেনডর্ফ (Erich Ludendorff) হিটলারকে সহায়তা করে। ৮ই নভেম্বর একটি দেশপ্রেমী শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে মিউনিখে এই অভ্যুত্থানের সূচনা করে। এই অভ্যুত্থানকে 'বিয়ার হল অভ্যুত্থান' (Beer Hall Putsch) নামে অভিহিত করা হয়। এই অভ্যুত্থানের সময় জার্মানির প্রাক্তন যোদ্ধাদলের Reichswehr স্থানীয় সেনাদল তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে। এর ফলে অভ্যত্থানটি সফলতা লাভে ব্যর্থ হয়। ৯ নভেম্বর নাৎসি দলের শোভাযাত্রা শুরু হলে, সেনাবাহিনী গুলি চালায় এবং ১৬ জন নাৎসি কর্মী নিহত হন। এই সময় হিটলার, জেনারেল এনরিখ লুডেনডর্ফ এবং এর সাথে যুক্ত বহু নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর পর্যন্ত হিটলার বন্দী থাকেন। এই সময় তিনি জেলে বসে রচনা করেন মেইন ক্যাম্প (Mein Kampf ) নামক গ্রন্থ।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে হিটলার জেল
থেকে মুক্তিলাভ করেন। ডিসেম্বর মাসে জার্মানির জাতীয় নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনে
নাৎসি দল মাত্র ১৪টি আসন পায়।
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে দলের সদস্যদের দুটি শ্রেণিতে বিভাজিত করেন। এর একটি দলে ছিল
পরিচালন দল অপরটি ছিল সাধারণ সদস্য। এপ্রিল
মাসে তিনি হিটলারের দেহরক্ষী বাহিনী হিসেবে এসএস দল গঠন করেন। এই দলের পরিচালক
হিসেবে নিয়োগ পান হিমলার (Himmler)।
অবশ্য এই এসএস-কে দলের পক্ষ থেকে সহায়ক দল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে নাৎসি দলের তৃতীয় শোভাযাত্রা হয় ওয়েনমার-এ। এই শোভাযাত্রায় ততটা অর্থবহ ছিল না। তবে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে আগষ্ট নুরেমবার্গে দলের তৃতীয় কংগ্রেস উপলক্ষে আয়োজিত শোভাযাত্রায় বিপুল মানুষের সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। তারপরেও ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় নির্বাচন নাৎসি দল ৪৯১টি আসনের মধ্যে মাত্র ১২টি আসন লাভ করে। এরপর এই দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্য হিটলার উদ্যোগ নেন। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে দলের সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৩০,০০০। এই বৎসরে নুরেমবার্গে অনুষ্ঠিত হয় দলের চতুর্থ কংগ্রেস। এই কংগ্রেস উপলক্ষে শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে জার্মানির অর্থনীতি বিধ্বস্ত দশায় পৌঁছায়। এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে নাৎসি দল ইহুদিদের দায়ী করে প্রচারণা চালায়। এই বৎসরের জুলাই মাসের জাতীয় নির্বাচনে নাৎসি দল ১০৭টি আসন লাভ করে। ১৯৩১-৩২ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে জার্মানির রাজনৈতিক সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করে। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জুলাই প্রুশিয়ান সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটে। আর এর কয়েকদিন পরে জার্মানের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে নাৎসি এবং কেডিপি দল ৫২% ভোট পায়। এর ভিতরে নাৎসি দল পায় ৩৭.৪% ভোট। ফলে নাৎসি দল নিজেদেরকে শক্তিশালী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়। এই নির্বাচনের জয়ের সূত্রে হিটলার জার্মানীর চ্যাঞ্চেলর হন।
১৯৩৩
খ্রিষ্টাব্দে জার্মানির চ্যান্সেলর
হন। তাঁর এই পদে অভিষেক হয় ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০
জানুয়ারিতে। কিন্তু ২৭ ফেব্রুয়ারিতে রাইখস্ট্যাখ ভবনে আগুন লাগে। ধারণা করা হয়,
হিটলারের নির্দেশে নাৎসি দলের সদস্যরাই এই আগুন দিয়েছিল। এই আগুন দেওয়ার জন্য
হিটলার কমুনিষ্ট পার্টির উপর দোষারোপ করে এবং তৎকালীন
প্রেসিডেন্ট পল ভন হিন্ডেনবার্গ-এর চাপ প্রয়োগ করে, দেশে জরুরী আইন জারী করা হয়। এই
জরুরী আইনের আওতায়, জার্মানি কমুনিষ্ট পার্টির অসংখ্য কর্মী এবং সাংসদের গ্রেফতার
করা হয়। ফলে জার্মান পার্লামেন্টে নাৎসি দল নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠ দলে পরিণত হয়।
২৩ মার্চ Enabling Act of 1933
পাশ হয়। এবং এই আইনের দ্বারা
হিটলার জার্মানির সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেন। এই
বৎসরের ১৪ জুলাই হিটলার নাৎসি ছাড়া জার্মানির সকল দলকে অবৈধ ঘোষণা করেন।
১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের
২রা আগষ্ট জার্মান প্রেসিডেন্ট
পল ভন হিন্ডেনবার্গ মৃত্যবরণ করেন। এর আগের
"Law Concerning the Highest State Office of the Reich".আইন
বলে, হিটলার জার্মানির প্রেসিডেন্ট
পদ বিলোপ করে দেন এবং একাই চ্যাঞ্চেলর এবং প্রেসিডন্টের দায়িত্ব
পালন করা শুরু করেন। তাঁর নতুন পদের নাম হয় Führer
und Reichskanzler
(ফুয়েরার এবং চ্যাঞ্চেলার)। এরপর হিটলার জার্মানীকে
শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করেন।
১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই মার্চ, বাধ্যতামূলক সর্বজনীন সৈনিক বৃত্তি চালুকরণের জন্য একটি আইন পাশ করে। এর দ্বারা জার্মানজাতিকে একটি যোদ্ধাজাতিতে পরিণত করার চেষ্টা করা হয়। ২১শে তিনি 'সাম্রাজ্য প্রতিরক্ষ বিষয়ক' একটি গোপন আইন পাশ করান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর পূর্বে এই আইন প্রকাশিত হয় নি। এই আইনে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের যাবতীয় পরিকল্পনা ছিল। সমগ্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বাহিনীর প্রতিরক্ষা বিষয়ক নীতির ভিত্তি ছিল এই গোপন আইনটি।
১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে অক্টোবর |
জার্মানিতে নিয়োগপ্রাপ্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত কিন্টোমো মুশাকোজি এবং জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোয়াকিম ভন রিববেনট্রপ 'কমিন্টার্নবিরোধী চুক্তি'তে স্বাক্ষর করছেন। |
১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে হিটলার আন্তর্জাতিক চুক্তি অমান্য করে, রাইন অঞ্চলে সৈন্য মোতায়েন করে। এই বৎসরে হিটলার তাঁর অর্থনীতি বিষয়ক মন্ত্রী শাখ্টকে ফ্রান্সের সাথে চুক্তি করার নির্দেশ দেয়। অক্টোবর মাসে স্বাক্ষরিত এই চুক্তি অনুসারে, ফ্রান্স প্রায় সাড়ে তিন শত কোটি মার্কেরও বেশি মূল্যের লৌহ আকরিক সরবরাহ করতে বাধ্য হয়ে পড়ে। এই বৎসরের সেপ্টেম্বর মাসে নুরেমবার্গে নাৎসি দলের অষ্টম দলীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় । এর নাম ছিল "Rally of Honour" (Reichsparteitag der Ehre)। এই অধিবেশনে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য জার্মানীর অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য একটি চারশালা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এই বৎসরের শেষের দিকে একটি গোপন বিজ্ঞতির মাধ্যমে, তিনি জার্মান সেনাবাহিনীকে চারবছর পরের কোনো এক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন।
১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে নভেম্বর জার্মানির রাজধানী বার্লিনে, জার্মানির নাৎসী নেতা
ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোয়াকিম ভন রিববেনট্রপ জার্মান ও জাপানের রাষ্ট্রদূত কিন্টোমো মুশাকোজি
'কমিন্টার্নবিরোধী
চুক্তি'তে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে
কমিন্টার্নের বিরুদ্ধাচারণ ছাড়াও উল্লেখ করা হয় যে—
যদি জার্মান বা জাপান রাশিয়া কর্তৃক আক্রান্ত হয়, তবে উভয় দেশ পরস্পরের পাশে এসে
দাঁড়াবে।
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ৬ নভেম্বরে ইতালি
কমিন্টার্নবিরোধী শিবিরে যোগদান করে। এর ফলে জার্মান, জাপান ও ইতালি'র ত্রিদেশীয়
জোট তৈরি হয়। পরে এই জোট
অক্ষশক্তি নামে পরিচিতি লাভ করে।
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে চীন-জার্মান চুক্তি বাতিল করে এবং মাঞ্চুরিয়ায় জাপানের পুতুল সরকারকে জার্মান স্বীকৃত দেয়। এই বৎসরের ১২ মার্চ অস্ট্রিয়াকে জার্মানের অংশ হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং অস্ট্রিয়া দখল করে নেয়। ২৮-২৯ মার্চে, বেশ কিছু গোপন আলোচনার সূত্রে চেকোশ্লোভাকিয়ার জার্মান বংশোদ্ভুত Sudeten Heimfront চেকোশ্লোভাকিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ জার্মানীর সাথে যুক্ত করতে সম্মত হয়। ২৯ সেপ্টেম্বর ব্রিটেন ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালির প্রতিনিধিরা মিউনিখে চেকোশ্লোভাকিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ জার্মানীকে দেওয়ার চুক্তি করে। ৩০সে সেপ্টেম্বর দ্বিপাক্ষিক ইঙ্গো-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি করে। উল্লেখ্য ৬ই ডিসেম্বর জার্মানির সাথে অনুরূপ চুক্তি করে ফ্রান্স।
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ১লা অক্টোবর জার্মান বাহিনী চেকোস্লোভাকিয়া'র সুদেতস অঞ্চলে প্রবেশ করে। এবং ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ভিতর তারা সমগ্র চেকোস্লোভাকিয়া দখল করে নেয়। এরপর বসন্তকালে এর লিথুনিয়ার ক্লাইপেদা জেলা দখল করে। এই সময় জার্মান রুমানিয়ার সাথে একটি অর্থনৈতিক চুক্তি করে।
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ২১ মার্চ জার্মানি পোল্যান্ডের কাছে ডানজিগ বন্দরের দাবি করে। একই সাথে পোলিশ করিডোরে মোটর বাইক ও রেলপথ তৈরির অধিকার দাবি করে। উল্লেখ্য, পোলিশ করিডোর বা ডানজিগ করিডোর ছিল পোলিশ ভূখণ্ডের একটি সংকীর্ণ এলাকা। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ভার্সাই চুক্তি অনুসারে এই ভূখণ্ডের অধিকার পেয়েছিল পোল্যান্ড। এই করিডোরের মাধ্যমে পোল্যান্ড বাল্টিক সাগরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতো। পোলিশ গদানস্ক এবং তৎসংলগ্ন ভূখণ্ড নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত ছিল। সে সময়ে এর নাম ছিল 'স্বাধীন ডানজিগ শহর'। এর রক্ষণাবেক্ষণ করতো তৎকালীন জাতিপুঞ্জ।
হিটলারের দাবি পোল্যান্ড অস্বীকার করে, ৩রা
এপ্রিল হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণের পরিকল্পনার জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয়।
জার্মান এই আক্রমণের নাম দিয়েছিল 'শুভ্র পরিকলপনা'। ১১ই এপ্রিল যুদ্ধের প্রস্তুতি
গ্রহণের জন্য হিটলার একটি নির্দেশপত্রে স্বাক্ষর করে। ২৮শে এপ্রিল জার্মান ১৯৩৪
খ্রিষ্টাব্দে স্বাক্ষরিত জার্মান-পোল্যান্ড অনাক্রমণ চুক্তি বাতিল করে দেন হিটলার।
২৩ আগষ্ট জার্মান-সোভিয়েত ইউনিয়ন অনাক্রমণ চুক্তি করে। ৩১ আগষ্ট পোল্যান্ডের
সীমানার নিকটবর্তী গ্লেইভিৎস-একটি যুদ্ধ শুরুর একটি সাজানো ঘটনা ঘটায়। হিটলারের
নির্দেশে কিছু জার্মান আসামিকে পোল্যান্ডের সেনাসদস্যের পোশাক পরিয়ে হত্যা করা হয়।
এরা স্থানীয় একটি বেতার কেন্দ্রের মাইক্রোফোনের কাছে গোলাগুলি করে। এই শব্দ বেতার
প্রচারিত হয়। একই সাথে পোলিশ ভাষায় কিছু বিবৃতি দেওয়া হয়। এই বিবৃতির একটি অংশ ছিল-
'জার্মানির বিরুদ্ধে পোল্যান্ডের যুদ্ধ ঘোষণার সময় এসেছে।' হিটলার-এর নির্দেশে
জার্মানীর সকল বেতার কেন্দ্র থেকে এই সংবাদ প্রচার করা হয়। এই অজুহাতে জার্মান ১লা
সেপ্টেম্বর পোল্যান্ড আক্রমণ করে। এরই মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে
শুরু হয়।
১৯৪৫
খ্রিষ্টাব্দে ইভা ব্রাউনকে বিয়ে
করেন। বিয়ের পর ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার
আগেই তিনি ফিউরার বাংকারে
সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেন।
সূত্র:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। ভিক্তর
মাৎসুলেনকো।
প্রগতি
প্রকাশন।
মস্কো।১৯৮৭।