ইয়াহিয়া
খান
পাকিস্তানের সাবেক
সেনাপ্রধান এবং প্রেসিডেন্ট। পুরো নাম আগা মোহম্মদ ইয়াহিয়া খান।
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের
পেশোয়ারে জন্মগ্রহণ করেন।
পাঞ্জাব বিশববিদ্যালয় থেকে বি.এ ডিগ্রি লাভের পর তিনি সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে যোগ
দেন।
১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পাকিস্তানের সেনাপ্রধান পদে উন্নীত হন।
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে গণ-অভ্যুত্থানের কারণে ২৪শে মার্চ আয়ুব খান পদত্যাগ করলে, তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের
ডিসেম্বর মাসে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে
আওয়ামী লীগ বিপুল
সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। অন্যদিকে পাকিস্তান পিপল্স পার্টি জাতীয় পরিষদে
দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন
না, এই অঙ্গীকার থেকে
আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় যাওয়ার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।
তিনি
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেও, ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ আকস্মিকভাবে
অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে
আওয়ামী লীগ প্রধান
বঙ্গবন্ধু
শেখ
মুজিবর রহমানের আহ্বানে সারা পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়।
এ পরিস্থিতিতে, ইয়াহিয়া খান
বঙ্গবন্ধুর
সঙ্গে আলোচনার জন্য ১৫ই মার্চ ঢাকায় আসেন। তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বিমানবন্দর
থেকে প্রেসিডেন্ট হাউসে আসেন। এই বিষয়ে সিদ্দিক সালিক তাঁর -উইটনেস টু সারেন্ডার
(ইউপিএল; ঢাকা, ১৯৯৭) গ্রন্থে জানান-
অনেক প্রেসিডেন্ট ও রাষ্ট্রপ্রধানের আগমনই আমি দেখেছি, কিন্তু ১৫ মার্চ ১৯৭১ ইয়াহিয়া খান যে পরিবেশে ঢাকায় এলেন, তেমনটা আর কখনো দেখিনি। বিমানবন্দরে ঢোকার সব রাস্তা সেদিন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। টার্মিনাল ভবনের ছাদে ইস্পাতের হেলমেট পরা সেনাদের রাখা হয়েছিল রক্ষী হিসেবে। বিমানবন্দরে যারা ঢুকছিল, ব্যাপক তল্লাশি করা হচ্ছিল তাদের। পাকিস্তান এয়ারফোর্সের ফটকে প্রচুর সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল। টারমাকে ঢোকার ওটাই ছিল একমাত্র পথ। ফটকের বাইরে পদাতিক বাহিনীর (১৮ পাঞ্জাব) এক কোম্পানি (প্রায় ১০০) সৈন্য মেশিনগানসহ ট্রাকে অপেক্ষা করছিল। তাদের দায়িত্ব ছিল প্রেসিডেন্টকে পাহারা দিয়ে শহরে নিয়ে যাওয়া। অল্প কয়েকজন কর্মকর্তাকে বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল। তাদের বাছাই করা হয়েছিল খুবই সতর্কতার সঙ্গে।
সেখানে ফুল নিয়ে কেউ অপেক্ষা করছিল না। বেসামরিক কর্মকর্তা বা 'নগরের অভিজাতরা'ও লাইন ধরে তাঁর জন্য অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল না। ছিল না কোনো সাংবাদিকের ক্যামেরার ক্লিক। এমনকি সরকারি আলোকচিত্রীদেরও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। প্রেসিডেন্টকে বরণ করে নেওয়ার জন্য যাঁরা অপেক্ষা করছিলেন, তাঁরা হলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান, মেজর জেনারেল খাদিম হুসেন রাজা, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও মেজর জেনারেল এ ও মিঠা। মিঠা ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল।
১৬ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত তিনি ঢাকায় ছিলেন। এর ভিতরে ১৬ এবং ১৭ই মার্চ তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনায় বসেন। কিন্তু সিদ্ধান্তে না আসায় এইআলোচনা ব্যর্থ হয়ে যায়। এর ভিতরে তিনি বাঙালিদের দমন করার জন্য পাকিস্তান থেকে সৈন্য এনে পূর্ব-পরিকল্পিত অপারেশন সার্চ লাইট কার্যকর করার উদ্যোগ নেন। আয়োজন সম্পন্ন হলে, তিনি ২৫ মার্চ রাত্রে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন এবং ওই রাত্রে ১২টার দিকে অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হয়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে নারকীয় হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য, তিনি কুখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ২৫শে মার্চের এক ঘোষণায় সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন। সামরিক ক্ষমতাবলে তিনি সংবিধান বাতিল এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন এবং তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর,
পাকিস্তানে ইয়াহিয়া বিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। এরপর
জুলফিকার আলী
ভুট্টো প্রত্যক্ষ মদদে শুরু হয়
পাকিস্তানের টিভিসহ সব মিডিয়ায় ইয়াহিয়ার কুকীর্তির কাহিনী প্রকাশিত হয়। হামদুর
রহমান কমিশনের অনুসন্ধান অনুযায়ী ইয়াহিয়ার ২০০ জন মহিলার সাথে অবৈধ সম্পর্ক ছিল।
হামদুর রহমান কমিশনের মূল রিপোর্টে ইয়াহিয়ার সাথে বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী নুরজাহানের
অবৈধ প্রেম সংক্রান্ত পুরো একটি অধ্যায় আছে। তাঁর শাসনামলে তাঁর বান্ধবীদের বিশাল
প্রভাব ছিল। ইয়াহিয়ার প্রভাবশালী এই নারী মহলকে পাকিস্তানি সংসবাদ মাধ্যমে 'হারেম
কেবিনেট' (হাই ক্লাস বান্ধবীরা এই দলভুক্ত), 'পেটিকোট ব্রিগেড' (অপেক্ষাকৃত
লো-প্রোফাইল বান্ধবীদের দল) এসব নাম প্রচারিত হয়।
২০শে ডিসেম্বর
প্রেসিডেন্ট পদ ত্যাগ করেন। এই সময়
জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতা গ্রহণ করেন ও ইয়াহিয়াকে গৃহবন্দী করে রাখেন।
১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দর ১০ই আগষ্ট মৃত্যুবরণ করেন।