মেদিনীপুর
ভারত প্রজাতন্ত্রের পশ্চিমবঙ্গ নামক প্রদেশের বিভাগ এবং জেলা সদর দফ্তর, একটি শহর এর ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক ২২.৪২৪° উত্তর ৮৭.৩১৯° পূর্ব। সমুদ্র সমতল হতে এর গড় উচ্চতা হল ২৪ মিটার (৭৮ ফুট)।

মেদেনীপুরের ইতিহাস:
মহাভারতের আমলে বঙ্গদেশ এবং তৎসংলগ্ন জনপদগুলোর ভিতরে
প্রত্নতত্ত্ববিদ্গণ ৩টি জনপদকে  আদি জনপদ হিসেবে নির্দেশিত করে থাকেন। এই জনপদগুলো হলো- অঙ্গ (রাজশাহী ও ভাগলপুর অঞ্চল), কলিঙ্গ (উত্তরে ভাগীরথী থেকে দক্ষিণে গোদাবরী নদী পর্য্যন্ত) এবং বঙ্গ (অঙ্গ ও কলিঙ্গের পূর্বাঞ্চল)। নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত বিশ্বকোষে (তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩০০) বলা হয়েছে- 'এখনকার মেদিনীপুর, উড়িষ্যা, গঞ্জাম ও সরকার তৎকালে কলিঙ্গ-রাজ্যের অন্তর্গত ছিল'। এই কলিঙ্গ-রাজ্যের উত্তরপূর্বাংশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল সুহ্ম-রাজ্য। সে সময়ের মেদিনীপুর অঞ্চলের অধিকাংশই ছিল প্রাচীন সুহ্ম-রাজ্যের অন্তর্গত। ধারণা করা হয় প্রাচীন তাম্রলিপ্তি নগরটি সেই রাজ্যের রাজধানী। এই রাজটি পরে
তাম্রলিপ্তি জনপদ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। এই বিচারে তাম্রিলপ্তি বা সুহ্মরাজ্যের ভৌগোলিক সীমা ছিল- ও পশ্চিমে পুণ্ড্র রাজ্য, পূর্ব্বে বঙ্গরাজ্য, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে কলিঙ্গ-রাজ্য (বর্তমান উড়িষ্যা)।

কলিঙ্গ রাজ্যটি বিভাজিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল উৎকল। কালিদাসের বর্ণনামতে উৎকলদেশের দক্ষিণেই কলিঙ্গ-রাজ্য ছিল। রঘুবংশে দেখিতে পাওয়া যায়, রঘু তাঁর রাজ্যের রাজধানী থেকে সুহ্মদেশ পর্য্যন্ত সমস্ত রাজ্য জয় করেছিলেন। তিনি পূর্ব্ব-মহাসাগরের তালীবনশ্যাম উপকণ্ঠে সুহ্মরাজ্যে উপস্থিত হয়েছিলেন। পরে উৎকলবাসীরা তাঁর পথ প্রদর্শক হন। এবং সেখান থেকে তিনি কলিঙ্গের উদ্দদেশ্যে যাত্রা করেন। এ সকল বিবরণ থেকে অনুমান করা যায়, সুহ্ম বা তাম্রলিপ্তি ও কলিঙ্গের মধ্যবর্তী রাজ্য ছিল উৎকল।

কলিঙ্গদেশের উত্তরাংশ ছিল উৎকল। সেরূপ পুণ্ড্র-রাজ্যের অংশবিশেষ গঠিত হয়েছিল উড্র। সম্ভবতঃ আধুনিক ছোটনাগপুর, ময়ুরভঞ্জ, কেঁউঝর, মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমাংশ ও বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণাংশ নিয়ে উড্রদেশ গঠিত ছিল। পরবর্ত্তিকালে সুহ্ম বা তাম্রলিপ্ত রাজ্যের স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হইয়া গেলে, এর কিছু অংশ উৎকলের সহিত মিলিত হয় এবং বাকি অংশ রাঢ়দেশ নামে পরিচিত হয়। উল্লেখ্য, এই সময় রাঢ়দেশ বলিতে প্রায় সমস্ত পশ্চিমবঙ্গকেই বুঝানো হতো। খ্রিষ্টীয় একাদশ শতাব্দীতে রচিত কৃষ্ণ মিশ্রের প্রবোধ-চন্দ্রোদয় নাটকে রাঢ়দেশের নাম পাওয়া যায়। এ সময়ে রাঢ়দেশ উত্তররাঢ় ও দক্ষিণরাঢ় নামে দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। বর্ত্তমান হুগলী ও হাবড়া জেলা এবং মেদিনীপুর জেলার কিয়দংশ দক্ষিণরাঢ়ের অন্তর্গত ছিল। দক্ষিণরাঢ়ের উৎকলের সীমান্ত থেকে আরম্ভ হয়েছিল। উৎকলের সীমা উত্তরে রূপনারায়ণ নদ পর্য্যন্ত বিস্তৃত হওয়ার কারণে বর্ত্তমান মেদিনীপুর জেলার প্রায় সমস্ত অংশই সে সময় উৎকলের অন্তর্ভূত হয়েছিল।

১৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দে
মানসিংহ উড়িষ্যা ও মেদেনীপুরের অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে সম্রাট আকবরের রাজস্ব-সচিব রাজা তোডরমল্ল বাঙ্গালা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্ব-নির্দ্ধারণকল্পে সুবা বাঙ্গালাকে কতকগুলি সরকারে বিভক্ত করেন। ঐ সরকারগুলিকেও আবার মহাল নামে কতকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করা হইয়াছিল। ঐ নির্দ্দেশক্রমে বঙ্গদেশ ১৯টি সরকার ও ৬৮২টি মহালে এবং উড়িষ্যাপ্রদেশ ৫টি সরকার ও ৯০টি মহালে বিভক্ত হয়। এই সময় মেদিনীপুর জেলার অধিকাংশই ছিল জলেশ্বর সরকারের অন্তর্ভূত হইয়াছিল। এর কিছু অংশ মান্দারণ বা মাদারুণের অন্তর্গত হয়। সে সময়ে মান্দারণ অর্দ্ধ-বৃত্তাকারে বীরভূম জেলার অন্তর্গত নাগর থেকে আরম্ভ হয়ে বর্দ্ধমান জেলার রাণীগঞ্জ, হুগলী জেলার জাহানাবাদ এবং হাবড়া জেলার পশ্চিমাংশ থেকে মেদিনীপুর জেলার চিতুয়া ও মহিষাদল পরগণা পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ৯০টি মহালের ভিতর ১৬টি মহাল মান্দারণের অন্তর্ভুক্ত হয়।

১৬৪৬ খ্রিষ্টাব্দে শাহ সুজা দ্বিতীয়বার বাঙলা-বিহার-উড়িষ্যার সুবেদার হিসেবে আসেন। ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দে শাহ সুজা সুবা বাংলার রাজস্বের জন্য একটি নূতন হিসাব প্রস্তুত করেন। তাতে দেখা যায় তোডরমল্লের সময়ের বাঙ্গালার পূর্ব্বোক্ত ১৯টি সরকারের সাথে হিজলী ও বন্দর বালেশ্বর ফৌজদারীর ছয়টি সরকার যুক্ত হয়। এর সাথে আরও নয়টি সরকার মিলিত করিয়া সুবা বাঙ্গালাকে ৩৪ সরকারে ও ১৩৫০ মহালে বিভক্ত করেন। ঐ সময় পুরাতন সরকারবিভাগের সীমারও কিছু কিছু পরিবর্তন করা হয়েছিল। রাজা তোডরমল্লের সময়ের সরকার মান্দারুণের অন্তর্গত হয় এবং এই জেলার মধ্যস্থিত পূর্ব্বোক্ত চারিটি মহালের মধ্যে চিতুয়া মহাল নূতন বন্দোবস্তেও সরকার মান্দারুণের অন্তর্ভুক্ত থাকে। কিন্তু সাহাপুর ও মহিষাদল মহাল দুইটি যথাক্রমে সরকার কিস্মৎ গোয়ালপাড়ার ও সরকার কিস্মৎ মালঝিটার অন্তর্ভুক্ত হয়। পুরাতন সরকার মান্দারুণের অন্যতম মহাল হাভেলি মাদারুণের অন্তর্গত বরদা ও চন্দ্রকোণা ভূভাগ ঐ সময়ে সরকার পেস্কোসের অন্তর্ভূত হয়েছিল।

১৭২২ খ্রিষ্টাব্দে বাঙ্গালার সুবাদার মুর্শিদকুলি খাঁ সুবা বাঙ্গালার রাজস্বের তৃতীয় হিসাব প্রস্তত করেন। তিনি ব্যয়-সংক্ষেপ করার জন্য সুজার সময়ে নির্ধারিত ৩৪টি সরকারের সমন্বয় করে ১৩টি চাকলায় ও ১৬৬০টি পরগণায় ভাগ করেন। ঐ সময় থেকে মহালগুলি পরগণা নামে অভিহিত হ‌ওয়া শুরু হয়। মুর্শিদকুলির বিভাগানুসারে হিজলী ফৌজদারীর অন্তভূর্ত সুজার নির্দ্ধারিত কিস্মৎ জলেশ্বর, কিস্মৎ মালঝিটা ও কিস্মৎ মুজকুরির অন্তর্গত ৩৫টি পরগণা চাক‍লা হিজলীর অন্তর্ভুক্ত হয় মুর্শিদকুলি খাঁর রাজস্ব-বিভাগে।

১৭২৮ খ্রিষ্টাব্দে চাক‍লা হিজলীতে ৩৮টি পরগণা ছিল এবং তৎকালে হিজলীর পরিমাণফল ১০৯৮ বর্গমাইল নির্দ্ধারিত হইয়াছিল। ঐ সময় সরকার পেস্কোসের অন্তর্গত চন্দ্রকোণা ও বরদা পরগণা এবং সরকার মান্দারুণের অন্তর্গত চিতুয়া পরগণা চাক‍লা বর্ধধমানের অন্তর্ভুক্ত হয়। চাক‍লা হিজলী ও চাকলা বর্ধমানের অন্তর্গত পূর্ব্বোক্ত পরগণাগুলো ব্যতীত জলেশ্বর, মুজকুরি ও গোয়ালপাড়া সরকারের অন্যান্য পরগণাগুলোর ভিতরে চাকলা মেদিনীপুর।

নবাবী আমলে সুবর্ণরেখা নদীকে উড়িষ্যার উত্তরসীমা হিসেবে গণ্য করা হতো। সে সময়ে সুবর্ণরেখা ও রূপনারায়ণের মধ্যবর্ত্তী মেদিনীপুর প্রদেশটি তখনও কাগজে-কলমে উড়িষ্যারাজ্য নামে পরিচিত ছিল। ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধিকারের প্রারম্ভেও সুবর্ণরেখা ও রূপনারায়ণ নদীর মধ্যবর্ত্তী চাকলা মেদিনীপুর বিভাগটি উড়িষ্যার অন্তর্গত ছিল। পরবর্তী সময়ে মেদেনীপর বঙ্গদেশের অন্তভূর্ত হয়েছিল।

১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দের সন্ধির শর্তানুসারে নবাব মিরকাশিম ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পনীকে চাক্‌লা বর্ধমান, চাকলা মেদিনীপুর ও চট্টগ্রামের সম্পূর্ণ অধিকার ছেড়ে দেন। এই স্থানগুলো তখন থেকই ইংরাজদের অধিকারে চলে যায়। তবে চাকলা হিজলীতে তখনও মুসলমানদিগের আধিপত্য ছিল। ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী সমগ্র বাঙ্গালার দেওয়ানী প্রাপ্ত হলে, চাকলা হিজলীও ইংরেজদের অধিকারভুক্ত হয়।

১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে মিঃ পিয়ারস মেদিনীপুরের প্রথম কালেকটর নিযুক্ত হন। এই সময় চাকলা মেদিনীপুরে ৫৪টি পরগণা ছিল এবং এর আয়তন ছিল ৬১০২ বর্গ-মাইল নির্দ্ধারিত হয়েছিল।

সমস্ত বঙ্গদেশে ইংরাজদের অইধকার প্রতিষ্ঠিত হইলে, রাজস্ব আদায়ের জন্য ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যাকে কয়েকটি জেলায় বিভক্ত করেন। এই সময় মেদিনীপুর জেলা গঠিত হয়। ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ২রা সেপ্টেম্বর মেদিনীপুর শহরকে জেলার সদর ঘোষণা করা হয়।

১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে জলেশ্বর জেলাকে মেদিনীপুর জেলার সাথে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়।
১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে বর্ধমান জেলার কিয়দংশ বিচ্ছিন্ন করে হুগলী জেলা গঠিত হয়েছিল। এই জেলার উত্তরাংশের কয়েকটি পরগণা আবার হুগলী জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।