তাম্রলিপ্তি
প্রাচীন বাংলার জনপদ বিশেষ।  বঙ্গোপসাগরে উপকূলীয় গঙ্গা-অববাহিকার এই অঞ্চলটি গড়ে উঠেছিল। সুদূর অতীতে যখন বঙ্গদেশ অধিকাংশ অঞ্চল সাগরগর্ভে ছিল। তখন বঙ্গোপসাগরের উত্তর-সীমা ছিল রাজমহল-পর্ব্বতমালা।

বঙ্গদেশের হিমালয় সংলগ্ন পাহাড় এবং পাহাড়ী উচ্চভূমি থেকে প্রবাহিত জলধারা সাগরগর্ভের ভূমিকে উচ্চতর করেছিল। সেই সূত্রে হিমালয়ের দক্ষিণাংশ জুড়ে পলিগঠিত ভূমির উত্থান উত্থান হয়েছিল। এই ধারায় দক্ষিণের এই জনপদ হিসেবে তাম্রলিপ্তি ও চন্দ্রদ্বীপ গড়ে উঠেছিল বঙ্গাদেশের দক্ষিণ-প্রান্তীয় শেষ জনপদ হিসেবে।

মহাভারতের আমলে বঙ্গদেশ এবং তৎসংলগ্ন জনপদগুলোর ভিতরে প্রত্নতত্ত্ববিদ্গণ ৩টি জনপদকে  আদি জনপদ হিসেবে নির্দেশিত করে থাকেন। এই জনপদগুলো হলো- অঙ্গ (রাজশাহী ও ভাগলপুর অঞ্চল), কলিঙ্গ (উত্তরে ভাগীরথী থেকে দক্ষিণে গোদাবরী নদী পর্য্যন্ত) এবং বঙ্গ (অঙ্গ ও কলিঙ্গের পূর্বাঞ্চল)। নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত বিশ্বকোষে (তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩০০) বলা হয়েছে- 'এখনকার মেদিনীপুর, উড়িষ্যা, গঞ্জাম ও সরকার তৎকালে কলিঙ্গ-রাজ্যের অন্তর্গত ছিল'। এই কলিঙ্গ-রাজ্যের উত্তরপূর্বাংশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল সুহ্ম-রাজ্য। সে সময়ের মেদিনীপুর অঞ্চলের অধিকাংশই ছিল প্রাচীন সুহ্ম-রাজ্যের অন্তর্গত। ধারণা করা হয় প্রাচীন তাম্রলিপ্তি নগরটি সেই রাজ্যের রাজধানী। এই রাজটি পরে তাম্রলিপ্তি জনপদ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। এই বিচারে তাম্রিলপ্তি বা সুহ্মরাজ্যের ভৌগোলিক সীমা ছিল- ও পশ্চিমে পুণ্ড্র রাজ্য, পূর্ব্বে বঙ্গরাজ্য, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে কলিঙ্গ-রাজ্য (বর্তমান উড়িষ্যা)।

কলিঙ্গ রাজ্যটি বিভাজিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল উৎকল। কালিদাসের বর্ণনামতে উৎকলদেশের দক্ষিণেই কলিঙ্গ-রাজ্য ছিল। রঘুবংশে দেখিতে পাওয়া যায়, রঘু তাঁর রাজ্যের রাজধানী থেকে সুহ্মদেশ পর্য্যন্ত সমস্ত রাজ্য জয় করেছিলেন। তিনি পূর্ব্ব-মহাসাগরের তালীবনশ্যাম উপকণ্ঠে সুহ্মরাজ্যে উপস্থিত হয়েছিলেন। পরে উৎকলবাসীরা তাঁর পথ প্রদর্শক হন। এবং সেখান থেকে তিনি কলিঙ্গের উদ্দদেশ্যে যাত্রা করেন। এ সকল বিবরণ থেকে অনুমান করা যায়, সুহ্ম বা তাম্রলিপ্তি ও কলিঙ্গের মধ্যবর্তী রাজ্য ছিল উৎকল।

ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ/তৃতীয় শতাব্দী থেকে এই অঞ্চলে মনুষ্যপল্লী গড়ে উঠে। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর দিকে স্থল ও জল পথের যোগাযোগ সুগম হয়েছিল। এই সূত্রে হুগলী ও রূপনারায়ণ নদের সঙ্গমস্থল হতে ১২ মাইল দূরে রূপনারায়ণের তীরে একটি বন্দরটি গড়ে উঠেছিল। কালক্রমে বাণিজ্যের গুরুত্বে এই বন্দরটি আন্তর্জাতিকভাবে একটি বন্দর-নগরী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। তখন এর নাম ছিল তমলুক। চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন-সাং এই নগরটিকে  ‘তান-মো-লি-তি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। গ্রিক ভৌগোলিক টলেমীর মানচিত্রে ‘তমলিটিস্’ নামে এর উল্লেখ আছে। এই নগরকে কেন্দ্র করে বিকশিত যে জনপদ গড়ে, কালক্রমে তাই তাম্রলিপ্তি বা তাম্রলিপ্ত নামে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানেনের বিচারে এই অঞ্চলটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মেদেনীপুর ও বর্ধমান বিভাগ অংশবিশেষ জুড়ে অবস্থিত।  উল্লেখ্য, চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন-সাং ন-সাং ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে চীন থেকে তাঁর ভ্রমণ শুরু করে ভারতে আসেন। ৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করেন। তিনি এই নগরী সম্পর্কে তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে বলেন—
‘সমতট থেকে পশ্চিম দিকে ৯০০ লি পথ পাড়ি দেয়ার পর এসে পৌঁছলাম তান মো লি তি বা তাম্রলিপ্তি রাজ্যে। রাজ্যটি আকারে ১৫০০ লির মতো। রাজধানীর আয়তন ১০ লি। ... নিয়মিত চাষবাস চলে। প্রচুর ফল ও ফুলের ছড়াছড়ি এখানে। ... এখানে দশটির মতো সংঘারাম আছে, হাজার খানেক ভিক্ষুর বাস। দেবমন্দির আছে পঞ্চাশটির মতো। নানা সম্প্রদায়ের লোকেরা এখানে মিলেমিশে বাস করছে। দেশটির উপকূল ভাগ একটি সমুদ্র খাঁড়ি দিয়ে বেষ্টিত। জল ও ভূমি যেন একে অপরকে আলিঙ্গন করছে এখানে। প্রচুর দামী দামী জিনিস এবং রত্নসামগ্রী এখান থেকে সংগৃহীত হয়। এজন্য এলাকার অধিবাসীরা বেশ ধনী। ...’ (সূত্র : হিউয়েন সাঙ ভ্রমণকাহিনী, ভাষান্তর; খুররম হোসাইন, শব্দগুচ্ছ, ঢাকা, ২০০৩, পৃ. ৮৯)
নীহাররঞ্জন রায় তাঁর 'বাঙ্গালীর ইতিকথা, আদিপর্ব', তাম্রলিপ্তিকে প্রাচীন বাংলার বহির্বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দর হিসেবে চিহ্নিত করলেও, স্থান হিসেবে মেদেনিপুরকে স্বীকার করতে চান নি। তিনি সেকালের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হিসেবে মেঘনা-বুড়িগঙ্গা মুখের কোনো বন্দর অথবা চট্টগ্রামের কথাও ভেবেছেন। তাঁর মতে-
'...মিলিন্দ-পঞ্চহ গ্রন্থে বঙ্গ বা পূর্ববঙ্গকেও একটি অন্যতম সামুদ্রিক বাণিজ্য-কেন্দ্র বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে... এই বন্দর কোন্ বন্দর তাহা অনুমান করিবার উপায় নাই। তবে বুড়ীগঙ্গা ( Ptolemy’ Antibole?) বা মেঘনার মুখের কোনও বন্দর হওয়া অসম্ভব নয়, অথবা চট্টগ্রামও হইতে পারে, কিন্তু মধ্যযুগে Bengala বন্দর হওয়াই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।...’
(তথ্যসূত্র : নীহাররঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিকথা, আদিপর্ব, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০১, পৃ. ১৫৭)
এই নগরী সম্পর্কে আই.সি.এস গৌড়দাস বসাক আঠারো শতকের শেষপাদে তমলুকের ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কে বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। এই বিষয়ে তাঁর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল — ‘প্রসিডিংস অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল’-এর ১৮৮৮ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর সংখ্যায় (কলকাতা, ১৮৮৯)।

১৯২০-২১ খ্রিষ্টাব্দে ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ (এ.এস.আই) তমলুকের ওপর একটি সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট তৈরি করে। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ সম্পাদন করেন স্যার গুরুসদয় দত্ত, টি.এন রামচন্দ্রন এবং কে.এন দীক্ষিত। এই খননের সূত্রে কিছু পোড়ামাটির সামগ্রী, মৃৎপাত্র এবং মুদ্রা পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, প্রাপ্ত নিদর্শনাবলির কয়েকটি ছিল খ্রিষ্টপূর্ব তিন শতকের। এরপর এ.এস.আই ১৯৫৪-৫৫ খ্রিষ্টাব্দে এম.এন দেশপাণ্ডের তত্ত্বাবধানে পুনরায় প্রত্ন-উৎখননের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। অবশ্য এ উৎখনন থেকে কোনো ধরনের কাঠামোগত অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি। কেবল পেটানো মেঝে এবং কিছু পাতকুয়ার সন্ধান পাওয়া যায়।

১৯৭৩-৭৪ খ্রিষ্টাব্দে এ.এস.আই-এর পক্ষ থেকে প্রত্নস্থলটিতে এস.কে মুখার্জীর তত্ত্বাবধানে আরেক দফা উৎখননের উদ্যোগ চলে। এ উৎখনন থেকে চারটি পৃথক সাংস্কৃতিক পর্বের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলো হলো—

সূত্র :
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।
http://www.banglapedia.org/HTB/102800.htm