মৌর্য সাম্রাজ্য (খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৪ অব্দ
থেকে ১৮৬ অব্দ)
আলেকজান্ডার ভারতের
পূর্ব-দিকের অভিযান ত্যাগ করে, ঝিলম ও
বিপাশা
নদীর মধ্যাভাগের
অঞ্চল পুরুকে এবং সিন্ধু ঝিলম নদীর মধ্যভাগের অঞ্চল অম্ভির কাছে ছেড়ে দেন এবং
আলেকজান্ডার পারস্যে ফিরে যান। এরপর
চন্দ্রগুপ্ত (মৌর্য) উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের
উপর আধিপত্য বিস্তরে সক্ষম হন।
তিনি পারশ্য সীমান্ত থেকে দক্ষিণ
ভারতের মহীশূর এবং সৌরাষ্ট্র থেকে বঙ্গদেশ পর্যন্ত রাজ্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছিলেন।ৱ
চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যসীমা |
অনেকে মনে করেন গঙ্গারিডাই ছিল নন্দরাজের অধীনস্থ একটি রাজ্য। নন্দরাজের পতনের পর এই রাজ্য চন্দ্রগুপ্তের অধীনস্থ হয়। মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত ব্রাহ্মীলিপি থেকে অনুমান করা যায়, উত্তরবঙ্গ তথা পুণ্ড্রবর্ধন খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩-৩২৪ অব্দের দিকে চন্দ্রগুপ্তের অধিকারে এসেছিল। সেই সূত্রে ধীরে ধীরে মৌর্যবংশের শাসনাধীন চলে যায়।
মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত । চন্দ্রগুপ্তের বংশ পরিচয় নিয়ে মতান্তর আছে। প্রাচীন হিন্দু কিংবদন্তী থেকে জানা যায়, ইনি নন্দবংশের সন্তান ছিলেন। অন্যমতে তাঁর মাতা (মতান্তরে মাতামহী) ছিলেন মুরা ছিলেন শুদ্রাণী। এই মতে নন্দরাজের উপপত্নী মুরা'র সন্তানের মৌর্য নামে অভিহিত হয়েছে। হিন্দু পুরাণ থেকে এই সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। পুরাণে বরং পাওয়া যায়, নন্দবংশের পতনের পর শূদ্র বংশের আরম্ভ হয়েছিল। বৌদ্ধ গ্রন্থাদিতে মৌর্য বংশের রাজাদের ক্ষত্রিয় হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
মৌর্যবংশের রাজাদের তালিকা :
অশোকের মৃত্যুর পর উল্লেখযোগ্য কোনো রাজা মৌর্য বংশে আসে নি। অশোকের পরে তিবর, মহেন্দ্র, জলোকি ও কুনালের নাম পাওয়া যায়। এর ভিতরে তিবর রাজা ছিলেন কিনা সন্দেহ করা হয়। মহেন্দ্র অশোকের পুত্র বা ভাই ছিলেন। কল্হণের 'রাজতরঙ্গিনী' গ্রন্থ থেকে জানা যায়, অশোকের পুত্র জলোকি কাশ্মীরের রাজা ছিলেন। তিব্বতীয় গ্রন্থকার তারানাথের মতে গান্ধারের রাজা ছিলেন অশোকের উত্তরাধিকার বীরসেন। বিষ্ণুপুরাণের মতে, অশোকের পুত্র ছিলেন কুনাল। তিনি ৮ বৎসর রাজত্ব করেন। এরপর যে সকল রাজার নাম পাওয়া যায়, তাঁর হলেন বন্ধুপালিত, ইন্দ্রপালিত, দেববর্মণ ও বৃহদ্রথ। আবার বৌদ্ধগ্রন্থ 'দিব্যবদন'-মতে অশোকের উত্তরাধিকারদের ভিতরে ছিলেন সম্প্রতি, বৃহস্পতি, পুষ্যধর্মণ ও পুষ্যমিত্র। গার্গী-সংহিতা অনুসারে অশোকের পৌত্র দশরথ মৌর্য সিংহাসনে বসেছিলেন। দশরথের পর সিংহাসনে বসেন সম্প্রীতি। পাটালিপুত্রকল্প নামক গ্রন্থে সম্প্রতিকে ভারতের অধীশ্বর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার জৈন গ্রন্থে সম্প্রতিকে পাটালিপুত্র ও উজ্জ্বয়িনীর অধীশ্বর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
নানা গ্রন্থে এরূপ পরস্পর বিরোধী তথ্যের দ্বারা অশোকের পরের রাজাদের
ইতিহাস সাজানো মুশকিল। এর ভিতর দিয়ে যতটুকু জানা যায়, তা হলো সম্প্রতি নামক একজন
অশোকের পরে
উল্লেখযোগ্য রাজা ছিলেন। সম্প্রতির পুত্র ছিলেন বৃহস্পতি। সালিশুক নামক আরও একজন
রাজার নাম পাওয়া যায়। সম্ভবত সালিশুক এবং বৃহস্পতি একই ব্যক্তি ছিলেন। পুরাণ ও
বাণভট্ট রচিত হর্ষচরিত থেকে জানা যায়, মৌর্যবংশের শেষ রাজা ছিলেন বৃহদ্রথ।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৫ অব্দে বৃহদ্রথের সেনাপতি পুষ্যমিত্র তাঁকে হত্যা করে সিংহাসন দখল
করেন। এরই ভিতর দিয়ে মৌর্য বংশের শাসনের অবসান হয় এবং পুষ্যামিত্রের মাধ্যমে
শুঙ্গ বংশীয়দের
রাজত্ব শুরু হয়।
কিন্তু মৌর্যবংশের রাজত্বের শেষের দিকে একাধিক রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। মগধের
শুঙ্গ বংশীয়দের
প্রতিষ্ঠিত হলেও, মগধ থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে দাক্ষিণাত্যে
সাতবাহন রাজবংশ
(খ্রিষ্টপূর্ব ২৭ থেকে ১৯৬ খ্রিষ্টাব্দ) স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা
করে। এর ভিতরে স্বল্প সময়ের জন্য
কান্ব রাজবংশ (খ্রিষ্টপূর্ব
৭৩-২৮ অব্দ)-এর শাসনকাল পাওয়া যায়। এই সময় দেশীয় রাজাদের কোন্দলের ফলে, ভারতে একক
শক্তিশালী সাম্রাজ্য গঠিত হয় নি। এই সুযোগে বিদেশীরা ভারতবর্ষে আধিপত্য বিস্তারের
চেষ্টা করে। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য ছিল ব্যাক্ট্রীয় গ্রিক, শক, পহ্লব, কুষাণ।
এসব আক্রমণের ফলে মৌর্য সাম্রাজ্য ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর
হতে থাকে। এই সুযোগে তৎকালীন উদীয়মান রাজশক্তিগুলো এই সাম্রজ্যের বিভিন্ন অংশ দখল
করেন।
৫৬৬-৫৯৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বাতাপী
চালুক্য
রাজবংশের দ্বিতীয় রাজা
কীর্তিবর্মণ প্রথম কাদম্ব ও
দুর্বল মৌর্যদের পরাজিত করে কঙ্কন,
বেলারি ও কুর্ণল অঞ্চল দখল করেছিলেন।
পুলকেশী দ্বিতীয় ৬১০-৬৪২
খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে
উত্তরে কঙ্কনের
মৌর্য রাজাকে পরাজিত করে
তাঁর রাজধানী পুরী দখল করেন।
সূত্র :
বাংলাদেশের
ইতিহাস (আদিপর্ব)/রমেশচন্দ্র মজুমদার।
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।