সাতবাহন রাজবংশের উল্লেখযোগ্য রাজা
এরপর সাতবাহন রাজ্য শক, পহ্লব এবং কুষাণদের আক্রমণের শিকার হয়। ফলে সাতবাহন রাজ্য ক্রমান্বয়ে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে শকরা পল্লব রাজ্যের অন্যতম নগর নাসিক আক্রমণ করে দখল করে এবং সেখানে তাঁদের রাজধানী স্থাপন করে। এরপর শকদের আক্রমণে সাতবাহনরা পশ্চিম দাক্ষিণ্যত্যের উপর অধিকার হারিয়ে ফেলে। ফলে এরা পূর্ব দিকে অন্ধ্রপ্রদেশের দিকে চলে যায়। এরপর শকদের রাজা নহপান এবং এবং তাঁর জামাতা ঋষভদত্ত সাতবাহনদের মহারাষ্ট্র থেকে বিতারিত করে। এসব কারণে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে সাতবাহন রাজ্য বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু ১০৬ খ্রিষ্টাব্দে এই বংশের সাতকর্ণী নামক অপর একজন রাজা সাতবাহন রাজ্যের ঘোরতর বিপদ থেকে রক্ষা করেন এবং রাজ্যের প্রসার ঘটান। এই সাতকর্ণী গৌতমী সাতকর্ণী নামে পরিচিত।
গৌতমীপুত্র কেবল রণক্ষেত্রেই কৃতিত্বের পরিচয় দেননি। শাসক হিসেবে এবং সংস্কারক হিসেবেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন । দরিদ্র জনগণের সুবিধার জন্য তিনি করভার লাঘব করেছিলেন বলে জানা যায় । তিনি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং ক্ষত্রিয়দের দর্প চূর্ণ করে ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । তিনি বর্ণপ্রথার গোঁড়া সমর্থক ছিলেন এবং বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে মেলামেশা বন্ধ করে দেন । কিন্তু পরিস্থিতির চাপে পড়ে তিনি নিজেই শক রাজা রুদ্রদমনের কন্যার সঙ্গে নিজ পুত্রের বিবাহ দেন ।
বশিষ্ঠীপুত্র পুলমায়ী
১৩১ খ্রিষ্টাব্দে গৌতমী সাতকর্ণী মৃত্যবরণ করলে, তাঁর পুত্র বশিষ্ঠী পুত্র পুলমায়ী রাজত্ব লাভ করেন। পুলমায়ীর মায়ের নাম ছিল বশিষ্ঠী। সেকারণে তাকে বশিষ্ঠী পুলমায়ী নামে অভিহিত করা হয়েছিল। পুলমায়ী রাজত্বলাভের পর অন্ধ্র প্রদেশ জয় করেন। তিনি মধ্যপ্রদেশের কিছু অংশ অধিকার করেছিলেন। এই সময় মালব এবং কাথিয়াবাড় শকদের রাজা রুদ্রদমনের অধিকারে ছিল। পুলমায়ীর এই আগ্রাসী অভিযানের সূত্রে শকদের সাথে আবার যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। কিন্তু এই যুদ্ধে কোনো পক্ষই চূড়ান্ত লাভ করতে পারেন নি। টলেমীর বিবরণ থেকে জানা যায়, পুলমায়ীর রাজধানী ছিল পৈথান। অমরাবতীতে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায়, কৃষ্ণা নদীর মোহনা পর্যন্ত তাঁর রাজ্যের সীমা ছিল। ধারণা করা হয় পুলমায়ী ১৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণী
বশিষ্ঠী পুলমায়ীর মৃত্যুর পর স্বল্প সময়ের জন্য রাজ্য শাসন কেউ করেছিলেন কিনা তা স্পষ্ট জানা যায় না। আনুমানিক ১৬৫ খ্রিষ্টাব্দে এই রাজবংশের শেষ রাজা যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণী সিংহাসন লাভ করেন। তিনি পশ্চিমী শক রাজাদের পরাজিত করে, রাজ্যের দক্ষিণাংশ উদ্ধার করেন। তাঁর সময়ে মহারাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রদেশও সাতবাহন রাজ্যের অংশীভূত হয়। ১৯৬ খ্রিষ্টাব্দে যজ্ঞশ্রী মৃত্যুবরণ করেন।
যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণীর মৃত্যুর পর, তাঁর রাজ্য সাতবংশীয় বিভিন্ন উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বিভাজিত হয়ে যায়। ফলে সাতবাহন রাজ্যের কেন্দ্রীয় শক্তি খর্ব হয়। এই সুযোগে মহারাষ্ট্রে আভিররা স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করে। অন্য দিকে ইক্ষ্বাকুরা অন্ধ্র প্রদেশে স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করে। এই সময় পহ্বব ও ভটকদের ক্রমাগত আক্রমণে সাতবাহন রাজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায়।
সাতবাহনদের শাসনামলে
কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের দ্রুত বিকাশ হয়। প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে
নিত্য নতুন চাহিদা পূরণের জন্য নতুন নতুন পণ্যের উৎপাদন হতে থাকে। রাষ্ট্রের
সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় পণ্যের সংখ্যা ও উৎপাদনের উৎকর্ষ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
দৈনন্দিন প্রয়োজনের খাদ্য, বস্ত্র, মন্দির, বাসস্থান, যানবাহন, তৈজসপত্র, আসবাব
বাদেও বিস্তর সৌখিন জিনিস তৈরির কথা আছে। স্বর্ণরৌপ্য মণিমুক্তার গহনা, বিলাসের ছোট
ছোট সুন্দর উপকরণ, গন্ধদ্রব্য, হাতির দাঁতের শিল্পদ্রব্য, চন্দনকাঠের, পুঁতির,
হাড়ের কাজ, রেশমি কাপড়, নানা ধরনের খোদাই, মুদ্রানির্মাণ ইত্যাদির কথা এতে উল্লেখ
রয়েছে। সাতবাহন শাসনামলে রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রার প্রচলন ছিল।
সূত্র :
এদের সময় জনপদের বিস্তার ঘটছিল, শহরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। গ্রামে ছিল মূল
খাদ্যবস্ত্র উৎপাদন ও ছোট ছোট শিল্পদ্রব্য উৎপাদনের কারখানা। শহরে প্রশাসন ছাড়াও
কিছু কিছু শিল্পচর্চার অবকাশ ছিল। কাজেই বোঝা যায়, বহু প্রকারের পণ্য উৎপাদনের
জন্যে যে ধরনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিজ্ঞানের দরকার ছিল তা তখন স্থানীয় বিজ্ঞানী ও
প্রযুক্তিবিদদের অধিগত ছিল। এ ধরনের পণ্যের চাহিদা বেড়েছিল, কারণ ফসল, মশলা, পশু,
পশুজাত দ্রব্য থেকে নির্মিত শিল্পবস্তু, বিভিন্ন ধাতু ও দামি পাথরের অলংকার, রেশমি
কাপড় ইত্যাদির জন্যে গ্রীস, রোম, চীন, মিসর, সিরিয়া, আরব, পারস্য এবং দূরপ্রাচ্যের
ব্রহ্মদেশ, মালয়েশিয়া, যবদ্বীপ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের সঙ্গে বর্ধিষ্ণু এক
বহির্বাণিজ্যের দীর্ঘ ইতিহাস পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের
ইতিহাস (আদিপর্ব)/রমেশচন্দ্র মজুমদার।
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।