জৈনদের 'পবন্নবণাসূত্র' এবং 'সমবায়াঙ্গসূত্র' নামক গ্রন্থদ্বয়ে যে ১৮টি লিপির উল্লেখ পাওয়া যায়, তার ভিতরে এই লিপির নাম পাওয়া যায় 'বংভী' হিসাবে। ''ভগবতীসূত্র' নামক গ্রন্থে এই ভাষার নাম পাওয়া যায় সশ্রদ্ধ নিবেদন (নমো বংভীএ লিপিএ)। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সংস্কৃত ভাষায় রচিত গ্রন্থ 'ললিতবিস্তর' -এ ৬৪টি লিপির নাম পাওয়া যায়। এই লিপিগুলোর প্রথম লিপিটি হল- ব্রাহ্মী। ললিতবিস্তর-এর সূত্রে চীনের ফা ওয়ান চু লিন্ ৬৬৮ খ্রিষ্টাব্দে যে বৌদ্ধকোষ রচনা করেছিলেন, সেখানেও এই লিপির নাম পাওয়া যায়। এই গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, এই লিপির আনুভূমিক দিক নির্দেশনা ছিল বাঁ দিক থেকে ডান দিকে (বাংলার মত)। পক্ষান্তরে যে লিপি ডান দিক থেকে বাঁ দিক বরাবর লিখা হতো (আরবি লিপির মত), তার নাম ছিল খরোষ্ঠী।
ইউরোপীয় পণ্ডিতরা এই লিপির উৎস সম্পর্কে এক প্রকার জোর- জবরদস্তি করে বলার চেষ্টা করেছেন যে, এই লিপির উদ্ভব ঘটেছিল ভারতবর্ষের বাইরে। এক্ষেত্রে যে মতামতগুলো পাওয়া যায়, তা হল-
১. গ্রীকরা ভারতবর্ষে আসার পর ভারতবর্ষে ব্রাহ্মীলিপির উৎপত্তি হয়েছিল। মতবাদ- ড. আফ্রড মুলর, প্রিন্সেস, সেনার্ট, উলসন
২. ফিনিশীয় লিপি থেকে ব্রাহ্মীলিপির উদ্ভব ঘটেছিল। মতবাদ-উলসন, ক্লিষ্ট, স্টিবেনসন, পল গোল্ডস্মিথ বার্নেল, লেনোর্মট
৩. সেমেটিক লিপি থেকে ব্রাহ্মীলিপির উদ্ভব ঘটেছিল। মতবাদ- জোন্স, কাপ্প, লেপ্সিয়স, ওয়েবার, আইজাক টেলর, ওয়েবার।
৪. আরামাইক লিপি থেকে ব্রাহ্মীলিপির উদ্ভব ঘটেছিল। মতবাদ-বার্নেল ও অন্যান্য।
ইউরোপীয় পণ্ডিতদের এই সকল মতবাদ একবাক্যে গ্রহণ করা যায় না, যে সকল কারণে-
১. ভারতীয় ভাষায় ব্যবহৃত বর্ণ সংখ্যা উল্লিখিত লিপিগুলোর চেয়ে অনেক বেশি।
২. বর্ণমালার বিন্যাসে ইউরোপীয় বর্ণমালার চেয়ে ভারতীয় লিপিগুলোর বিন্যাস অনেকগুণে বিজ্ঞানসম্মত। লক্ষ্যণীয় যে, ভারতবর্ষের বর্ণামালায় স্বরবর্ণের সেট পৃথক। ব্যঞ্জনধ্বনির প্রকৃতি অনুসারে বর্গীয় বর্ণ, ঘোষ, অঘোষ, অল্পপ্রাণ, মহাপ্রাণ ইত্যাদির বিজ্ঞানসম্মত বিন্যাস অন্যান্য প্রাচীন লিপিমালায় ছিল না। এছাড়া শব্দ তৈরিতে বর্ণের ব্যবহারি-বিধি নির্ধারিত ছিল চোদ্দটি সূত্রে। 'প্রত্যাহ্রিয়ন্তে সংক্ষিপ্যন্তে বর্ণা অস্মিন্নিতি প্রত্যাহারঃ'। সরলার্থ- চোদ্দটি সূত্রস্থ বর্ণগুলি নিয়ে প্রত্যাহারের সাহায্যে সংক্ষেপে একাধিক বর্ণের নির্দেশ করা হয়। [পাণিনীয় শব্দশাস্ত্র। ড.সত্যনারায়ণ চক্রবর্তী। ২০০৩]৩. প্রাচীন লিপিগুলো ছিল বেশ সরল। সেই তুলনায় ভারতবর্ষের লিপিগুলো যথেষ্ঠ জড়ানো প্যাচঁনো। ইউরোপীয় লিপিগুলিতে প্রাচীন লিপিগুলোর সরলতা খুঁজে পাওয়া যায়। ভারতবর্ষের লিপিকাররা প্রাচীন লিপির সারল্য বর্জন করে, অপেক্ষাকৃত জটিল জড়ানো-প্যাচঁনো লিপিকে গ্রহণ করেছিলেন, এ কথা ভাবতে কষ্ট হয়। ভারতবর্ষে '০' এর ধারণা প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল। এর ফলে প্রাচীন লিপিগুলোকে বাদ দিলেও ইউরোপীয় ভাষায় অঙ্কবাচক লিপিগুলো ভারত থেকে পৃথিবীর অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছে।
৪. ভারতীয় লিপিতে কার-চিহ্নের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন লিপিতে এই বিষয়টি একেবারেই ছিল না।
মূলত ব্রাহ্মীলিপি ভারতবর্ষেই সৃষ্টি হয়েছে। তবে এই লিপির ক্রমবিকাশের ইতিহাস যথাযথভাবে উপস্থাপন করা সহজ নয়। কারণ-
১. ভারতবর্ষে রচিত গ্রন্থগুলো লিখা হতো তালাপাতা, কলাপাতার মত সহজে নষ্ট হয়ে যাওয়ার মত মাধ্যমে। পাথরে খোদাইও করে লিখার চর্চা ছিল না বলে, প্রাচীন নমুনা পাওয়া যায় না। এই বিচারে পাথরে লিখা অশোকের বাণী বা এই জাতীয় কিছু শিলালিপি থেকে প্রাচীন ভারতের লিপিগুলো সম্পর্কে যৎসামান্য ধারণা করা যায়।
২. ভারতবর্ষের শিক্ষা পদ্ধতি ছিল গুরুপরম্পরার সূত্রে। প্রাচীন ভারতে গ্রন্থ সংরক্ষণ সহজ না হওয়ার কারণে, শিষ্যরা বিশাল বিশাল গ্রন্থ মুখস্থ করে রাখতেন। কিন্তু লেখার একাবারেই চল ছিল না, এ কথা বিশ্বাস করা যায় না। বিশেষ করে পাণিনি, কাত্যায়নী, পতঞ্জলীর মত ব্যাকরণবিদদের গবেষণামূলক ভাষাবিষয়ক গ্রন্থ অলিখিতভাবে সংগৃহীত এবং সমালোচিত (ভাষ্য ও প্রতিবাদ অর্থে) হয়েছে এটা ভাবা যায় না। পাণিনির স্বহস্তে রচিত ব্যাকরণ পাওয়া যায় নাই সত্য, কিন্তু এর বিভিন্ন অনুলিপি পাওয়া যায়। এবং এই অনুলিপিগুলোর পাঠ (লিপিকারভেদে সামান্য কিছু পার্থক্য ছাড়া) অভিন্ন।
একটি লিপির
উদ্ভব এবং এর বিকাশকে সুনির্দিষ্ট সময়ে নিরিখে বাঁধা যায় না। ধারণা করা হয়,
আনুমানিক
খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর দিকে এই লিপির উদ্ভব হয়েছিল। কালক্রমে এই লিপি
ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। দীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন লিপিকারদের হাতে এই
লিপির বিবর্তন ঘটেছিল। অবশ্যই এই বিবর্তনের ধারাটি অনুমান করা যায় মাত্র। কারণ এর
পর্যাপ্ত প্রামাণ্য দলিল নেই।
ব্রাহ্মীলিপির প্রাচীনতম নমুনা পাওয়া গেছে নেপালের তরাই অঞ্চলের পিপ্রাবা থেকে।
ধারণা করা হয়, এই লিপিটি
গৌতম বুদ্ধ -এর নির্বাণকালের (৪৮৭-৪৮৩
খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) কিছু পরে। এই
লিপির উৎকর্ষরূপ পাওয়া যায় ব্রাহ্মীবর্ণমালায় লিখিত
সম্রাট অশোক -এর
শিলালিপি থেকে। এই
উৎকর্ষতার বিচারে
আমরা যদি অশোকের অনুশাসনে লিখিত লিপির সময় থেকে
মৌর্যবংশের অন্তিমকাল পর্যন্ত লিপির বিকাশকালকে একটি মোটামুটি সময়সীমা হিসাবে
ধরি,
তা হলে
এই লিপির অস্তিত্বকাল হিসাবে ধরা যায়- খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০-১০০ অব্দ।
ব্রাহ্মীলিপির আদিপাঠগুলো সম্রাট অশোকের নির্দেশে স্থাপিত হয়েছিল বলে,
অনেকে এই লিপিকে অশোকলিপি নামে অভিহিত করেছেন। অশোক ছিলেন মৌর্যবংশীয় রাজা।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৭ বা ১৮৫ অব্দে,
মৌর্যবংশীয় শেষ রাজা বৃহদ্রথকে তাঁর সেনাপতি পুষ্যামিত্র শুক্ হত্যা করে মৌর্য
সিংহাসন দখল করেন। মৌর্যবংশীয়
রাজাদের সময়ে প্রচলিত ব্রাহ্মীলিপিকে মৌর্যলিপি বলা হয়। ভাষা বিজ্ঞানীরা
খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীকে মৌর্যলিপির সময় সীমা ধরে থাকেন।
গিনার পর্বেত লিখিত ব্রাহ্মীলিপির নমুনা |
এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত ব্রাহ্মীলিপিতে লিখিত যে সকল নমুনা পাওয়া গেছে, সেগুলো হলো-
১. ব্রাহ্মীলিপির প্রাচীনতম নমুনা পাওয়া গেছে নেপালের তরাই অঞ্চলের পিপ্রাবা থেকে। ধারণা করা হয়, এই লিপিটি গৌতম বুদ্ধ -এর নির্বাণকালের (৪৮৭-৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) কিছু পরে।
২. সম্রাট অশোকের অনুশাসনের প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া গেছে গুজরাটের জুনাগর জেলার গির্নার পর্বতের গায়ে। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে রচিত এই নির্দশনে ব্রাহ্মীলিপির যে নমুনা পাওয়া যায়, তার সাথে খ্রিষ্ট-পূর্ব দ্বিতীয় ও প্রথম শতাব্দীর ব্রাহ্মীলিপিগুলোর পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। তিন শত বৎসরের ভিতরে এই লিপির যে পরিবর্তন ঘটেছিল, তার জন্য অনেকাংশেই দায়ী ছিলেন তৎকালীন লিপিকারেরা।
৩. খ্রিষ্ট-পূর্ব ২য় শতাব্দীতে আবিষ্কৃত রামগঢ়, ঘোসুণ্ডী, বেসনগর, নাগার্জুনীগুম্ফা, নানাঘাট, ভরহুত, সাঁচী হাথীগুম্ফা ও ভট্টীপ্রোলুস্তূপের শিলালিপি।
৪. খ্রিষ্ট-পূর্ব ১ম শতাব্দীতে পভোসা ও মথুরায় প্রাপ্ত লিপি।
নেপালের তরাই অঞ্চলের
পিপ্রাবা থেকে প্রাপ্ত নমুনা থেকে
সম্রাট অশোক -এর
শিলালিপি পর্যন্ত ব্রাহ্মীলিপির জীবিতকাল ধরা যায়। এরপর ক্রমে ক্রমে ভারতবর্ষের
লোকেরা
ব্রাহ্মীলিপি
পড়তে ভুলে যায়। কথিত আছে, দিল্লির সুলতান ফিরিজশাহ তুঘলক অশোকের শিলালিপি পাঠ করার
জন্য, বেশকিছু শিলালিপি দিল্লীতে এনেছিলেন। কিন্তু সুলতানের লিপি গবেষকরা এর
পাঠোদ্ধার করতে পারেন নি।
ভারতবর্ষের
বিভিন্ন প্রান্তে
এই লিপি ছড়িয়ে পড়েছিল এবং বিভিন্ন স্থানের লিপিকারদের হাতে এই লিপি নানা রূপ লাভ
করেছিল। এর নমুনা পাওয়া যায়, শঙ্গফলকে, ক্ষত্রপদলিপিতে এবং
কুষাণলিপিতে।
কুষাণলিপিতে কিছু কিছু বর্ণ আংশিক রূপান্তরিত হলেও, ব্রাহ্মীলিপির মূল কাঠামোর সাথে
এর মিল পাওয়া যায়। কোনো কোনো বর্ণ লিপিকারদের হাতে ব্রাহ্মী ও
কুষাণলিপি প্রায় একই মনে হয়। ক্রমবিবর্তনের ধারায়, এই লিপির শৈলী দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।
মোটাদাগে একে বলা হয়ে থাকে, পশ্চিমা ধারা ও পূর্বীধারা। এই দুটি ধারা থেকেই একালের
ভারতীয় লিপিগুলো উদ্ভব হয়েছিল।
এযাবৎকালের প্রাপ্ত নিদর্শনগুলোর বিচারে যায় ব্রাহ্মীলিপিতে মাত্র ৪৪টি বর্ণের
সন্ধান পাওয়া যায়। এর ভিতরে স্বরবর্ণ পাওয়া গেছে ৯টি। বাংলা বর্ণমালার বিচারে ঋ এবং
ঔ বর্ণের নিদর্শন পাওয়া যায় নাই। তবে ব্যঞ্জনবর্ণের ঔ বর্ণের ব্যবহার লক্ষ্য করা
যায়। তাতে মনে হয় এই বর্ণ দুটির অস্তিত্ব ছিল। ব্যঞ্জন বর্ণের ভিতরে ৩৫ বর্গীয় বর্ণ
পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে ব্রাহ্মীলিপির যে নমুনা পাওয়া যায়,
সেগুলো কয়েকটি ভাগে ভাগ করে নিচের তালিকাগুলোতে দেখানো হলো।
ব্রাহ্মীলিপির স্বরবর্ণের তালিকা | |
|
|
ব্রাহ্মীলিপির ব্যঞ্জনবর্ণের কণ্ঠবর্ণের (ক-বর্গ) তালিকা | |
ব্রাহ্মীলিপির ব্যঞ্জনবর্ণের তালব্যবর্ণের (চ-বর্গ) তালিকা | |
ব্রাহ্মীলিপির ব্যঞ্জনবর্ণের মূর্ধাবর্ণের (ট-বর্গ) তালিকা | |
ব্রাহ্মীলিপির ব্যঞ্জনবর্ণের দন্ত ও দন্তমূলীয় (ত-বর্গ) তালিকা | |
ব্রাহ্মীলিপির ব্যঞ্জনবর্ণের ওষ্ঠাধর বর্ণ (ত-বর্গ) তালিকা | |
ব্রাহ্মীলিপির ব্যঞ্জনবর্ণের অন্তস্থ, কম্পিত ও পার্শ্বিক ধ্বনিগত বর্ণসমূহের তালিকা | |
ব্রাহ্মীলিপির ব্যঞ্জনবর্ণের উষ্ম ও পরাশ্রয়ী বর্ণসমূহের তালিকা |
|
সূত্র :