অজন্তার ছবি |
মায়াদেবীর মন্দির |
লুম্বিনীতে পরে মায়াদেবীর মন্দির
প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই মন্দিরের একটি স্থানকে গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান হিসেবে
চিহ্নিত করা হয়েছ। এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রাচীন মঠ ও মন্দির,একটি
প্রাচীন পবিত্র বোধিবৃক্ষ।
বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়ে সম্রাট
অশোক ২৫০
খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই তীর্থভূমি পরিদর্শনে এসেছিলেন। তিনি এই গ্রামের
প্রজাদের রাজস্ব এক-অষ্টমাংশ হ্রাস করেছিলেন। তিনি অশোকের আগমনের স্মারক
হিসেবে এখানে একটি অশোক স্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছিল।
বুদ্ধের নামকরণ
দীর্ঘদিন পর অনেক সাধনায় এই পুত্র জন্মছিল বলে রাজা এঁর নাম রেখেছিলেন
সিদ্ধার্থ। জন্মের অল্পকাল
পরেই তিনি মাতৃহারা হন। ফলে তিনি লালিতপালিত হন বিমাতা গৌতমীর কাছে। তাই
তাঁর আরেক নাম গৌতম। শাক্যবংশে জন্মেছিলেন বলে এঁর অপর নাম ছিল শাক্যসিংহ।
বুদ্ধের বিবাহ
তিনি
শৈশব থেকেই সংসার বিবাগী ছিলেন এবং অধিকাংশ সময় ঈশ্বরচিন্তায় কাটাতেন। রাজা
পুত্রকে সংসারী করার জন্য, প্রতিবেশী কোলিয় রাজপরিবারের ষোড়শী কন্যা
যশোধরার (ভদ্রা কাপিলায়নী) সাথে তাঁর বিবাহ দেন। ২৯ বছর বয়সে তাঁর একটি
পুত্র সন্তান জন্মে। এই পুত্রের নাম রাখেন রাহুল।
বুদ্ধের ধর্মভাবনার উন্মেষ
এবং গৃহত্যাগ
একদিন তিনি নগর পরিক্রমণে বের হলে রাজপথে ব্যাধিগ্রস্ত বৃদ্ধ এবং এক মৃতদেহ দেখে
খুবই বিচলিত হয়ে পড়েন। আর তখন থেকেই তিনি মানবজীবনের শোক, দুঃখ, জরা, ব্যাধি এবং মৃত্যুর হাত থেকে কিভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায়, সে বিষয়ে ভাবতে শুরু করেন। এই ভাবনা থেকেই ৫৩৪ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে (মতান্তরে ৫৩৮ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে), তিনি ঘুমন্ত স্ত্রী ও পুত্রকে রেখে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে রাতের অন্ধকারে গৃহত্যাগ করলেন। কথিত আছে, তখন রাহুলের বয়স ছিল মাত্র সাত দিন।
মহাবোধি বৃক্ষ |
বুদ্ধের ধর্মশিক্ষা ও বুদ্ধগয়ায় বোধিত্বলাভ
গৃহত্যাগের পর প্রথম
বৈশালী নগরে (বজ্জি (বৃজি গণতন্ত্র)
মহাজনপদের রাজধানী) যান
এবং সেখানে থেকে আরাল কালাম নামক পণ্ডিতের কাছে হিন্দু দর্শনে সম্যক জ্ঞান লাভ
করেন। কিন্তু এই জ্ঞানে পরিতৃপ্ত হতে পারেন নি। তাই এখান থেকে তিনি উদ্দক
রামপুত্তের কাছে শিক্ষাগ্রহণের জন্য আসেন। এই গুরুর কাছে তিনি সাংখ্য এবং যোগবিদ্যা
শেখেন। এই নতুন জ্ঞানও তাঁকে শান্ত করতে পারলো না। এরপর তিনি
মগধের রাজধানী রাজগিরীতে আসেন।
লোকমুখে নতুন সন্ন্যাসীর প্রশংসা শুনে
বিম্বিসার তাঁর সাথে দেখা করেন এবং
রাজপ্রাসাদে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু বুদ্ধ এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে জানান যে,
যদি কখনও সত্যের সন্ধান পান, তাহলে তিনি রাজার আমন্ত্রণ রক্ষা করবেন। এর কিছুদিন
পর,
বিম্বিসার এক যজ্ঞানুষ্ঠানের জন্য ১০০০ মেষ
বলির উদ্যোগ নেন। এই কথা জানতে পেরে বুদ্ধ রাজার সাথে দেখা করেন এবং মেষ বলি থেকে
বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করেন।
বিম্বিসার এই অনুরোধে বলি বন্ধ করে দেন। এরপর
বুদ্ধ
উরুবিল্ব গ্রামের নিকটবর্তী এক উপবনে এসে তপস্যা শুরু করেন। এখানে তিনি কঠোর তপস্যা শুরু করেন। সে সময়
পাঁচজন সন্ন্যাসীও তাঁর সাথে ধ্যান শুরু করেন। বুদ্ধের কঠোর তপস্যা দেখে এই পাঁচ
সন্ন্যাসী তাঁর ভক্ত হয়ে পড়েন। এরপর তিনি ভারতের বর্তমান বিহার প্রদেশের গয়া জেলার একটি
গভীর অরণ্যের ভিতর,
নিরাঞ্জনা নদীর তীরস্থ
একটি অশ্বত্থ গাছের
নিচে কঠোর তপস্যা শুরু করেন। এই সময় অনাহারে অনিদ্রায় তাঁর শরীরের
মেদ-মাংস ক্ষয়ে কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছিলেন। এই সময় তাঁর শারীরীক অক্ষমতার কারণে
ধ্যানে মনোনিবেশ করতে পারছিলেন না। তাই তিনি অল্প কিছু আহার করতে থাকেন। এই সময়
সুজাতা নামক এক গৃহবধু প্রথম পুত্র সন্তান লাভের পর বনদেবতার পূজা দিতে আসতেন। তিনি
সেখানে বুদ্ধকে দেবতা ভেবে পূজা দিতে গেলে, বুদ্ধ তাঁর ভুল ভেঙে দিয়ে বলেন যে, তিনি
দেবতা নন। তিনি সুজাতার নিবেদিত পায়েস গ্রহণ করে বলেন যে, তোমার মনস্কাম যেমন পূর্ণ
হয়েছে, এই পায়েস গ্রহণের পর আমার মনস্কামও যেন পূর্ণ হয়। বুদ্ধের এই খাদ্যগ্রহণ
দেখে, বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে, তাঁর সাথের সন্ন্যাসীরা তাঁকে ত্যাগ করেন। এরপর তিনি একাই
ধ্যান করতে থাকেন। প্রায় ৪৯ দিন ধ্যান করার পর, তিনি বৈশাখী পূর্ণিমায় গৌতম
বুদ্ধত্ব লাভ করেন।
এই সময় তাঁর বয়স ছিল ৩৫ বৎসর। বোধিপ্রাপ্ত
হয়ে তাঁর নাম হল তাঁর বুদ্ধ। কথিত আছে তিনি এই রাতের প্রথম যামে পূর্বজন্মের
জ্ঞান লাভ হয়, দ্বিতীয় যামে তাঁর দিব্যচক্ষু বিশুদ্ধ হয়, অন্তিম যামে দ্বাদশ
প্রতীত্যসমুৎপাদ এবং অরুণোদয়ে সর্বজ্ঞাতা প্রত্যক্ষ করেন। বর্তমানে নিরঞ্জনা নদীকে
স্থানীয়ভাবে বলা হয় ফল্গু। আর উরুবিল্ব গ্রামের নাম
বুদ্ধগয়া
এবং তিনি যে গাছের নিচে
বসে বোধিত্ব লাভ করেছিলেন, সেই অশ্বত্থগাছের নামকরণ করা
হয়েছে বোধিবৃক্ষ। বোধিবৃক্ষ এবং
মন্দির ছাড়া এখানে একটি দীঘির নাম সুজাতা দিঘি। কথিত আছে। এই দিঘির জলে স্নান করে
বুদ্ধদেবকে পায়েস নিবেদন করেছিলেন।
চৌখণ্ডী স্তূপ |
সারনাথ গমন
বোধিলাভের পর তিনি
উরুবিল্ব তথা
বুদ্ধগয়া'য়
ছয় বছর ছিলেন।
এরপর তাঁর গুরু আরাল কালাম,
উদ্দক রামপুত্ত এবং তাঁকে ছেড়ে যাওয়া পাঁচজন শিষ্যকে জ্ঞান দানের উদ্যোগ নেন।
কিন্তু ইতিমধ্যে আরাল কালাম এবং উদ্দক রামপুত্ত দেহত্যাগ করেছিলেন।
তাই পাঁচ শিষ্যকে জ্ঞান দানের জন্য,
বোধিবৃক্ষ ত্যাগ করে
বারাণসীর অদূরবর্তী সারনাথ
নামক স্থানে আসেন।
যে স্থানে প্রথম এই পাঁচজন শিষ্যের সাথে বুদ্ধের প্রথম দেখা হয়, সে স্থানটি
বর্তমানে বর্তমানে 'চৌখণ্ডী স্তূপ' পরিচিত। পরবর্তী সময়ে এই স্থানে সম্রাট
অশোক এই
স্তূপটি নির্মাণ করেছিলেন।
গৌতম বুদ্ধ
আষাঢ় মাসের পূর্ণিমার দিন এই
পাঁচ সন্ন্যাসীকে দীক্ষা দেন। এই ঘটনাকে বলা হয় 'ধর্মচক্র প্রবর্তন'। এই কারণে
সারনাথ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র তীর্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই পাঁচ
সন্ন্যাসীর দীক্ষাস্থানটিতে নির্মিত হয়েছিল ধামেখ স্তূপ।
এই
স্তূপটিও সম্রাট
অশোক
নির্মাণ করেছিলেন। এর সংস্কৃত
নাম 'ধর্মচক্র স্তূপ'। পালিভাষায় এরা নাম ধম্মখ বা বর্তমানকালে ধামেখ স্তূপ নামে
পরিচিত।
বুদ্ধ সারনাথের মৃগদাব ইসিপত্তনে 'ধর্মচক্র প্রবর্তন'-
করেন এবং সেখানে বর্ষাযাপন করেন। এই সময় তিনি ৬০ জন শিষ্য তৈরি করতে সক্ষম
হন।
এরপর তিনি স্থানীয় সাধারণ গৃহীদের ভিতর ধর্ম প্রচার করা শুরু করেন। এই সময় তিনি একটি সংঘ
প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই সঙ্ঘের জন্য যে আইন তৈরি করা হয়েছিল, তাকে বলা হয় উপসম্পদা।
শুরুর দিকে তিনি শুধু পুরুষদের দীক্ষা দিতেন। পরে তাঁর প্রিয় শিষ্য আনন্দের অনুরোধে
নারীদের দীক্ষা দেওয়া শুরু করেন। কথিত আছে প্রথম ভিক্ষুণী হয়েছিলেন, তাঁর গৌতমের
বিমাতা গৌতমী।
রাজগিরীতে বুদ্ধ
এরপর
সারনাথ
থেকে ধর্ম প্রচার করতে করতে
মগধ রাজ্যের
রাজধানী রাজগিরীর সন্নিকটে
আবার উরুবিল্বে আসেন। সেখানে কাশ্যপ তাঁর শিষ্যদের নিয়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। এর
কিছুদিন পর নদীকাশ্যপ এবং গয়াকাশ্যপ নমক দুই জন হিন্দু ধর্মগুরু বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ
করেন। এরপর
বুদ্ধ
নবদীক্ষিত শিষ্যদের নিয়ে প্রতিশ্রুতি
রক্ষার্থে
মগধ রাজ্যের রাজধানী
রাজগিরীতে আসেন। রাজা
বিম্বিসার
বুদ্ধকে ধর্মগুরু
হিসেবে মান্য করে প্রাসাদে নিয়ে যান।
বুদ্ধ তাঁকে চতুরার্য সত্য সম্বন্ধে উপদেশ প্রদান করেন।
এরপর বৌদ্ধ সংঘের সহস্রাধিক
ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য বেণুবন নামক তার প্রমোদ উদ্যানটি গৌতম বুদ্ধকে প্রদান করেন। পরে
রাজা সেখানে একটি বিহার নির্মাণ করেন। এই বিহারটি 'বেণুবন বিহার' নামে পরিচিতি
পেয়েছিল।
বিম্বিসারের অনুরোধে বুদ্ধ অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে উপোবাস ব্রত পালনের বিধি
প্রচলন করেন। কথিত আছে, বিম্বিসারের অনুরোধেই
বুদ্ধ বর্ষাকালে পরিব্রাজন না করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে
অবস্থান করে সাধনার 'বর্ষাবাস' নামক রীতি প্রচলন করেন। ভিক্ষুদের বর্ষাবাসের সুবিধার
জন্য কুটীর নির্মাণ এবং বুদ্ধ ও ভিক্ষুদের চিকিৎসার জন্য রাজবৈদ্য জীবককে নিযুক্ত
করেন।
বিম্বিসারের তৃতীয়া পত্নী
ক্ষেমা পরবর্তীকালে ভিক্ষুণী সংঘে যোগদান করে অর্হত্ত্ব লাভ করেন।
বুদ্ধ বেণুবনে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষ উদ্যাপন করেন।
শেষ বছরে সারিপুত্র ও মৌদ্গল্যায়ন বুদ্ধের শিষ্য হন। এই সময়
রাজবৈদ্য জীবক তাঁর আম্রকাননে বুদ্ধ সংঘের জন্য একটি বিহার নির্মাণ করে দেন।
বর্তমানে এই বিহারটি 'জীবকাম্রবন' বামে পরিচিত। সূত্র: পৃথিবীর ইতিহাস (সপ্তম
খণ্ড)। দুর্গাদাস লাহিড়ী। বৌদ্ধসভ্যতা
ও বৌদ্ধকীর্তি দেশে দেশে। জ্যোতিবিকাশ বড়ুয়া
এরপর
তিনি তাঁর পিতার অনুরোধে কপিলাবাস্তুতে আসেন। এখানে এসে তিনি তাঁর পিতার শত
অনুরোধেও প্রথমে গৃহে প্রবেশ করতে রাজী হলেন না। রাজবাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার
সময় তাঁর স্ত্রী গোপা পুত্র রাহুলকে ডেকে বললেন -ওই তোমার পিতা মতাকে ডেকে আন। রাহুল
নিজের পরিচয় দিয়ে ঘরে যেতে বললেন। গৌতম সে আহ্বান অগ্রাহ্য করলেন। এরপর সকলের কাতর
অনুরোধে ইনি বাড়িতে প্রবেশ করলেন কিন্তু কোথাও দাঁড়ালেন না। রাজবাড়ি থেকে
শেষবারের মতো বের হওয়ার সময় তাঁর স্ত্রী বুদ্ধের সামনে তাঁর দীর্ঘ চুল বিছিয়ে
অপেক্ষা করলেন। গৌতম বিন্দু মাত্র বিচলিত না হয়ে সে চুল মাড়িয়ে রাজবাড়ী থেকে
বেরিয়ে এলেন। এই সময় ইনি তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই নন্দ এবং সাত বৎসরের পুত্র
রাহুলকে দীক্ষিত করে রাজধানী ত্যাগ করলেন।
এরপর ইনি ১৩ বৎসর ধরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর ধর্মমত প্রচার করে বেড়ালেন। পিতার
অসুস্থাতার কথা শুনে ইনি কপিলাবস্তুতে আসেন এবং পিতার মৃত্যুকালে উপস্থিত হলেন।
পিতার মৃত্যুর পর ইনি পুরনারীদের ভিক্ষু বানালেন। এই ভিক্ষুদলের নেত্রী বানালেন
তাঁর স্ত্রী গোপাকে। এরপর ইনি তাঁর ধর্মমত প্রচারের জন্য আবার পথে বেড়িয়ে পড়েন। ৮০
বছর বয়সে নেপালের কুশী নগরে ইনি দেহত্যাগ করেন। কথিত আছে তাঁর জন্ম
বোধিত্ব লাভ ও মৃত্যু-
একই তারিখ ও সময়ে হয়েছিল।