বিম্বিসার
বিম্বিসারকে বলা হয় মগধের হর্যঙ্ক বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা। এর পিতার নাম ছিল ভট্টিয় বা মহাপদ্ম। বৌদ্ধগ্রন্থ মহাবংশ থেকে জানা যায়, বিম্বিসার ১৫ বৎসর বয়সে রাজপদে অভিসিক্ত হন। সিংহলী ঐতিহ্য অনুসারে জানা যায়
বিম্বিসারের রাজত্বের সূচনা হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪৫ অব্দে। এই বিচারে বলা হয়, তিনি খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪০ (মতান্তরে ৫৫৮) অব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

বিম্বিসারের পিতা মহাপদ্মের সাথে অঙ্গরাজের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে মহাপদ্ম পরাজিত হলে, মগধ অঙ্গরাজ্যের অধিনস্থ হয়। এই কারণে বিম্বিসার ক্ষমতা লাভের পর থেকেই এর প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্যোগ নেন। তিনি রাজ্যকে প্রথমে স্থিতিশীল অবস্থায় এনে সেনাবহিনীকে শক্তিশালী করেন। অবশেষে তিনি একটি বিশাল সেনবাহিনী তৈরি করতে সক্ষম হন। এরপর তিনি অঙ্গরাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এই সময় অঙ্গরাজ্যের রাজা ছিলেন উদয়ন। এই যুদ্ধে উদয়নকে পরাজিত করে বিম্বিসার অঙ্গরাজ্য জয় করেন।

এরপর তিনি কোশল রাজকন্যাকে বিবাহ করে কাশীরাজ্যের একটি অংশ যৌতুক পান। এর ফলে মগধরাজ্যের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হয়। এরপর তিনি বৈশালী রাজবংশের লিচ্ছবি রাজকন্যাকে বিবাহ করেন। এরফলে বিম্বিসার হিমালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হন। এই দুটি বিবাহের ফলে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো মগধ আক্রমণ থেকে বিরত থাকে। এরপর বিম্বিসার রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে গান্ধাররাজ্যের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন। এরপর তিনি অবন্তী-রাজ প্রদ্যোৎ-এর সাথে মিত্রতা স্থাপন করেন। এর ফলে বিম্বিসার যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়াই একটি বিশাল অঞ্চলের উপর আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বিম্বিসার বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। ফলে তিনি ঠিক কোন ধর্মের অনুসারী ছিলেন, এ নিয়ে মতভেদ আছে। জৈন ও বৌদ্ধ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, গৌতম বুদ্ধ এবং মহাবীর-এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল।

গৌতম বুদ্ধ
গৃহত্যাগের পর প্রথম বৈশালী নগরে (বজ্জি (বৃজি গণতন্ত্র) মহাজনপদের রাজধানী) যান এবং সেখানে থেকে আরাল কালাম নামক পণ্ডিতের কাছে হিন্দু দর্শনে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। কিন্তু এই জ্ঞানে পরিতৃপ্ত হতে পারেন নি। তাই এখান থেকে তিনি উদ্দক রামপুত্তের কাছে শিক্ষাগ্রহণের জন্য আসেন। এই গুরুর কাছে তিনি সাংখ্য এবং যোগবিদ্যা শেখেন। এই নতুন জ্ঞানও তাঁকে শান্ত করতে পারলো না। এরপর তিনি মগধের রাজধানী রাজগিরীতে আসেন। লোকমুখে নতুন সন্ন্যাসীর প্রশংসা শুনে বিম্বিসার তাঁর সাথে দেখা করেন এবং রাজপ্রাসাদে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু বুদ্ধ এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে জানান যে, যদি কখনও সত্যের সন্ধান পান, তাহলে তিনি রাজার আমন্ত্রণ রক্ষা করবেন। এর কিছুদিন পর, বিম্বিসার এক যজ্ঞানুষ্ঠানের জন্য ১০০০ মেষ বলির উদ্যোগ নেন। এই কথা জানতে পেরে বুদ্ধ রাজার সাথে দেখা করেন এবং মেষ বলি থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করেন। বিম্বিসার এই অনুরোধে বলি বন্ধ করে দেন। এরপর বুদ্ধ উরুবিল্ব গ্রামের নিকটবর্তী এক উপবনে এসে তপস্যা শুরু করেন। বোধিত্বলাভের পর বুদ্ধ, বুদ্ধগয়া'য় ছয় বছর কাটান। এরপর সারনাথ প্রায় দুই বছর পর, কাটিয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে তিনি মগধ রাজ্যের রাজধানী রাজগিরীতে আসেন। রাজা বিম্বিসার বৌদ্ধ সংঘের সহস্রাধিক ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য বেণুবন নামক উদ্যানটি গৌতম বুদ্ধকে প্রদান করেন। এরপর বুদ্ধ তাঁকে চতুরার্য সত্য সম্বন্ধে উপদেশ প্রদান করেন। বিম্বিসারের অনুরোধে বুদ্ধ অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে উপোবাস ব্রত পালনের বিধি প্রচলন করেন। কথিত আছে, বিম্বিসারের অনুরোধেই বুদ্ধ বর্ষাকালে পরিব্রাজন না করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে সাধনার বর্ষাবাস নামক রীতি প্রচলন করেন। ভিক্ষুদের বর্ষাবাসের সুবিধার জন্য কুটীর নির্মাণ এবং বুদ্ধ ও ভিক্ষুদের চিকিৎসার জন্য রাজবৈদ্য জীবককে নিযুক্ত করেন। বিম্বিসারের তৃতীয়া পত্নী ক্ষেমা পরবর্তীকালে ভিক্ষুণী সংঘে যোগদান করে অর্হত্ত্ব লাভ করেন।

বিম্বিসারের মৃত্যু
দেবদত্তের প্ররোচনায় বিম্বিসারের পুত্র অজাতশত্রু তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেন। বুদ্ধের মতাদর্শে বিশ্বাসী বিম্বিসার তাঁর পুত্রকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু পুনরায় দেবদত্তের প্ররোচনায় অজাতশত্রু বিম্বিসার ও তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলীকে গৃহবন্দী করে নিজেকে মগধের শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। ৪৯১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গৃহবন্দী অবস্থায় বিম্বিসারের মৃত্যু ঘটে।


বিম্বিসারের স্ত্রী কোশলদেবীর গর্ভে তাঁর পুত্র অজাতশত্রুর জন্ম হয়। কথিত আছে অজাতশত্রু তাঁর পিতা বিম্বিসারকে উপবাস করিয়ে হত্যা করেন। এই শোকে কোশলদেবী মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ধারণা করা হয় বিম্বিসার খ্রিষ্টপূর্ব ৪৯০-৪৯৩ অব্দের দিকে মৃত্যুবরণ করেন।


সূত্র :
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।
http://en.wikipedia.org/wiki/Bimbisara