বুদ্ধগয়া
ভারতের বিহার রাজ্যের গয়া জেলার অন্তর্গত একটি শহর ও বৌদ্ধ তীর্থক্ষেত্র বিশেষ। ভৌগোলিক অবস্থান ২৪.৬৯৫১০২° উত্তর ৮৪.৯৯১২৭৫° পূর্ব। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের জনগণনা অনুসারে বুদ্ধগয়া শহরের জনসংখ্যা ছিল ৪৫,৩৪৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৫৪%, এবং নারী ৪৬%।  এখানে সাক্ষরতার হার ছিল ৫১%। এর ভিতরে পুরুষদের সাক্ষরতার হার ছিল ৬৩% এবং নারীদের ভিতরে ছিল ৩৮%।

গৌতম বুদ্ধের আমলে বুদ্ধগয়া ছিল একটি জঙ্গলবেষ্টিত গ্রাম। তখন এর নাম ছিল উরুবিল্ব।
৫৩৪ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে (মতান্তরে ৫৩৮ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে), ঘুমন্ত স্ত্রী ও পুত্র রাহুলকে ত্যাগ করে গৌতম বুদ্ধ রাজপ্রাসাদ ছেড়ে রাতের অন্ধকারে গৃহত্যাগ করেছিলেন। তিনি প্রথম বৈশালী নগরে যান এবং সেখানে থেকে আরাল কালাম নামক পণ্ডিতের কাছে হিন্দু দর্শন-বিষয়ক সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। কিন্তু এই জ্ঞানে তিনি পরিতৃপ্ত হতে পারেন নি। তাই এখান থেকে তিনি উদ্দক রামপুত্তের কাছে শিক্ষাগ্রহণের জন্য আসেন। এই গুরুর কাছে তিনি সাংখ্য এবং যোগবিদ্যা শেখেন। এই নতুন জ্ঞানও তাঁকে শান্ত করতে পারলো না। সেখান থেকে তিনি চলে আসেন উরুবিল্ব গ্রামের নিকটবর্তী এক উপবনে। এখানে তিনি কঠোর তপস্যা শুরু করেন। সে সময় পাঁচজন সন্ন্যাসীও তাঁর সাথে ধ্যান শুরু করেন। বুদ্ধের কঠোর তপস্যা দেখে এই পাঁচ সন্ন্যাসী তাঁর ভক্ত হয়ে পড়েন।

এরপর তিনি ভারতের বর্তমান বিহার প্রদেশের গয়া জেলার
একটি গভীর অরণ্যের ভিতর, নিরাঞ্জনা নদীর তীরস্থ একটি অশ্বত্থ গাছের নিচে কঠোর তপস্যা শুরু করেন। এই সময় অনাহারে, অনিদ্রায় তাঁর শরীরের মেদ-মাংস ক্ষয় হয়ে কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছিল। তাঁর শারীরীক দুর্বলতার কারণে ধ্যানে মনোনিবেশ করতে পারছিলেন না। তাই তিনি অল্প কিছু আহার করতে থাকেন। বুদ্ধের এই খাদ্যগ্রহণ দেখে, বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে, সাথের সন্ন্যাসীরা তাঁকে ত্যাগ করেন। এরপর তিনি একাই ধ্যান করতে থাকেন। প্রায় ৪৯ দিন ধ্যান করার পর, তিনি বৈশাখী পূর্ণিমায় গৌতম বুদ্ধত্ব লাভ করেন।
এই সময় তাঁর বয়স ছিল ৩৫ বৎসর। বোধিপ্রাপ্ত হয়ে তাঁর নাম হল তাঁর বুদ্ধ।  কথিত আছে তিনি এই রাতের প্রথম যামে পূর্বজন্মের জ্ঞান লাভ করেন, দ্বিতীয় যামে তাঁর দিব্যচক্ষু বিশুদ্ধ হয়, অন্তিম যামে দ্বাদশ প্রতীত্যসমুৎপাদ এবং অরুণোদয়ে সর্বজ্ঞাতা প্রত্যক্ষ করেন।

উল্লেখ্য, বর্তমানে নিরঞ্জনা নদীকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় ফল্গু। আর উরুবিল্ব গ্রামের নাম
বুদ্ধগয়া এবং তিনি যে গাছের নিচে বসে বোধিত্ব লাভ করেছিলেন, সেই অশ্বত্থগাছের নামকরণ করা হয়েছে বোধিবৃক্ষ। এই বোধিবৃক্ষকে চীনা পরিব্রাজকরা 'মহাবোধি' নামকরণ করেছিলেন। বোধিবৃক্ষের সামনে যে স্থানে বুদ্ধ ধ্যানে বসেছিলেন, বৌদ্ধরা তার নাম দিয়েছেন 'বোধিপঙ্ক' বা 'বজ্রাসন'। গুপ্তযুগে সাত ফুট ছয় ইঞ্চি দীর্ঘ, চারফুট দশ ইঞ্চি প্রস্থ এবং তিন ফুট উঁচু লাল বেলে পাথরের একটি অখণ্ড বেদি স্থাপন করা হয়েছিল। সে সময়ে এই বেদীটির নাম 'বজ্রাসন' দেওয়া হয়েছিল। গৌতম বুদ্ধের প্রচারিত ধরম ব্যাপকভাবে সমাদৃত এবং প্রচারিত হওয়ার পর, বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা এই বৃক্ষকে ঘিরে প্রাচীর তৈরি করেছিলেন।

বোধিলাভের পর তিনি উরুবিল্ব তথা বুদ্ধগয়া'য় ছয় বছর ছিলেন। এরপর তাঁর গুরু আরাল কালাম, উদ্দক রামপুত্ত  এবং তাঁকে ছেড়ে যাওয়া পাঁচজন শিষ্যকে জ্ঞান দানের উদ্যোগ নেন। কিন্তু ইতিমধ্যে আরাল কালাম এবং উদ্দক রামপুত্ত দেহত্যাগ করেছিলেন। তাই পাঁচ শিষ্যকে জ্ঞান দানের জন্য, বোধিবৃক্ষ ত্যাগ করে বারাণসীর অদূরবর্তী সারনাথ নামক স্থানে আসেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলে চীনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন ভারতে এসেছিলেন। ৪০০-৪১১ (মতান্তরে ৪০৫-৪১১) খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ভারতে ছিলেন। ৪০২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বুদ্ধগয়া ভ্রমণ করেন। এই সময় বুদ্ধগয়া পরিত্যাক্ত নগর ছিল। আর বুদ্ধের তপস্যার জায়গা ছিল জঙ্গলাকীর্ণ।

সম্রাট অশোক ২৭৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে দিকে সিংহাসন লাভ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সম্রাট হিসেবে অভিষেক হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২৬৯ অব্দের দিকে। এই সময় তিনি বৌদ্ধধর্মের বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার ছিলেন। এই সময় তিনি প্রথমে বোধিবৃক্ষটিকে কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পরে গাছটি দেখে অভিভূত হয়ে তিনি এই আদেশ ফিরিয়ে নেন। সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার পর বৃক্ষটি রক্ষার জন্য এর চারদিকে একটি প্রাচীর তৈরি দিয়েছিলেন। এছাড়া সন্ন্যাসী উপগুপ্তের তত্ত্বাবধানে এখানে একটি নতুন প্রাচীর এবং মন্দির নির্মাণ করেন। সম্রাট অশোক তাঁর রাজত্বকালেই বোধিবৃক্ষের একটি শাখা কেটে তাঁর প্রিয় কন্যা ভিক্ষুণী সঙ্ঘমিত্রাকে দিয়ে পাঠিয়েছিলেন সিংহলে। সে সময়ে সিংহলের প্রাচীন রাজধানী অনুরাধাপুরে রোপিত হয়েছিল বোধিবৃক্ষের শাখা।

কথিত আছে এরপর বঙ্গের শৈব ধর্মাবলম্বী রাজা শশাঙ্ক বৌদ্ধধর্মের প্রতিপত্তি নাশের জন্য বোধিবৃক্ষটি কেটে ফেলেছিলেন। উল্লেখ্য,
শশাঙ্কের ৬১৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছিলেন। কিন্তু চীনা চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ-এর বিবরণ থেকে তেমনটি মনে হয় না। উল্লেখ্য, চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে, চীন থেকে যাত্রা শুরু করে ভারত সীমানায় পদার্পণ করেন ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে। তারপর অধ্যয়ন ও ভ্রমণ করতে করতে ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে (রাজা শশাঙ্কের রাজত্বের অন্তিম সময়) আসেন মগধে ও নালন্দা বিহারে। সম্ভবত ওই সময়েই তিনি এসেছিলেন বুদ্ধগয়ায়। রাজা শশাঙ্ক বৌদ্ধধর্মের প্রতি বিদ্বেষ থাকলেও, বৌদ্ধবিহারে ক্ষতগ্রস্থ বা বৌদ্ধদের উপর অত্যাচার করেছিলেন তেমনটা জানা যায় না।

হিউয়েন সাঙ-এর ভ্রমণ গ্রন্থ থেকে জানা যায় সে সময় বোধিবৃক্ষের অনেকাংশ কেটে ফেলা হয়েছিল। তারপরেও সে সময় গাছটির উচ্চতা ছিল ৪০ থেকে ৫০ ফুট। এই গাছের বাকল ছিল হলদেটে-সাদা এবং ছিল পাতা গাঢ় সবুজ রঙের।  সে সময়ে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা বোধিবৃক্ষের পাদদেশ সুগন্ধি জল ও সুরভিত দুধ দিয়ে ধুইয়ে দিতো। এছাড়া এই বৃক্ষের নিচে এসে সমবেতভাবে সবাই স্তবগান করে ফুল ছড়ায়, সুগন্ধি ধূপধূনা জ্বালাতো। রাত্রিবেলা মশাল জ্বালিয়ে স্থানটি আলোকিত করা হতো। বুদ্ধ যেখানে পায়চারি করতেন সেখান থেকে উত্তর রাস্তার বাঁদিকে একটি বড় পাথরের উপর একটি বুদ্ধের মূর্তি ছিল।

তবে রাজা শশাঙ্কের রাজত্বকালে বুদ্ধগয়ার বোধিমন্দির অবহেলার শিকারে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল। পরে রাজা পূর্ণবর্মা মন্দির সংস্কার করেন। এই সময় নতুন বোধিবৃক্ষ রোপণ করে এর বাইরে ২৪ ফুট উঁচু প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল। এরপর খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে জনৈক তীর্থযাত্রী এই মন্দিরের সংস্কার করেন। এ বিষয়ে জানা যায় মন্দিরের রেলিং-এ লিখিত লিপি থেকে। এরপর খ্রিষ্টীয় নবম ও দশম শতাব্দীতে পাল বংশীয় রাজারা এই মন্দিরের সংস্কার করেন। একাদশ শতাব্দীতে বার্মার পাগান রাজা কিয়ানজিট্ট, বুদ্ধগয়ার সংস্কার করেন। এরপর এর সংস্কার করেছিলেন আরাকান রাজারা।

১১৯৯ খ্রিষ্টাব্দে বখতিয়ার খলজি বিহারের ওদন্ত বৌদ্ধবিহার আক্রমণ করেন। এখানে তাঁর সৈন্যরা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা করে। এই সময় বখতিয়ার খলজি মগধ জুড়ে ব্যাপক বৌদ্ধবিহারগুলোতে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এই আক্রমণে বুদ্ধগয়াও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই আক্রমণের পর বুদ্ধগয়া পরিত্যাক্ত এলাকায় পরিণত হয়। চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম দিক পাঠান শাসকদের অনুমতি নিয়ে বার্মার রাজা মন্দির সংস্কার করেন। তারপরেও পনের শতাব্দী বুদ্ধগয়া সম্পূর্ণ পরিত্যাক্ত নগরীতে পরিণত হয়।

সপ্তদশ শতাব্দীতে শঙ্করাচার্যের অনুসারী ধমন্দিনাথ তাঁর শিষ্যদের নিয়ে বুদ্ধগয়ার মন্দির এলাকায় বসবাস শুরু করেন। তিনি মহাবোধির প্রাচীর, ইট দিয়ে একটি শিব মন্দির নির্মাণ করেন। এরপর তাঁর শিষ্যরা মূল মন্দিরের সামনে পঞ্চপাণ্ডব মন্দির তৈরি করেন। এরপর গোপাল গিরি নামক মহান্ত মোগল সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে এই এলাকার মস্তিপুর ও তরাদীর অধিকার লাভ করেন। তিনি মহাবোধি মন্দিরকে হিন্দু মন্দিরে পরিণত করেন। এই সময় ৩৩টি রেলিং মহান্তের প্রাসাদে এবং ৯টি রেলিং পঞ্চপাণ্ডবের মন্দিরে ব্যবহার করেছিলেন। বাকি স্তম্ভগুলো মাটির নিচে পুঁতে ফেলা হয়েছিল। তিনি  মন্দিরের ভিতরে শিবলিঙ্গ স্থাপন করেন। এর পাশাপাশি বৌদ্ধমূর্তিগুলিকে লাল কাপড়ে জড়িয়ে চুন ও মাটির প্রলেপ লাগিয়ে ব্রাহ্মণ্যমূরিততে পরিণত করেন। কালক্রমে মন্দিরের সম্পত্তি দিয়ে তিনি ওই অঞ্চলের ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়ে যান।

১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ আমলে ফ্রান্সিস বুকানন বুদ্ধগয়া পরিদর্শন করেন। তিনি বুদ্ধগয়ার ধ্বংসবশেষ সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে এই অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক জরীপ চালানো হয়। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে আলেকজান্ডার ক্যানিংহাম পর্যায়ক্রমে এই জরীপ শেষ করেন। ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বার্মার রাজা মিনডন তৎকালীন ভারত সরকারে কাছে বুদ্ধগয়ার সংস্কারের জন্য প্রতিনিধি দল পাঠান। কিন্তু এই দলের অনভিজ্ঞ কর্মীরা এই অঞ্চলে সংস্কার করতে গিয়ে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক উপকরণের ক্ষতি করেন। পরে ইঙ্গ-বার্মিজ সম্পর্কের অবনতি হলে বর্মী কর্মিরা ভারত ত্যাগ করেন। এরপর ভারত সরকার এই অঞ্চলের সংস্কার শুরু করে। এই সময় বুদ্ধগয়ার মালিক ছিলেন মোহান্ত। এই মোহান্তের কবল থেকে বুদ্ধগয়াকে উদ্ধার করার জন্য
শ্রীলঙ্কার অনাগরিক ধর্মপাল উদ্যোগ নেন।

১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রবল ঝড়ে বোধিবৃক্ষ উপড়ে গিয়েছিল। তখন এর একটি পুরানো শাখা মূল বৃক্ষের স্থানে এবং মহাবোধি মন্দিরের ৮০ ফুট উত্তরে রোপণ করা হয়েছিল।  ধর্মপাল ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে জানুয়ারি বুদ্ধগয়ায় আসেন।  এই অঞ্চল পরিদর্শনের পর তিনি
শ্রীলঙ্কায় ফিরে যান এবং ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে মে সেখানে 'বুদ্ধগয়া মহাবোধি সোসাইটি' গঠন করেন । এই বছরের ৩১শে অক্টোবর বুদ্ধগয়ায় শ্রীলঙ্কা, চীন, জাপান, বার্মা (মিয়ানমার) এবং চট্টগ্রামের [বাংলাদেশ] প্রতিনিধিদের নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেন। এই সময় জাপান মোহান্তের কাছ থেকে বুদ্ধগয়া ক্রয়ের জন্য অর্থ প্রদান করার কথা জানান। কিন্তু নানা ধরনের আইনি জটিলতায় এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়ে উঠতে বিলম্ব হয়। এছাড়া এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার আগেই দ্বিতীয় জাপান ও ব্রিটিশ সরকার পরস্পরের শত্রু হয়ে যাওয়ায়, জাপানি টাকায় বুদ্ধগয়া বিক্রয়ে ব্রিটিশ সরকার বাধা দেয়।

১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা জানুয়ারি অনাগরিক ধর্মপাল বুদ্ধগয়ায় এসে দেখেন মোহান্তের অনুচররা বার্মার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উপর অত্যাচার করেছে। ধর্মপাল রাষ্ট্রপক্ষের কাছে এর প্রতিকার চেয়ে সুবিচার পান নি। এই বছরে তিনি চিকাগোর ধর্ম-সম্মেলনে যোগদান করেন। সেখান থেকে ফিরে তিনি বিভিন্ন দেশে ঘুরে বুদ্ধগয়া উদ্ধারের জন্য অর্থ সংগ্রহ এবং জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকেন। এই সময় জাপানের কোজেন নামক এক ব্যক্তি ৭০০ বছরের পুরানো বুদ্ধমূর্তি তাঁকে উপহার হিসেবে দেন। ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে ফেব্রুয়ারি ধর্মপাল এই মূর্তিটি মহাবোধি মন্দিরে স্থাপন করেন। এই মূর্তির পূজার সময় মোহান্তের সাঙ্গপাঙ্গরা পূজা ভণ্ডুল করে দেয় এবং মূর্তিটি পঞ্চপাণ্ডব মন্দিরের বারান্দায় ফেলে রাখে। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় 'বুদ্ধগয়া টেম্পল কেস'। ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে ৮ই এপ্রিল এই মামলা শুরু হয়। দীর্ঘদিন মামলা চলার পর, মহান্তের তিনজন অনুচরের এক মাসের জেল ও ১০০ টাকা জরিমানা হয়। কিন্তু এই রায়ের আপিল করলে উচ্চ আদালত ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে মোহান্তের অনুকুলে রায় প্রদান করে।

ইতিমধ্যে ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড ক্যানিংহাম
শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করেন এবং সেখানে বুদ্ধগয়া নিয়ে তিনি বিব্রতকর প্রশ্নের মুখোমুখী হন। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারতে এলে, তিনি বাংলার গভর্নরকে বুদ্ধগয়া বৌদ্ধদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেন। সে সময় মোহান্ত চাপের মুখে একট খসড়া চুক্তি করেন। অবশ্য তিনি পরে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে বিহার প্রাদেশিক কংগ্রসে বুদ্ধগয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় এবং এ বিষয়ে একটি কমিটিও গঠিত হয়। কিন্তু বুদ্ধগয়া মোহান্তের হাতেই থেকে যায়। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ধর্মপাল মৃত্যুবরণ করলে, বিষয়টি আবার চাপা পড়ে যায়। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মার্চ রাজেন্দ্রপ্রসাদ বুদ্ধগয়া সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন জাতীয় কংগ্রেসে উত্থাপন করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বুদ্ধগয়া তখনও বৌদ্ধদের অধিকারে আসে নি।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর, ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে 'বুদ্ধগয়া টেম্পল এ্যাক্ট' পাস হয়। এই আইন্ দ্বারা বৌদ্ধরা বুদ্ধগয়ার উপর অধিকার লাভ করেছে।

বর্তমান সংস্কারকৃত বোধিমন্দিরটির ৫০ ফুট প্রশস্ত বাহু একটি বর্গাকার তলের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এর উচ্চতা ১৮০ ফুট। এর চার পঞ্চমাংশ পিরামিডের মতো সরল রেখায় উপরের দিকে সরু হয়ে উঠে গেছে। বাকি এক-পঞ্চমাংশ বর্তুলাকার স্তূপের মতো সরু হয়ে চূড়াতে গিয়ে শেষ হয়েছে। এই মন্দিরের চারকোণায় মূল মন্দিরের অনুরূপ চারটি ছোটো মন্দির রয়েছে। এর পূবদিকের মন্দির দুটিতে আছে উপরে উঠার সিঁড়ি। এই সিঁড়ির দুই পাশে দণ্ডায়মান অবস্থায় আছে বোধিসত্ত্ব পদ্মপাণি ও অবলোকিতেশ্বর মূর্তি। মন্দিরের বাইরের গায়ে আছে নানা ভঙ্গিমায় বুদ্ধমূর্তি, পদ্ম, পশু-পাখি ও জাতকের চিত্রিত আখ্যান। মন্দিরের ভিতরে রয়েছে সাড়ে পাঁচফুট দৈর্ঘ্যের ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় বৌদ্ধমূর্তি।

বোধিবৃক্ষ এবং মন্দির ছাড়া এখানে একটি দীঘির নাম সুজাতা দিঘি। কথিত আছে। এই দিঘির জলে স্নান করে বুদ্ধদেবকে পায়েস নিবেদন করেছিলেন।


সূত্র: