বখতিয়ার খলজি
এদের পরিবারের সদস্যরা ছিলেন উত্তর
আফগানিস্তানের গরমশির (আধুনিক দস্ত-ই-মার্গ) এলাকার বাসিন্দা। এঁরা ছিলেন তুর্কি
জাতির খলজি গোত্রের। এই কারণে, বখতিয়ার আফগানিস্তান থেকে এলেও, তাঁকে তুর্কি বলা
হয়।
তাঁর বাল্যজীবন সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। সেকালের খলজি
পরিবারের পুরুষ সদস্যরা সৈনিক পেশাকে অগ্রাধিকার দিত। সেই কারণে, ১১৯৫ খ্রিষ্টাব্দে
গজনীতে তিনি সৈনিক হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার
জন্য মুহম্মদ ঘুরীর আজির-ই-মালিকের নিকট আবেদন করেন। কিন্তু খর্বাকৃতি ও বাহুদ্বয়
হাটুর নিচ পর্যন্ত লম্বা হওয়ার কারণে তাঁর আবেদন বাতিল হয়ে যায়।
ভগ্নমনোরথ হয়ে তিনি দিল্লিতে আসেন। সেখানে কুতুবউদ্দীন আইবকের অধীনে চাকরির জন্য যান। এখানেও তিনি প্রত্যাখ্যিত হন। এরপর তিনি তিনি বদাউনে চলে যান এবং সেখানে মালিক হিজবরউদ্দীন তাঁকে একটি নিম্নপদের চাকরি দেন। এই পদে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। সেকারণে অল্পকাল পরেই তিনি বদাউন পরিত্যাগ করে অযোধ্যায় চলে যান। ১১৯৭ খ্রিষ্টব্দে অযোধ্যার শাসনকর্তা মালিক হুসামউদ্দীনের অধীনে তাঁর যোগ্যতার উপযোগী একটি চাকরি লাভ করেন। তাঁকে মির্জাপুর জেলার ভাগওয়াত ও ভিউলী নামে দুটি পরগনার জায়গির প্রদান করা হয়। এখানে তিনি দ্রুত অন্যান্য ভাগ্যান্বেষী মুসলিমদের নিয়ে একটি সেনাদল গঠন করেন। তিনি অযোধ্যা এবং বিহারের সীমান্তবর্তী কর্মনাশা নদীর পূর্ব-উপকূলে লুটতরাজ করে সম্পদ সঞ্চয় করেন। ফলে অল্পদিনের ভিতরে তিনি এই অঞ্চলের ভাগ্যান্বেষী তুর্কিদের তাঁর সৈন্য বাহিনীকে বড় করে তোলেন। এরপর দিন ভূমি দখলের মধ্য দিয়ে তাঁর শাসন এলাকার বৃদ্ধি ঘটানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রাথমিকভাবে তিনি শক্তিশালী হিন্দু জমিদারদের মোকাবেলা করার পরিবর্তে দক্ষিণ-বিহারের অরক্ষিত এলাকা আক্রমণ করেন। এর দ্বারা তিনি অর্থ এবং স্থান উভয় লাভ করতে সক্ষম হন। ১১৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিহারের ওদন্ত বৌদ্ধবিহার আক্রমণ করেন। এখানে তাঁর সৈন্যরা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা করে। কালক্রমে এই বিহারটি বিহার শরিফ নামে পরিচিতি লাভ করে। এই সময় মগধের অধিকাংশ বৌদ্ধ স্থাপনা এই তুর্কি সেনাপতির আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়।
১২০১-০২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি প্রচুর ধন-সম্পদসহ কুতুবুদ্দিন আইবক-র সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁকে বহুমূল্যবান উপহার প্রদান করেন। কুতুবুদ্দিন আইবক তাঁকে বিশেষভাবে সম্মানিত করেন এবং বিহারের ওই অঞ্চল শাসনের অনুমতি দেন। বিহারে ফিরে তিনি সৈন্য সংগ্রহ করার দিকে মনোযোগ দেন। অচিরেই অর্থের দ্বারা তিনি একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরি করতে সক্ষম হন। ১২০৪-০৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি বাংলা আক্রমণের জন্য ঝাড়খণ্ডের ভিতর দিয়ে নদীয়ার দিকে অগ্রসর হন। এরপর তিনি বাংলার সেনবংশের রাজা লক্ষ্মণসেন (১১৭৯-১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ)-এর নদীয়া আক্রমণ করে দখল করে নেন। ঘোরীর একটি স্বর্ণমুদ্রায় এর তারিখ উল্লেখ আছে ৬০১ হিজরী সনের ১৯শে রমযান। গ্রেগোরিয়ান পঞ্জিকা মতে সময়টা দাঁড়ায় ১০ই মে, ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ।
বখতিয়ারের বিহার জয়ের সংবাদে নদীয়ায় আতঙ্কের ভাব সৃষ্টি হয়েছিল। তখন রাজ্যের বিশিষ্ট ব্যক্তি মন্ত্রীবর্গ ও জ্যোতিষিগণ রাজা লক্ষ্মণসেনকে নদীয়া ত্যাগের পরামর্শ দেন, কিন্তু তিনি নদীয়া পরিত্যাগ না করে দৃঢ়তার পরিচয় দেন। অন্যদিকে ঝাড়খণ্ডের দুর্গম এলাকার ভিতর দিয়ে বখতিয়ার নদীয়ার উদ্দেশ্যে এমনই দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়েছিলেন যে, মাত্র ১৮ জন সৈনিক তাঁর সঙ্গে ছিল এবং মূল বাহিনী পশ্চাতে ছিল। তাঁদেরকে অশ্ববিক্রেতা মনে করে নদীয়াতে কারো মনে সংশয় সৃষ্টি হয় নি। এই সুযোগে এরা সরাসরি রাজপ্রাসাদে গিয়ে আকস্মিক আক্রমণে প্রাসাদরক্ষীদের পরাস্ত করেন। মিনহাজের বর্ণনা থেকে জানা যায়, বখতিয়ারের প্রথম আক্রমণ ছিল প্রাসাদরক্ষীদের বিরুদ্ধেই এবং তখন লক্ষণসেন স্বীয় প্রাসাদে দ্বিপ্রহরের ভোজনে রত ছিলেন। স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত পাত্রে তাঁকে আহার পরিবেশ করা হচ্ছিল। এই আকস্মিক ঘটনায় তিনি বিভ্রান্ত হয়ে রাজপ্রসাদের পিছন দিয়ে খালি পায়ে বিক্রমপুরে পালিয়ে যান। এরপর বখতিয়ারের মূল বাহিনী এসে পড়লে, সমগ্র নদীয়া শহরটি বখতিয়ারের হস্তগত হয়। বখতিয়ারের সৈন্যরা নদীয়ায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এরপর বিনা বাধায় গৌড়ের রাজধানী লক্ষ্মণাবতী অধিকার করেন। গৌড় জয়ের পর তিনি আরও পূর্বদিকের বরেন্দ্র তথা উত্তর বঙ্গে নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।
১২০৫ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে তাঁর রাজ্যের সীমা দাঁড়ায়- পূর্বে তিস্তা নদী ও করতোয়া নদী, দক্ষিণে পদ্মা নদী, উত্তরে
দিনাজপুর জেলার দেবকোট হয়ে রংপুর শহর পর্যন্ত এবং পশ্চিমে পূর্বে অধিকৃত বিহার।
তিনি দেবকোট-এ তাঁর রাজ্যের রাজধানী করেন। যদিও সে সময়ে বাংলাদেশের বেশিরভাগ অংশই
তিনি দখলে আনতে পারেন নি। তারপরেও এই সব অঞ্চল বাদ দিয়ে তিনি তিব্বত আক্রমণের
পরিকল্পনা করেন।
এই সময় হিমালয়ের পাদদেশে কোচ, মেচ এবং ধারু নামক তিনটি উপজাতি বাস
করতো। বখতিয়ার এই অঞ্চলে প্রবেশ করে মেচ উপজাতির সর্দারকে বন্দি করেন এবং তাঁকে
ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। তিনি এই সর্দারের নাম রাখেন আলীমেচ। এই সর্দারের কাছ
থেকে তিব্বতে যাওয়ার খুঁটিনাটি জেনে নেন।
তিব্বত অভিযানের
সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর, তিনি
১২০৬ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে, তিনি প্রায় দশ হাজার সৈন্য নিয়ে
দেবকোট থেকে
তিব্বত অভিমুখে রওনা দেন। এই অভিযানে পথ প্রদর্শক হিসেবে আলীমেচ
সেনাবাহিনীর অগ্রমুখে ছিলেন। সৈন্যবাহিনী বর্ধনকোট
নামক স্থানের কাছে পৌঁছালে, তারা বেগমতী নদী নামক চওড়া একটি নদীর মুখোমুখি হয়।
বখতিয়ার এই নদী পার না
হয়ে দশ দিন ধরে
উত্তরদিক বরাবর নদীর উর্ধ্ব মুখে সৈন্যদের চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর,
নদীর
সংকীর্ণ একটি স্থানে একটি পাথরের সেঁতু পান। সেখানে তাঁর দুই সেনাপতিকে সেঁতু সুরক্ষায় রেখে
নদী পার হয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হন। এই সময় তিনি কামরূপের রাজার সাথে যোগাযোগ করেন।
কামরূপ-রাজ বখতিয়ারকে পরের বছর তিব্বত আক্রমণের পরামর্শ দেন। কিন্তু বখতিয়ার সে
পরামর্শে কর্ণপাত না করে, তিব্বতের পথে রওনা দেন। ষোল দিন পর তিব্বত বাহিনীর সাথে
বখতিয়ারের বাহিনীর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বখতিয়ার জয়লাভ করলেও, তাঁর সেনাবাহিনী ব্যাপক
ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে তিনি, এখানে বেশিদিন থাকাটা সমীচীন মনে করলেন না। বখতিয়ারের
বাহিনী দেবকোটের দিকে ফিরে যাওয়ার জন্য রওনা দিলে, তিব্বতি সৈন্যরা এদের আক্রমণ করা
শুরু করে। এর ভিতর দিয়ে এরা বেগমতী নদী পর্যন্ত পৌঁছাতে সমর্থ হয়। এই সময় পার্বত্য
উপজাতিরাও বখতিয়ারের বাহিনীকে আক্রমণ করা শুরু করে। সেঁতুর কাছে এসে বখতিয়ার দেখেন যে
পার্বত্য লোকেরা তার দুই সেনাপতির উপর আক্রমণ করে হত্যা করেছে এবং সেতুটি
পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে। এরপর তিনি পার্বত্যবাসীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার
জন্য সসৈন্যে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই সময় তাঁর বহু সৈন্য নদীতে ডুবে যায়। শেষ
পর্যন্ত অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে তিনি রাজধানী দেবকোটে পৌঁছাতে সক্ষম হন।
তিব্বত অভিযান বিফলতা এবং সৈন্যবাহিনীর ব্যাপক ক্ষতির ফলে, তাঁর অনুগত খলজি অভিজাতবৃন্দ বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এর ভিতর ঘোরতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই অবস্থায় ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। অনেকে মনে করেন, তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি আলী মার্দান খলজি তাঁকে হত্যা করেছিলেন।
সূত্র :
বাংলাদেশের
ইতিহাস/রমেশচন্দ্র মজুমদার।
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।