লক্ষ্মণসেন
সেন রাজবংশের তৃতীয় রাজা।
১১৭৯ খ্রিষ্টাব্দে
সেন রাজবংশের দ্বিতীয়
রাজা
বল্লালসেন (১১৬০-১১৭৯ খ্রিষ্টাব্দ)
তাঁর পুত্র লক্ষ্মণসেনের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে, গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থলে
আশ্রমবাসী হয়েছিলেন। এই সূত্রে লক্ষ্মণসেন সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তাঁর রাজত্বকালের ৮টি তাম্রশাসন এবং সভাকবিদের প্রশস্তি থেকে এবং মুসলমান ঐতিহাসিক
মিনহাজ উদ্দীন রচিত তবকাত-ই-নাসিরী গ্রন্থ থেকে, তাঁর রাজত্বকাল সম্পর্কে বিশেষভাবে
জানা যায়। তাঁর সময়ের ৮টি তাম্রশাসন হলো−
১. গোবিন্দপুর তাম্রশাসন (২৪ পরগনা)
২. আনুলিয়া তাম্রশাসন (নদীয়া)
৩. তর্পণদীঘি তাম্রশাসন (দিনাজপুর)
৪. মাধাইনগর তাম্রশাসন (পাবনা)
৫. শক্তিপুর তাম্রশাসন (মুর্শিদাবাদ)
৬. ভাওয়াল তাম্রশাসন (ঢাকা)
৭. সুন্দরবন তাম্রশাসন
৮. চণ্ডী মূর্তিলিপি (ঢাকা)।
মিনহাজের বর্ণনায় বখতিয়ার কর্তৃক নদীয়া আক্রমণের সময় লক্ষ্মণসেনের (জন্ম ১১২৪ খ্রিষ্টাব্দে) বয়স প্রায় ৮০ বছর ছিল এবং সম্ভবত ৫৪ বছর বয়সে তিনি রাজক্ষমতা গ্রহণ করেন। সুতরাং পিতা ও পিতামহের রাজত্বকালে তাঁর যৌবনকাল অতিক্রান্ত হয়।
পিতা বল্লালসেন ও পিতামহ বিজয়সেন শৈবপন্থী
ছিলেন। লক্ষ্মণসেন বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি পিতা ও পিতামহের চিরাচরিত ‘পরম
মাহেশ্বর’ উপাধির পরিবর্তে ‘পরম বৈষ্ণব’ উপাধি এবং ‘অরিরাজ মদন শঙ্কর’ উপাধি গ্রহণ
করেন। তাঁর তাম্রশাসনগুলি নারায়ণের প্রণাম ও স্তূতিবাচক শ্লোক দিয়ে আরম্ভ করা
হয়েছে।
লক্ষ্মণসেনের তাম্রশাসন থেকে জানা
যায়, তিনি কৌমারে
উদ্ধৃত গৌড়েশ্বরের শ্রীহরণ ও যৌবনে কলিঙ্গদেশে অভিযান করেছিলেন, এবং যুদ্ধে কাশীরাজকে
পরাজিত করেছিলেন। এছাড়া প্রাগজ্যোতিষের (কামরূপ ও আসাম) রাজা তাঁর বশ্যতা স্বীকার
করেছিলেন। মাধাইনগর তাম্রশাসন থেকে লক্ষ্মণসেনের হাতে গৌড়, কলিঙ্গ, কামরূপ ও কাশীর রাজাদের
পরাজয়ের কথা জানা যায়। তাঁর পুত্রের তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে− লক্ষণসেন পুরী,
বারানসী ও এলাহাবাদে বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন।
লক্ষ্মণসেন একটি নতুন রাজধানী স্থাপন করেন এবং নিজের নামের সাথে মিলিয়ে নাম মিলিয়ে নতুন
রাজধানীর নাম রেখেছিলেন লক্ষ্মণাবতী। এছাড়া তিনি গৌড়েশ্বর উপাধি ধারণ করেছিলেন। অবশ্য তাঁর দুই পুত্র বিশ্বরূপসেন এবং কেশবসেন উভয়েই তাঁদের তাম্রশাসনে বল্লালসেন,
বিজয়সেন এবং লক্ষ্মণসেনকে গৌড়েশ্বর উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
তাঁর পুত্র বিশ্বরূপ সেন ও কেশবসেনের
তাম্রশাসনে তাঁর পুরী, কাশী ও প্রয়াগে সমর জয়স্তম্ভ স্থাপনের উল্লেখ আছে। এসময়
গঙ্গা বংশীয় রাজাগণ কলিঙ্গ ও উৎকলে রাজত্ব করতেন। তাঁদের তাম্রশাসনে লক্ষ্মণসেনের
সময়ে তাঁর রাজ্য আর সম্প্রসারিত হওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। সমসাময়িক গাহড়বাল
রাজাদের তাম্রশাসনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পাল বংশ পতনের আগেই গাহড়বাল রাজাগণ মগধে
আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। বিজয়সেন নৌ-বাহিনী পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু যুদ্ধে জয়লাভ
করতে পারেন নি।
বল্লালসেন কিছু সফলতা লাভ করলেও পালদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় গাহড়বালগণ মগধে অধিকার বিস্তারের সুযোগ পায়। গাহড়বাল রাজা বিজয়চন্দ্র ও জয়চন্দ্রের লিপি হতে প্রমাণিত হয় যে, ১১৬৯ হতে ১১৯০ অব্দের মধ্যে মগধের পশ্চিম ও মধ্য ভাগ গাহড়বাল রাজ্যভুক্ত ছিল। পূর্বদিকে তাদের রাজ্যবিস্তারে বাধা দিলে লক্ষ্মণসেনের সঙ্গে হয়ত যুদ্ধ বাধে। এ যুদ্ধের ফলাফল বিস্তারিত জানা যায় না। মাধাইনগর ও ভাওয়াল তাম্রলিপিতে লক্ষ্মণসেনকে গৌড়েশ্বর বলা হয়েছে। কিন্তু তিনি উত্তরাধিকারী হিসেবেই গৌড়ের রাজা ছিলেন। এতদ্ব্যতীত প্রবন্ধকোষ ও পুরাতন প্রবন্ধ সংগ্রহ প্রভৃতি জৈন গ্রন্থ হতেও এর সমর্থন মিলেছে। পালদের পতনে মগধাঞ্চলে গাহড়বালদের অগ্রগতি সেনসাম্রাজ্যের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছিল। তাঁদের বিরুদ্ধে বিজয়সেন ও বল্লালসেন বিশেষ সাফল্য অর্জন করেন নি। লক্ষ্মণসেনের পুত্ররা তাম্রশাসনে লিখেছেন যে, তিনি সমুদ্রতীরে পুরুশোত্তর ক্ষেত্র, কাশীতে ও প্রয়াগে যজ্ঞয়ুপের সাথে ‘সমরজয়স্তম্ভ’ স্থাপন করেছিলেন। উল্লেখ্য, এ সময়ে গঙ্গাবংশীয় রাজাগণ কলিঙ্গ ও উৎকল, উভয় দেশেই রাজত্ব করতেন। অবস্য জয়স্তম্ভ স্থাপনের সমসাময়িক সূত্র থেকে লক্ষ্মণসেনের প্রমাণ পাওয়া যায় না। মগধে তখন রাজত্ব করছিলেন গাহরবাল রাজ জয়চন্দ্র (১১৭০-১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দ) বেনারস ও এলাহাবাদ তখন তাঁর সম্পূর্ণ কর্তৃত্বাধীনে ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। সেকারণে ঐতিহাসিকরা, রাজা বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেনের তাম্রশাসনের দাবি স্বীকার করেন না।
রাজা লক্ষ্মণসেনের সভাকবি উমাপতি ধর ও শরণ চেদিরাজা (কলচুরি রাজা) ও এক ম্লেচ্ছ রাজার বিরুদ্ধে সম্ভবত তাঁর (লক্ষ্মণসেন) জয়লাভের কথা বলেছিলেন। তখন রতনপুরের কলচুরি রাজবংশের রাজত্ব চলছিল। কলচুরিদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লক্ষ্মণসেনের সাফল্য সভাকবিরা উল্লেখ করলেও মধ্যপ্রদেশে প্রাপ্ত লিপিতে তাঁরই (লক্ষ্মণসেন) পরাজয়ের উল্লেখ আছে। সুতরাং উভয় পক্ষের সাফল্য দাবি এর ফলাফলকে অনিশ্চিত করেছে। ম্লেচ্ছ অর্থাৎ মুসলমান রাজার বিরুদ্ধে জয়লাভের উল্লেখ থেকে, নীরহাররঞ্জন রায় বখতিয়ার খলজির বিরুদ্ধে লক্ষ্মণসেনের সাফল্য অনুমান করেছেন। আবার জে. এম. রায় ম্লেচ্ছ বলতে আরাকানের মগদের বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে, মগগণ হয়তো বাংলা আক্রমণ করেছিল এবং লক্ষ্মণসেন তাঁদেরকে পরাজিত করেছিলেন। এসবই অনুমান মাত্র। বিশেষ করে, মুসলমানদের সাথে কোনো যুদ্ধে লক্ষ্মণসেনের জয়ী হওয়ার সংবাদ জানা যায় নাই।
লক্ষ্মণসেন শিল্প, সাহিত্য ও ধর্মচর্চায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি একজন সুকবি ছিলেন এবং তাঁর রচিত কয়েকটি শ্লোক সদ্যুক্তিকর্ণামৃত গ্রন্থে পাওয়া যায়। তাছাড়াও তিনি পিতা বল্লালসেনের অসমাপ্ত অদ্ভুতসাগর গ্রন্থটির রচনা সমাপ্ত করেন। ধোয়ী, শরণ, জয়দেব, গোবর্ধন আচার্য, উমাপতি ধর তাঁর রাজসভার পঞ্চরত্ন ছিলেন। ব্রাহ্মণসর্বস্বম গ্রন্থ রচয়িতা হলায়ুধ লক্ষ্মণসেনের মন্ত্রী ও ধর্মাধ্যক্ষ ছিলেন। সাহিত্যক্ষেত্র ব্যতীত শিল্পক্ষেত্রেও বাংলা এই সময় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করে।
তিনি একজন দানশীল রাজা ছিলেন। রাজার মতোই ছিল তাঁর দানের পরিমাণ। যাঞ্চাকারীকে তিনি লক্ষ কড়ির কম দান করেন নি। তখনো এক লক্ষ কড়ির মূল্য ছিল ৭৮ টাকা থেকে একটু বেশি যা ছিল একজন সাধারণ শ্রমিকের এক বৎসর চার মাসের শ্রমের দাম। তাঁর দানশীলতা ঐতিহাসিক মিনহাজউদ্দীনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। মিনহাজউদ্দীন তাঁর দানশীলতার প্রশংসা করে তাঁকে ভারতের একজন মহানুভব শাসক হিসেবে অভিহিত করেছেন।
কিন্তু লক্ষ্মণসেনের শেষজীবনে রাষ্ট্রাভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা, ষড়যন্ত্র, অভ্যুত্থান ও বহিঃশত্রুর আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। সুন্দরবন অঞ্চলের এক মহামাণ্ডলিকের পুত্র ডোম্মনপাল বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং মহারাজাধিরাজ উপাধি ধারণ করে স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। অপরদিকে প্রায় একই সময়ে মেঘনা নদীর পূর্বপার্শ্বে দেববংশ নামে একটি স্বাধীন রাজবংশের উদ্ভব হয়। এতেই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ভয়াবহ ষড়যন্ত্র, কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতা এবং অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও অন্তর্বিরোধের আভাস পাওয়া যায়। এমনই এক সংকটকালে নদীয়ায় তুর্কি অভিযান পরিচালিত হয়। বখতিয়ার খলজি ১২০৪-০৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বাংলা আক্রমণের জন্য ঝাড়খণ্ডের ভিতর দিয়ে নদীয়ার দিকে অগ্রসর হন। ধারণা করা হয়, এই অভিযান পরিচালিত হয় ১০ই মে, ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দে। উল্লেখ্য ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত বখতিয়ার খলজির প্রবর্তিত, মোহাম্মদ ঘোরীর নামে মুদ্রিত একটি স্বর্ণমুদ্রা [বখতিয়ার খলজির স্বর্ণমুদ্রা ] থেকে এই তারিখটি অনুমান করা হয়। এ মুদ্রা থেকে বখতিয়ার খলজির গৌড় বিজয়ের তারিখ পাওয়া যায় ৬০১ হিজরী সনের ১৯ শে রমযান। গ্রেগোরিয়ান পঞ্জিকা মতে '১৯শে রমজান ৬০১ হিজরী' সময়টা দাঁড়ায় ১০ই মে, ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ।
বখতিয়ার খলজির নদীয়া আক্রমণ ও জয়ের বিবরণ সমসাময়িক ঐতিহাসিক মিনহাজ উদ্দীনের তবকাত-ই-নাসিরী গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে যে, বখতিয়ার খলজি বিহার জয় করে নদীয়া অভিযান করেন। এ সময় বাংলার রাজা লক্ষ্মণসেন নদীয়াতে অবস্থান করছিলেন।
বখতিয়ার খলজির
বিহার জয়ের সংবাদে নদীয়ায় আতঙ্কের ভাব সৃষ্টি হয়েছিল। তখন রাজ্যের
বিশিষ্ট ব্যক্তি মন্ত্রীবর্গ ও জ্যোতিষিগণ রাজা লক্ষ্মণসেনকে নদীয়া ত্যাগের পরামর্শ
দেন, কিন্তু তিনি নদীয়া পরিত্যাগ না করে দৃঢ়তার পরিচয় দেন। অন্যদিকে বখতিয়ার নদীয়ার
উদ্দেশ্যে এমনই দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়েছিলেন যে মাত্র ১৮ জন সৈনিক তাঁর সঙ্গে ছিল
এবং মূল বাহিনী পশ্চাতে ছিল। তাঁদেরকে অশ্ববিক্রেতা মনে করে নদীয়াতে কারো মনে সংশয়
সৃষ্টি হয় নি। এই সুযোগে সরাসরি রাজপ্রাসাদে গিয়ে বখতিয়ার স্বমূর্তি উন্মোচন করেন এবং
আকস্মিক আক্রমণে প্রাসাদরক্ষীদের পরাস্ত করেন।
মিনহাজের বর্ণনা থেকে জানা যায়,
বখতিয়ারের প্রথম আক্রমণ ছিল প্রাসাদরক্ষীদের বিরুদ্ধেই এবং তখন লক্ষণসেন স্বীয়
প্রাসাদে দ্বিপ্রহরের ভোজনে রত ছিলেন। স্বর্ণ ও রৌপ্য নির্মিত পাত্রে তাঁকে
আহার পরিবেশ করা হচ্ছিল।
এই আকস্মিক ঘটনায় তিনি বিভ্রান্ত
হয়ে রাজপ্রসাদের পশ্চাৎ দিয়ে নগ্ন পায়ে (পূর্ব) বিক্রমপুরে পলায়ন করেন। অতঃপর মূল বাহিনী
এসে পড়লে সমগ্র নদীয়া শহরটি বখতিয়ারের হস্তগত হয়।
নদীয়া থেকে
বিক্রমপুরে পৌঁছে তিনি নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নেন। এর তিনি সেখান থেকে বাংলা কিছু
অংশ শাসন করেন। কিছুদিন রাজত্ব করেন।
বখতিয়ার খলজির
তাঁকে অনুসরণ করে বিক্রমপুরের দিকে আসেন নি। এছাড়া অন্যান্য স্থানীয় রাজারাও তাঁকে
আক্রমণ করেন নি।
১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই অঞ্চলে রাজত্ব করার পর
তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র:
করতোয়া মাহাত্ম/ পি.সি. সেন- , ১৯২৯।
কেশবসেনের আদিলপুর তাম্রশাসনের শ্লোক নং- ১৩।
Statistical Account of Bengal,
Vol VII/W.W. Hunter
বাঙালির ইতিহাস/সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস/সুকুমার সেন।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, খণ্ড- ১/ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
মিনহাজ-ই-সিরাজ: তবকাত-ই-নাসিরী (অনুবাদক: আবুল কালাম মোঃ যাকারিয়া)।
বাংলাদেশের
ইতিহাস/রমেশচন্দ্র মজুমদার।
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।