জয়দেব
সম্ভবত সংস্কৃত ভাষার শেষ কবি। খ্রিষ্টীয় ১২শ শতকের কবি হিসেবে অনুমান করা হয়।

তাঁর জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকের মতে, পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার অজয় নদের তীরবর্তী কেন্দুবিল্ব বা কেঁদুলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কেউ কেউ তাঁকে মিথিলা বা উড়িষ্যার অধিবাসী বলেও মনে করেন।
তাঁর রচিত গীতগোবিন্দ কাব্যের দ্বাদশ তথা অন্তিম সর্গের শেষ পদে, তিনি তাঁর পরিচয় জানিয়ে লিখেছেন তাঁর পিতার নাম ভোজদেব এবং মাতার নাম বামাদেবী। তাঁর স্ত্রীর নাম পদ্মাবতী।

যতদূর জানা যায়, জয়দেব ছিলেন বাংলা রাজা লক্ষণসেন (১১৭৯-১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ) রাজসভার পঞ্চরত্নের অন্যতম। উল্লেখ্য অপর চারজন রত্ন ছিলেন
গোবর্ধন আচার্য, শরণ, ধোয়ীউমাপতি ধর। কারও কারও মতে তিনি কিছুকাল উৎকলরাজেরও সভাপণ্ডিত ছিলেন।

জয়দেব তাঁর সংস্কৃত ভাষায় রচিত 'গীতগোবিন্দম্' গীতিকাব্য-এর জন্য বিখ্যাত। এই কাব্যের মূখ্য বিষয়- রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা। গ্রন্থটি ২৮৬টি শ্লোক এবং ২৪টি গীতের সমন্বয়ে ১২ সর্গে এটি রচিত। বর্ণিত বিষয়ের তত্ত্বনির্দেশক বারোটি ভিন্ন ভিন্ন নামে সর্গগুলির নামকরণ করা হয়েছে। যেমন- সামোদ-দামোদর, অক্লেশ-কেশব, মুগ্ধ-মধুসূদন, স্নিগ্ধ-মধুসূদন, সাকাঙ্ক্ষ-পুণ্ডরীকাক্ষ, ধৃষ্ট-বৈকুণ্ঠ, নাগর-নারায়ণ, বিলক্ষ-লক্ষ্মীপতি, মুগ্ধ-মুকুন্দ, মুগ্ধ-মাধব, সানন্দ-গোবিন্দ এবং সুপ্রীত-পীতাম্বর। এই কাব্যের নায়ক-নায়িকা রাধা-কৃষ্ণ হলেও, এঁদের প্রতীকে জীবাত্মা-পরমাত্মার সম্পর্ক এবং নর-নারীর চিরন্তন প্রেমকে তুলে ধরা হয়েছে।

এর গীতগুলো কোনো না কোন রাগের আশ্রয়ে তৈরি করা হয়েছিল। বাংলা কাব্য ও গানের ধারায়, আদি পদাবলি হিসেবে বিবেচিত চর্চাপদের চেয়েও, মধ্যযুগীয় বাংলা গানে গীতগোবিন্দের বেশি প্রভাব পড়েছিল সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কাছে এই গ্রন্থটি হয়ে উঠেছিল ধর্মগ্রন্থের মতো। দীর্ঘকাল ধরে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে এই গ্রন্থটি পাঠের রেওয়াজ ছিল। ভারত ও ভারতের বাইরেও গ্রন্থটি বেশ জনপ্রিয় এবং ইংরেজিসহ ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে। গীতগোবিন্দম্-এর ওপর প্রায় অর্ধশত টীকাগ্রন্থ রচিত হয়েছে।

গীতগোবিন্দম্-এর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এতে চরণশেষে অন্তমিল অনুসৃত হয়েছে, যা সংস্কৃত সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রায়শই দুর্লভ। জয়দেবের আমলে বাংলা কবিতার অন্ত্যমিলটা একটি উল্লেখযোগ্য অঙ্গ ছিল। তিনি সংস্কৃতকাব্য রচনা করলেও ছন্দের এবং ভাষাশৈলীর বিচারে সহজ-সরল এবং প্রায় তৎসম-প্রাধন বাংলার মতো। 

উল্লেখ্য, শ্রীধরদাসের কোষকাব্য সদুক্তিকর্ণামৃতে (১২০৬) গীতগোবিন্দম্-এর ৫টি শ্লোক ছাড়া জয়দেবের নামাঙ্কিত আরও ২৬টি শ্লোক পাওয়া যায়। শিখদের ধর্মগ্রন্থ গ্রন্থসাহেবে (ষোল’শ শতক) জয়দেবের দুটি শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে। নাভাজি দাসের ভক্তমাল, হলায়ুধ মিশ্রের সেখশুভোদয়া প্রভৃতি গ্রন্থে এবং প্রচলিত জনশ্রুতিতে জয়দেব ও পদ্মাবতী সম্পর্কে নানা কাহিনি প্রচলিত আছে। বৈষ্ণব সহজিয়ারা জয়দেবকে আদিগুরু এবং নবরসিকের অন্যতম বলে বিবেচনা করে। বীরভূমের কেন্দুবিল্বতে প্রতিবছর পৌষ সংক্রান্তিতে জয়দেবের স্মরণে উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসব উপলক্ষে অনুষ্ঠিত মেলাটি ‘জয়দেব মেলা’ নামে পরিচিত।