বল্লালসেন
১০৮৩-১১৭৯ খ্রিষ্টাব্দ
সেন রাজবংশের দ্বিতীয় রাজা। ১১৬০ থেকে ১১৭৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেছিলেন। াঁর পিতা ছিলেন সেন রাজবংশের প্রথম রাজা বিজয়সেন (১০৯৭-১১৬০ খ্রিষ্টাব্দ)। মায়ের নাম প্রভাবতী।

রাজলাভের পর তিনি রাজ্য বিস্তারের পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ সংস্কারকার্যে অধিকতর মনোনিবেশ করেন। তিনি পিতার মতোই ‘অরিরাজনিশঙ্ক শঙ্কর’ এবং অন্যান্য সম্রাটসুলভ উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি চালুক্যরাজ দ্বিতীয় জগদেকমল্লের কন্যা রামাদেবীকে বিবাহ করে সেনবংশের সম্মান ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেন।।

বল্লালসেনের রাজত্বকালের ইতিহাস পুনর্গঠন করার জন্য কয়েকটি মূল্যবান উপকরণ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে যথাক্রমে ‘নৈহাটি তাম্রশাসন’ ও ‘সানোখার মূর্তিলিপি’, বল্লালসেন কর্তৃক রচিত ‘দানসাগর’ ও ‘অদ্ভুতসাগর’ ছাড়াও বল্লাল চরিত নামে দু’খানি গ্রন্থ আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রথমটি বল্লাল সেনের অনুরোধে তাঁর শিক্ষক (গোপাল ভট্ট) ১৩০০ শকাব্দে দুই খণ্ডে রচনা করেন এবং বল্লাল চরিতের তৃতীয় খণ্ড নবদ্বীপাধিপতির আদেশে গোপালভট্টের বংশধর আনন্দভট্ট ১৫০০ শকাব্দে রচনা করেন। বল্লালচরিতের দ্বিতীয় গ্রন্থ নবদ্বীপের রাজা বুদ্ধিমন্তখানের আদেশে আনন্দভট্ট ১৪৩২ শকাব্দে রচনা করেন। সম্ভবত ষোড়শ অথবা সপ্তদশ শতাব্দীতে শুধুমাত্র প্রচলিত গল্পকাহিনীর উপর নির্ভর করে এই গ্রন্থ দু’খানি রচনা করা হয়েছিল। কাজেই গ্রন্থ দু’টিতে বর্ণিত কাহিনীগুলো ইতিহাসের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয় না। তবে বল্লালসেন রচিত দানসাগর ও অদ্ভুতসাগরে গ্রহণযোগ্য কিছু কিছু তথ্য পাওয়া যায়।

বল্লালসেন পিতার মতো সামরিক বিজেতারূপে ইতিহাসে খ্যাতিলাভ না করলেও তাঁর সামরিক সাফল্যের কয়েকটি খবর সেনলিপিতে পাওয়া যায়। নৈহাটি তাম্রশাসনে বল্লালসেনের বিশেষ কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। তবে সনোখার লিপিতে বল্লালসেনের মগধের পূর্বাঞ্চল জয়ের উল্লেখ আছে। উল্লেখ্য যে, বিজয়সেনের সামরিক অভিযানে বাংলা হতে মদনপাল বিতাড়িত হয়ে মগধে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ধারণা করা হয় মদনপালকে পরাজিত করে মগধের পূর্বাঞ্চল অধিকার করেন। অদ্ভুতসাগর গ্রন্থে এর পরোক্ষ উল্লেখ আছে। বল্লালচরিত গ্রন্থ হতেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। কুলপঞ্জিকার ভিত্তিতে এন,এন, ভাসু বলেন যে, জনৈক ভটেশ্বরমিত্রকে বল্লালসেন মগধের শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি কলগঙ্গে ভটেশ্বরনাথ নামে একটি শিবমন্দির স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু সমসাময়িক সূত্র থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায় না। অন্যপক্ষে জানা যায় যে, বল্লালসেন ক্ষমতায় আসার বহু শতাব্দী পূর্ব থেকেই এই শিবমন্দিরের অস্তিত্ব ছিল। এই গ্রন্থে আরও উল্লেখ আছে যে, বল্লালসেন পিতার জীবদ্দশায় মিথিলা জয় করেন। কিন্তু সেই সময় মিথিলা সেন সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ নান্যদেবের পরবর্তী বংশধরদের মিথিলা শাসনের প্রমাণ পাওয়া যায়।

মগধের পূর্বাঞ্চল জয়ের কথা বল্লালসেনের অদ্ভুতসাগরে আছে। সম্ভবত যুদ্ধে হারার পর মদনপাল বাংলা থেকে মগধে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এইসময় তাঁর বংশের একজন সামন্ত গোবিন্দপাল গয়াতে রাজত্ব করতেন। মদনপালের পর তিনি কিছুদিন মগধে রাজত্ব করেছেন। ১৬২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বল্লালসেনের কাছে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যান। এরপর পাল সাম্রাজ্য চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

বাংলার কুলজী গ্রন্থ অনুসারে বল্লালসেন অনেক সমাজসংস্কারমূলক কাজ করেন। তিনি হিন্দু সমাজকে নতুনভাবে গঠন করে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থ- এই তিন শ্রেণীর মধ্যে কৌলীন্য প্রথার প্রবর্তন করেন। এই কুলীন শ্রেণীর লোকদের কিছু কিছু বিশেষ রীতিনীতি মান্য করতে হতো। ন্যায়পরায়ণতা, জাতিগত পবিত্রতা, সততা প্রভৃতি সদগুণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য এই সকল রীতিনীতি প্রবর্তিত হয়েছিল। বল্লালচরিতে বল্লালসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে যে, তিনি নিজের পছন্দমত কোনো কোনো বর্ণকে অবনমিত করেছেন আবার কোনো কোনো বর্ণকে উচ্চমর্যাদায় উন্নীত করেছেন।।

তিনি বেশ কয়েকবার মণিপুর আক্রমণ করে জয়লাভে ব্যর্থ হন। এই যুদ্ধের জন্য তিনি সে যুগের বাংলার শ্রেষ্ঠ ধনী বল্লভানন্দের নিকট থেকে এক কোটি নিস্কর (মুদ্রা) কর্জ করেন। পরে শেষবারের মতো মণিপুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার জন্য কিন্তু তাঁর আরও দেড় কোটি নিস্কের প্রয়োজন হয়। তাঁর দূত এর জন্য বল্লভানন্দের নিকট গেলে, তিনি হরিকেল রাজ্যের রাজস্বের বিনিময় করার শর্তে কর্জ দিতে রাজী হলেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে বল্লালসেন বণিকদের নিকট থেকে জোর জুলুম করে এই টাকা আদায় করেন এবং তাদেরকে বৈশ্য বর্ণে অবনমিত করে সৎশূদ্রের পর্যায়ে নামিয়ে দেন। আর রাজাজ্ঞা প্রচার করেন যে, যে ব্রাহ্মণ বণিকদের বাড়িতে পূজা বা তাদের দান গ্রহণ করবে, সে ব্রাহ্মণ পতিত বলে গণ্য হবে।’ তবে এ অভিযোগ বল্লালসেনের বিরুদ্ধে সত্য বলে প্রমাণিত না হলেও বিষয়টি এমনই হয়েছিল। আদিতে স্বর্ণবণিকরা ছিল বৈশ্যবর্ণের অন্তর্ভুক্ত এবং সেন আমলেই তাদেরকে শূদ্র হিসেবে অবনমিত করা হয়েছে। ‘অনুরূপ কৈবর্ত, মালাকার, কুম্ভকারদিগকে শূদ্র বর্ণ হতে উত্থিত করে সৎশূদ্রের পর্যায়ভুক্ত করেন। এমনকি, কৈবর্তদের মোড়ল মহেশকে মহামাণ্ডলিকের পদমর্যাদা দেয়া হয়।

সর্বশেষে বল্লালসেন আরও ঘোষণা দেন যে, বণিকরা উপবীত ধারণ করতে পারবে না। এর ফলে অনেক বণিক দেশত্যাগ করে। সমাজে উচ্চবর্ণের মধ্যেও অনেক দুর্নীতি লক্ষ্য করে বল্লালসেন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের সাথে পরামর্শ করে ঐ সমুদয় আচারহীন ব্রাহ্মণদেরকে প্রায়শ্চিত্ত করতে বাধ্য করেন এবং যে সকল ব্রাহ্মণ ব্যবসা-বাণিজ্য করত তাদেরকে জাতিচ্যুত করেন।’ বল্লালচরিত থেকে আরও জানা যায় যে, নিম্নবর্ণের মেয়েদের প্রতি বল্লালসেনের দুর্বলতা ছিল। একারণেই হয়তো বল্লালচরিতের লেখক আনন্দ ভট্ট ১৬/১৭ শতাব্দীতে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, সেনরাজগণ বৈশ্য বা কায়স্থ ছিলেন। আধুনিক গবেষণায় কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তনের সাথে বল্লালসেনের জড়িত থাকার কথা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। কারণ সমকালীন সাহিত্য ও সেনলিপিতে এর কোনো উল্লেখ নেই। উল্লেখ্য যে, তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত স্মৃতিশাস্ত্রকার ভট্টভবদেব, হলায়ুধমিশ্র, অনিরুদ্ধ ভট্ট, জীমূতবাহন প্রভৃতি বিখ্যাত মনীষী হিন্দু সমাজের বহু বিধান প্রদান করলেও কৌলীন্য প্রথার কোনো উল্লেখ তাঁদের রচিত কোনো গ্রন্থে নেই। তাছাড়া ব্রাহ্মণদের ভূমিদান সম্পর্কিত সেনলিপিমালার কোথাও কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তনের ইঙ্গিতও নেই। তবে বঙ্গীয় কুলজী গ্রন্থে কৌলিন্য প্রথার উৎপত্তির সঙ্গে বল্লালসেনের নাম জড়িত আছে।

বল্লালসেনের একটি বিরাট গ্রন্থালয় ছিল বলে জনশ্রুতি ছিল। বসুনন্দন প্রণীত স্মৃতিতত্ত্বের একটি পুঁথিতে বল্লালসেন দেবাহৃত দ্বিখণ্ডাক্ষর লিখিত শ্রীহয়শীর্ষপঞ্জরাত্রেয় পুস্তকের উল্লেখ আছে। তবে কোনো কোনো ঐতিহাসিকের ধারণা বাংলায় মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহুকাল পরে ব্রাহ্মণরা তৎকালীন বাংলার সামাজিক বিধিবিধান প্রবর্তনে সকল সময়েই উদগ্রীব থাকতেন। জানা যায়, বল্লালসেনের পাণ্ডিত্যের খ্যাতি ছিল। বল্লালসেন একজন পণ্ডিতব্যক্তি ছিলেন। প্রশস্তিকারগণ তাঁকে ‘বিদ্বানমণ্ডলীর চক্রবর্তী’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তিনি গুরু অনিরুদ্ধ ভট্টের নিকট বেদ, স্মৃতিশাস্ত্র, পুরাণ প্রভৃতি বিষয় অধ্যয়ন করেছিলেন। উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি দানসাগর ও অদ্ভুতসাগর নামে গ্রন্থ দুটি রচনা করেন, কিন্তু অদ্ভুতসাগর গ্রন্থটি শেষ করে যেতে পারেন নি। তাঁর পুত্র লক্ষ্মণসেন এই গ্রন্থের রচনা সমাপ্ত করেন। গুরু অনিরুদ্ধ ভট্টের নির্দেশে বল্লালসেন দানসাগর গ্রন্থটি রচনা করেন। অদ্ভুতসাগর গ্রন্থ হতে জানা যায় যে, বল্লালসেন বৃদ্ধবয়সে পুত্র লক্ষ্মণসেনের পক্ষে সিংহাসন ত্যাগ করেন।
বল্লালসেন তাঁর রাজত্বকালে সুষ্ঠু সুশাসন প্রতিষ্ঠাপূর্বক পিতৃরাজ্য শুধু রক্ষাই করেন নি, বরঞ্চ মগধেও এর সম্প্রসারণ ঘটান বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বল্লালসেন একদিকে যাগযজ্ঞ, শাস্ত্রচর্চা, সমাজ সংস্কার ও সংস্কৃত সাহিত্যের অনুরাগী হলেও যুদ্ধবিগ্রহ হতে একেবারে নিরস্ত থাকেন নি। অদ্ভুত সাগরে তাঁকে ‘গৌতেন্দ্র-কুঞ্জরালান-স্তম্ভবাহর্মহীপতিঃ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এতে অনুমিত হয় যে, তিনি গৌড়রাজের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন তাঁর পিতার সহযোগী হিসেবে। তাছাড়া প্রচলিত জনশ্রুতি থেকে জানা যায় যে, বল্লালসেন তার রাজ্যকে রাঢ়, বরেন্দ্র, বাগড়ী, বঙ্গ ও মিথিলা এই পাঁচ ভাগে ভাগ করেছিলেন। তৃতীয়ত বল্লালসেনের পুত্র লক্ষ্মণসেনের নামযুক্ত সংবৎ মিথিলায় অদ্যাবধি প্রচলিত আছে। মিথিলার বাইরে অন্য স্থানে প্রচলনের খবর পাওয়া যায় না। মিথিলা সেনরাজ্যভুক্ত না হলে সেখানে এই সংবৎ প্রচলনের কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল না। ঐতিহাসিকদের অনেকে অবশ্য এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন।

বল্লালচরিতের রচনাকাল নিয়ে কিছু মতভেদ থাকলেও এর উত্তর ও পূর্ব খণ্ড সম্ভবত বল্লালসেনের শিক্ষক গোপালভট্টের রচনা। বল্লালসেনের মৃত্যু সম্পর্কে অদ্ভূতসাগরে বর্ণিত আছে যে, তিনি এই গ্রন্থের সূচনা করেন সম্ভবত ১০৮৯ অথবা ১০৯০ বঙ্গাব্দে। এই গ্রন্থ শেষ করার পূর্বেই বল্লালসেন এই গ্রন্থ শেষ করা এবং রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর পুত্র লক্ষ্মণ সেনের হাতে অর্পণ করে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থলে নির্ঝরপুরে গমন করেন। এতে বোঝা যায় তিনি হয় আত্মহনন করেছিলেন অথবা পুত্রের হস্তে রাজ্যভার অর্পণ করে অবসর নিয়ে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থলে আশ্রমবাসী হয়েছিলেন।

১১৭৯ বৎসর বয়সে সিংহাসন ত্যাগ করলে, তাঁর পুত্র লক্ষ্ণণ সেন সিংহাসনে বসেন।


সূত্র :