বিজয় সেন
সেন রাজবংশের প্রথম রাজা। পিতার নাম হেমন্ত সেন।

হেমন্ত সেনের 'মহারাজাধিরাজ' উপাধি থাকলেও ঐতিহাসিকদের ধারণা তাঁর পুত্র বিজয়সেনই সেন রাজবংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। পাল রাজগণের অধীন রাঢ় অঞ্চলের সামন্ত হিসেবে তিনি স্বীয় ক্ষমতার প্রসার ঘটান। তিনি সম্ভবত ১০৯৭ খ্রিষ্টাব্দে পিতার কাছ থেকে একটি বড়সড় জমিদারি পান।

রামপাল (১০৭৭-১১৩০ খ্রিষ্টাব্দ)-এর  রাজত্বকালে তিনি  রামপালের অধীনে সামন্তরাজা ছিলেন। রামপালের রাজ্যত্যাগের পর কুমারপাল ক্ষমতায় এলে, দক্ষিণবঙ্গে বিদ্রোহ হয়। এই বিদ্রোহ তিনি দমন করতে সক্ষম হন। এরপর কামরূপের তিমগাদেব বিদ্রোহ করে। কুমারপাল তাঁর প্রধাম অমাত্য বৈদ্যদেবকে এই বিদ্রোহ দমনের জন্য পাঠান। বৈদ্যদেব এই বিদ্রোহ দমন করে, কামরূপের রাজা হন। এ ছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ মাথা চাড়া উঠতে থাকে। ফলে পাল সাম্রাজ্য ক্রমে ক্রমে দুর্বল হতে থাকে। এই সুযোগে কলিঙ্গের রাজা অনন্তবর্মণ চোড়গঙ্গ পাল-সাম্রাজ্য আক্রমণ করে এবং হুগলী জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নেয়। অন্যদিকে গাহড়বাল-রাজ গোবিন্দচন্দ্র মগধ আক্রমণ করে পাটনা পর্যন্ত অগ্রসর হয়। এই অবস্থায় বিজয় সেন তাঁর অধীনস্থ সৈন্যবাহিনী শক্তিশালী করেন।

তিনি শূরবংশীয় রাজকন্যাকে বিলাসদেবীক বিবাহ করেন। সম্ভবত এই বিবাহের মাধ্যমে শূরবংশীয়দের নিকট হতে বিজয়সেন উত্তর ও দক্ষিণ রাঢ় লাভ করেন। বৈবাহিক সম্পর্ক ছাড়াও বিজয়সেন কুটনীতির মাধ্যমে কোনো কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্রের সঙ্গে সখ্যতা স্থাপন করে একদিকে নিরাপত্তা ও অন্যদিকে শক্তি বৃদ্ধি করেছিলেন। বিশেষ করে উড়িষ্যারাজ অনন্তবর্মণ চোড়গঙ্গের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে লাভবান হয়েছিলেন।

মিথিলার রাজা কর্ণাট দেশীয় নান্যদেব,
বঙ্গদেশ দখল করতে আসেন। একই উদ্দেশ্যে বিজয়সেনও অগ্রসর হন। ফলে দখলদারিত্ব নিয়ে দু’জনের মধ্যে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে নান্যদেব পরাজিত হয়ে বঙ্গ দখল করার আশা ত্যাগ করে মিথিলায় ফিরে যান। এই সময় মদনপাল (১১৪৪-১১৫২ খ্রিষ্টাব্দ) গৌড়ের রাজা ছিলেন। অন্যদিকে রাঘব ছিলেন উড়িষ্যার রাজা। কুমারপালের রাজত্বকালে কামরূপের তিমগাদেব বিদ্রোহ করেছিলেন। কুমারপাল তাঁর প্রধাম অমাত্য বৈদ্যদেবকে এই বিদ্রোহ দমনের জন্য পাঠান। বৈদ্যদেব এই বিদ্রোহ দমন করে, কামরূপের রাজা হন। মদনপালের রাজত্বকালে তিনি স্বাধীনভাবে কামরূপ শাসন করতে থাকেন। পালরাজ্যের এই দুর্দিনে বিজয়সেনকে প্রতিরোধ করার কোনো ক্ষমতা মদনপালের ছিল না।

দেওপাড়া লিপিতে উল্লিখিত আছে যে, পাশ্চাত্যচক্র ধ্বংস করার জন্য বিজয়সেনের নৌ-অভিযান গঙ্গা-নদীর উপর দিয়ে অগ্রসর হয়েছিল। এই অভিযান কার বিরুদ্ধে এবং কতটুকু সফল বা বিফল হয়েছিল জানা যায় না। সম্ভবত পাল ও গাহড়বাল এই দুই রাজশক্তির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। কিন্তু দেওপাড়া লিপি থেকে সফলতার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয়, বিজয়সেন তাঁর সমসাময়িক সামন্তরাজা বীর ও বর্ধনকে পরাভূত করে ও গৌড়রাজ মদনপালকে বিতাড়িত করে উত্তর বাংলা অধিকার করেন।

উড়িষ্যারাজ রাঘব, কামরূপরাজ বৈদ্যদেব এবং পাশ্চাত্য শক্তির বিরুদ্ধে বিজয়সেন কর্তৃক প্রেরিত নৌ-অভিযান প্রভৃতির সাফল্য বিতর্কিত বিষয় হয়ে আছে। বিজয়সেনের ব্যারাকপুর তাম্রশাসন বিক্রমপুরে উৎকীর্ণ হয়েছিল। এটিও তাঁর দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের ইঙ্গিত বহন করে। সম্ভবত সমতট অঞ্চলভুক্ত সুন্দরবনের খাড়িমণ্ডলে ভূমিদান করার বিষয় এতে বর্ণিত হয়েছে। তাও বিজয়সেনের দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় আধিপত্য বিস্তারের কথাই প্রমাণ করে। কিন্তু এই অঞ্চল কখন সেন সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল তা নিশ্চিতভাবে নিরূপণ করা সম্ভব নয়।

একাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ হতে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তীকাল পর্যন্ত এই অঞ্চলে বর্মণদের শাসন চলছিল। সুতরাং নিশ্চিত যে, দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো এক সময় বিজয়সেন বর্মণদের নিকট হতে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা অধিকার করে থাকবেন। আবদুল মোমিন চৌধুরী এই সময়কাল সুনির্দিষ্ট করে ১১৫৭-১১৫৯ খ্রিষ্টাব্দ বলে উল্লেখ করেছেন। ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সরকার দেওপাড়া প্রশস্তিতে উল্লিখিত বীরকে ভোজবর্মার উত্তরাধিকারী হিসেবে অনুমান করেছেন। কিন্তু মমিন চৌধুরী তা প্রত্যাখ্যান করে নির্দিষ্ট প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ অসমীচীন বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

দেওপাড়া শিলালিপিতে বিজয়সেন কর্তৃক সামরিক সাফল্য অর্জন ছাড়াও শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ ও দরিদ্রদের প্রতি তাঁর মহানুভবতার বিষয় উল্লেখ আছে। তিনি ব্রাহ্মণদের শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁর অনুগ্রহে ব্রাহ্মণগণ বিত্তশালী ও ধনবান হয়ে উঠেছিলেন। তিনি শৈব ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তিনি ‘পরম মাহেশ্বর, পরমেশ্বর, পরমভট্টারক, মহারাজাধিরাজ’প্রভৃতি উপাধি এবং ‘অধিরাজ বৃষভশঙ্কর’ গৌরবসূচক নামেও অভিষিক্ত হয়েছিলেন।

পাল সাম্রাজ্যের শেষ অধ্যায়ে পাল শাসনব্যবস্থার অবনতি ও পাল সম্রাটদের ক্ষয়িষ্ণু শক্তি বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেছিল, তিনি সেই অবস্থা থেকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।


সূত্র :
বাঙালির ইতিহাস (আদিপর্ব)। নীহাররঞ্জন রায়।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, খণ্ড-১। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
বাংলাদেশের ইতিহাস। রমেশচন্দ্র মজুমদার ।
বাঙ্গালা দেশের নামের পুরাতত্ত্ব। সুকুমার সেন।
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।