রামপাল
পাল রাজবংশের পঞ্চদশতম রাজা১০৭৭ খ্রিষ্টাব্দে পাল রাজবংশের চতুর্দশতম রাজদ্বিতীয় শূরপাল (১০৭৫-৭৭ খ্রিষ্টাব্দ)-এর রাজ্যত্যাগের পর, তাঁর কনিষ্ঠ ভাই রামপাল রাজত্ব লাভ করেন।

পাল রাজবংশের দ্বাদশতম রাজা তৃতীয় বিগ্রহপাল (১০৫৪-১০৭২ খ্রিষ্টাব্দ)-এর মৃত্যুর পর, তাঁর পুত্র দ্বিতীয় মহীপাল রাজত্ব লাভ করেন। মহীপাল রাজ্যের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন। ফলে প্রজা অসন্তোষ তীব্র আকার ধারণ করে। এরই ভিতরে তিনি কুচক্রীদের পরামর্শক্রমে তাঁর অপর দুই ভাই শূরপাল এবং রামপালকে কারারুদ্ধ করেন। এর ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলের সামন্তরা প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। মহীপাল এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য সামন্তদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। শেষ পর্যন্ত তিনি বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন। এই সুযোগে বরেন্দ্র অঞ্চলের উচ্চাভিলাসী দিব্য কৈবর্ত বরেন্দ্রভূমিতে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় মহীপাল-এর মৃত্যুর পর দ্বিতীয় শূরপাল ও রামপাল মুক্তিলাভ করেন। ১০৭৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শূরপাল রামপালের কাছে রাজ্যভার অর্পণ করেন।

রামপাল যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন উত্তর বাংলা এবং রাঢ় অঞ্চল কৈবর্ত্যরাজ দিব্যের অধীন। অন্যদিকে উত্তর বিহার মিথিলারাজ নান্যদেবের (১০৯৭-১১৫০ খ্রিষ্টাব্দ) অধিকারে ছিল। পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলা ছিল বর্মণরাজদের শাসনাধীন।

এই সময় দক্ষিণ বিহারের সামন্তরাও রামপালের অনুগত ছিল না। তাঁর সহায়ক ছিল শুধু পশ্চিম বাংলার সামন্তরা। রামপাল রাজত্ব লাভের পরও দিব্যর বিরুদ্ধে কোনো অভিযান চালান নি। ইতিমধ্যে দিব্য আরও শক্তিশালী হয়ে পালরাজ্যের অবশিষ্টাংশ দখলের উদ্যোগ নিলে, রাজ্যের শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ রাজ্য রক্ষার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই সময় সামন্তরা সৈন্য সংগ্রহ করা শুরু করেন। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রামপাল একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরি করতে সক্ষম হন। এই আয়োজনে রামপালের প্রধান সহায়ক ছিলেন তাঁর মাতুল রাষ্ট্রকূটকুলতিলক মথন। ইনি মহণ নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি এই কাজে তাঁর দুই পুত্র মহামাণ্ডলিক কাহ্নরদেব ও সুবর্ণদেব এবং ভ্রাতুষ্পুত্র মহাপ্রতীহার শিবরাজ প্রভৃতিকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। অপর যেসব সামন্তরাজ রামপালকে সৈন্যদ্বারা সাহায্য করেছিলেন, তাঁদের কয়েকজনের নাম রামচরিতে পাওয়া যায়। এঁরা হলেন

১. ভীমযশ: ইনি মগধ ও পীঠীর অধিপতি। রামচরিত থেকেই জানা যায় যে, তিনি একাকী কান্যকুব্জরাজের সৈন্যদের পরাস্ত করেছিলেন।

২. কোয়াটবীর রাজা বীরগুণ: রামচরিতের টীকাতে বীরগুণ সম্বন্ধে বলা হয়েছে ‘দক্ষিণ সিংহাসনে চক্রবর্তী’। নগেন্দ্রনাথ বসুর মতে এটি বিশাল অরণ্যানী-বেষ্টিত উড়িষ্যার গড়জাত প্রদেশ। আইন-ই-আকবরীতে এই স্থান কটক সরকারের অন্তর্গত ‘কোটদেশ’ বলেই অভিহিত হয়েছে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই মত সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু উড়িষ্যায় রামপালের বা তাঁর পিতার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত সামন্তশাসিত কোনো রাজ্য ছিল এর কোনো প্রমাণ নেই। বিষ্ণুপুরের পূর্বে কোটেশ্বর নামক গ্রামের সাথে এর নামসাদৃশ্য আছে। শ্রীযুক্ত পঞ্চানন মণ্ডলের মতে অজয় নদের দক্ষিণ তীরে বর্ধমান জেলার ও আউসগ্রাম থানার অন্তর্গত ভল্কীকোট গ্রামই প্রাচীন কোটাটবী, কারণ এই অঞ্চলকে এখনও কোটার জঙ্গল বলা হয়।

৩. দণ্ডভুক্তির রাজা জয়সিংহ। দণ্ডভুক্তি মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণভাগে অবস্থিত ছিল। ইনি উড়িষ্যার রাজা কর্ণকেশরীকে পরাজিত করেছিলেন।

৪. বিক্রম: রামচরিতে শুধু এই নামটি আছে, টীকাতে এঁকে বিক্রমরাজ বলা হয়েছে। টীকাকারের ভাষ্যে ‘দেবগ্রাম প্রতিবদ্ধ’ ও ‘বালবলভী তরঙ্গ’, এই দুইটি শব্দ আছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এর অর্থ করেছিলেন যে বিক্রমরাজ দেবগ্রামের রাজা ছিলেন এবং এর চারিপার্শ্ব বালবলভী দেশের নদী দ্বারা বেষ্টিত ছিল। তাঁর মতে বালবলভী প্রাচীন বাগড়ীর (মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা) নাম। শ্রীরাধাগোবিন্দ বসাক বলেন যে, বালবলভী একটি নদীর নাম এবং বিশাল তরঙ্গ-বহুল নদীদ্বারা বেষ্টিত থাকায় রাজধানী দেবগ্রাম সুরক্ষিত ছিল। দেবগ্রামের অবস্থিতি সম্পর্কে কেউ কেউ ধারণা করেন: কলিকাতা-লালগোলা রেলওয়ে লাইনে কলিকাতার শিয়ালদহ স্টেশন হতে ১৪০ কিলোমিটার দূরে দেবগ্রাম নামক স্টেশনের আধ মাইল দূরে দেবগ্রাম নামক গ্রামই খুব সম্ভব প্রাচীন দেবগ্রাম।

৫. ‘নগেন্দ্রনাথ বসু নদীয়া জেলার একটি গ্রামকে চিহ্নিত করেছেন। রমেশচন্দ্র মজুমদার দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার সুবর্ণরেখা নদীর মুখে পিপলী গ্রামকে চিহ্নিত করেছেন। ‘বর্ধমানের পুরাকথা’ নামক গ্রন্থে এই স্থানের অনেক প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের বিবরণ আছে।

৬. লক্ষ্মীশূর: তিনি হুগলী জেলার অন্তর্গত অপারমন্দারের অধিপতি ছিলেন। শ্রীপঞ্চানন মণ্ডলের মতে, বর্তমান গড়মান্দারণ নামক গ্রাম হুগলী জেলার আরামবাগ হতে নয় মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। নলিনী দাশগুপ্ত এই মত গ্রহণ করেন নি। তাঁর মতে বর্তমান দেওঘর, বৈদ্যনাথ এবং অপর মন্দার অর্থাৎ ভাগলপুরের ৩০ মাইল দক্ষিণে মন্দার পর্বতের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে অবস্থিত অরণ্যসঙ্কুল ‘অপর-মন্দার’ প্রদেশেই লক্ষ্মীশূরের রাজ্য ছিল। প্রথম মহীপালের সমসাময়িক রণশূর দক্ষিণ রাধা শাসন করতেন। লক্ষ্মীশূর আর রণশূর এক বংশীয় হতে পারেন। বিজয়সেন যে শূর বংশে বিবাহ করেছিলেন, হয়তো এরাই সেই বংশের। জানা যায় যে, লক্ষ্মীশূর পার্বত্য এলাকার সামন্তদের প্রধান ছিলেন।

৭. কুব্জবটির রাজা শূরপাল: কুব্জবটি সাঁওতাল পরগনার অন্তর্ভুক্ত নয়া দুমকার ১৪ মাইল উত্তরে অবস্থিত ছিল।

৮. তৈলকম্পের (মানভূম) রাজা রুদ্রশিখর: বিহারের মানভূম জেলার তেলকুপিই প্রাচীন তৈলকম্প।

৯. উচ্ছালের রাজা ভাস্কর অথবা মদকলসিংহ: পূর্বে বীরভূম জেলার অন্তর্গত ‘জৈনউঝিয়াল’ পরগনার নামই উচ্ছাল বলে গৃহীত হতো। শ্রীপঞ্চানন মণ্ডলের মতে, এটি বর্ধমান জেলার উছলান গ্রাম। এটিই অধিকতর সঙ্গত বলে মনে করেছেন ঐতিহাসিক মজুমদার, কিন্তু অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেছেন।

১০. ঢেক্করীরাজ প্রতাপসিংহ: কাটোয়ার নিকটবর্তী বর্ধমান জেলায় অবস্থিত বলে জানা যায়।

১১. কয়ঙ্গলমণ্ডলের অধিপতি নরসিংহাসর্জুন: এর বর্তমান নাম কাঙ্গজোল- এটি বর্তমান রাজমহলের ২০ মাইল
দক্ষিণে অবস্থিত।

১২. সঙ্কটগ্রামের রাজা চণ্ডার্জুন: শ্রীপঞ্চানন মণ্ডলের মতে বর্ধমান জেলার রায়না থানার অন্তর্গত সংকট নামক গ্রাম হতে শক্তিগড় পর্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগই প্রাচীন সংকট রাজ্য। আইন-ই-আকবরীতে সাতগাঁও সরকারের অন্তর্গত সকোট পরগনার উল্লেখ পাওয়া যায়। সম্ভবত বল্লাল চরিতের সংককোট এবং তবকাত-ই-নাসিরীর সঙ্কনাৎ ও এই সংকট গ্রাম অভিন্ন।

১৩. নিদ্রাবলীর রাজা বিজয়রাজ: সম্ভবত সেনবংশীয় রাজা বিজয় সেন। বিজয় সেন ও বিজয়রাজ অভিন্ন বলে গ্রহণ করলে নিদ্রাবলী পশ্চিম বাংলায় অবস্থিত ছিল। বল্লালসেন নৈহাটী তাম্রশাসন থেকে আমরা জানতে পারি যে, তাদের পূর্বপুরুষ রাধা রাজ্যে প্রথমে বসতি স্থাপন করে।

১৪. কৌশাম্বীর রাজা দ্বোরপবর্ধন: কৌশাম্বী সম্ভবত রাজশাহী অথবা বগুড়া জেলায় অবস্থিত ছিল। কেউ কেউ একে ভাগীরথীর পূর্ববতীরে কলিকাতার দক্ষিণে অবস্থিত বলে মত প্রকাশ করেছেন। শ্রীপঞ্চানন মণ্ডল বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার অন্তর্গত কুসুমগ্রামই রামচরিতের কোশাম্বী বলে মত প্রকাশ করেছেন।

১৫. পদুবন্বার রাজা সোম: ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ হুগলী, পাবনা অথবা দিনাজপুর চিহ্নিত করেছেন। খুব সম্ভব হুগলী জেলার অন্তর্গত পাউনান পরগনা প্রাচীন পদুবন্বার স্মৃতি বহন করছে বলে আচার্য মজুমদার চিহ্নিত করেছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মনে করেন, বর্তমান পাবনা নগরীর প্রাচীন নাম হতে পারে।

যদি কোশাম্বী রাজশাহী বা বগুড়া জেলায় এবং পদুবন্বা পাবনায় ছিল বলে অনুমান করা যায়, তাহলে বলতে হবে যে, বরেন্দ্রী বা উত্তর বাংলা ভীমের হলেও এর কোনো কোনো সামন্তরাজ রামপালের কূটনীতিতে তাঁর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। এর ফলে ভীম খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। অথবা এরূপও হতে পারে যে দিব্য বা ভীম কেউই সমগ্র উত্তরবঙ্গে স্বীয় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি। সামন্তরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্তভাবে দিব্যের বিদ্রোহের পরও রামপালের অনুরক্ত ছিলেন। এই সমুদয় সম্পন্ন করার পর দিব্য হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেন। এরপর বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজা হন দিব্যের পুত্র ভীম।

রামপাল সম্ভবত বঙ্গ থেকে ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন। সমস্ত সামন্তরাজ্যের সৈন্য একত্র করে তিনি প্রথমে মহাপ্রতীহার শিবরাজকে একদল সৈন্যসহ প্রেরণ করেন। এই সৈন্যদল পদ্মা বা গঙ্গা নদী পার হয়ে বরেন্দ্রভূমি বিধ্বস্ত করে। এভাবে গঙ্গার উত্তর তীর সুরক্ষিত করে রামপাল তাঁর বিপুল সৈন্যসহ নদী পার হয়ে বরেন্দ্রভূমি আক্রমণ করেন। এবার কৈবর্তরাজ ভীম সসৈন্যে রামপালকে বাধা দিলেন এবং দুই দলে ভীষণ যুদ্ধ হলো। রামচরিতে নয়টি শ্লোকে এই যুদ্ধের বর্ণনা আছে। রামপাল ও ভীম উভয়েই বিশেষ বিক্রম প্রদর্শন করেন এবং পরস্পরের সম্মুখীন হয়ে যুদ্ধ করেন। কিন্তু হস্তীপৃষ্ঠে যুদ্ধ করতে করতে দৈববিড়ম্বনায় ভীম বন্দী হলেন। এর ফলে তাঁর সৈন্যদল ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। হরি নামক তাঁর এক সুহৃদ পুনরায় তাঁর সৈন্যগণকে একত্র করে যুদ্ধ করেন এবং প্রথমে কিছু সফলতাও লাভ করেন। তথাপি পরিশেষে রামপালেরই জয় হয়।

রামপাল প্রথমে ভীমের সাথে সদ্ব্যবহার করেছিলেন। এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ রামচরিতে অনুসরণ করা কষ্টকর, এজন্য যে এখানে টীকাকারের ভাষ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু পরে ভীমকে বধ্যভূমিতে নিয়ে প্রথমে তাঁর সম্মুখেই পরিজনবর্গকে হত্যা করা হয়। তারপর বহু শরাঘাতে ভীমকেও বধ করা হয়। এর ভিতর দিয়ে বরেন্দ্র বিদ্রোহের অবসান ঘটে।

বরেন্দ্র অঞ্চল অধিকারের পর রামপাল এর শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি প্রজার করভার লাঘব ও কৃষির উন্নতি বিধান করলেন। এরপর তিনি রামাবতী নামক নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করলেন। পালবংশের রাজ্যের শেষ পর্যন্ত রামাবতীই রাজধানী ছিল। রামচরিত-এ এর ঐশ্বর্যের ও সৌন্দর্যের বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায়।

বিক্রমপুরের বর্মরাজ সম্ভবত বিনা যুদ্ধেই রামপালের বশ্যতা স্বীকার করেন। রামচরিতে বর্ণিত্যক্ত হয়েছে যে, পূর্বদেশীয় বর্মরাজ নিজের পরিত্রাণের জন্য উৎকৃষ্ট হস্তী ও স্বীয় রথ উপঢৌকন দিয়ে রামপালের আরাধনা করলেন। যুদ্ধে বিজিত হয়ে কামরূপরাজ তিমঞ্জদেব অধীনতা স্বীকার করলেন। পালের মন্ত্রী বৈদ্যদেব এই যুদ্ধের সেনাপতি ছিলেন। তিনি কামরূপ জয় করে ফিরে এলে রামপাল তাঁকে বহু সম্মানদানে আপ্যায়িত করলেন।

এরপর তিনি বাংলার দক্ষিণাঞ্চলের দিকে অগ্রসর হন। শুরুতেই রাঢ়দেশের সামন্তরা রামপালের অধীনতা স্বীকার করেছিলেন। তাঁদের সাহায্যে রামপাল উড়িষ্যা অধিকার করেন। এই সময় উড়িষ্যার রাজনৈতিক অবস্থা বিশেষ শোচনীয় হয়ে উঠেছিল। দক্ষিণ হতে গঙ্গরাজগণ বার বার আক্রমণ করে একে বিপর্যস্ত করছিলেন। রামপালের সামন্তরাজ দণ্ডভুক্তির অধিপতি জয়সিংহ রামপালের বরেন্দ্র অভিযানে যোগ দেয়ার পূর্বেই উৎকলরাজ কর্ণকেশরীকে পরাজিত করেছিলেন। গঙ্গরাজগণ উৎকল অধিকার করলে বাংলাদেশর সমূহ বিপদ হতে পারে, এই আশঙ্কাতেই সম্ভবত রামপাল নিজের মনোনীত একজনকে উৎকলের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করলেন। ঠিক অনুরূপ কারণেই অনন্তবর্মা চোড়গঙ্গ রাজ্যচ্যুত উৎকলরাজকে আশ্রয় দিলেন। এভাবে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজার রক্ষকরূপে উৎকলের অধিকার নিয়ে রামপাল ও অনন্তবর্মার মধ্যে বহুদিনব্যাপী যুদ্ধ চলেছিল। রামচরিত অনুসারে রামপাল উৎকল জয় করে কলিঙ্গদেশ পর্যন্ত স্বীয় প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। অনন্তবর্মার লিপি হতে জানা যায়, ১১৩৫ অব্দের অনতিকাল পূর্বে তিনি উড়িষ্যা জয় করে স্বীয় রাজ্যভুক্ত করেন।

কিন্তু রামপালের রাজত্বকালেই আর্যাবর্তে কর্ণাটের রাজার প্রভুত্ব বিস্তার করতে সক্ষম হয়ে। কর্ণাটের দুইজন সেনানায়ক পালসাম্রাজ্যের সীমার মধ্যে দুটি রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমটি রাঢ়দেশের সেনরাজ্য। রামপালের জীবিতকালে এটি খুব শক্তিশালী ছিল না। কিন্তু কর্ণাটবীর নান্যদেব একাদশ শতাব্দের শেষ ভাগে (আনুমানিক ১০৯৭ খ্রিষ্টাব্দ) মিথিলায় একটি স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। মিথিলা প্রথম মহীপালের সময় পালরাজ্যভুক্ত ছিল। নান্যদেবের সাথে গৌড়াধিপের সংঘর্ষ হয়। এই গৌড়াধিপ সম্ভবত রামপাল, কারণ রামপালকে পরাজিত না করে কোনো কর্ণাটবীর মিথিলায় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, এটি সম্ভবপর বলে মনে হয় না। সুতরাং কর্ণাটের লোলুপ দৃষ্টি এ সময় বাংলার বিশেষ শঙ্কা ও উদ্বেগের কারণ হয়েছিল। রামপালের জীবিতকালে বাংলা জয় করতে পারেন নি এবং সেনরাজারাও মাথা তুলতে পারেন নি।

১১৩০ খ্রিষ্টাব্দে বার্ধক্যজনীত কারণে সিংহাসন ত্যাগ করেন। এরপর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র কুমারপাল


সূত্র :
বাংলাদেশের ইতিহাস/রমেশচন্দ্র মজুমদার।
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।