কুতুবউদ্দিন আইবক
ইংরেজি: Qutb -ud-din Aibak
ভারতবর্ষে আদি তুর্কি শাসনের তুর্কি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।

বাল্যাবস্থায় এক ক্রীতদাস ব্যবসায়ীরা কুতুব উদ্দিনকে তুরস্ক থেকে পারশ্যের নিশাপুর নামক স্থানে নিয়ে আসে। নিশাপুরের একজন বিচারক (কাজি) তাঁকে ক্রয় করেন। এই বিচারক তাঁকে পুত্রের মতো প্রতিপালন করেন। এখানে তিনি সাহিত্য ও সমরকৌশল শিক্ষালাভ করেন। এই কাজির মৃত্যুর পর, কাজির পরিবারের লোকজন তাঁকে মোহম্মদ ঘোরীর কাছে বিক্রয় করেন। মোহম্মদ ঘোরী তাঁর সামরিক প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে, তাঁকে তাঁর সেনাবহিনীর একটি শাখার অধিনায়ক করে দেন। ১১৯১ খ্রিষ্টাব্দে তরাইনের প্রথম যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ ভারতের অন্যান্য রাজপুত রাজাদের সাহায্য নিয়ে মোহম্মদ ঘোরীকে পরাস্ত করেন। এই সময় তিনি ঘোরীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করেন। ১১৯২ খ্রিষ্টাব্দে মোহম্মদ ঘোরী একটি বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এই যুদ্ধে পৃথ্বীরাজকে পরাজিত ও নিহত হন। ফলে দিল্লী ও আজমীর মোহম্মদ ঘোরীর দখলে আসে। এরপর তিনি মিরাট, বুলান্দগড়, এবং আলিগড় অধিকার করেন। পরের বার ভারত অভিযানে এসে মোহম্মদ ঘোরীর কনৌজ রাজ্যও জয় করে নেন । ধীরে ধীরে গুজরাট, গোয়ালিয়র, বারানসী, বুন্দেলখন্ড, প্রভৃতি তাঁর অধিকারে আসে । এমনকি বাংলা পর্যন্তও তাঁর অধিকার বিস্তৃত হয় ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে আততায়ীর হাতে মোহম্মদ ঘোরীর নিহত হন। এই সূত্রে কুতুবুদ্দিন আইবক রাজত্ব লাভ করেন।

মোহম্মদ ঘোরীর অধিকাংশ সময়ে রাজ্য জয়ের নেশায় যুদ্ধ বিগ্রহের ভিতরে কাটাতেন। ফলে রাজ্যের প্রকৃত শাসক হয়ে উঠেছিলন কুতুব উদ্দিন। সে কারণেই দেখা যায়, ১২০১-০২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বখতিয়ার খলজি প্রচুর ধন-সম্পদসহ কুতুবুদ্দিন আইবক-র সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁকে বহুমূল্যবান উপহার প্রদান করেন। কুতুবুদ্দিন আইবক তাঁকে বিশেষভাবে সম্মানিত করেন এবং বিহারের ওই অঞ্চল শাসনের অনুমতি দেন। এক্ষেত্রে কুতুব উদ্দিন মোহম্মদ ঘোরীর অনুমোদনের প্রয়োজন মনে করেন নি। বিহারে ফিরে বখতিয়ার খলজি সৈন্য সংগ্রহ করার দিকে মনোযোগ দেন। অচিরেই অর্থের দ্বারা তিনি একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরি করতে সক্ষম হন। ১২০৪-০৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি বাংলা আক্রমণের জন্য ঝাড়খণ্ডের ভিতর দিয়ে নদীয়ার দিকে অগ্রসর হন। এরপর তিনি বাংলার সেনবংশের রাজা লক্ষ্মণসেন (১১৭৯-১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ)-এর নদীয়া আক্রমণ করে দখল করে নেন। ঘোরীর একটি স্বর্ণমুদ্রায় এর তারিখ উল্লেখ আছে ৬০১ হিজরী সনের ১৯শে রমযান। গ্রেগোরিয়ান পঞ্জিকা মতে সময়টা দাঁড়ায় ১০ই মে, ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ। এই সময় বখতিয়ার খলজি কুতুবউদ্দিন আইবক-এর অনুগত ছিলেন। ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দে বখতিয়ার খলজি মৃত্যুর পর, গৌড়ে যে কয়জন খলজি শাসক বাংলা শাসন করেছেন, তাঁরা প্রত্যকেই কুতুব উদ্দিনের অনুগ্রহভাজন ছিলেন।

১২০৭ খ্রিষ্টাব্দে লক্ষ্মণাবতীর প্রভাবশালী আমিররা মহম্মদ সিরান খলজিকে গৌড়ের রাজা হিসেবে নির্বাচিত করেন। দেশে শান্তি ফিরে আসার পর মহম্মদ সিরান খলজিআলী মার্দান খলজিকে মুক্ত করে দেন। মুক্তি পাওয়ার পর আলী মার্দান দিল্লীতে কুতুব-উদ্দিনের রাজদরবারে যান এবং বাংলা আক্রমণের জন্য উত্তেজিত করতে থাকেন। অবশেষে কতুবউদ্দীন বাংলা দখলের জন্য সৈন্য পাঠান। এই সময় তাঁর আমিরদের বিশ্বাস ঘাতকতায় কুতুবউদ্দিনের সৈন্যরা জয়লাভ করতে সক্ষম হয়। ১২০৮ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীর সুলতানের মনোনীত প্রার্থী হুসাম উদ্দিন আইওয়াজ গৌড়ের রাজা হন। এই বৎসরই কুতুব উদ্দিন সুলতান উপাধি গ্রহণ করেন। এই কারণে কুতুবউদ্দিনকেই দিল্লীর প্রথম সুলতানের মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকে। এই সময় নাসির উদ্দিন কুবাচা মুলতানের শাসক ছিলেন। আন্য দিকে তাজউদ্দিন কিরমানের শাসনকর্তা ছিলেন। মোহম্মদ ঘোরীর মৃত্যুর পর তাজউদ্দিন গজনী দখল করে নেন।

১২০৮ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীতে কুতুব উদ্দিন যখন সুলতান উপাধি গ্রহণ করেন, সে সময় খারাজিম শাহ গজনী দখল করে নেন। এই সুযোগে কুতুব উদ্দিন সহজেই গজনী দখল করেন। কিছুদিন গজনী দখলে রাখার পর গজনীর সাধারণ মানুষের অসন্তোষ লক্ষ্য করে বিরক্ত হন। এই সময় গজনীর আমিররা তাজউদ্দিনকে ক্ষমতা প্রদানের জন্য গোপনে প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। বিষয়টি বুঝতে পরে, কুতুব উদ্দিন গজনী ত্যাগ করেন। সম্ভবত এরপর থেকে কুতুব উদ্দিন পুরোপুরি স্বাধীনভাবেই দিল্লী শাসন করেছেন। কুতুব উদ্দিন নতুন রাজ্য দখলের পরিবর্তে রাজ্যশাসনের দিকে নজর দেন।

এই সময় আলী মার্দান দিল্লীতে কুতুব-উদ্দিনের সাথে থেকে নানাভাবে সাহায্য করেন। বিশেষ করে কুতুব-উদ্দিনের গজনী অভিযানে তিনি তাঁর প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেন। এই সূত্রে কুতুব উদ্দিন তাঁকে বাংলার শাসন কর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। ১২১০ খ্রিষ্টাব্দে আলী মার্দান এক বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে বাংলার অভিমুখে রওনা দেন। কিন্তু হুসাম উদ্দীন আইওয়াজ তাঁর সাথে যুদ্ধ করার পরিবর্তে অভ্যর্থনা করে লক্ষ্মণাবতীতে নিয়ে আসেন। ফলে আলী মার্দান গৌড়ের নতুন শাসনকর্তা হন।

বাংলার অধিকার অক্ষুণ্ণ রেখেই কুতুব উদ্দিন ১২১০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যবরণ করেন। এরপর তাঁর পোষ্য পুত্র আরাম শাহ নিজেকে দিল্লীর সুলতান ঘোষণা করেন ও দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু তাঁর অযোগ্যতা লক্ষ্য করে দিল্লীর আমির-ওমরাহগণ লতুৎমিসকে দিল্লীর সিংহাসন গ্রহণে আমন্ত্রণ জানান। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে ১২১১ খ্রিষ্টাব্দে লতুৎমিস আরাম শাহকে পরাজিত করে দিল্লীর সিংহাসন দখল করেন।

কুতুব উদ্দিন তিনি দিল্লির বিখ্যাত কুতুবমিনার -এর নির্মাণ পরিকল্পনা ও নির্মাণকার্য শুরু করেন। কিন্তু এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিল লতুৎমিস-এর সময়। এই মিনার সুফি সন্ত খাজা কুতুবউদ্দিন কাকীর সম্মানে নির্মিত হয়েছিল । 


সূত্র :
বাংলাদেশের ইতিহাস/রমেশচন্দ্র মজুমদার।
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।