মহম্মদ ঘোরী
ঘোর রাজবংশ-এর
সুলতান।
১১৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ঘোর-রাজ্যের গিয়াস উদ্দিন মহম্মদ গজনী দখল করে পূর্ণ অধিকারে
আনতে সক্ষম হন। এরপর তিনি তাঁর ভাই মুইজ উদ্দিন মহম্মদকে গজনীর শাসন কর্তা নিযুক্ত
করেন। এই মুইজ উদ্দিন মহম্মদই ভারতের ইতিহাসে মোহম্মদ ঘোরী
নামে পরিচিতি লাভ করেন।
ঘোরী গজনীর শাসনকর্তা হওয়ার পর, ভারত আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি
তাঁর সৈন্যবাহিনীকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলেন। এরপর তিনি ১১৭৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম
মুলতান আক্রমণ করে, ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের রাজ্য দখল করেন। এরপর ১১৭৬ খ্রিষ্টাব্দে
উচ্ নামক এক হিন্দুরাজার দুর্গ আক্রমণ করেন। কথিত আছে সেখানকার রানীর
বিশ্বাসঘাতকতায় ঘোরী ওই দুর্গ দখল করতে সক্ষম হন। ১১৭৯ খ্রিষ্টাব্দে পেশোয়ার
আক্রমণ করে সেখানকার জনৈক গজনীর শাসনকর্তাকে পরাজিত করেন। এরপর দুই বৎসর তিনি তাঁর
শক্তি বৃদ্ধির জন্য ব্যয় করেন। ১১৮১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জম্মুর হিন্দুরাজা তাঁর
রাজ্য আক্রমণ করলে, তিনি ওই রাজাকে পরাস্ত করেন। এই সূত্রের লাহোরের গজনী শাসনকর্তা
খসরু শাহ তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেন। এরপর তিনি ১১৯১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি দিল্লী
ও আজমীঢ়ের চৌহান বংশীয় রাজা তৃতীয় পৃথ্বীরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এই সময়
পাঞ্জাবের সকল রাজা পৃথ্বীরাজ্যের পক্ষালম্বন করেন। একমাত্র কনৌজ-রাজ জয়চাঁদ
নিরপেক্ষ থাকেন। কথিত আছে পৃথ্বীরাজ জয়চাঁদের কন্যা সংযুক্তাকে স্বয়ংবর সভা থেকে
অপহরণ করে নিয়ে যান। ১১৯১ খ্রিষ্টাব্দে থানেশ্বরের নিকটবর্তী তরাইন নামক স্থানে উভয়
বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়। ইতিহাসে একে প্রথম তরাইনের যুদ্ধ বলা হয়। এই যুদ্ধে মহম্মদ
ঘোরী পরাজিত হন এবং স্বদেশে ফিরে যান। এরপর ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে ঘোরী পুনরায়
পৃথ্বীরাজের রাজ্য আক্রমণ করেন। এবারও ওই তরাইনের প্রান্তরেই যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধকে
বলা হয় তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ এবং সম্মিলিত রাজপুত বাহিনী
পরাজিত হন এবং পৃথ্বীরাজ নিহত হন। এই যুদ্ধের পর দিনি হ্যান্সি, সামান, খুরম
ইত্যাদি দুর্গ দখল করেন। এরপর তিনি আজমীঢ় দখল করেন। পরে তিনি পৃথ্বীরাজের এক
পুত্রকে করদরাজ্য হিসেবে আজমীঢ় প্রদান করেন। এরপর এই বৎসরেই তিনি তাঁর এক বিশ্বস্ত
অনুচর 'কুতুবউদ্দিন'-এর কাছে বিজিত রাজ্যের শাসনভার তুলে দিয়ে দেশে ফিরে যান।
ঘোরীর অবর্তমানে ১১৯২ খ্রিষ্টাব্দে কুতুব উদ্দিন মিরাট,
দিল্লী, রথোম্ভোর ইত্যাদি অঞ্চল দখল করেন এবং তাঁর রাজ্যের রাজধানী করেন দিল্লী।
১১৯৪ খ্রিষ্টাব্দে ঘোরী আবার ভারতবর্ষে আসেন এবং জয়চাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা
করেন। এই যুদ্ধে জয়চাঁদ পরাজিত ও নিহত হন। এরপর ঘোরী বারানসী আক্রমণ করে তা
দখল করেন এবং নগরীটি বিধ্বস্ত করেন। এই সময়
মুহম্মদ
ঘোরীর
সৈন্যরা সারনাথের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা করে এবং
সারনাথের
সকল বৌদ্ধ স্থাপনা ধ্বংস
করে ফেলে। উল্লেখ্য,
খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত
সারনাথ
ছিল বৌদ্ধ শিক্ষা-দানের
অন্যতম স্থান। এখানে ২১০ ফুট উঁচু বিহার, ৩৬টি মন্দির এবং হীনযান বৌদ্ধদের প্রায়
১৫০০ স্তূপ ছিল। এই আক্রমণ থেকে সৌভাগ্যক্রমে অশোকের ধর্মরাজিকা স্তূপটি রক্ষা পেয়েছিল।
১২০৩ খ্রিষ্টাব্দে ঘোরীর ভাই গিয়াসউদ্দীন
মৃত্যুবরণ করেন। এরফলে তিনি ঘোর, গজনী, দিল্লী-সহ এবং তাঁর অধিকৃত সকল অংশের সুলতান
হন। এরপর ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মধ্য এশিয়ার খোয়ারাজম অঞ্চল আক্রমণ করেন। এই
যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়ে সন্ধি করতে বাধ্য হন। এই পরাজয়ের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে, তাঁর
অধিকৃত অনেক অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দেয়। এদের ভিতর গজনী ও পাঞ্জাব অঞ্চলের রায়সাল-এর
নেতৃত্বে খোকরজাতির লোকেরা লুটতরাজ চালাতে থাকে। এই সময় তিনি খোকরদের আক্রমণ করে,
তাদের কঠোরভাবে দমন করেন। এরপর তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তনকালে ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে
আততায়ীর হাতে নিহত হন।
ঘোরীর