ইলতুৎমিস
ভারতবর্ষে আদি তুর্কি শাসনের দ্বিতীয় সুলতান।

প্রথম জীবনে তিনি ক্রীতদাস ছিলেন। গজনীতে জামিল উদ্দিন নামক এক বণিকের কাছ থেকে কুতুবুদ্দিন আইবক তাঁকে ক্রয় করেন। তিনি অল্প দিনের ভিতরে সমরবিদ্যায় দক্ষ হয়ে উঠেন। দৈহিক সৌন্দর্য এবং গুণের জন্য মুগ্ধ হয়ে কুতুবুদ্দিন আইবক তাঁর মেয়ের সাথে ইলতুৎমিসের বিবাহ দেন। এরপর তাঁকে
বদাউনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। ১২১০ খ্রিষ্টাব্দে কুতুবুদ্দিন আইবক মৃত্যবরণ করলে, তাঁর পোষ্য পুত্র আরাম শাহ নিজেকে দিল্লীর সুলতান ঘোষণা করেন ও দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু তাঁর অযোগ্যতা লক্ষ্য করে দিল্লীর আমির-ওমরাহগণ ইলতুৎমিসকে দিল্লীর সিংহাসন গ্রহণে আমন্ত্রণ জানান। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে ১২১১ খ্রিষ্টাব্দে ইলতুৎমিস আরাম শাহকে পরাজিত করে দিল্লীর সিংহাসন দখল করেন।

সিংহাসনে আরোহণ পর ইলতুৎমিসকে কয়েকটি বিদ্রোহ দমনের দিকে মনোযোগ দিতে হয়। প্রথমেই তিনি দিল্লির আমির-ওমরাহদের দমন করে নিজ সিংহাসন সুরক্ষিত করেন ও বদাউন, অযোধ্যা, বারানসী ও শিবালিকে নিজ কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করেন । ১২১৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তাজউদ্দিন ইলদিজকে তরাইনের যুদ্ধে পরাজিত করে বন্দী করেন। পরে কারাগারে তাঁকে হত্যা করা হয়। ১২১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নাসিরউদ্দিন কুবাচাকে লাহোর থেকে বিতাড়িত করেন। নাসিরউদ্দিন কুবাচা এই সময় সিন্ধু প্রদেশে আশ্রয় নেন। নাসিরউদ্দিন কুবাচাকে শায়েস্তা করার জন্য তিনি সিন্ধু প্রদেশে আক্রমণ করেন। উপায়ন্তর না দেখে নাসিরুদ্দিন আত্মহত্যা করেন। ফলে সহজেই সিন্ধু ইলতুৎমিসের অধিকারে আসে।

১২২১ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে ইলতুৎমিস ছোটো বড় আরও কিছু বিদ্রোহ দমন করেন। এই সময় (১২২১ খ্রিষ্টাব্দ) মোঙ্গলনেতা চেঙ্গিশ খান খারাজিম রাজ্য আক্রমণ করেন। এই আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়ে সেখানকার শাসক কাস্পিয়ান সাগরের দিকে পালিয়ে যান। অন্যদিকে যুবরাজ জালাল উদ্দিন মাঙ্গবার্নী পাঞ্জাবে আশ্রয় নেন। চেঙ্গিশ খান তাঁকে অনুসরণ করে সিন্ধু পর্যন্ত অগ্রসর হন। এই সময় চেঙ্গিশ খান পশ্চিম-পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালান। উপায়ান্তর না দেখে মাঙ্গবার্নী ইলতুৎমিসের সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু মাঙ্গবার্নীকে সাহায্য করতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনার পক্ষাপাতী ছিলেন না। তাই তিনি মাঙ্গবার্নীর প্রার্থনা নাকোচ করে দেন। এর ফলেচেঙ্গিশ খানা সন্তুষ্ট হয়ে, ইলতুৎমিসের রাজ্য আক্রমণ না করে, ভারত ত্যাগ করেন।

চেঙ্গিশ খানের ভারতত্যাগের পর তিনি এরপর তিনি বাংলার দিকে নজর দেন। উল্লেখ্য ১২১০ খ্রিষ্টাব্দে  কুতুবুদ্দিন আইবকের মৃত্যুর পর, তাঁর উত্তরাধিকারদের মধ্যে গোলোযোগ সৃষ্টি হয়। এই সুযোগে আলী মার্দান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ক্রমে ক্রমে তিনি অত্যাচারী সুলতান হয়ে উঠেন, ফলে বাংলার খলজি আমিররা যড়যন্ত্র করে তাঁকে হত্যা করে এবং নতুন সুলতান হিসেবে হুসাম উদ্দীন আইওয়াজ  সিংহাসনে বসেন। ১২১৩ খ্রিষ্টাব্দে নতুন সুলতান হিসেবে নাম গ্রহণ করেন হুসাম-উদ্দিন আইওয়াজ গিয়াস উদ্দিন আইওয়াস। তিনি নিজের নামে মুদ্রা প্রচলন করেন। তিনি নানাবিধ সংস্কার করে রাজ্যের ভিতর শান্তিস্থাপন করতে সমর্থ হন। ১২২৫ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীর সুলতান ইলতুৎমিস বাংলা ও বিহার দখলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। বিহারে উভয় বাহিনী মুখোমুখী হলে শান্তি চুক্তি হয়। এই চুক্তি বলে, হুসাম উদ্দীন আইওয়াজ দিল্লীর অনুগত্য স্বীকার করে নেন। ফলে বাংলার শাসনকর্তা হিসেবে তিনি থেকেই যান এবং ইলুৎমিশ দিল্লীতে ফিরে যান।

১২২৬ খ্রিষ্টাব্দে ইলতুৎমিস রথোম্ভর জয় করেন। এই সময় বাংলায় হুসাম উদ্দীন আইওয়াজ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ফলে, তাঁকে শায়েস্তা করার জন্য, ইলতুৎমিশ তাঁর পুত্র নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি সেনাবাহিনী পাঠান। ১২২৭ খ্রিষ্টাব্দে উভয় বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হলে, আইওয়াজ সপরিবারে নিহত হন। এই সময় নাসির উদ্দিন বাংলার শাসনকর্তা মনোনীত হন। এই সময় তিনি অযোধ্যাকে বাংলার সাথে যুক্ত করেন। ১২২৯ খ্রিষ্টাব্দে নাসিরুদ্দিনের মৃত্যুর পর,  হুসাম উদ্দীন আইওয়াজ-এর বল্কা নামক এক অনুচর নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা দেন। ফলে ১২৩০ খ্রিষ্টাব্দে ইলতুৎমিস পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। যুদ্ধে বল্কা পরাজিত ও নিহত হন। এরপর আলাউদ্দিন জনিকে বাংলা শাসনকর্তা নিযুক্ত করে আবার দিল্লীতে ফিরে যান।

১২৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি গোয়ালিয়র অধিকার করেন। ১২৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মালব অধিকার করেন। এই সময় উজ্জয়িনীর বিখ্যাত মহাকালের মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর কন্যা রাজিয়া সিংহাসনে বসেন।

ইলতুৎমিসের সন্তানাদি


সূত্র :
বাংলাদেশের ইতিহাস/রমেশচন্দ্র মজুমদার।
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।