শশাঙ্ক
শশাঙ্ককে বঙ্গদেশের প্রথম সার্বভৌম রাজা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই রাজার বংশ পরিচয় সম্পর্কে তেমন বিশেষ কিছুই জানা যায় না।

সম্ভবত তিনি মগধ ও গৌড়ের অধিপতি
মহাসেনের অধীনে মহাসামন্ত হিসেবে কিছুদিন রাজ্য শাসন করেন। ইনি উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গের গুপ্তবংশীয় শাসকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, ৬০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে গুপ্তশাসকদের নিয়ন্ত্রণ থেকে গৌড়কে মুক্ত করে একটি স্বাধীন রাজ্যের পত্তন ঘটিয়েছিলেন। তাঁর রাজ্যের রাজধানীর নাম ছিল কর্ণসুবর্ণ। ধারণা করা হয়— পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় রাজবাড়িডাঙ্গা'র (রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের প্রত্নস্থল অথবা আধুনিক রাঙ্গামাটি) সন্নিকটে চিরুটি রেলস্টেশনের কাছে কর্ণসুবর্ণ ছিল।

রাজ্যে নিজের ক্ষমতা সংহত করার পর, তিনি রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হন। তিনি প্রথমে দক্ষিণের দণ্ডভুক্তি, উৎকল ও কোঙ্গোদ রাজ্য জয় করেন। এই সময় দক্ষিণের বঙ্গ রাজ্যের রাজা তাঁর কাছে বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন।

এই সময় মৌখরীদের অত্যন্ত শক্তিশালী সেনাবাহিনী ছিল। এই সময় মৌখরীর রাজা ছিলেন গ্রহবর্মণ। তিনি থানেশ্বরের রাজা পুষ্যভূতি রাজবংশের রাজা প্রভাকরবর্মণ কন্যা রাজ্যশ্রীকে বিবাহ করেন। ফলে বৈবাহিক সূত্রে উভয় রাজ্য শক্তিশালী হয়ে উঠে। পুরুষানুক্রমে মালব রাজ্যের সাথে পুষ্যভূতি রাজবংশের শত্রুতা ছিল। ফলে মালব-রাজ দেবগুপ্ত, পুষ্যভূতি রাজবংশে শক্তি বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং  রাজশক্তি বৃদ্ধির জন্য শশাঙ্কের সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ হন। অন্যদিকে কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মণ শশাঙ্কের শক্তিবৃদ্ধিতে শঙ্কিত ছিলেন। তাই ভাস্করবর্মণ, পুষ্যভূতি রাজবংশের পক্ষে যোগ দেন। ক্ষমতার এই মেরুকরণ সম্পন্ন হওয়ার পর কিছুদিন উভয় পক্ষ নির্লিপ্তভাবে সময় কাটায়। এরপর এই রাজ-শক্তিদ্বয়ের ভিতর যুদ্ধ শুরু হয়। ঠিক কোন সূত্রে এই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল, তার কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না।

যুদ্ধের শুরুতে শশাঙ্ক বারণাসী আক্রমণ করে দখল করে নেন। এরপর তিনি সসৈন্যে কনৌজ অভিমুখে যাত্রা করেন। এই সময় মালব-রাজ দেবগুপ্তও কনৌজ অভিমুখে যাত্রা করেন। মৌখরীর রাজা গ্রহবর্মণ দেবগুপ্তের মুখোমুখী হলে, উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় এবং গ্রহবর্মা পরাজিত ও নিহত হন। ফলে কনৌজ দেবগুপ্তের অধিকারভুক্ত হয়। এই সময় দেবগুপ্ত গ্রহবর্মণের স্ত্রী রাজ্যশ্রীকে বন্দি করেন। এই সময় থানেশ্বরের রাজা ছিলেন রাজ্যবর্ধন৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তাঁর ছোটো ভাই হর্ষবর্ধনের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে, দশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে দেবগুপ্তে বিরুদ্ধে যুদ্ধ অগ্রসর হন। এই সময় দেবগুপ্তকে সাহায্যের জন্য শশাঙ্কও অগ্রসর হন। কিন্তু শশাঙ্কের পৌছানোর আগেই রাজ্যবর্ধন দেবগুপ্তকে পরাজিত করে হত্যা করেন। এরপর তিনি রাজ্যশ্রীকে উদ্ধারের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু তার আগেই তাঁকে হত্যা করা হয়। এই হত্যা নিয়ে নানা রকম গল্প প্রচলিত আছে। বাণভট্টের হর্ষচরিত থেকে জানা যায় যে, 'মিথ্যা কথায় বিশ্বাস করে রাজ্যবর্ধন একাকী এবং নিরস্ত্র অবস্থায় রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করতে গেলে, শশাঙ্ক তাঁকে হত্যা করে। চৈনিক তীর্থযাত্রী হিউয়েন সাং-এর মতে মন্ত্রীদের দোষেই রাজ্যবর্ধন শত্রুভবনে নিহত হন। হর্ষবর্ধনের শিলালিপি অনুসারে, সত্যানুরোধে রাজ্যবর্ধন শত্রুভবনে প্রাণত্যাগ করেন।

রাজ্যবর্ধনের মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ ভাই হর্ষবর্ধন বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে রাজশ্রীকে উদ্ধার ও শশাঙ্ককে শাস্তি দিতে অগ্রসর হন। এই সময় এর সাথে যোগ দেন কামরূপ রাজ ভাস্করবর্মন। বাণভট্টের হর্ষচরিত সূত্রে জানা যায়, হর্ষবর্ধন বিন্ধ্যা পর্বতের জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করেন। এরপর শশাঙ্ক ভাস্করবর্মণ ও হর্ষবর্ধনের সেনাবহিনী দ্বারা আক্রমণ এড়িয়ে, কৌশলের সাথে তিনি কনৌজ ত্যাগ করেন। এই কারণে হর্ষবর্ধন শশাঙ্ককে শাস্তি দিতে না পেরে রাজধানীতে ফিরে আসেন এবং তিনি বোন রাজ্যশ্রীর অনুমতি নিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন।

বৌদ্ধ গ্রন্থ আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প-এ পুণ্ড্রবর্ধনের যুদ্ধে হর্ষের হাতে শশাঙ্কের পরাজয়ের কাহিনী এবং তাঁর রাজত্বকাল সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, তা সমসাময়িক অপর কোন উৎস দ্বারা সমর্থিত নয়। ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে  শশাঙ্ক-এর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর
৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে হর্ষবর্ধন এবং ভাস্করবর্মন গৌড়রাজ্যের বিভিন্ন অংশ দখল করে নেন। ভাস্করবর্মন শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ নিজের রাজ্যভুক্ত করেছিলেন।

শশাঙ্ক ছিলেন শিবের ভক্ত। বানভট্ট এবং হিউয়েন সাঙ শশাঙ্কে বৌদ্ধ-বিদ্বেষী হিসাবে উল্লেখ করেছন। কিন্তু নালন্দায় অবস্থিত বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, যেখানে হিউয়েন-সাং নিজেও বেশ কিছুদিন লেখাপড়া করেছিলেন। ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে মগধে ও নালন্দা বিহার ভ্রমণ করে। সম্ভবত ওই সময়েই তিনি এসেছিলেন বুদ্ধগয়ায়। এই সময় বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষের অনেকাংশ কেটে ফেলা হয়েছিল। হিউয়েন সাঙ তাঁর ভারত ভ্রমণ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, এই সময় গাছটির উচ্চতা ছিল ৪০ থেকে ৫০ ফুট। এই গাছের বাকল ছিল হলদেটে-সাদা এবং ছিল পাতা গাঢ় সবুজ রঙের।  সে সময়ে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা বোধিবৃক্ষের পাদদেশ সুগন্ধি জল ও সুরভিত দুধ দিয়ে ধুইয়ে দিতো। তাতে মনে হয়ে বৌদ্ধধর্মের প্রতি তাঁর বিশ্বাস না থাকলেও, তিনি বৌদ্ধ মন্দির বা স্তূপ ধ্বংস করেছিলেন তাছাড়া শশাঙ্কের রাজধানী শহর কর্ণসুবর্ণের উপকণ্ঠে রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারসহ বেশ কিছু সংখ্যক বৌদ্ধ মঠের অস্তিত্বের ইত্যাদি থেকে এদের তথ্যকে যথার্থ বলে মনে করা যায় না।


সূত্র: