শ্রীলঙ্কা

জাতীয় পতাকা জাতীয় প্রতীক

 

 

 

 

এশিয়া মহাদেশের ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একটি দ্বীপ-দেশ। আরব বণিকরা এই দ্বীপকে সেরেন্দ্বীপ (Serendip) নামে ডাকত। পূর্বে বাংলাতে এই দেশের নাম সিংহল নামে পরিচিত ছিল। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পর্তুগিজরা এই দ্বীপে পৌঁছে এর নাম দিয়েছিল শেইলাও। ধারণা করা হয়, এই সূত্রে ইংরেজরা এর নামকরণ করেছিল সিলোন (ceylon)। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের সময় এর নাম ছিল সিলোন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে এর নামকরণ করা হয় শ্রীলঙ্কা। উল্লেখ্য সংস্কৃত শ্রী শব্দের অর্থ সৌন্দর্যমণ্ডিত এবং লঙ্কা অর্থ দ্বীপ। এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে নাম শ্রীলঙ্কা (সৌন্দর্যমণ্ডিত দ্বীপ)।

দাপ্তরিক নাম : গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী শ্রীলঙ্কা (Democratic Socialist Republic of Sri Lanka)।
স্বাধীনতা দিবস:  ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ (ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীন হয়)।
রাজধানী : শ্রী জয়বর্ধনাপুর কোটে
বাণিজ্যিক রাজধানী : কলম্বো
বিচার ব্যবস্থা : সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগীয় কোর্ট। প্রেসিডেন্ট নিজে বিচারক নিয়োগ করে থাকেন।
জাতির জনক : ডন ষ্টিফেন সেনানায়কে। তিনি দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী (১৯৪৭-১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন।
জাতীয় পাখি : বন্য মোরগ।
জাতীয় ফুল: নীল মাহানেল।
জাতীয় খেলা : শ্রীলঙ্কার জাতীয় খেলা ভলিবল হলেও ক্রিকেট সর্বাধিক জনপ্রিয় খেলা। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয় করে। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে ক্রিকেট বিশ্বকাপ আয়োজন করেছে।
জাতীয় সঙ্গীত : 'শ্রীলঙ্কা মাথা'
(Mother Sri Lanka)। কথা ও সুর - আনন্দ সমরকোন। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে এই গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়।
সময় : আন্তর্জাতিক সময়ের সাথে (গ্রিনউইচ সময় মান জিএমটি/ইউটিসি) ৫.৫ ঘন্টা যোগ করলে শ্রীলঙ্কার স্থানীয় সময় পাওয়া যায়।

ভাষা : সিংহলি (দাপ্তরিক এবং জাতীয় ভাষা) ৭৪%, তামিল (জাতীয় ভাষা) ১৮%, অন্যান্য ৮% । তবে স্থানীয় ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা সরকারি এবং ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করা হয়। প্রায় ১০% মানুষ ইংরেজি ভাষা বেশ দক্ষতার সাথে ব্যাবহার করতে পারে।
মুদ্রা : শ্রীলঙ্কান রুপি
(LKR)
টেলিফোন সঙ্কেত : ৯৪
ইন্টারনেট সঙ্কেত : .
lk

আয়তন ও অবস্থান : মোট ৬৫,৬১০ বর্গকিমি। এর ভিতরে স্থলভাগ ৬৪,৬৩০ বর্গকিমি এবং জলভাগ ৯৮০ বর্গকিমি। শ্রীলঙ্কা ভারতের দক্ষিণে অবস্থিত।  দেশটি ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপ। এর অক্ষাংশ ৭.০০ ডিগ্রি উত্তর এবং দ্রাঘিমাংশ ৮১.০০ডিগ্রি পূর্ব। দেশটি চারিদিকে সমুদ্রবেষ্টিত, ফলে অন্য কোন দেশের সাথে এর কোন আন্তর্জাতিক স্থল-সীমানা নাই। উপকূলের মোট দৈর্ঘ্য ১,৩৪০ কিমি। ভারতের দক্ষিণ উপকূল থেকে ৩১ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত।

প্রশাসনিক অঞ্চলসমূহ :  প্রশাসনিকভাবে মোট ৯টি ভাগে বিভক্ত। এই ভাগগুলো হলো- মধ্য, পূর্বাঞ্চল, উত্তর মধ্য, উত্তরাঞ্চলীয়, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, সাবারাগামুওয়া, উভা, দক্ষিণাঞ্চল এবং পশ্চিমাঞ্চল।

জলবায়ু : শ্রীলঙ্কার গড় তাপমাত্রা ১৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড যা গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ ৩৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত হতে পারে। দিন-রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য ৪ থেকে ৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। সাধারণত দক্ষিণাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকায় আর্দ্রতা সবচেয়ে বেশি থাকে, কলোম্বোতে সারা বছর প্রায় ৭০% আর্দ্রতা থাকে এবং জুন মাসের দিকে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে তা সর্বোচ্চ ৯০% পর্যন্ত হয়।

ভূ-প্রকৃতি : দেশের অধিকাংশ অঞ্চলই নিম্নভূমি এবং সমতল।  এর দক্ষিণ-মধ্যভাগে পার্বত্যময়। সর্বনিম্ন বিন্দু ভারত মহাসাগর সমুদ্রপৃষ্ঠীয় উচ্চতায় অবস্থিত। কিন্তু সর্ব্বোচ্চ বিন্দু পিদুরুতালাগালা-এর উচ্চতা সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে ২,৫২৪ মিটার।

জনসংখ্যা : ২১,৪৮১,৩৩৪ (জুলাই ২০১২)। জাতিসত্তার বিচারে সিংহলি ৭৩.৮%, মুর ৭.২%, ভারতীয় তামিল ৪.৬%, স্থানীয় তামিল ৩.৯%, অন্যান্য ০.৫%, অনির্দেশিত ১০% (২০০১)। ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যার বিচারে বৌদ্ধ ৬৯.১%, ইসলাম ৭.৬%, হিন্দু ৭.১%, খ্রিষ্টধর্ম ৬.২%, অন্যান্য ১০%। প্রতি ৯৬ জন পুরুষের বিপরীতে ১০০ জন মহিলা। মোট জনসংখ্যার ৯০.৭% শিক্ষিত।

যোগাযোগ : সারাদেশে রেলপথের দৈর্ঘ্য ১,৪৪৯ কিমি। এর পুরোটাই ব্রডগেজ। সড়কপথের দৈর্ঘ্য ৯১,৯০৭ কিমি। জলপথের দৈর্ঘ্য ৪৩০ কিমি। দেশটির উল্লেখযোগ্য সমুদ্র বন্দরগুলো হলো
কলম্বো, ত্রিকামেলি ও গ্যালি অন্যতম।

প্রাকৃতিক সম্পদ:  চুনাপাথর, গ্রাফাইট, খনিজ বালু, মুক্তা, ফসফেট, কাদামটি, জলশক্তি।

কৃষি : চা, কফি, চাল, আখ, ভুট্টা, ডাল, তৈলবীজ, মসলা, শাক-সব্জী, ফল, রাবার, নারিকেল, দুধ, ডিম, চামড়া, গো-মাংস, মাছ।

শিল্প : কৃষিজাত পণ্য : শিল্প রাবার প্রক্রিয়াকরণ, চা, নারিকেল, তামাক এবং অন্যান্য দ্রব্য।
          যান্ত্রিক পণ্য : টেলিকমিউনিকেশন, জাহাজ, তৈরী পোষাক, সিমেন্ট, পেট্রোলজাত দ্রব্য বিশুদ্ধকরণ।

আমদানি : পেট্রোল জাতীয় পণ্য, সুতা ও বস্ত্র শিল্প, ভারি যন্ত্রপাতি এবং যোগাযোগ সামগ্রী, খনিজ পদার্থ, খাদ্য সামগ্রী, নির্মাণ সামগ্রী।

রপ্তানি : সুতা এবং তৈরি পোশাক, চা, মসলা, রাবার, মূল্যবান পাথর, নারিকেল জাত পণ্য, মাছ।

খেলাধূলা : আন্তর্জাতিক খেলার জগতে, শ্রীলঙ্কা সবচেয়ে সাফল্য পেয়েছে ক্রিকেটে। ক্রিকেটে ১৯৯০ সাল থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দল অনেক উল্লেখযোগ্য জয় পেয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ১৯৯৬ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ, ১৯৯৬ ও ২০০৪ সালের এশিয়া কাপ এবং ২০০৭ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের রানার্সআপ। শ্রীলঙ্কা ১৯৯৬ সালে পাকিস্তান ও ভারতের সাথে ক্রিকেট বিশ্বকাপের আয়জক ছিল এবং তারা ২০১১ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ আয়োজক দেশ ছিল।

অন্যান্য খেলার ক্ষেত্রে তাদের বিশ্বক্রীড়াঙ্গনে আন্তর্জাতিক অর্জন খুব বেশি নেই। তবে প্রায় সকল ধরনের খেলার প্রচলন রয়েছে। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য খেলাগুলো হলো- রাগবি, ফুটবল, আথলেটিক্স, টেনিস ও নানা রকম জলক্রীড়া ।

ইতিহাস
ধারণা করা হয়, শ্রীলঙ্কার সর্বপ্রাচীন জাতি গোষ্ঠী ভেদ্‌দাগণ। উত্তরভারত থেকে আগত জনগোষ্ঠী খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে শ্রীলঙ্কায় আসে এবং ভেদ্‌দাগণকে পরাজিত করে বসতি স্থাপন করে। নব্য এই জাতিগোষ্ঠীই আদি সিংহলী নামে পরিচিত। শ্রীলঙ্কার ঐতিহাসিক কাহিনী মহাবংশ মতে শ্রীলঙ্কার প্রথম রাজা ছিলেন বিজয় সিংহ। সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৩ অব্দে ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চল [বঙ্গদেশ] থেকে এসে বসতি স্থাপন করেন। এই সময় বিজয় সিংহের অনুগত বাহিনী শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলে উন্নত পানিসেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন করে, কৃষিক্ষেত্রগুলোকে প্রস্তুত করেন। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে ভারত থেকে বৌদ্ধ ধর্মগুরুরা এসে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। পরবর্তী সময়ে এখানকার অনুরাধাপুরে বৌদ্ধ ধর্মের একটি অন্যতম অনুশীলন-কেন্দ্রে পরিণত হয়। বৌদ্ধ ধর্মগুরুরা বুদ্ধগয়া থেকে বটবৃক্ষের একটি চারা এনে অনুরাধাপুরে রোপণ করেন। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা ক্রমে ক্রমে শ্রীলঙ্কা একটি শান্তি ও সমৃদ্ধির জনপদ হিসাবে গড়ে উঠে। খ্রিষ্টীয় ৪র্থ থেকে ৬ষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত দক্ষিণ ভারত থেকে তামিলরা শ্রীলঙ্কা আক্রমণ করে। দক্ষিণ ভারতে চোল রাজবংশ খ্রিষ্টীয় ১১শ শতকের প্রথম দিকে অনুরাধাপুর দখল করে নিয়েছিল। অবশ্য কিছুদিন পর সিংহলীরা এই নগরী পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল। খ্রিষ্টীয় ১২শ শতাব্দীতে শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চল তামিলরা দখল করে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। এর ফলে সিংহলীরা দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে সরে যায়। এই দ্বীপের মসলার আকর্ষণে আরব বণিকরা খ্রিষ্টীয় ১২শ ও ১৩শ শতকে আনগোনা শুরু করে। এই সময় এদের এবং স্থানীয় ধর্মান্তরীত মুসলমানদের সমন্বয়ে ধর্মভিত্তিক একটি স্বতন্ত্র মিশ্র জাতিগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। খ্রিষ্টীয়  ১৫০৫ সালে পর্তুগীজরা সর্বপ্রথম এখানে পৌছায়। কালক্রমে তারা উপকূলীয়ভাগ নিজেদের দখলে আনে এবং মসলার ব্যবসার পাশাপাশি এরা রোমান কাথলিক ধর্মের প্রচার শুরু করে। খ্রিষ্টীয় ১৭শ শতাব্দীর মধ্য দিকে ডাচরা শ্রীলঙ্কায় আসে এবং তারা পর্তুগিজ এলাকা দখল করে নেয়। এই সময় ডাচরা মসলার ব্যবসার পূর্ণ অধিকার লাভ করে। ১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে ইংরেজরা এই দ্বীপের দখল নেওয়ার চেষ্টা করে। ইংরেজরা ১৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দে দ্বীপটি নিজেদের আয়ত্তে আনতে সক্ষম হয়। ১৭৯৮ খ্রিষ্টাব্দে দ্বীপটি ব্রিটিশ রাজকীয় উপনিবেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮১৫ সালে ক্যান্ডি ব্রিটিশ শাসনাধীনে এলে শ্রীলঙ্কা সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়। এই সময় ব্রিটশরা এখানে চা, রাবার, চিনি, কফি এবং নীলের চাষ শুরু করে। একই সাথে পুরো শ্রীলঙ্কায় শিক্ষা, যোগাযোগ ইত্যাদির উন্নয়ন করা হয়। ব্রিটিশ শাসনধীন সময়ে কলোম্বকে উপনিবেশের প্রশাসনিক কেন্দ্র করা হয়। ১৯৩০ সালের দিকে স্থানীয়দের প্রতি ব্রিটিশদের নির্যাতন-অত্যাচারের জন্য স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে সিংহলীদের সর্বজনীন ভোটাধিকার দেওয়া হয়। এরপর থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে এই আন্দোলনে কিছুটা স্থবির হয়ে পড়লেওযুদ্ধ শেষে তা আবার পুনরজ্জীবিত হয়ে উঠে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনাধীনে সিলোন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ডি.এস. সেনানায়েকা। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি দেশটি ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে। এই সময় দেশটি সিলন নামে পরিচিতি লাভ করে। এরপরেও ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত  ব্রিটিশ নৌবাহিনী ত্রিঙ্কোমালি-তে থেকে যায়।

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে ডি.এস. সেনানায়েকা মৃত্যবরণ করলে, ডুড্‌লে সেনানায়েকা প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে গণ-নির্বাচন ডুড্‌লে সেনানায়েকা জয়লাভ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী হন। চালের রেশন পদ্ধতি উঠিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীলঙ্কায় আন্দোলন শুরু হলে, প্রধান মন্ত্রী পদত্যাগ করেন।  এরপর প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন স্যার জন কোটেলাওয়ালা। এরপর ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে সেনানায়েকা এবং বান্দারানায়েকা যৌধভাবে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু সেনানায়েকা ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে পদত্যাগ করলে বান্দারানায়েকা প্রধানমন্ত্রী হন। এই সময় সিংহলি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা হয় এবং তামিলদের অধিকার অনেকাংশে ক্ষুণ্ণ হয়। ফলে তামিলদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের জন্ম নেয়। বান্দরানায়েকা তামিল ও সিংহলিদের ভিতর সম‌ঝোতার চেষ্টা করেন। কিন্তু ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে উগ্রপন্থি বৌদ্ধদের হাতে নিহত হন। এই সময় অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পান ডব্লিউ দাহানায়েকা।

১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে বান্দরানায়েকার বিধবা স্ত্রী শ্রীমাভো বান্দরানায়েকা জয়লাভ করেন এবং প্রধান মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে একটি সামারিক অভ্যুত্থান হয়, কিন্তু শ্রীমাভো তা প্রতিহত করতে সক্ষম হন। তিনি ধীরে ধীরে দেশটিকে সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতির দিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেন। এই কারণে শ্রীলঙ্কার সাথে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনের সাথে সখ্যতার সৃষ্টি হয়। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের আস্থাভোটে ইনি পরাজিত হন এবং ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে চূড়ান্ত নির্বাচনে পরাজিত  হন। নতুন প্রধানমন্ত্রী হন জে.আর জয়বর্ধনা। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীমাভো দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে দেশটির দাফতরিক নামকরণ করা হয়- গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী শ্রীলঙ্কা
(Democratic Socialist Republic of Sri Lanka)। এই সময় শ্রীলঙ্কার তামিল ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সাথে সিংহলীদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে জাফনার মেয়র আলফ্রেড দুরাইয়াপ্পাহ আততায়ীর হাতে নিহত হলে, তামিলরা সংহিস আন্দোলনে ঝূঁকে পড়ে। ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে শ্রীমাভো ক্ষমতা হারান। এবারে ক্ষমতায় আসেন জে.আর জয়বর্ধনা। ইনি ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে সংবিধান পরিবর্তন করেন। এই সংবিধান মোতাবেক ইনি শ্রীলঙ্কার প্রথম এক্সিকিউটিভ রাষ্ট্রপ্রধান হন। এই সময় প্রধান মন্ত্রী হন প্রেমাদাসা। ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মত জয়লাভ করেন।

১৯৮৩ খ্রিষ্টব্দের দিকে শ্রীলঙ্কায় তামিল ও সিংহলীদের মধ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। লিবারেশন টাইগারস অফ তামিল ঈলাম (Liberation Tigers of Tamil Eelam (LTTE)) নামধারী তামিল সশস্ত্র বাহিনীর সাথে শ্রীলঙ্কার জাতীয় সেনাবাহিনী'র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের এলআইটিই'র পরিচালিত এক বোমা আক্রমণে প্রেমাদাসা নিহত হন। প্রেমাদাসার নিহত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী হন দিঙ্গিরি ওয়াইজেতুঙ্গে। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে বান্দরানায়েকা দম্পতির কন্যা চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়লাভ করে, রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপতি হন। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে মাহিন্দা রাজাপাক্সা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।  ২০০৯ সালের ১৮ মে এলটিটিই প্রধান ভিলুপিলাই প্রভাকরনের মৃত্যুর মাধ্যমে এই যুদ্ধের সমাপ্তি হয়েছে বলে সামরিক বাহিনী দাবী করে আসছে। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে মাহিন্দা রাজাপাক্সা দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন।


সূত্র :
বাংলা বিশ্বকোষ
। চতুর্থ খণ্ড। নওরোজ কিতাবিস্তান। নবেম্বর, ১৯৭৬।
http://www.priu.gov.lk/PrimeMinister/formerprimeministers.html#Hon. Sirimavo R. D. Bandaranaike (August 1994-August 2000)