প্রাগৈতিহাসিক ভাষা
প্রাগ্ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার
ভাষা পরিবার :
ইন্দো-ইউরোপিয়ান
ভাষা উপ-পরিবার :  
ইন্দো-ইরানিয়া ভাষা
শাখা : ভারতীয়-আর্য ভাষা
বিবর্তিত ধারা: বৈদিকভাষা
ভাষা সঙ্কেত :

ISO 639-1 sa
ISO 639-2 san
ISO 639-3 san

সংস্কৃত
প্রাচীন ভারতীয় ভাষা বিশেষ।

মানুষের কথিত ভাষার ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা পরিবারের অন্তর্গত
ইন্দো-ইরানিয়া ভাষা উপ-পরিবারের একটি শাখার নাম  ভারতীয়-আর্য ভাষা। এই শাখার প্রধান ধারার ভাষা হলো সংস্কৃতি। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের জনগণনা অনুসারে জানা যায়, এই ভাষায় কথা বলে এমন লোকের সংখ্যা প্রায় ১৪০০০। ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। বর্তমানে এই ভাষার লেখার জন্য প্রধান লিপি হিসেবে 'দেবানগরী লিপি' ব্যবহার করা হয়। এছাড়া বার্মিজ লিপি, প্রচলিত নেপালি লিপিতে স্থানীয় সংস্কৃতভাষীরা লেখার কাজ করে। বাংলাদেশে সংস্কৃত ভাষার চর্চা রয়েছে ধর্মীয় গ্রন্থাদি পাঠ এবং শিক্ষাকার্যক্রমের ব্যাকরণ গ্রন্থাদিতে।  এছাড়া ভারতবর্ষ এবং ভারতবর্ষের বাইরে বহুদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ভাষা পড়ানো হয়। বাংলাদেশে সংস্কৃত ভাষার লিখন-পঠনে চর্চায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে  দেবনাগরী ও বাংলা বর্ণমালায়।

খ্রিষ্ট-পূর্ব ১৮০০-১৫০০ অব্দের দিকে ইরান থেকে আর্যরা ভারতবর্ষে যখন প্রবেশ করেছিল, তখন ইরানের আর্যদের ভাষার সাথে ভারতের আর্যদের ভাষার কোনো প্রভেদ ছিল না। এরপর আর্যরা ৩০০ বৎসর ধরে ভারতের বিশাল অংশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা, অনার্যদের সাথে সংঘাত ইত্যাদি সব মিলিয়ে আর্যদের অনেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ধারণা করা হয়- খ্রিষ্ট-পূর্ব ১২০০-৮০০ অব্দের ভিতরে বেদ রচিত হয়েছিল। বিভিন্ন ঋষিদের রচিত শ্লোকগুলো শিষ্য পরম্পরায় প্রচলিত ছিল। শ্রবণের দ্বারা শিষ্যরা ধারণ করতেন, তাই বেদের অপর নাম শ্রুতি। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দের দিকে অখণ্ড বেদের বিভাজন করেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন। বেদ ভাগ করার জন্য তিনি বেদব্যাস নামে পরিচিতি লাভ করেন। ভারতীয় আর্য ভাষার ক্রমবিবর্তনের প্রথম অধ্যায়কে বলা বৈদিক ভাষা।

খ্রিষ্টীয় ১২০০-৮০০ অব্দের ভিতরে রচিত বেদগুলো কোনো বিশেষ এলাকার ঋষিদের তত্ত্বাবধানে রচিত হলেও, তা ছিল সাহিত্যের ভাষা। ঋষিরা মেধাবী শিষ্যদের বেদের শিক্ষা দিতেন। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে বেদের ভাষা ছিল সমীহ করার ভাষা। অক্ষজ্ঞানহীন সাধারণ মানুষের কাছে বেদ পাঠ অসাধ্য ছিল। ফলে তখন থেকেই বৈদিক ভাষার সাথে কথ্য ভাষার একটি প্রভেদ গড়ে উঠেছিল। দূরবর্তী আর্য পল্লীতে বেদজ্ঞ ঋষিরা ধর্মজ্ঞান দান করতেন এবং ব্যাখ্যা করতেন বটে, কিন্তু মূল বেদ পাঠ করা বা শ্রবণ করার অধিকার ছিল না। দীর্ঘ সময় ধরে বেদের ভাষা অক্ষুণ্ণ রইলো বটে, কিন্তু মানুষের মুখের কথা পরিবর্তিত হয়ে চলেছিল। স্থানীয় প্রাকৃতিক উপাদান সমূহের পরিচয়জ্ঞাক শব্দ, পারিবারিক বা সামাজিক আচার আচরণে ব্যবহৃত শব্দের বিকৃত ঘটেছিল এবং একই সাথে অনার্য শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল ব্যাপকভাবে।

খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০-৬০০ অব্দের দিকে এই বৈদিকভাষা আর মানুষ্যের কথ্য ভাষার ভিতরে যে প্রভেদ ঘটেছিল, তা বৈদিক ভাষার জন্য হুমকী হয়ে উঠেছিল। কারণ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ভিতরে কথ্য বৈদিক ভাষায় গ্রন্থ রচনার প্রক্রিয়া চালু হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী ২০০ বৎসরের ভিতরে কথ্য ভাষার রীতিটিই প্রাধান্য লাভ করেছিল ব্যাপকভাবে।

খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৫০০ অব্দের ভিতরে বৈদিক ভাষার এই  সংস্কৃতি পরিবর্তিত হয়েছিল। এই পরিবর্তনের একটি চূড়ান্ত রূপ পাওয়া যায় পাণিনির রচিত সংস্কৃত ব্যাকরণ থেকে। পাণিনি এই গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০-৪০০ অব্দের দিকে। বৈদিক সংস্কৃতি বিবর্তনের ভিতর দিয়ে একটি পরিমার্জিত ও পরিশীলিতরূপ লাভ করেছিল। এই সূত্রে পাণিনির ব্যাকরণের ভাষাকে নামকরণ করা হয়ে থাকে সংস্কৃত।

পাণিনি ছিলেন উদীচ্য অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম ভারতের অধিবাসী। কিন্তু তাঁর সময়ে প্রমিত সংস্কৃত চর্চা হতো ভারতের মধ্যদেশে। পাণিনি এই অঞ্চলের সংস্কৃত ভাষাকেই আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করে, তাঁর ব্যাকরণকে সাজিয়েছিলেন। সংস্কৃত ভাষার প্রধান কবি-সাহিত্যিকরা এই ভাষাতেই তাঁদের সাহিত্য চর্চা করেছেন। এঁদের তালিকায় রয়েছেন অশ্বঘোষ, কালিদাস, ভবভূতি, ভারবি, মাঘ, বিশাখদত্ত, শূদ্রক, বাণভট্ট প্রমুখ। সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়েছিল দুটি প্রখ্যাত মহাকাব্য মহাভারতরামায়ণ এবং পুরাণসহ নানা বিষয়ের গ্রন্থাদি। খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতকে প্রমিত সংস্কৃত ভাষার শেষ কাব্যের সন্ধান পাওয়া যায় কবি জয়দেব রচিত গীতগোবিন্দ

মূলত বৈদিক এবং সংস্কৃত উভয়ই হলো সাহিত্যের ভাষা। ভারতীয় আর্য ভাষার এই রূপ ছিল কৃত্রিম। সাহিত্যের দ্বারা চর্চিত এবং ব্যাকরণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত প্রমিত সংস্কৃত ভাষার ভারতের আর্য অধ্যুষিত মধ্যদেশের ভাষা। যার সাথে স্থানীয় লোকের কথ্য ভাষার প্রভেদ ছিল। এই দূরত্ব ব্যাপক ছিল মধ্যদেশ থেকে দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতে। প্রমিত ভাষা ব্যাকরণের সুশৃঙখল বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। শিক্ষিত মহলে তার কদর ছিল বটে, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে অনেকটাই ভীতিপ্রদ ছিল। ফলে কাল-পরিক্রময়া  সংস্কৃত প্রমিত ভাষা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। সংস্কৃত এবং স্থানীয় লোকমুখের ভাষা মিশ্রিত হয়ে প্রাকৃত ভাষা। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাকৃত ভাষাগুলো নানাভাবে বিকশিত হয়ে নানা ভাষার জন্ম দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত প্রমিত সংস্কৃত ভাষা লোকমুখে অপ্রচলিত হওয়ার কারণে এক সময় প্রায় মৃতভাষায় পরিণত হয়েছে। বর্তমানে ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যে এবং নেপালে কিছু অংশে সংস্কৃত ভাষায় কথা বলে এমন লোক পাওয়া যায়। 

পাণিনির পূর্বে বা সমসাময়িককালে সংস্কৃত ভাষার তিনটি কথ্য রূপ গড়ে উঠিছল। এই তিনটি রূপ হলো

সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের মতে ভারতের মহারাষ্ট্র অঞ্চলে সংস্কৃত ভাষার অপর একটি রূপ ছিল বলে অনুমান করেছেন। তিনি এর নাম করেছেন দাক্ষিণ্যাত্য।


সূত্র :
ভাষা প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত।  ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
সাধারণ ভাষা বিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা
। ডঃ রামেশ্বর শ।  ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
http://en.wikipedia.org/wiki/Indo-Aryan_languages
http://www.ethnologue.com/language/san