বাংলাদেশের প্রাচীন জনপদ
এই এলাকা যে কয়েকটি জনপদ হিসাবে
ইতিহাসে পাওয়া যায়, তার ভিতরে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য জনপদগুলো হলো—গৌড়,
বঙ্গ ,
সমতট, হরিকেল,
বরেন্দ্র ও পুণ্ড্রবর্ধন,
রাঢ়। বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থে বঙ্গদেশের
জনপদগুলোকে নানারূপ বর্ণনায় পাওয়া যায়। ঐতেরিয় ব্রাহ্মণে পুণ্ড্রদেরকে উত্তরবঙ্গের
বর্বর অধিবাসী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একই ধরনের মন্তব্য পাওয়া যায় ধর্মসূত্রের
রচয়িতা বৌদ্ধায়নের গ্রন্থ থেকে।
কালক্রমে বঙ্গদেশের এই সকল অঞ্চলের আদি জনগোষ্ঠীর মানুষেরা, আর্যদের আচার
আচরণের সাথে পরিচিত হয়ে উঠে। এই সূত্রে মহাভারতে পুণ্ড্র ও বঙ্গের অধিবাসীদের 'সুজাত'
ক্ষত্রিয় নামে পরিচিত লাভ করে। রামায়ণে বঙ্গকে সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে উল্লেখ করা
হয়েছে। সে সময়ে বঙ্গের ক্ষত্রিয়দের সাথে অযোধ্যার ক্ষত্রিয়দের রাজনৈতিক সুসম্পর্ক
ছিল। মহাভারতের বন পর্বে দেখা যায়, ভীমের কাছে পুণ্ড্র, বঙ্গ এবং তাম্রলিপ্তের
রাজারা পরাজিত হয়েছিলেন। জৈন গ্রন্থ 'উপাঙ্গ'-এ আর্যসভ্যতার তালিকায় বঙ্গ এবং রাঢ়ের
উল্লেখ পাওয়া যায়। দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার রাঢ় অঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার
বঙ্গ-অঞ্চলের অধিবাসীদের আর্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এ গ্রন্থে। জৈন গ্রন্থ মতে,
তাঁদের ধর্মগুরু মহাবীরের সাথে রাঢ় অঞ্চলের মানুষ হীন আচরণ করেছিল।
পাণিনির ব্যাকরণে, কৌটিল্যের অর্থ শাস্ত্রে বাৎসায়নের কামসূত্রে গৌড়পুর বা
গৌড়ের নাম পাওয়া যায়। বাৎস্যায়নের কামসূত্র-এ গৌড়ের সমৃদ্ধির কথা
বিশেষভাবে জানা যায়। এই গ্রন্থমতে দক্ষিণ কলিঙ্গ পর্যন্ত গৌড়ের বিস্তার
ছিল। হর্ষবর্ধনের অনুশাসনলিপি থেকে জানা যায়, মৌখরীর রাজা ঈশান বর্মণ
গৌড়বাসীকে পরাজিত করে সমুদ্র পর্যন্ত বিতারিত করেন। এই লিপি অনুসারে ধারণা
করা যায়, গৌড় সুমুদ্রের নিকটবর্তী এলাকায় ছিল। রাষ্ট্রকূট-রাজ প্রথম
অমোঘবর্ষের অনুশাসনলিপিতে মুর্শিদাবাদের একটি অঞ্চল হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
এই অনুশাসনে এক বলা হয়েছে 'গৌড়-বিষয়'। সম্ভবত এই 'গৌড়-বিষয়' থেকে গৌড়দেশ
নামটি সৃষ্টি হয়েছিল। বরাহমিহির তাঁর বৃহৎ-সংহিতা গ্রন্থে গৌড়কে
পুণ্ডবর্ধন, সমতট, তাম্রলিপ্ত প্রভৃতি অঞ্চল থেকে পৃথক এলাকা হিসাবে উল্লেখ
করেছেন।
-
গৌড়: উত্তর বঙ্গে নিয়ে গঠিত জনপদ। [বিস্তারিত]
-
চন্দ্রদ্বীপ:
বর্তমান বরিশাল জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এই জনপদ ছিল। [বিস্তারিত]
-
তাম্রলিপ্তি বা তাম্রলিপ্ত: হরিকেলের উত্তরে অবস্থিত জনপদ। [বিস্তারিত]
-
বঙ্গ :
দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গদেশ বঙ্গ নামে পরিচিত ছিল। [বিস্তারিত]
-
বরেন্দ্র ও পুণ্ড্রবর্ধন:
উত্তরবঙ্গের একটি জনপদ। ঐতিহাসিকেদের মতে−
বর্তমান রাজশাহী,
চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও
মুর্শিদাবাদের কিছু অংশ এবং দার্জিলিং ও কোচবিহারসহ গঠিত সমগ্র অঞ্চল বরেন্দ্র
এলাকা। [বিস্তারিত
-
সমতট:
বঙ্গদেশের আর্দ্র-নিম্নভূমিকে সমতট হিসেবে উল্লেখ পাওয়া
যায়। [বিস্তারিত]
-
রাঢ়
: ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত অঞ্চলকে
রাঢ় বলা হয়।
[বিস্তারিত]
-
হরিকেল:
পূর্বভারতের একটি জনপদ। এই জনপদটি
বঙ্গদেশের অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমান
চট্টগ্রাম, কুমিল্লা
ও ত্রিপুরার এবং তৎসংলগ্ন এলাকা হরিকলের অংশ ছিল বলে অনুমান করা
হয়। [বিস্তারিত]
এছাড়া বৃহত্তর প্রাচীন বাংলায় দণ্ডভুক্তি, উত্তর রাঢ় (বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার
পশ্চিমাংশ, সমগ্র বীরভূম জেলা এবং বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমা), দক্ষিণ রাঢ়
(বতর্মান বর্ধমানের দক্ষিণাংশ, হুগলীর বহুলাংশ এবং হাওড়া জেলা), বাংলা বা বাঙলা
(সাধারণত খুলনা, বরিশাল ও পটয়াখালীর সুন্দর বনাঞ্চল) ইত্যাদি নামেও শক্তিশালী জনপদ
ছিল। সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে শশাংক গৌড়ের রাজা হয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে উৎকল (উত্তর
উড়িষ্যা) পর্যন্ত সমগ্র এলাকাকে সংঘবদ্ধ করেন। তারপর থেকে বাংলা তিনটি জনপদ নামে পরিচিত হত। এগুলো হলো-
পুন্ড্রুবর্ধন, গৌড় ও বঙ্গ। বাকি অন্যান্য জনপদগুলো এ তিনটির মধ্যে বিলীন হয়ে
যায়। বিভক্ত জনপদগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা পাল ও সেন রাজাদের আমলেই অনেকটা
সাফল্য লাভ করেছিল। শশাংশ এবং পাল রাজারা সমগ্র পশ্চিম বঙ্গের রাজা হয়েও
‘রাঢ়াধিপতি’ বা ‘গৌড়েশর’ বলেই পরিচয় দিতেন। ফলে, ‘গৌড়’ নামটি পরিচিতি লাভ করে।
প্রাচীন বাংলার জনপদ থেকে, তখনকার বাংলার ভৌগোলিক অবয়ব, সীমারেখা, রাজনৈতিক
বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা লাভ করা যায়।
সূত্র :
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।
http://www.banglapedia.org/HTB/102800.htm