গৌড়
বঙ্গদেশের প্রাচীন জনপদগুলোর ভিতরে একটি উল্লেখযোগ্য জনপদ এবং ওই জনপদের রাজধানী। গৌড় নগরীর অপর নাম লক্ষ্মণাবতী। ধ্বংসপ্রাপ্ত এই নগরী বর্তমান ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ছিল। এই দুর্গনগরী কেন্দ্রিক প্রশাসনিক অঞ্চলটির অধিকাংশই বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদা জেলায় পড়েছে। সামান্য কিছু অংশ পড়েছে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। শহরটির অবস্থান ছিল গঙ্গানদীর পূর্ব পাড়ে, রাজমহল থেকে ৪০ কি:মি: ভাটিতে এবং মালদার ১২ কি:মি: দক্ষিণে। 

পাণিনির ব্যাকরণে, কৌটিল্যের অর্থ শাস্ত্রে বাৎসায়নের কামসূত্রে গৌড়পুর বা গৌড়ের নাম পাওয়া যায়। বাৎস্যায়নের কামসূত্র-এ গৌড়ের সমৃদ্ধির কথা বিশেষভাবে জানা যায়। এই গ্রন্থমতে বঙ্গ থেকে দক্ষিণ কলিঙ্গ পর্যন্ত গৌড়ের বিস্তার ছিল। হর্ষবর্ধনের অনুশাসনলিপি থেকে জানা যায়, মৌখরীর রাজা ঈশান বর্মণ গৌড়বাসীকে পরাজিত করে সমুদ্র পর্যন্ত বিতারিত করেন। এই লিপি অনুসারে ধারণা করা যায়, গৌড় সুমুদ্রের নিকটবর্তী এলাকায় ছিল। রাষ্ট্রকূট-রাজ প্রথম অমোঘবর্ষের অনুশাসনলিপিতে মুর্শিদাবাদকে এর একটি অঞ্চল হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এই অনুশাসনে এক বলা হয়েছে 'গৌড়-বিষয়'। সম্ভবত এই 'গৌড়-বিষয়' থেকে গৌড়দেশ নামটি সৃষ্টি হয়েছিল। বরাহমিহির তাঁর বৃহৎ-সংহিতা গ্রন্থে গৌড়কে পুণ্ডবর্ধন, সমতট, তাম্রলিপ্ত প্রভৃতি অঞ্চল থেকে পৃথক এলাকা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
শক্তিসঙ্গমতন্ত্র মতে-
        বঙ্গদেশং সমাভ্য ভুবনশাস্তগং শিবে
        গৌড়দেশঃ সমখ্যাতঃ সর্ব্বশাস্ত্রবিশারদঃ
 [বঙ্গদেশ হইতে আরম্ভ করিয়া ভুবনেশ্বরের সীমা পর্যন্ত গৌড়দেশ নামে বিখ্যাত। এখানকার লোকেরা সর্বশাস্ত্রে বিশারদ]

শক্তিসঙ্গমতন্ত্র মতে গৌড়ের অনুসারে
গৌড় ছিল বিস্তীর্ণ জনপদ। কুর্ম ও লিঙ্গপুরাণ মতে, সূর্যবংশীয় শ্রাবস্তী পুত্র বংশক গৌড়দেশে শ্রাবস্তী নগরী তৈরি করেন। বর্তমানে এই প্রাচীন নগরী অযোধ্যা প্রদেশের অন্তর্গত। স্কন্দপুরাণে  সারস্বত, কনোজ, উৎকল, মিথিলা ও গৌড় অঞ্চলের বসবাসকারী ব্রাহ্মণদেরকে বলা হয়েছে পঞ্চগৌড় ব্রাহ্মণ। এর ভিতরে মিথিলা ও বঙ্গের মধ্যবর্তী অঞ্চলে ছিল গৌড়। বাণভট্টের শ্রীহর্ষচরিতে পাওয়া যায়, রাজ্যবর্ধন ও হর্ষবর্ধনের সময় গৌড়ে নরেন্দ্রগুপ্ত নামক একজন রাজা ছিলেন।

আধুনিক ঐতিহাসকদের মতে খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে
রাজা স্কন্ধগুপ্ত (৪৫৫-৪৬৭ খ্রিষ্টাব্দ)-এর মৃত্যুর পর পরবর্তী অযোগ্য শাসকরা রাজত্ব করেন। এই সময় গুপ্তরাজ বংশের উত্তরাধিকারদের মধ্যে আত্মকলহের সুযোগে সাম্রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলে একাধিক রাজবংশের উত্থান ঘটে। হুনরা গান্ধার, পাঞ্জাব থেকে শুরু করে মালব পর্যন্ত দখল করে। এর পাশাপাশি দক্ষিণে বলভীর  মৈত্রবংশ, থানেশ্বররের পুষ্যভূতি বংশ, কনৌজের মৌখরীবংশ এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলে দুটি শক্তিশালী রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। এই রাজ্য দুটি হলো- স্বাধীন বঙ্গরাজ্য ও স্বাধীন গৌড়রাজ্য।

৫২৫ থেকে ৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বঙ্গরাজ্য প্রবল দাপটে প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই সময় পৃথক রাজশক্তি হিসেবে গৌড় ততটা শক্তিশালী ছিল না। এরপর চালুক্য-রাজ কীর্তিবর্মণ-এর আক্রমণে বঙ্গরাজ্য হীনবল হয়ে পড়ে। কিন্তু গৌড় শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত হয় এবং বঙ্গরাজ্যের একটি অংশ গৌড়রাজ্য দখল করে। এই সময় উত্তর ভারতের রাজা মৌখরী গৌড়রাজ্য বারবার আক্রমণ করতে থাকে।  মৌখরী রাজ বংশের ঈশান বর্মণ গৌড় রাজাকে পরাজিত করে, তাঁর রাজ্য থেকে বিতারিত করেন। একই সময় চালুক্য রাজারাও গৌড় আক্রমণ করা শুরু করে। ফলে অচিরেই গৌড়রাজ্য ক্ষীণবল হয়ে পড়ে।

গৌড়রাজ্যের এই হীনাবস্থার ভিতরে শশাঙ্কের গৌড়ের রাজা হন।
সম্ভবত তিনি মগধ ও গৌড়ের অধিপতি মহাসেনের অধীনে মহাসামন্ত হিসেবে কিছুদিন রাজ্য শাসন করেন। তিনি উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গের গুপ্তবংশীয় শাসকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, ৬০৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে গুপ্তশাসকদের নিয়ন্ত্রণ থেকে গৌড়কে মুক্ত করে একটি স্বাধীন রাজ্যের পত্তন ঘটিয়েছিলেন। গঞ্জামের তাম্রলিপি থেকে জানা যায়, শশাঙ্ক ৬১৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর রাজ্যের রাজধানীর নাম ছিল কর্ণসুবর্ণ। ধারণা করা হয় পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় রাজবাড়িডাঙ্গা'র (রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের প্রত্নস্থল অথবা আধুনিক রাঙ্গামাটি) সন্নিকটে চিরুটি রেলস্টেশনের কাছে কর্ণসুবর্ণ ছিল।

শশাঙ্কের মৃত্যুর পর কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মন কর্ণসুবর্ণকে নিজের রাজ্যভুক্ত করেছিলেন। ৬৪৭ খ্রিষ্টাব্দে হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর শশাঙ্কের মানবদেব নামক এক পুত্র রাজ্য পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এরপর জয়নাগ নামক জনৈক সামন্ত গৌড়ের সিংহাসনে বসেন। তিনি  ভাস্করবর্মনের অধিকারভুক্ত থেকে কর্ণসুবর্ণকে মুক্ত করেন। এই রাজা নিজের নামে মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন। তবে জয়নাগ সম্পর্কে এর বেশি কিছু জানা যায় না।

জয়নাগের মৃত্যুর পর, তিব্বতের রাজা আসাম এবং উত্তরবঙ্গের কিছু অংশ দখল করে নেন। ৭০২ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বতীরা গৌড় ত্যাগ করে। এই সময় কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্যও বঙ্গদেশের কিছু অংশ দখল করেছিল। এই অরাজকতা থেকে মুক্তি লাভের জন্য, সেকালের প্রবীণ ব্যক্তিরা ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে
গোপাল (৭৫০-৭৭০ খ্রিষ্টাব্দ) নামক এক জনপ্রিয় সামন্তকে রাজপদে বর্ণ করেন। পরবর্তী সময়ে রাজা গোপাল-এর সূত্রে বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয় পালবংশীয় রাজত্বকাল(৭৫০-১১৬২ খ্রিষ্টাব্দ)। ১১৫২ থেকে ১১৬২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই বংশের মোট ১৯জন রাজা রাজত্ব করেন। এঁরা হলেন

২. ধর্মপাল (৭৭০-৮১০ খ্রিষ্টাব্দ)

৩. দেবপাল (৮১০-৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ)
৪. প্রথম শূরপাল (৮৫৫-৮৬০)
৫. বিগ্রহ পাল (৮৫৫-৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দ)
৬. নারায়ণ পাল (৮৫৪-৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ)
৭. রাজ্যপাল (৯০৮-৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ)
৮. দ্বিতীয় গোপাল (৯৪০-৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ)
৯. দ্বিতীয় বিগ্রহপাল (৯৬০-৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দ)
১০. মহীপাল প্রথম (৯৮৮-১০৩৮ খ্রিষ্টাব্দ)
১১. নয়াপাল (১০৩৮-১০৬৪ খ্রিষ্টাব্দ)
১২. তৃতীয় বিগ্রহপাল (১০৫৪-১০৭২ খ্রিষ্টাব্দ)
১৩. দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭২-১০৭৫ খ্রিষ্টাব্দ)
১৪. দ্বিতীয় শূরপাল (১০৭৫-৭৭ খ্রিষ্টাব্দ)
১৫. রামপাল (১০৭৭-১১৩০ খ্রিষ্টাব্দ)
১৬. কুমার পাল (১১৩০-১১৪০ খ্রিষ্টাব্দ)
১৭. তৃতীয় গোপাল (১১৪০-১১৪৪ খ্রিষ্টাব্দ)
১৮. মদনপাল (১১৪৪-১১৫২ খ্রিষ্টাব্দ)
১৯. গোবিন্দপাল (১১৫২-১১৬২ খ্রিষ্টাব্দ)

পালবংশের পরে রাঢ়ের সেন রাজবংশ (১১২৫-১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ রাজারা গৌড় অধিকার করেন। এই সময় পর্যন্ত গৌড় নামক কোনো উল্লেখযোগ্য নগরের হদিস পাওয়া যায় না। সেনবংশীয় রাজা বিজয় সেনের পুত্র বল্লালসেন (১১৬০-১১৭৯ খ্রিষ্টাব্দ) গঙ্গার তীরে অখ্যাত গৌড় নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেন। এই নগরীর অবস্থান ছিল ২৪.৫২ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮.১০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। বল্লালসেনের পুত্র লক্ষ্মণসেন (১১৭৯-১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ) ওই নগরীর নাম রাখেন লক্ষ্মণাবতী। এরপর তিনি নবদ্বীপে আরও একটি নগরী স্থাপন করেন এবং এই নগরী ছিল লক্ষ্মণসেনের দ্বিতীয় রাজধানী।

১২০৫ খ্রিষ্টাব্দে
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি (১২০৫-১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ)  সেনবংশের রাজা লক্ষ্মণসেন (১১৭৯-১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ)-কে পরাজিত করে নদীয়া দখল করেন। পরে তিনি গৌড় বা লক্ষ্মণাবতী দখল করে নেন। বখতিয়ার খলজি প্রথমে দেবকোট-এ তাঁর রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। এই সময় আগের রাজধানী লক্ষ্মণাবতী ক্ষুদ্র রাজ্য হিসেবে বখতিয়ার খলজির অনুগত কতিপয় আমির দ্বারা শাসিত হতো। ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে বখতিয়ার খলজি'র তিব্বত অভিযান থেকে ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কিছুদিন পর মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তাঁর অন্যতম সেনপাতি আলী মার্দান খলজি গৌড়ের সুলতান হন। এরপর থেকে গৌড় বঙ্গদেশের রাজধানী করে মুসলমান শাসকরা রাজত্ব করতে থাকেন। প্রায় দেড়শত বৎসর মুসলমান শাসকদের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে গৌড় অশান্ত পরিস্থিতির ভিতরে চলে যায়। এই দেড়শত বৎসরে গৌড়ের ইতিহাসে ২২ বৎসরে মোট ৪জন শাসক রাজত্ব করেন। এই সময়কে বলা হয় বাংলা খলজি শাসন। এই সময় ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি থেকে শাসকের নাম পাওয়া যায়, তা হলো-

মূলত খলজি বংশের শেষ স্বাধীন সুলতান ছিলেন হুসাম উদ্দীন আইওয়াজ১২২৫ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীর সুলতান লতুৎমিস  বাংলা ও বিহার দখলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। বিহারে উভয় বাহিনী মুখোমুখী হলে শান্তি চুক্তি হয়। এই চুক্তি বলে, আইওয়াজ দিল্লীর অনুগত্য স্বীকার করে নেন। ফলে বাংলার শাসনকর্তা হিসেবে তিনি থেকেই যান। লতুৎমিস দিল্লীতে ফিরে গেলে, আইওয়াজ পুনরায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই অবস্থায় লতুৎমিস তাঁর পুত্র নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি সেনাবাহিনী পাঠান। ১২২৭ খ্রিষ্টাব্দে উভয় বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হলে, আইওয়াজ সপরিবারে নিহত হন। এরপর বাংলার শাসনক্ষমতা লাভ করেন নাসির উদ্দিন। এই সময় নাসিরুদ্দিন বাংলার সাথে অযোধ্যাকে যুক্ত করেছিলেন। ১২২৯ খ্রিষ্টাব্দে নাসিরুদ্দিনের মৃত্যুর পর,  হুসাম উদ্দীন আইওয়াজ -এর বল্কা নামক এক অনুচর নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা দেন। ফলে ১২৩০ খ্রিষ্টাব্দে লতুৎমিস  পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। যুদ্ধে বল্কা পরাজিত ও নিহত হন। এরপর আলাউদ্দিন জনিকে বাংলা শাসনকর্তা নিযুক্ত করে আবার দিল্লীতে ফিরে যান। এই সূত্রে গৌড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় তুর্কি শাসন, বলবনী। প্রায় ১০০ বৎসরে তুর্কী শাসনকালেও গৌড়ে শান্তি ফিরে আসে নি। এর পিছনেও ছিল রাজত্বের অধিকার লাভের লড়াই। এই ১০০ বছরে গৌড়ে যে সকল শাসকদের নাম পাওয়া যায়, তাঁরা হলেন-

১৩২২ খ্রিষ্টাব্দে বঘরা খাঁর উত্তরাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত সুলতান ফিরোজ শাহের মৃত্যু হয়। এরপর তাঁর পুত্রদের মধ্যে বাহাদুর শাহ এবং নাসিরউদ্দিন ইব্রাহিম শাহ ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। এই সূত্রে দিল্লীর সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক বাংলায় আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হন এবং বাংলাদেশ তুঘলকি শাসনে চলে যায়। অর্থাৎ ১৩২৮ থেকে ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত গৌড়ে তুঘলকি শাসন চলে। এই শাসনামলে বাংলা চরম অরাজকতায় পৌঁছেছিল। এরপর ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৪১৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত গৌড় শাসিত হয় ইলিয়াসশাহী রাজবংশের শাসকদের দ্বারা। এই আমলের শাসকরা ছিলেন

ইলিয়াস শাহী রাজবংশ-এর চতুর্থ শাসক হামজা শাহ (১৪০৯-১৪১৩ খ্রিষ্টাব্দ)-এর মৃত্যুর পর, শিহাবউদ্দিন বায়াজিদ অল্প সময়ের জন্য সিংহাসনের অধিকারী হন। এই সময় রাজা গণেশ নামক জমিদার ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসেন। নানা ধরনের দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে রাজা গণেশের উত্তরাধিকাররা রাজত্ব করেন ১৪৪২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। রাজা গণেশের পুত্র মহেন্দ্র দেব ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে জালালুদ্দিন নাম গ্রহণ করেন। তাঁর শাসনামলে (১৪১৮-১৪৩১ খ্রিষ্টাব্দে) পাণ্ডুয়া থেকে গৌড়ে রাজধানী স্থান্তরিত হয়।

জালালুদ্দিনের মৃত্যুর পুত্র শামসুদ্দিন আহম্মদ শাহ ক্ষমতা লাভের পর, ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দে অনুচরদের চক্রান্তে নিহত হন। এরপর ইলিয়াস শাহী রাজবংশের শাসনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয় ১৪৪২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। ১৪৮৭ খ্রিষ্টাব্দে
মুজফ্‌ফর নামক এক হাবসী  ইলিয়াসশাহী রাজবংশের শেষ সুলতান জালালউদ্দিনকে হত্যা করে ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসেন। কিন্তু তাঁর কুশাসনের জন্য বাংলায় আবার ঘোরতর অরাজকতা সৃষ্টি হয়। এই কারণে এদের শাসনামলকেও অন্ধকারযুগ বলা হয়। ১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত হাবসি শাসন চলে। এই সময় রাজ্যের প্রধান মন্ত্রী
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ-এর নেতৃত্বে বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করে। বিদ্রোহীরা মুজফ্ফরকে হত্যা করে। ১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সিংহাসনে হুসেন শাহ বসেন। এর দ্বারা সূচিত হয়, হুসেনশাহী রাজবংশের। এই রাজবংশের রাজত্ব ছিল ১৪৯৩-১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। হুসেনশাহী রাজবংশের পতন ঘটে ১৫৩৩৭-৩৮ খ্রিষ্টাব্দে শেরশাহ সুরি বাংলা দখলের মধ্য। মোগল সম্রাট হুমায়ুন এবং শেরশাহ সুরি'র ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে, হুমায়ুন ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে চুনার আক্রমণ করে দখল করে নেন। শেরশাহ বিপদ বুঝে গৌড় ত্যাগ করে চলে যান। এই সময় হুমায়ুন গৌড় অধিকার করে প্রায় নয় মাস অবস্থান করেন।

১৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দে পথিমধ্যে বক্সারে কাছাকাছি চৌসাতে শের শাহ মোগল বাহিনীর মুখোমুখী হন। প্রথমে শের শাহ হুমায়ুনের কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠান। হুমায়ুন তাতে সম্মতি জানিয়ে সন্ধির জন্য প্রস্তুত হন। মোগল শিবিরে অসতর্কতা লক্ষ্য করে, শেরশাহ  আকস্মাৎ আক্রমণ করে, মোগল শিবির তছনছ করেন।  হুমায়ুন অতি কষ্টে আগ্রায় ফিরে যেতে সক্ষম হন। ফলে বাংলা ও বিহারের উপর পুনরায় শেরশাহ -এর পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ কনৌজের যুদ্ধে হুমায়ুনকে পরাজিত করে, দিল্লীর সিংহাসন দখল করেন। এই যুদ্ধে জয়ের পর, শেরশাহ একে একে দিল্লী. আগ্রা, জৌনপুর, বিহার ও বাংলাদেশের সম্রাট হন। কিন্তু ১৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে মাহমুদ শাহ'র জামাতা খিজির খাঁ বাংলাদেশে নিজেকে স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা দেন। শের শাহ বাংলা আক্রমণ করে  খিজির খাঁকে বন্দী করেন। এই সময় তিনি বাংলাকে দুর্বল করার জন্য, বাংলাকে ১৯টি সরকারে বিভাজিত করেন। এই সরকারগুলোর শাসনভার অর্পণ করেন 'কাজী-ফজল' নামক জনৈক কর্মচারির উপর।

১৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ-এর মৃত্যুর পর, তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র জালাল খাঁ সিংহাসন লাভ করেন। সিংহাসন লাভের পর তিনি নামগ্রহণ করেন ইসলাম খাঁ। ১৫৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাতে আর কোনো বিদ্রোহ হয় নি। ১৫৫৩ খ্রিষ্টাব্দ ইসলাম খাঁ'র মৃত্যুর পর, বাংলার সুর-শাসক মহম্মদ খাঁ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং জৌনপুর দখল করেন। এরপর আগ্রা অভিমুখে যাত্রা করলে, ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দে মহম্মদ শাহ আদিলের সেনাপতি হিমু তাঁকে বাধা দেন। যুদ্ধে মহম্মদ শাহ পরাজিত হলে, মহম্মদ শাহ আদিল নিজ অনুচর শাহবাজ খাঁকে বাংলার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। কিন্তু অচিরেই মহম্মদ খাঁর পুত্র খিজির খাঁ তাঁকে পরাস্ত করেন এবং গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ উপাধি ধারণ করে বাংলার সিংহাসন দখল করেন।

১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে হিমুকে পরাজিত করে হুমায়ুন আগ্রার সিংহাসন অধিকার করেন। এই সময় বাংলার শাসনকর্তা গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর পলায়মান আদিল শাহকে সুরকগড়ের কাছে পরাজিত ও হত্যা করেন। ফলে বাংলার শাসন ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপই গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর অধিকারে আসে। ১৫৬০ খ্রিষ্টাব্দে এই প্রথম গিয়াসউদ্দিন মৃত্যুবরণ করলে, তাঁর পুত্র দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ ১৫৬৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁর মৃ্ত্যুর পর, তাঁর এক আমির তৃতীয় গিয়াসউদ্দিন নাম ধারণ করে ১ বৎসর রাজত্ব করেন। ১৫৬৩ খ্রিষ্টাব্দে কর্‌রানী এই গিয়াজউদ্দিনকে পরাজিত করে বাংলায় কররানী রাজ বংশের প্রতিষ্ঠা করে। এরা বাংলার নতুন রাজধানী স্থাপন করেছিলেন মালদহ শহরের ১৫ মাইল দক্ষিণে তাণ্ডা নামক স্থানে। এরপর ধীরে ধীরে তাণ্ডা বাংলার গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয় এবং গৌড়ের গুর্ত্ব হ্রাস পায়।

১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দে মোগল শাসনাধীনে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশে কর্‌রানী রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়। এই রাজবংশের সুলতান সুলেমান আকবরের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিয়েছিলেন। ফলে বাংলা তখন ছিল মোগলদের করদ রাজ্য। সুলেমানের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দাউদ বাংলার স্বাধীন সুলতান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আকবর দাউদকে দমন করার জন্য, সেনাপতি টোডরমল এবং মুনিম খাঁকে পাঠান। মুনিম খাঁ কৌশলে ১৫৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন বাংলার রাজধানী তাণ্ডা বিনা বাধায় দখল করেন। এই তাণ্ডা থেকেই মুনিম খাঁ তাঁর প্রশাসনিক কাজ চালাতে থাকেন। ফলে ক্রমে ক্রমে গৌড় গুরুত্বহীন হয়ে পড়তে থাকে। দাউদ খাঁর সাথে মুনিম খাঁর প্রথম যুদ্ধ হয় ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দের তুকারই সমরক্ষেত্রে। এই যুদ্ধে উভয় বাহিনীই চূড়ান্ত জয়লাভে ব্যর্থ হয়। ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজমহলে দ্বিতীয়বার যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে দাউদ পরাজিত ও নিহত হন। এরপর বাংলাতে মোগল শাসনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। কিন্তু বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে তখনও আফগান শাসকরাই স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতেন। সে সময় বাংলার শাসনকর্তা হন মুনিম খাঁ। ১৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার শাসনকর্তা হিসেবে আসেন রাজা মানসিংহ। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলার রাজধানী তাণ্ডা থেকে রাজমহলে স্থানান্তর করেন। তাণ্ডা রাজধানী হলেও গৌড়ের গুরুত্ব তখনও ছিল। কিন্তু  রাজমহলে রাজধানী স্থানান্তরের পর, গৌড় ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হয়।


সূত্র :
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।
http://www.banglapedia.org/HTB/102800.htm