বাংলায় শেরশাহ সুরি রাজবংশের শাসন
হুসেন শাহী রাজবংশের সুলতান নসরৎ শাহ ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে আততায়ীর হাতে নিহত হন। এরপর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ। ফিরোজ শাসনকার্যে অনুপযুক্ত ছিলেন। তাঁর কুশাসনের বিরুদ্ধে আমিররা বিদ্রোহ করেন। এই সময় বিহারের লোহানী আমিররা শের শাহ-এর ক্ষমতা বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে, শের শাহকে আক্রমণ করার জন্য সুলতান মাহমুদ শাহকে উদ্বুদ্ধ করেন। ফলে ১৫৩৪ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়েন। সুরজগড়ের যুদ্ধে শের খাঁ সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধ জয়ের পর শের শাহ সমগ্র বিহারের সুলতান হয়ে উঠেন। ১৫৩৬ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। প্রথমে তিনি বাংলার কিছু অংশ দখল করেন। এই সময় মাহমুদ শাহ শেরখাঁকে ১৩ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করে সন্ধি করেন। ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ পুনরায় বাংলা আক্রমণ করে গৌড় অধিকার করেন। এবং শেষ পর্যন্ত মাহমুদকে সম্পূর্ণ পরাজিত করে বাংলা থেকে বিতারিত করেন। এর ফলে বাংলাদেশে হুসেনশাহী রাজবংশের শাসনের অবসান হয়। এরপর শুরু হয় শের শাহ-এর রাজত্ব কাল।
শেরশাহ এই শক্তি বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে, হুমায়ুন ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে চুনার আক্রমণ করে দখল করে নেন। শেরশাহ বিপদ বুঝে গৌড় ত্যাগ করে চলে যান। এই সময় হুমায়ুন গৌড়ে প্রায় নয় মাস অবস্থান করেন। এই সময়ের ভিতর শেরখাঁ বারাণসী, জৌনপুর ও কনৌজ দখল করে নেন। ফলে হুমায়ুন দ্রুত আগ্রা ফিরে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হন। ১৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দে পথিমধ্যে বক্সারে কাছাকাছি চৌসাতে শের শাহ মোগল বাহিনীর মুখোমুখী হন। প্রথমে শের শাহ হুমায়ুনের কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠান। হুমায়ুন তাতে সম্মতি জানিয়ে সন্ধির জন্য প্রস্তুত হন। মোগল শিবিরে অসতর্কতা লক্ষ্য করে, শেরশাহ আকস্মাৎ আক্রমণ করে, মোগল শিবির তছনছ করেন। হুমায়ুন অতি কষ্টে আগ্রায় ফিরে যেতে সক্ষম হন। ফলে বাংলা ও বিহারের উপর পুনরায় শেরশাহ -এর পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ধাপে মূলত বাংলা ৯ মাস মোগল শাসনে ছিল।
১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ কনৌজের যুদ্ধে হুমায়ুনকে পরাজিত করে, দিল্লীর সিংহাসন দখল করেন। এই যুদ্ধে জয়ের পর, শেরশাহ একে একে দিল্লী. আগ্রা, জৌনপুর, বিহার ও বাংলাদেশের সম্রাট হন। কিন্তু ১৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে মাহমুদ শাহ'র জামাতা খিজির খাঁ বাংলাদেশে নিজেকে স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা দেন। শের শাহ বাংলা আক্রমণ করে খিজির খাঁকে বন্দী করেন। এই সময় তিনি বাংলাকে দুর্বল করার জন্য, বাংলাকে ১৯টি সরকারে বিভাজিত করেন। এই সরকারগুলোর শাসনভার অর্পণ করেন 'কাজী-ফজল' নামক জনৈক কর্মচারির উপর।
১৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ-এর মৃত্যুর পর, তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র জালাল খাঁ সিংহাসন লাভ করেন। সিংহাসন লাভের পর তিনি নামগ্রহণ করেন ইসলাম খাঁ। ১৫৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাতে আর কোনো বিদ্রোহ হয় নি। ১৫৫৩ খ্রিষ্টাব্দ ইসলাম খাঁ'র মৃত্যুর পর, বাংলার সুর-শাসক মহম্মদ খাঁ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং জৌনপুর দখল করেন। এরপর আগ্রা অভিমুখে যাত্রা করলে, ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দে মহম্মদ শাহ আদিলের সেনাপতি হিমু তাঁকে বাধা দেন। যুদ্ধে মহম্মদ শাহ পরাজিত হলে, মহম্মদ শাহ আদিল নিজ অনুচর শাহবাজ খাঁকে বাংলার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। কিন্তু অচিরেই মহম্মদ খাঁর পুত্র খিজির খাঁ পরাস্ত করেন এবং গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ উপাধি ধারণ করে বাংলার সিংহাসন দখল করেন।
১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে হিমুকে পরাজিত করে আগ্রার সিংহাসন অধিকার করেন। এই সময় বাংলার শাসনকর্তা গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর পলায়মান আদিল শাহকে সুরকগড়ের কাছে পরাজিত ও হত্যা করেন। ফলে বাংলার শাসন ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপই গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর অধিকার করেন। ১৫৬০ খ্রিষ্টাব্দে এই প্রথম গিয়াসউদ্দিন মৃত্যুবরণ করলে, তাঁর পুত্র দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ ১৫৬৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁর মৃ্ত্যুর পর, তাঁর এক আমির তৃতীয় গিয়াসউদ্দিন নাম ধারণ করে ১ বৎসর রাজত্ব করেন। ১৫৬৩ খ্রিষ্টাব্দে কর্রানী এই গিয়াজউদ্দিনকে পরাজিত করে বাংলায় কররানী রাজ বংশের প্রতিষ্ঠা করে। এর ভিতর দিয়ে বাংলাদেশে শেরশাহ সুরি রাজবংশের শাসন বিলুপ্ত হয়ে যায়।
সূত্র :
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।