শেরশাহ
অন্যান্য নাম: শের খাঁ, শের শাহ শুরি।
প্রকৃত নাম: ফরিদ।

মধ্যযুগীয় আফগান বংশোদ্ভুত ভারতীয় সম্রাট। ১৪৭২ খ্রিষ্টাব্দে ফিরোজা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম হাসান শাহ শুর। এই কারণে তাঁর নাম ছিল শেরশাহ শুরি। তাঁর পিতা ছিলেন বিহারের অন্তর্গত সাসারামের জায়গিরদার। অল্প বয়সে তাঁর মা মারা যাওয়ার কারণে বিমাতার কাছে  তিনি অবহেলিত হয়ে বড় হয়ে উঠেন। এরপর তিনি ভাগ্যান্বেষে গৃহত্যাগী হন। নানা জায়গায় ঘুরে তিনি বিহারের সুলতান বাহার খান লোহানীর অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। এ্খানে তিনি আরবি ও ফারসি ভাষা শেখেন। তাঁর সাহস ও বীরত্বের জন্য বাহার খান তাঁকে 'শের খান' খেতাবে ভূষিত করেন।
 

 ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই মালিকের অধীনে থেকে প্রশাসনিক কাজে আরও দক্ষ হয়ে উঠেন। বাহার খাঁ তাঁর নিজ পুত্র জালাল খাঁর শিক্ষক হিসেবে তাঁর নিয়োগ দেন। পরে তাঁকে দক্ষিণ বিহারে বাহার খাঁর সহকারী শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। কিন্তু বাহার খাঁর সাথে মনোমালিন্য হওয়ায়, ১৫২৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিহার ত্যাগ করে মোগল সম্রাট বাবর-এর অধীনে চাকরী নেন। ১৫২৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বাবর মেবারের রাণা সংগ্রাম সিংহ এবং পূর্ব-ভারতে আফগানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই সময় বিহার আক্রমণের সময় তিনি বাবর-এর সাহায্য করেন। এই কারণে বাবর সন্তুষ্ট হয়ে, তাঁকে সাসারামের জায়গির প্রদান করেন। কিন্তু ১৫২৮ খ্রিষ্টাব্দে মোগল রাজসভা ত্যাগ করে, পুনরায় বিহারে ফিরে আসেন এবং জালাল খাঁর অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন। এই সময় নাবালক জালাল খাঁর অভিভাবক হয়ে তিনি নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন।

১৫৩০ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট বাবর -এর মৃত্যুর পর, হুমায়ুন সিংহাসনে বসেন। এই সময় তিনি প্রকৃত অর্থে বিহারের শাসনকর্তা হয়ে উঠেন। তিনি  হুমায়ুন-এর বশ্যতা অস্বীকার করলে, হুমায়ুন চুনার দুর্গ আক্রমণ করে দখল করে নেন। এই সময় চতুর শেরশাহ হুমায়ুন-এর বশ্যতা স্বীকার করে নেন।

শের শাহের উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে, বিহারের লোহানী আমিররা বাংলাদেশের সুলতান মাহমুদ শাহকে শেরশাহকে আক্রমণ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। ফলে ১৫৩৪ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়েন। সুরজগড়ের যুদ্ধে শের শাহ সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধ জয়ের পর শের শা সমগ্র বিহারের সুলতান হয়ে উঠেন। ১৫৩৬ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। প্রথমে তিনি বাংলার কিছু অংশ দখল করেন। এই সময় মাহমুদ শাহ শেরখাঁকে ১৩ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করে সন্ধি করেন। ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে শের শা পুনরায় বাংলা আক্রমণ করে গৌড় অধিকার করেন। ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ মাহমুদকে সম্পূর্ণ পরাজিত করে বাংলা থেকে বিতারিত করেন। এর ফলে বাংলাদেশে হুসেনশাহী রাজবংশের শাসনের অবসান হয়।

শেরশাহ এই শক্তি বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে, হুমায়ুন ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে চুনার আক্রমণ করে দখল করে নেন। শেরশাহ  বিপদ বুঝে গৌড় ত্যাগ করে চলে যান। এই সময় হুমায়ুন গৌড়ে প্রায় নয় মাস অবস্থান করেন। এই সময়ের ভিতর শের শাহ ঘুর পথে আক্রমণ করে বারাণসী, জৌনপুর ও কনৌজ দখল করে নেন। বিপদ বুঝে হুমায়ুন দ্রুত আগ্রা ফিরে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হন। ১৫৩৯ খ্রিষ্টাব্দে পথিমধ্যে বক্সারে কাছাকাছি চৌসাতে শের শাহ মোগল বাহিনীর মুখোমুখী হন। প্রথমে শের শাহ হুমায়ুনের কাছে সন্ধির প্রস্তাব পাঠান। হুমায়ুন তাতে সম্মতি জানিয়ে সন্ধির জন্য প্রস্তুত হন। মোগল শিবিরে অসতর্কতা লক্ষ্য করে, শেরশাহ আকস্মাৎ আক্রমণ করে, মোগল শিবির তছনছ করেন।  হুমায়ুন অতি কষ্টে আগ্রায় ফিরে যেতে সক্ষম হন। ফলে বাংলা ও বিহারের উপর পুনরায় শের শাহ-এর পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দে একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে হুমায়ুন পুনরায় শের শাহর বিরুদ্ধে অভিযান চালান। কনৌজে পৌঁছে হুমায়ুন প্রায় এক মাস নিষ্ক্রিয় অবস্থায় কাটান। এই সময়ের ভিতরে শেরশাহ ক্রমণের সুযোগ খুঁজতে থাকেন। তারপর মোগল বাহিনীর অসতর্ক মুহুর্তে আক্রমণ করে, তাদেরকে নাস্তানাবুদ করেন। এই যুদ্ধে হুমায়ুন পরাজিত হয়ে আগ্রা ত্যাগ করে কাশ্মীরে পথে চলে যান।

এই যুদ্ধে জয়ের পর, শেরশাহ একে একে দিল্লী. আগ্রা, জৌনপুর, বিহার ও বাংলাদেশের সম্রাট হন। ১৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার শাসন কর্তা বিদ্রোহ করলে, তা দমন করেন। প্রশাসনিক সুবিধার জন্য, তিনি বাংলাকে ১৯টি সরকারে বিভাজিত করেন। এই সরকারগুলোর শাসনভার অর্পণ করেন 'কাজী-ফজল' নামক জনৈক কর্মচারির উপর।

এরপর ১৫৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মালব রাজ্য জয় করেন। ১৫৪৩ খ্রিষ্টাব্দে রাজপুতনা অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করেন। আক্রমণের শুরুতেই তিনি রায়সিন দুর্গ জয় করেন। পরে সিন্ধুদেশ জয় করে যোধপুরের রাজধানী মাড়ওয়ার অবরোধ করেন। প্রায় দুই মাস অবরোধের পর তিনি ১৫৪৪ খ্রিষ্টাব্দে মাড়ওয়ার দখল করেন।

১৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহের মৃত্যুর পর, তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র জালাল খাঁ সিংহাসন লাভ করেন।


সূত্র :
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।