পাল রাজ বংশ
৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে
রাজা
শশাঙ্ক-এর মৃত্যুর পর, সুযোগ্য শাসকের অভাবে সমগ্র বাংলাদেশে কোনো সার্বভৌম
প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ফলে ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৭৫০ বৎসর পর্যন্ত বাংলাদেশে ঘোর
অরাজকতার সৃষ্টি হয়। এই সময়ের এই অবস্থাকে মাৎসন্যায় নামে অভিহিত করা হয়।
শশাঙ্কের মৃত্যুর পর কনৌজের রাজা যশোবর্মণ, বঙ্গদেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ অধিকাংশ অংশই দখল করে নেন। এই সময় কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্য বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের কিছুটা দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ৬৪৭ খ্রিষ্টাব্দে হর্ষবর্ধনের মৃত্যু হলে, রাজা শশাঙ্কের পুত্র রাজত্ব পুনপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। কিন্তু সফল হতে পারেন নি। এই সময় জয়নাগ নামক জনৈক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি গৌড়ের সিংহাসন অধিকার করেন। তিনি প্রাথমিকভাবে নিজেকে রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। এরপর তিনি একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী তৈরি করেন, কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মণ-এর সৈন্যদের পরাজিত করে শশাঙ্কের রাজধানী 'কর্ণসুবর্ণ' জয় করেন। জয়নাগের মৃত্যুর পর উত্তরবঙ্গ তিব্বতীয়দের অধিকারে চলে যায়।
এই সকল ভিন্নদেশী শাসকদের দ্বারা বাংলাদেশ যখন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, সেই সময় বাংলাদেশের
প্রবীন ও প্রাজ্ঞ নেতারা আত্মকলহ ত্যাগ করে, গোপাল নামক এক জনপ্রিয় সামন্তকে রাজা
হিসেবে নির্বাচিত করেন। এই গোপাল থেকেই বঙ্গদেশে পাল বংশের শুরু হয়। ৭৫০
খ্রিষ্টাব্দে গোপাল তাঁর রাজত্ব শুরু করেন।
প্রকৃত অর্থে মদনপাল ছিলেন এই রাজবংশের শেষ রাজা।
১১৫২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মদনপাল-এর রাজত্বের
পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপর মগধে আর কোনো পাল রাজা প্রতিষ্ঠা পায় নি। অবশ্য এই সময় গয়াতে
পালবংশের এক সামন্ত রাজা গোবিন্দপাল রাজত্ব করতেন। তিনি পাল-সাম্রাজ্যের মূল
স্রোতের বাইরে ছিলেন। ১১৬২ খ্রিষ্টাব্দে এই রাজার রাজত্ব বিলুপ্ত হয়। এরপর পাল
সাম্রাজ্য চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
পাল রাজবংশের রাজাদের তালিকা
১. গোপাল (৭৫০-৭৭০ খ্রিষ্টাব্দ)
২. ধর্মপাল (৭৭০-৮১০ খ্রিষ্টাব্দ)
৩. দেবপাল (৮১০-৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ)
৪. প্রথম শূরপাল (৮৫৫-৮৬০)
৫. বিগ্রহ পাল (৮৫৫-৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দ)
৬. নারায়ণ পাল (৮৫৪-৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ)
৭. রাজ্যপাল (৯০৮-৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ)
৮. দ্বিতীয় গোপাল (৯৪০-৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ)
৯. দ্বিতীয় বিগ্রহপাল (৯৬০-৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দ)
১০. মহীপাল প্রথম (৯৮৮-১০৩৮ খ্রিষ্টাব্দ)
১১. নয়াপাল (১০৩৮-১০৬৪ খ্রিষ্টাব্দ)
১২. তৃতীয় বিগ্রহপাল (১০৫৪-১০৭২ খ্রিষ্টাব্দ)
১৩. দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭২-১০৭৫ খ্রিষ্টাব্দ)
১৪. দ্বিতীয় শূরপাল (১০৭৫-৭৭ খ্রিষ্টাব্দ)
১৫. রামপাল (১০৭৭-১১৩০ খ্রিষ্টাব্দ)
১৬. কুমার পাল (১১৩০-১১৪০ খ্রিষ্টাব্দ)
১৭. তৃতীয় গোপাল (১১৪০-১১৪৪ খ্রিষ্টাব্দ)
১৮. মদনপাল (১১৪৪-১১৫২ খ্রিষ্টাব্দ)
১৯. গোবিন্দপাল (১১৫২-১১৬২ খ্রিষ্টাব্দ)
পাল সাম্রাজ্যের পরে সেনরাজবংশ রাজত্বকাল শুরু হয়। ১১৬২ খ্রিষ্টাব্দে পাল রাজবংশের বিলুপ্তের পর এই রাজবংশ রাজত্ব কায়েম করে। যদিও পাল রাজবংশের আমলেই ১১২৫ খ্রিষ্টাব্দেই সেনবংশের প্রথম রাজা বিজয় সেন রাজত্ব কায়েম করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু সমগ্র বাংলাদেশের উপর অধিকার পাল রাজাদের ছিল। পাল রাজবংশের অন্তিম দশায়, ১১৫৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সেন বংশের দ্বিতীয় রাজা বল্লাল সেন প্রকৃষ্ট অর্থে বাংলার রাজা হয়ে উঠেন। এই কারণে পাল রাজবংশের পরে সেন রাজাদের শাসনামল ধরা হয়।
সূত্র :
বাংলাদেশের
ইতিহাস/রমেশচন্দ্র মজুমদার।
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।