সেন রাজবংশ
বাংলাদেশের রাজবংশ বিশেষ। ১১৬২ খ্রিষ্টাব্দে পালবংশীয় রাজত্বকাল (৭৫০-১১৬২ খ্রিষ্টাব্দ) বিলুপ্তের পর এই রাজবংশ রাজত্ব কায়েম করে। যদিও পাল পাল রাজবংশের  আমলেই ১০৯৭ খ্রিষ্টাব্দেই সেনবংশের প্রথম রাজা বিজয় সেন রাজত্ব কায়েম করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু সমগ্র বাংলাদেশের উপর অধিকার পাল রাজাদেরই ছিল। পাল রাজবংশের অন্তিম দশায়, ১১৬০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সেন বংশের দ্বিতীয় রাজা বল্লাল সেন প্রকৃষ্ট অর্থে বাংলার রাজা হয়ে উঠেন। এই কারণে পাল রাজবংশের পরে সেন রাজাদের শাসনামল ধরা হয়। ১১৬০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সেন বংশের দ্বিতীয় রাজা বল্লাল সেন প্রকৃষ্ট অর্থে বাংলার রাজা হয়ে উঠেন। আর এই বংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালে, আনুমানিক ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন মোহম্মদ বখতিয়ার খিলজি লক্ষ্মণসেনকে পরাজিত করে, তাঁর রাজধানী লক্ষ্মণাবতী দখল করেন। লক্ষ্মণ সেন পূর্ববঙ্গে পালিয়ে যান। ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করলে, তাঁর দুই পুত্র  বিশ্বরূপ সেন এবং কেশব সেন (১২০৬-১২৩০ খ্রিষ্টাব্দ) কিছুদিন সেখানে রাজত্ব করেন। ১২৩০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এই রাজবংশের রাজত্ব পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিশ্বরূপসেনের তাম্রশাসনে সূর্যসেন ও কুমার পুরুষোত্তম সেনের নামের উল্লেখ আছে। সম্ভবত এঁরা বিশ্বরূপসেনের পুত্র ছিলেন। তবে তাঁদের কেউ রাজত্ব করেছিলেন কিনা তা জানা যায় না। ঐতিহাসিক মিনহাজ যে সময় লক্ষ্মণাবতীতে আসেন (১২৪৪-৪৫ খ্রিষ্টাব্দে) তখনও লক্ষ্মণসেনের বংশধরগণ পূর্ববাংলায় রাজত্ব করছিলেন। সুতরাং মনে হয় কেশবসেনের পরেও একাধিক সেনরাজা পূর্ববাংলায় রাজত্ব করেছিলেন। তবে তাদের রাজা না বলে জমিদার বলাই বোধ হয় সমীচীন হবে।

সেনবংশীয়রা বাংলার বাইরে থেকে এসেছিলেন। সেনবংশের লিপি থেকে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য লক্ষ্য করা যায়। একটি লিপি থেকে জানা যায় যে, সামন্তসেনই বাংলাদেশে বসবাসকারী সেনরাজবংশের প্রথম পুরুষ। আবার অন্য একটি লিপিমালা হতে মনে হয় যে, সামন্তসেনের পূর্বেই সেনবংশ রাঢ় অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলেন। এ সকল তথ্যের সামঞ্জস্য বিধান করে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, “কর্ণাটের এক সেনবংশ বহুদিন যাবত রাঢ়দেশে বসবাস করছিলেন, কিন্তু তারা কর্ণাটদেশের সাথেও সম্বন্ধ রক্ষা করে আসছিলেন। এই বংশের সামন্তসেন যৌবনে কর্ণাটদেশে বহু যুদ্ধে নিজের শৌর্যবীর্যের পরিচয় দিয়ে এই বংশের উন্নতির সূত্রপাত করেন।” এই সূত্রে বলা যায়, সেনবংশীয়রা দাক্ষিণাত্যের কর্ণাট দেশ হতে আগত। তবে তাঁরা কি কারণে বাংলায় এসেছিলেন তা সুনিশ্চিত নয়।

প্রথমত অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে, সেনরা কর্ণাট হতে বাংলায় এসে পালরাজাদের অধীনে চাকুরি গ্রহণ করেছিলেন। বিশেষ করে সামরিক বাহিনীর খাদ্যসামগ্রী, কাপড়-চোপড়, অস্ত্র-শস্ত্র প্রভৃতি বহন করার জন্য অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন হতো। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংযুক্ত পরিবহন ও অন্যান্য শ্রমিক রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রবহির্ভুত বহু অঞ্চল থেকে নিয়োগ করা হতো। দেবপাল (৮১০-৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ) থেকে মদনপাল (১১৪৪-১১৫২ খ্রিষ্টাব্দ) পর্যন্ত, পাল লেখমালায় উল্লিখিত কর্মচারীর তালিকায় নিয়মিতভাবে গৌড়-মালব.খসহূণ-কলিক-কর্ণাট-লাট-চাট-ভাট প্রভৃতি জাতির লোকজন নিয়োজিত হতো বলে উল্লেখ আছে। লিপিসাক্ষ্য থেকে মনে হয়, পাল রাজারা গৌড়, মালব, খস প্রভৃতির ন্যায় কর্ণাটগণকে সৈনিক বা কর্মচারী পদে নিযুক্ত করতেন। ঐতিহাসিকদের মতে, হয়তো কর্ণাটাগত সেনবংশীয় কোনো একজন কর্মচারী শক্তিসঞ্চয় করে পালরাজাদের দুর্বলতার সুযোগে স্বীয় আধিপত্য স্থাপন করেন। এই ধরনের উক্তি নৈহাটি তাম্রলিপিতে প্রদত্ত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, চন্দ্রবংশীয় অনেক রাজপুত্র রাঢ় দেশের অলংকারস্বরূপ ছিলেন এবং তাঁদেরই বংশে সামন্তসেন জন্মগ্রহণ করেন। এতে মনে হয় পাল রাজাদের সময়ে তাঁদের সৈন্যবাহিনীতে কর্নাটের চন্দ্রবংশীয় রাজপুত্ররা নিয়োজিত ছিলেন এবং যুদ্ধবিশারদ হিসেবে তাঁদের যথেষ্ট সুনাম ছিল। এমনই কোনো পদে নিয়োজিত থেকে সামন্তসেন সামন্তপ্রভু হতে পেরেছিল।

কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেন যে, কর্ণাটাগত সেন রাজাগণের পূর্বপুরুষ দক্ষিণাগত কোনো আক্রমণকারী রাজার সাথে বাংলায় এসেছিলেন। এই সম্পর্কে উত্তর-পূর্ব ভারত আক্রমণকারী চালুক্যরাজ ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্য ও প্রথম সোমেশ্বরের নাম উল্লেখযোগ্য। চালুক্যরাজন্যদের এই ধরনের আক্রমণের ফলে উত্তর বিহার ও নেপালে নান্যদেব এবং উত্তরভারতে হাহাড়বাল বংশ শাসনক্ষমতা লাভ করেছিল। তাঁরা উভয়েই কর্ণাট দেশীয় ছিলেন।

একথা প্রমাণিত যে, সামন্তসেন সেন রাজবংশের প্রথম ঐতিহাসিক ব্যক্তি। ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কর্ণাটে বিভিন্ন যুদ্ধবিগ্রহ করে শেষ বয়সে গঙ্গাতীরে বসতি স্থাপন করেন এমনও হতে পারে। হয়তো যুদ্ধ বিগ্রহের পর ধর্মপ্রাণ সেন বংশের পূর্বপুরুষ সামন্তসেন গঙ্গাতীরবর্তী বনে শান্তি ও সাধনার জায়গা বেছে নিয়েছিলেন যেখানে তোতাপাখীদেরও বেদের সমস্ত বক্তব্যের সঙ্গে পরিচয় ছিল। দেওপাড়া প্রশস্তিতে এমন ইঙ্গিত দেয়া আছে। সম্ভবত তিনি ধর্মীয় সাধনার জন্যই এসেছিলেন, কাজেই কোনো রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা শোনা যায় নি। একারণেই বোধ হয় সেন লিপিমালায় তাঁর কোনো রাজ্য প্রতিষ্ঠা অথবা রাজকীয় উপাধি গ্রহণের ইঙ্গিত নেই। এই কারণেই তার পৌত্র বিজয়সেনের অথবা তাঁর বংশধরদের লিপিতে তাঁর নামের সাথে কোনো রাজকীয় উপাধি ব্যবহৃত হয় নি।

হেমন্ত সেন
সেনবংশীয় রাজপুরুষ বলতে হেমন্ত সেনের নাম প্রথম পাওয়া যায়। হেমন্তসেন ছিলেন সামন্তসেনের পুত্র। বিজয়সেনের ব্যারাকপুর তাম্রশাসনে সামন্তসেনের পুত্র হেমন্তসেনকে ‘মহারাজাধিরাজ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই রাজকীয় উপাধি থেকে ঐতিহাসিকরা হেমন্তসেনকে সেন রাজবংশের প্রথম রাজা বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তখনও পালবংশীয়দের রাজত্ব বাংলাতে অটুট ছিল। সম্ভবত তিনি পালরাংশীয় শাসনামলে একজন সামন্ত ছিলেন। বিজয়সেনের ব্যারাকপুর তাম্রশাসনে হেমন্ত সেনকে ‘রাজরক্ষা সুদক্ষ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই উক্তি থেকে সামন্ত হেমন্ত সেন পালবংশীয় রাজাদের সময়ে খুব বিশ্বস্ত সামন্ত ছিলেন সেটাই মনে হয়। খুব সম্ভবত বিজয়সেনের ব্যারাকপুর তাম্রশাসনে তাঁকে ‘মহারাজাধিরাজ’ বলে উল্লেখ করেছেন, সেটা তিনি বংশের গৌরবকে প্রকাশ করার সময় বাড়িয়ে বলেছেন। অথবা হেমন্তসেন নিজেই এই উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। একই শিলালিপিতে বিজয়সেনের মাতা যশোদেবীকে মহারাজ্ঞী উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে।

হেমন্তসেনের কবে উল্লিখিত ‘মহারাজাধিরাজ’ হয়েছিলেন, তার তারিখ জানা যায় না। তবে তাঁর পুত্র বিজয়সেন ১০৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সামন্ত থেকে রাজা হয়ে উঠছিলেন।

সেন রাজাদের তালিকা।

১. বিজয়সেন (১০৯৭-১১৬০ খ্রিষ্টাব্দ)
২. বল্লালসেন (১১৬০-১১৭৯ খ্রিষ্টাব্দ)
৩. লক্ষ্মণসেন (১১৭৯-১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ)
৪. বিশ্বরূপ সেন এবং কেশব সেন (১২০৬-১২৩০ খ্রিষ্টাব্দ)


সূত্র :
বাংলাদেশের ইতিহাস/রমেশচন্দ্র মজুমদার।
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।