ধর্মপাল (৭৭০-৮১০ খ্রিষ্টাব্দ)
বাংলার পাল রাজবংশের দ্বিতীয় রাজা।

পাল
পালবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল (৭৫০-৭৭০ খ্রিষ্টাব্দ) -এর পুত্র। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের রাজা গোপাল -এর মৃত্যুর পর তিনি সিংহাসন লাভ করেন।

ধর্মপাল যুদ্ধ এবং রাজনীতিতে সুদক্ষ ছিলেন। তাঁর আমলে আর্যাবর্তে সার্বভৌমত্বের সূত্রে বাংলার পাল বংশ, দক্ষিণ ভারতের প্রতিহার এবং রাষ্ট্রকূট রাজবংশের মধ্যে ত্রিমুখী দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়।

ধর্মপাল রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হ। একই সময়ে মালব ও রাজপুতানার প্রতীহারবংশীয় রাজা বৎসরাজ পূর্ব-দিকে রাজ্য বিস্তারের জন্য অগ্রসর হ। ফলে একসময় উভয় রাজা মুখোমুখী হলে যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। এই যুদ্ধে ধর্মপাল পরাজিত হন। কথিত আছে বৎসরাজ ধর্মপালকে পরাজিত করে তাঁর রাজছত্রদ্বয় কেড়ে নিয়েছিলেন। কোথায় এই যুদ্ধ হয়েছিল সে সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছু জানা যায় না। কেউ কেউ অনুমান করেন যে, বৎসরাজ বঙ্গদেশ পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। এর একমাত্র প্রমাণ পাওয়া যায় পৃথ্বীরাজ বিজয় নামক একাদশ খ্রিষ্টাব্দে রচিত কাব্যের একটি উক্তি থেকে। দুর্লভরাজ গঙ্গাসাগর সঙ্গমে স্নান করে তাঁর দেহ পবিত্র করেছিলেন। উল্লেখ্য দুর্লভরাজের পুত্র বৎসরাজের পুত্রের অধীন একজন সামন্ত রাজা ছিলেন। সুতরাং দুর্লভরাজ বৎসরাজের সামন্ত ছিলেন এবং তাঁর সাথে বিজয়যাত্রায় বঙ্গদেশ পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন।

রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় গোবিন্দের একটি তাম্রশাসনে বর্ণিত হয়েছে যে, রাষ্ট্রকূটরাজ (ধ্রুব) হেলায় গৌড়রাজ্য জয়জনিত অহংকারে মত্ত বৎসরাজকে অচিরাৎ দুর্গম মরু অঞ্চলে তাড়িত করে (তাঁর) গৌড়জয়লব্ধ শরতের চাঁদের মত শুভ্র ছত্রদ্বয়ই কেড়ে এনেছিলেন। এরপর ধ্রুব আর্যাবর্তে বৎসরাজকে পরাজিত করেন। বৎসরাজ পালিয়ে মরুভূমিতে আশ্রয় নেন এবং তাঁর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আশা দূরীভূত হয়। এরপর ধ্রুব ধর্মপালের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। ধর্মপাল ইতোমধ্যে মগধ, বারাণসী ও প্রয়াগ জয় করে গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী ভূভাগ পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। এখানেই ধ্রুবে সাথে তাঁর যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ধ্রুব ধর্মপালকে পরাজিত করেন বটে, কিন্তু ধর্মপালের রাজ্যের উপর আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হন নি। কারণ ধ্রুব বঙ্গদেশের দিকে অগ্রসর না হয়ে তিনি শীঘ্রই দাক্ষিণাত্যে ফিরে গিয়েছিলেন। এর ফলে বঙ্গদেশে ধর্মপালের আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। এই সুযোগে ধর্মপাল ক্রমে ক্রমে প্রায় সমগ্র আর্যাবর্ত জয় করে নিজের আধিপত্য স্থাপন করলেন। এবং সার্বভৌম সম্রাটের পদ প্রাপ্ত হলেন এবং গৌরবসূচক ‘পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ’ প্রভৃতি উপাধি গ্রহণ করেছিলেন

ধর্মপালের পুত্র দেবপালের তাম্রশাসনে সূত্রে জানা যায়যে, ধর্মপাল দিগি¦জয়ে বের হয়ে হিমালয়ে কেদার তীর্থ দর্শন করেছিলেন।

ধর্মপাল নেপালে বাগমতী নদীর তীরে পশুপতি মন্দিরের দুই মাইল উত্তর-পূর্বে গোকর্ণ নামে তীর্থ আছে। সম্ভবত ধর্মপাল এই স্থানে এসেছিলেন। এই অনুমানের সপক্ষে বলা যেতে পারে যে, গৌড়রাজ ধর্মপাল নেপালের সিংহাসন অধিকার করেছিলেন। স্বয়ম্ভুপুরাণে কপিলাবস্তুর নিকট গঙ্গাসাগরের উলেখ আছে। তাম্রশাসনে গোকর্ণের পরে যে গঙ্গাসাগর নামক স্থানের উলেখ আছে তা সম্ভবত এই স্থানটিই সূচিত করে।

এরপর তিনি কান্যকুব্জের রাজা ইন্দ্ররাজকে পরাভূত করে মহোদয় অর্থাৎ কান্যকুব্জ অধিকার করেছিলেন। প্রাচীন কান্যকুব্জই আর্যাবর্তের রাজধানী বলে বিবেচিত হতো এবং সাম্রাজ্য স্থাপনে অভিলাষী রাজগণ কান্যকুব্জের দিকে লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন। ধর্মপাল কনৌজ-এর রাজা ইন্দ্রায়ুধকে পরাজিত করে, চক্রায়ুধকে কনৌজের সিংহাসনে বসান। এই সময় তিনি কান্যকুব্জে এক বৃহৎ রাজ্যাভিষেকের দরবার করেন। এই রাজদরবারে আর্যাবর্তের বহু সামন্ত নরপতি উপস্থিত হয়ে ধর্মপালের অধিরাজত্ব স্বীকার করেন। মালদহের নিকটবর্তী খালিমপুরে প্রাপ্ত ধর্মপালের তাম্রশাসনে এই ঘটনাটি নিম্নলিখিতরূপে বর্ণিত হয়েছে- ‘তিনি মনোহর ভ্রূভঙ্গি-বিকাশে (ইঙ্গিতমাত্র) ভোজ, মৎস্য, মদ্র, করু, যদু, যবন, অবন্তি, গন্ধার এবং ক্ষীর প্রভৃতি বিভিন্ন জনপদের (সামন্ত?) নরপালগণকে প্রণতিপরায়ণ চঞ্চলবনত মস্তকে ‘সাধু সাধু’ বলে কীর্তন করাতে করাতে হৃষ্টচিত্ত পাঞ্চালবৃদ্ধ কর্তৃক মস্ত কোপরি আত্মভিষেকের স্বর্ণকলস উদধৃত করিয়ে কান্যকুব্জকে রাজশ্রী প্রদান করেছিলেন। এই বিবরণে যে সকল রাজ্যের উল্লেখ আছে, তাদের রাজগণ সকলেই কান্যকুব্জে সম্ভবত এসেছিলেন এবং যখন পঞ্চাল দেশের বয়োবৃদ্ধগণ ধর্মপালের মস্তকে স্বর্ণকলস হতে পবিত্র তীর্থজল ঢেলে তাঁকে কান্যকুব্জের রাজপদে অভিষেক করছিলেন। সকলেই তখন নতশিরে ‘সাধু সাধু’ বলে এই কার্য অনুমোদন করেছিলেন – অর্থাৎ তাঁকে রাজচক্রবর্তী বলে সসম্ভ্রমে অভিবাদন করেছিলেন। সুতরাং অন্তত ঐ সমুদয় রাজ্য না হলেও তাদের অনেকেই যে ধর্মপালের সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল, তা বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। এই রাজ্যগুলির অবস্থান ও পরিচিতি এরূপ- সান্দার ছিল পশ্চিম পাঞ্জাব ও কাবুলের নিম্নাঞ্চল, মদ্র-মধ্য পাঞ্জাব, ক্ষীর- কংগ্র বা পাঞ্জাবের উত্তর-পশ্চিম অংশ কুরু-অনেশ্বর বা পূর্ব পাঞ্জাব, মৎস্য-সালোয়ার রাজ্য এবং জয়পুর ও ভারতপুরের অংশবিশেষ, অবন্তি -মালব দেশ, যবন- সিন্ধের রাষ্ট্র, যদু- পাঞ্জাবের বিভিন্ন অংশ যেমন সিংহপুর, মথুরা, কাথিয়ার এবং ভোজ ও বেয়ার। সম্ভবত ভোজরাজ্য বর্তমান বেরারে এবং যদুরাজ্য পাঞ্জাবে অথবা সৌরাষ্ট্রে অবস্থিত ছিল।

পাল রাজাদের তাম্রশাসন ও রাজপ্রশস্তি পর্যালোচনা করলে এবং পরবর্তীকালে কোনো কোনো সাহিত্যের উল্লেখ থেকে মনে হতে পারে যে, ধর্মপাল প্রায় সমগ্র আর্যাবর্তের অধীশ্বর ছিলেন। পালরাজগণের প্রশস্তি ব্যতীত অন্যত্রও ধর্মপালের এই সার্বভৌমত্বের উল্লেখ আছে। একাদশ শতাব্দীতে রচিত সোড্ঢল প্রণীত উদয়সুন্দরীকথা নামক চম্পূকাব্যে ধর্মপাল উত্তরাপথস্বামীক’ বলে অভিহিত হয়েছেন। আমরা জানি সাহিত্যের উল্লেখ ও কাব্যের বর্ণনাকে পুরোপুরিভাবে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। তবু পারিপার্শ্বিক অবস্থা, অন্যান্য রাষ্ট্রের তাম্রশাসন থেকে এসবের অনেক সত্যতা পাওয়া যায়।

গোয়ালিয়র ও বরোদার তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, ধর্মপালের পূর্বতন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতীহাররাজা বৎসরাজের পুত্র দ্বিতীয় নাগভট শীঘ্রই কিছু রাজ্য জয় এবং কয়েকটি রাজ্যের সাথে মিত্রতা স্থাপনপূর্বক স্বীয় শক্তি বৃদ্ধি করে ধর্মপালের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলেন। তিনি প্রথমে চক্রায়ূধকে পরাজিত করেন এবং চক্রায়ূধ ধর্মপালের শরণাপন্ন হন। অবশেষে ধর্মপালের সাথে দ্বিতীয় নাগভটের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। প্রতীহাররাজের প্রশস্তি অনুসারে নাগভট এই যুদ্ধে জয়ী হন। দ্বিতীয় নাগভটের পৌত্রের শিলালিপিতে এই যুদ্ধ সম্পর্কে লিখিত হয়েছে: ‘দুর্জয় শত্রুর (বঙ্গপতির স্বকীয়) শ্রেষ্ঠ সাজ, অশ্ব, রথসমূহের একত্র সমাবেশ গাঢ় মেঘের ন্যায় অন্ধকার-রূপে প্রতীয়মান বঙ্গপতিকে পরাজিত করে তিনি (নাগভট) ত্রিলোকের একমাত্র আলোকদাতা উদীয়মান সূর্যের ন্যায় আবির্ভূত হয়েছিলেন।’

এর কিছুদিন পর রাষ্ট্রকূটরাজ ধ্রুবের পুত্র তৃতীয় গোবিন্দ নাগভটের রাজ্য আক্রমণ করে তাঁকে সম্পূর্ণরূপে পরাভূত করেন এবং বৎসরাজের ন্যায় নাগভটের সাম্রাজ্য স্থাপনের আশাও দূরীভূত হয়। রাষ্ট্রকূটরাজগণের প্রশস্তি অনুসারে ধর্মপাল ও চক্রায়ূধ উভয়ে স্বেচ্ছায় তৃতীয় গোবিন্দের আনুগত্য স্বীকার করেন। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার এরূপ অনুমান করেন যে, ধর্মপাল ও চক্রায়ূধ নাগভটকে দমন করার নিমিত্তই রাষ্ট্রকূটরাজের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। 

নাগভটের পরাজয় এরূপ গুরুতর হয়েছিল যে, তিনি ও তাঁর পুত্র আর পালরাজগণের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারলেন না। সুতরাং ধর্মপালের বিশাল সাম্রাজ্য অটুট রইল।  

খালিমপুর তাম্রশাসনে ধর্মপালের ‘পাটলিপুত্রনগর-সমাবাসিত-শ্রীমজ্জয়স্কন্ধাবার-এর’ যে বর্ণনা আছে, তাতে নবসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার গর্বে দৃপ্ত বাঙালির মানসচিত্র ফুটে উঠেছে। অশোকের পুণ্যস্মৃতি-বিজড়িত মৌর্য রাজগণের প্রাচীন রাজধানী পাটলিপুত্রে (বর্তমান পাটনা) ধর্মপাল সাময়িক অথবা স্থায়ীভাবে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।

ধর্মপাল রাষ্ট্রকূটরাজ পরবলের কন্যা রন্নাদেবীকে বিবাহ করেছিলেন। এই পরবল কে এবং কোথায় রাজত্ব করতেন, সে সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না। ৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে উৎকীর্ণ রাষ্ট্রকূট বংশীয় পরবল নামক রাজার একটি শিলালিপি মধ্যভারতে পাওয়া গিয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, ইনিই রন্নাদেবীর পিতা। কিন্তু ঐ তারিখের অর্ধশতাব্দী পূর্বেই দীর্ঘকাল রাজত্বের পর ধর্মপালের মৃত্যু হয়। সুতরাং একেবারে অসম্ভব না হলেও ধর্মপালের সাথে উক্ত পরবলের কন্যার বিবাহ খুব অস্বাভাবিক ঘটনা বলেই গ্রহণ করতে হবে। রন্নাদেবী দাক্ষিণাত্যের প্রসিদ্ধ রাষ্ট্রকূট বংশের কোনো রাজকন্যা ছিলেন, এই মতটিই অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়।

ভাগলপুর তাম্রলিপ্তিতে বর্ণনা রয়েছে যে, ধর্মপালের কনিষ্ঠভ্রাতা বাকপাল অনেক যুদ্ধে তাঁর সেনাপতি ছিলেন এবং শত্রুদের পরাজিত করে ধর্মপালের একাধিপত্য বিস্তারে সহায়তা করেছেন। তাঁর বীরত্ব ও বিশ্বস্ততার জন্য ধর্মপালের রাজ্যবিস্তার অনেক সহজ হয়েছিল।  বাদল পিলারে খোদিত গৌরবমিশ্রের পরিবার থেকে বর্ণিত আছে যে, এই পরিবারের গর্গ নামে জনৈক ব্রাহ্মণ ধর্মপালের মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর সহায়তায় ধর্মপালের রাজ্য বিস্তার লাভ করেছিল।

পিতার মতো ধর্মপালও বৌদ্ধ ছিলেন। তিব্বতদেশীয় গ্রন্থে ধর্মপালের অনেক কীর্তিকলাপের উল্লেখ আছে। মগধে তিনি একটি বিহার বা বৌদ্ধমঠ নির্মাণ করেন। বিক্রমশীল, তাঁর এই দ্বিতীয় নাম বা উপাধি অনুসারে এটি ‘বিক্রমশীল-বিহার’ নামে অভিহিত হয়। নালন্দার ন্যায় বিক্রমশীল-বিহারও ভারতের সর্বত্র ও ভারতের বাইরে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। গঙ্গাতটে এক শৈলশিখরে অবস্থিত এই বিহারে একটি প্রধান মন্দির এবং তার চারদিকে ১০৭টি ছোট মন্দির ছিল।

৯ম-১২শ শতাব্দী পর্যন্তএটি একটি উচ্চশিক্ষাকেন্দ্র ছিল এবং ১১৪ জন শিক্ষক এখানে নানা বিষয়ে অধ্যাপনা করতেন। তিব্বতের বহু বৌদ্ধ ভিক্ষু এখানে অধ্যয়ন করতে আসতেন এবং এখানকার অনেক প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ আচার্য তিব্বতে বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেছিলেন। বরেন্দ্রভূমিতে সোমপুর নামক স্থানে ধর্মপাল আর একটি বিহার প্রতিষ্টা করেন। রাজশাহী জেলার অন্তর্গত পাহাড়পুর নামক স্থানে এর বিরাট ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। এত বড় বৌদ্ধবিহার ভারতবর্ষের আর কোথাও ছিল বলে জানা নেই। যে সুবিস্তৃত অঙ্গনের চতুর্দিক ঘিরে এই বিহারটি অবস্থিত ছিল, তার মধ্যস্থলে এক বিশাল মন্দিরের ভগ্নাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। এই প্রকার গঠন-রীতি ভারতবর্ষের আর কোনো মন্দিরে দেখা যায় না।

পাহাড়পুরের নিকটবর্তী সোমপুর গ্রাম এখনও প্রাচীন সোমপুরের স্মৃতি রক্ষা করে আসছে। ওদন্তপুরেও (বিহার) ধর্মপাল সম্ভবত একটি বিহার নির্মাণ করেছিলেন। তিব্বতীয় লেখক তারনাথের মতে ধর্মপাল ধর্মশিক্ষার জন্য ৫০টি শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

নিজে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও ধর্মপাল অন্যান্য ধর্মের প্রতি উদার ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সকল ধর্মের অনুসারীরা তাঁর নিকট সমাদরে গৃহীত হতো। তিনি যে অন্যান্য ধর্মের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। নারায়ণের এক মন্দিরের জন্য তিনি নিষ্কর ভূমি দান করেছিলেন। তিনি শাস্ত্রানুশাসন মেনে চলতেন এবং প্রতি বর্ণের লোক যাতে স্ব-ধর্ম প্রতিপালন করে, তার ব্যবস্থা করতেন। তাঁর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ; এঁর বংশধরেরা বহুপুরুষ পর্যন্ত বৌদ্ধ পালরাজগণের প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। পালরাজাদের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের সাথে রাজ্যশাসন ব্যাপারের কোনো সম্বন্ধ ছিল না।

খালিমপুর তাম্রশাসন ধর্মপালের বিজয়রাজ্যের ৩২ সম্বৎসরে লিখিত। সুতরাং এই তাম্রশাসনে তাঁর দরবারের ঐশ্বর্ষের ও সমৃদ্ধির যে বর্ণনা পূর্বে উদ্ধৃত হয়েছে, তা যে তাঁর দীর্ঘকাল রাজত্বের শেষ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল তা অনুমান করা যায়। তারনাথের মতে, ধর্মপালের রাজ্যকাল ৬৪ বছর, কিন্তু এর সমর্থনে কোনো প্রমাণ নেই। তাঁর পুত্র দেবপাল প্রায় ৪০ বছর রাজত্ব করেছিলেন।

৮১০ খ্রিষ্টাব্দে ধর্মপাল মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তাঁর রনড়বাদেবী নামক মহিষীর গর্ভজাত পুত্র দেবপাল সিংহাসনে আরোহণ করেন।


সূত্র :
বাংলাদেশের ইতিহাস (আদিপর্ব)/রমেশচন্দ্র মজুমদার।
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।